Header Advertisement

Sobar Desh | সবার দেশ জয়নুল আবেদীন


প্রকাশিত: ০০:০১, ১৬ এপ্রিল ২০২৫

প্রবন্ধ

জান্নাতুল বাকী ও প্রসঙ্গান্তর

জান্নাতুল বাকী ও প্রসঙ্গান্তর
ছবি: সবার দেশ

(শেষ পর্ব)

ওয়াহাবীদের ধর্মীয় ম্যানিফেস্টো আর ইসমাইল দেহলভীর ধর্মীয় ম্যানিফেস্টো অক্ষর ও শব্দ কম-বেশি থাকলেও সারমর্ম এক ও অভিন্ন। দেহলভীর শিকড়ের সন্ধানে একটু খুঁড়তে শুরু করলেই পাওয়া যাবে ওয়াহাবীদের ধর্মীয় ম্যানিফেস্টো। মুহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াহাব লিখিত গ্রন্থের নাম ‘কেতাবুল তাওহীদ’। ‘কেতাবুল তাওহীদ'-এর অনুবাদক ও অনুকরণই ‘তাকভীয়াতুল ঈমান'।

ইসমাইল দেহলভীর শিষ্য ছিলেন রশীদ অহম্মদ গাংগুহী। গাংগুহীর পুরা নাম ছিল ‘রশীদ আহম্মদ বিন করিমুন্নিছা বিনতে ফরিদ বখ্শ বিন গোলাম কাদের বিন মুহাম্মদ বিন ছালেহ বিন গোলাম মোহাম্মদ'। রশীদ আহম্মদ গাংগুহীর শিষ্য ইলিয়াস সাহেব দেওবন্দী ওরফে ইলিয়াস মেওয়াতী। ভারতের দিল্লির উপকণ্ঠে মেওয়াত গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বলে নামের শেষে মেওয়াতী যুক্ত হয়েছে। বাংলাদেশের বিশিষ্ট একটি ধর্মীয় গ্রæপ কিনা তাদের অনুসারী। (নূরুল হক এম.এ কর্তৃক প্রকাশিত ‘তাবলীগ জামাতের স্বরূপ' গ্রন্থের অনুসরণে)। আর এ কারণেই সমগ্র আরব জুড়ে ধর্মের অন্তঃসলিলা মিলাদ মাহফিল, মাজার-সমাধি, খানকা-দরবার, সুফি-সাধক এবং ধেয়ান-দর্শন নেই- নেই সুন্নত নফলসহ দু হাত তুলে মোনাজাত পদ্ধতিও।

‘ইসলাম' মহান স্রষ্টার মনোনীত, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানবের রোপিত, চার খলিফার খান্দানযুক্ত, চার তরিকার চার উদ্যানে বিন্যাস্ত, শত মনীষার পরিচর্যাকৃত, সহস্র দার্শনিকের সুচিন্তিত এবং হাজার বছরের পুষ্প- পল্লবে শোভমান বিশ্বনন্দিত সুচারু-সুদর্শন, সুপক্ক-সুষম, মহামহিমান্বিত, মহাকালের এক অবিনশ্বর 'মহীরুহ'। আগাছা পরিচ্ছন্নতার নামে কোনো অদক্ষ মালীর নির্বিচার কাঁচির কপচানিতে মহীরুহের লতাপাতা, ডালপালা, ছাল-ছিটা ও ফুল পাপড়ি কাটছাঁট হয়ে প্রধান মূলের উপর ন্যাড়া কান্ড ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলে যেমন হয়ে পড়ে তেমন হয়ে পড়তে শুরু করেছে আমাদের শাশ্বত ইসলামও। এ আগাছা পরিচ্ছন্নতার কাজে ব্যবহৃত শানানো কাঁচির কপচানি শুধু আরবের মাঠিতেই সীমাবদ্ধ রয়নি। বহির্বিশ্বের বিশেষ করে উন্নয়নশীল মুসলিম কান্ট্রির ধর্মবেত্তাদের হাতেও ওয়াহাবী সংস্কারের শানিত কাঁচি পৌঁছে গেছে। আরবের পূর্ববর্তী উমাইয়া এবং আব্বাসীয় শাসকগণ যে পদ্ধতিতে খাবারের দানা ছিটিয়ে কাক কব্জা করে নিজদের অনুক‚লে কলরব করাতেন ঠিক একই পদ্ধতিতে এখনো খাবারের দানা ছিটিয়ে কাক কবজা করতে শুরু করে দিয়েছে। আমাদের আলেম সমাজ থেকে এক শ্রেণীর ধর্মজীবীকে যতো সহজে খরিদ করা যায় ততো সহজে আর কাউকে খরিদ করা যায় না।

আর এ কারণেই পুরানো কথাটি আবারও বলতে হয়, শুধু দেশ পরিচালনায় নয়, একদিন এই আলেম সমাজের ভেতর থেকেই দেশের প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া বাধ্যতামূলক ছিল। সব খোয়ায়ে এখন ধর্মের ধ্বজা ধরে রয়েছে তারা। আমরা এখনও পরম বিশ্বাসে যাদের হাতে ধর্মের হাল তুলে দিয়ে চরম নিশ্চিন্তে নিরলস দাঁড় টানছি তাঁরা আজ কোন পথে? ক‚ল- কিনারা পাওয়া না পাওয়ার কোনো খবরই আমরা রাখি না। আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের পর যাদের কাঁধে ভর করে দেশ চলছিল তাদের ভারসাম্যহীন অবস্থা লক্ষ্য করে দেশের এক বরেণ্য কবি অনেক মনোবেদনা নিয়ে লিখেছিলেন, ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ'। কারবালা হত্যাকান্ডের পরপর যাদের কাঁধের উপর ভর করে মুসলিম উম্মাহ চলছিল, তাদের ভারসাম্যহীন অবস্থা লক্ষ্য করে- প্রয়াত বরেণ্য কবির উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ' কথাটি বারবার মনে পড়ে যায়। তার সাথে ভয়ও করে, মুসলিম উম্মাহকে কাঁধে নিয়ে তারা কোথায় চলেছেন- তার কিছুই আমরা জানি না। আমাদের বেহাল হয়ে পড়া হালধারী কান্ডারীগণও যদি কোনো আকর্ষণকারী অয়স্কান্তমণির আকর্ষণে বিকলাঙ্গ হয়ে মিলেনিয়ামের উত্তল তরঙ্গে ধর্মের ভরা তলিয়ে দেয়, তাহলে কি হবে? লক্ষ বছর তলিয়ে থাকলেও কেউ টেনে তুলবে না, কারণ শেষ মহামানবেরও মহাপ্রয়াণ হয়ে গেছে।

থিতিয়ে পড়া আলেম সমাজের অনেকে তাঁদের লুপ্ত গৌরব পুনরুদ্ধারের জন্য ধর্মকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে ব্যবসায়ী হয়ে পড়ছেন। কেউ কেউ ধর্মবেত্তার পরিচ্ছদে ব্যবসায়ীর ভ‚মিকায় অবতীর্ণ হওয়ায় শুধু ধর্মের ভরাই তলিয়ে যাচ্ছে নাÑ তৎসঙ্গে নিজেরাও তলিয়ে যেতে শুরু করেছেন। আধুনিক বিজ্ঞানের ভেল্কিবাজির যুগে, ঝড়-ঝঞ্ঝাময় উত্তাল তরঙ্গাকুল সমুদ্রে ধর্মের তরণী নিয়ে তীরে পৌঁছতে হলে যেখানে ইমাম গাজ্জালী (র.)-এর মতো বিশ্ব স্বীকৃত মেধা, যুক্তিবাদী ও দার্শনিক এবং খাজা মঈনউদ্দিন চিশতি (র.)-এর মতো আত্মসন্ধানী ব্যক্তিত্বের আবশ্যক সেখানে ধর্মের হালধারীগণ নিজেরা বেহাল হয়ে পড়লে পাল মাস্তুলসহ {নবী করিম (স)-এর গচ্ছিত রাখা} ধর্মের তরণী তীরে নিয়ে যাবে কে? ইসলাম ধর্মের জয়টা আরবের মাটিতে হয়েছিল, ক্ষয়টা যেন শুরু হয়েছে আরবের মাটিতেই। 'জয়'-এর পরে ‘ক্ষয়' চিরন্তন সত্য। সবকিছুই ক্ষয়ের পর ‘লয়'-এর দিকে ধাবিত হয়। আমাদের ধর্মের ‘ক্ষয়’টা ‘লয়’-এর দিকে না গেলেই হলো। ভয় হয়, ক্ষয়টা আরবের মাটি থেকেই শুরু হয়েছে কিনা তাই। কারণ, ‘পচন কখনো লেজ থেকে শুরু হয় না।’
আবার ফিরে আসি অধ্যাপক সাহেবের কথায়-

আমার মতো অধ্যাপক সাহেবও জান্নাতুল বাকী দেখতে গিয়ে বিস্মিত হয়ে- ‘আমার পথ নির্দেশককে জিজ্ঞেস করলাম, এটি কি? একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জানালেন, জান্নাতুল বাকী- গোরস্থান। মদীনার সোনালি যুগের করব। এতে শুয়ে আছে হাজার হাজার শহীদ, সিদ্দিক এবং আহলে বায়তের পবিত্র ঈমানদারগণ এবং মা ফাতিমা। তবে তাঁদের কবরের কোনো চিহ্ন নেই। সব ভেঙ্গেচুরে সমান করে দিয়েছে আলে সউদ আর ওহাবীরা। আর বলতে পারলেন না। তার গলা ধরে এলো। বুঝলাম তার দীর্ঘশ্বাসের কারণ। জান্নাতুল বাকীর নাম শুনতেই পরম শ্রদ্ধায় তার দিকে তাকালাম। মনে মনে বললাম, আসসালামু আলাইকা ইয়া জান্নাতুল বাকী, কত পবিত্র নাম, হুজুর পাকের দেওয়া এ নাম। বাকীর কত কাহিনী, কত ইতিহাস, কত বীরত্ব। কত সাহাবা, কত বীর, কত ওলী, কত কুতুব শুয়ে আছেন বাকীতে! সোনালি যুগের বিশ হাজার শহীদকে বুকে ধারণ করে আছে এই বাকী!

জান্নাতুল বাকীর কাছে এসে তাদের বললাম, এই সে পবিত্র ঐতিহাসিক বাকী- জান্নাতুল বাকী। আমার কথায় তারা যেনো আকাশ থেকে পড়লেন। মওলানা জাফরুল্লাহ খান সাহেব বললেন, এ যে স্টেডিয়াম। আমাদের আমীর সাহেব তো এ কথাই আমাদের বললেন। ইমাম সাহেবের দিকে তাকাতেই তিনি অতি বিষণ্ণ দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে বললেন, নাউজুবিল্লাহ! আল্লাহ ওদের হেদায়েত করুন, স্টেডিয়াম ছাড়া যে আমি অন্য কিছু ভাবতেই পারিনি।

আমিও তো এই নতুন এলাম। হায় হায়! নবীজীর এতো আদরের দেওয়া নাম- পৃথিবীর সর্বাধিক মর্যাদাসম্পন্ন গোরস্থান- জান্নাতুল বাকীর এই কি পরিণতি। কোথায় হাদিস রেওয়ায়েতের জান্নাতুল বাকী?'

সুফি সাধকগণ সমাধির সমঝদার বিধায় সমাধি নিশ্চিহ্ন করতে গিয়ে সুফি-সাধকদের নিশ্চিহ্ন করতে থাকে। নিশ্চিহ্ন করতে থাকে হযরত আলী (র.)-এর ছিলছিলাও বংশানুক্রমদের। কারণ- সুফি সাধনার মূলধারা প্রবাহিত হতো হযরত আলী (ক.) এবং তাঁর পরবর্তী বংশানুক্রমের দ্বারা। আমাদের হুজুরে আকরাম (স.) হযরত আলী (ক.) সম্পর্কে ফরমান করে গেছেন-
‘আমি যার মাওলা আলী তাঁর মাওলা। আমি এরূপ দুটি বস্তু তোমাদের মধ্যে রেখে যাচ্ছি যা তোমরা আকড়িয়ে ধরলে আমার তিরোধানের পর তোমরা কখনো পথভ্রষ্ট হবে না। প্রথম- তোমাদের হস্তে কেতাবুল্লাহ এবং দ্বিতীয়- আমার আহলে বাইয়েত। রাসূল (স.)-এর আহলে বাইয়েত বলতে রাসূলে করিম (স.), হযরত আলী (ক.), ফাতিমা (রা.), হাসান-হোসাইন ও তাঁদের বংশধরগণকেই বুঝায়। (তিরমিজি ও মেশকাত)। 

হযরত আলী (ক.) নিজ দেহপ্রাণকে রাসূলুল্লাহ (স.)-এর দেহপ্রাণের বিনিময়ে হিজরতের সময় রাসূলুল্লাহ (স.)-এর বিছানায় তাঁর চাদর মোবারক দ্বারা আপাদমস্তক ঢেকে শুয়ে নিজ প্রাণ উৎসর্গ করে প্রেম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। হযরত রাসূলুল্লাহ (স.)-এর আধ্যাত্মিক প্রাণশক্তি যা নবুয়তে সুপ্ত ছিল তা হযরত আলী (ক.)-এর জাতে পাকে প্রস্ফুটিত হলো। তাঁর বাণীর দ্বারাও এটিই প্রমাণিত হয়। যেমন ‘আমি মহা প্রতাপশালীর নিয়ন্ত্রণে রাজি হয়েছি, আমার ভাগে এলম বা জ্ঞান এবং আমার বিপক্ষ ভাগে ধন ঐশ্বর্য পড়েছে'। হযরত আলী (ক.)-এর মধ্যে রাসূল করিম (স.)-এর অনন্ত গৌরবময় বেলায়তি অভিযানের দ্বার উন্মুক্ত হলো।” (বেলায়েতে মোতলাকা থেকে)।

ফাতেমি পরিবার সম্পর্কে ঐতিহাসিক সৈয়দ আমির আলী তাঁর 'দ্য স্পিরিট অব ইসলাম' গ্রন্থে বলেন, ৬০৫ খ্রিস্টাব্দে হযরত মুহম্মদ (স.) ও তাঁর চাচা আব্বাস আবু তালেবের দুই পুত্রকে লালন-পালনের ভার গ্রহণ করেন। হযরত মুহম্মদ (স.) নেন আলীকে আর আব্বাস নেন জাফরকে। হযরত মুহম্মদ (স.)-এর কোনো পুত্র জীবিত না থাকায় শিশু আলীর উপর হযরত মুহম্মদ (স.)-এর অপত্য স্নেহ ঝরে পড়ে। এর এক বছর পরেই ৬০৬ খ্রিস্টাব্দে ফাতিমা (রা.)-এর জন্ম হয়। হযরত আলী (ক.) ও ফাতিমা (রা.)- এর সাথে একই সংসারে বেড়ে ওঠেন এবং বদরের যুদ্ধের কিছু দিন আগেই তাদের বাগদান হয়। বাগদানের তিন মাস পর তাদের বিবাহ হয়। এ সময় হযরত আলী (ক.)-এর বয়স ২১ বছর ও ফাতিমা (রা.)-এর বয়স ছিল ১৫ বছর। এ জন্যই আলী (ক.)-কে এক শ্রেণীর মানুষ রাসুলুল্লাহ (স.)-এর পুত্রস্থানীয় মর্যাদা দিতেন। (সমাপ্ত)

লেখক: আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক