Header Advertisement

Sobar Desh | সবার দেশ জয়নুল আবেদীন


প্রকাশিত: ১৬:৪৮, ২০ এপ্রিল ২০২৫

প্রবন্ধ

জান্নাতুল বাকী ও প্রসঙ্গান্তর

জান্নাতুল বাকী ও প্রসঙ্গান্তর
ছবি: সবার দেশ

(৪থ পর্ব)

ঐতিহাসিক ও অধ্যাপক হিট্টি বলেন, ‘মরণশীল জীবনের অতি অল্প পরিসরে মুহম্মদ (স.) অনৈক্য জর্জরিত অনমনীয় এক জনগোষ্ঠীকে এমন এক ঐক্যবদ্ধ ও সুশৃঙ্খল জাতিতে পরিণত করেন যা ইতোপূর্বে ভ‚গোল সম্পর্কিত জ্ঞানেই শুধু সীমাবদ্ধ ছিল।’

মহানবী (স.) মহাপ্রয়াণের কয়েকদিন আগে ময়দানে আরাফার চূড়ায় দাঁড়িয়ে বিপুল জনসমুদ্রকে লক্ষ্য করে শেষ ভাষণে বলেছিলেন, ‘তোমাদের পথ প্রদর্শনের জন্য আল্লাহর কালাম ও তাঁর প্রেরিত রাসূলের চরিতাদর্শ রেখে যাচ্ছি। যতদিন তোমরা এসব মেনে চলবে ততদিন তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না।

নবী করিম (স.) পরলোক গমনের পর পর, সুশৃঙ্খল জাতি এখন কার হাতে? তাঁর আদর্শে গড়া প্রিয়জনদের অবস্থাই বা কি? রাসূল (স.)-এর প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রে আহলে বাইয়েতের অবস্থান কোথায়? কেন এমন হলো?

এ কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজছিলাম অনেক দিন থেকে। ইতিহাস ও তথ্য নির্ভর উত্তর না পাওয়ায় খুবই মর্মাহত ছিলাম। এই গ্রন্থ রচনার শেষ দিকে স্থানীয় এক সুফীর সাথে সাক্ষাতের পর কথোপকথনের মাধ্যমে সুলেখক ও সুফী কাজী মো: বেনজীর হক চিশতির লিখিত ‘বেহুঁশের চৈতন্য দান' গ্রন্থটির সন্ধান পাই। তিনি পবিত্র কোরআনুল করিম থেকে উদ্ধৃতি ও ঐতিহাসিক তথ্যাদিসহ বৃহত্তর কলেবরের যে বইটি লিখেছেন- সেই বই থেকে আমার বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাই। তাই ‘বেহুঁশের চৈতন্য দান, গ্রন্থের বেশ কিছু অংশ হুবহু উল্লেখ করার লোভ সামাল দিতে পারলাম না। আহলে বাইয়েতের ধর্মীয় মূল্য সম্পর্কে নবী করিম (স.)-এর উক্তি বিভিন্ন ব্যক্তি ও গ্রন্থ থেকে যেসব উদাহরণ ও উদ্ধৃতি নেওয়া হয়েছে লেখকের অনুমতিক্রমে তার কিছু নিচে উল্লেখ করা হলো:
‘রাসূল (স.) একদিন এক বাগান দিয়ে যাবার পথে উচ্চঃস্বরে কেঁদে উঠলেন, হযরত আলী (ক.) কান্নার কারণ জিজ্ঞাসা করলে রাসূল (স.) বললেন, কিছু লোক তোমার বিরুদ্ধে মনে মনে হিংসা পোষণ করে, আমার ওফাতের পর তারা তা প্রকাশ করবে। হযরত আলী (ক.) বললেন, হে রাসূলুল্লাহ! তারা কি নিরাপত্তা সহকারে পৃথিবীতে থেকে যাবে?' (শাওয়াহেদুন নবুয়ত, ১৯০ পৃষ্ঠা)।

রাসূল (স.) আরো বলেছেন : ‘আমি এবং আলী ছাড়া আল্লাহকে কেউ চিনে না, আলী এবং আল্লাহ ছাড়া আমাকে কেউ চিনে না এবং আমি ও আল্লাহ ছাড়া আলীকে কেউ চিনে না।’

একবার হযরত রাসূল (স.) গোসল করতে ছিলেন এমনি সময় ইমাম হুসাইন (রা.) রাসূল (স.)-এর জামাটি গায়ে দেওয়ার ইচ্ছা জাগে এবং পরিধান করেন। জামা পরিধানের সাথে সাথে ইমাম হুসাইন (রা.) দেখতে পেলেন সামনে এক বিশাল অগ্নির সাগর। বহু লোক এ সাগরে ডুবে মারা যাচ্ছে। তার মধ্যে একটি বড় নৌকা ভাসতে দেখা যাচ্ছে। অনেক লোক ঐ নৌকায় চড়ে সাগর পাড়ি দিচ্ছে। এ দৃশ্য দেখে ইমাম হুসাইন (রা.) ভয়ে কাঁপতে ছিলেন। ইমাম হাসান (রা.) ইমাম হুসাইন (রা.)-এর এ অবস্থা দেখে তাকে ধরলেন এবং তিনিও ঐ দৃশ্য দেখতে পেলেন এবং ভয়ে জড়সড় হয়ে পড়লেন। রাসূল (স.) গোসল সেরে এসে তাদের এ দৃশ্য দেখে জামা খুলতে বললেন। জামা খোলার পর এ দৃশ্য আর দেখতে পেল না। ইমাম হাসান, ইমাম হুসাইন (আঃ) রাসূল (স.)-এর কাছে এর ভেদ জানতে চাইলেন। রাসূল (স.) বললেন, যে অগ্নির সাগর তোমরা দেখেছো তা হলো এ মায়াময় পৃথিবী আলমে নাছুতের সাগর যা অগ্নি স্বরূপ। এ সাগরে অধিকাংশ মানুষ ডুবে আছে যা অগ্নিময় দোজখ স্বরূপ। আর যে নৌকাটি তোমরা দেখেছো তা হলো মোহাম্মদী তরী। ঐ নৌকাটি তোমার মা জননী ফাতেমা, দুই পাশে দুই বৈঠা স্বরূপ তোমরা দুই ভাই, নৌকার মাস্তুল স্বরূপ আলী (ক.) এবং তার মাঝি হলেম আমি স্বয়ং আল্লাহর হাবিব মোহাম্মদ (স.)।

আল্লাহ বলেছেন : ‘ওয়া ইন্না লা নাহ্ নুহয়ী ওয়ানুমীতু ওয়া নাহ্ল ওয়ারিছুন।’ অর্থাৎ এবং নিশ্চয়ই আমরাই তো জীবন-মৃত্যু দান করি এবং আমরাই তো চূড়ান্ত (মালিকানার) অধিকারী [সূরা : হিজর ২৩ আঃ]। এ আয়াতে আল্লাহপাক নিজেকে ‘আমরা’ রূপে পরিচয় দিয়েছেন এবং আমরা রূপী আল্লাহ-ই জীবন-মৃত্যু দান করার অধিকার রাখে। এ “আমরা” রূপী আল্লাহ-ই পাক পাঞ্জাতন রূপে মানব অজুদে মিশে আছে।

উম্মুল মুমিনীন। হযরত ছালমা (রা.) হতে বর্ণিত আছে যে, একবার হযরত রাসূল (স.) আমার ঘরে আসলেন। তখন তিনি একটি কালো ইয়ামেনী চাদর গায়ে দিয়ে ডাকলেন, আইনাল হাসান! ইমাম হাসান (ক.) এসে বললেন, লাব্বাইকা ইয়া রাসূলুল্লাহ (স.)। তিনি তাকে চাদরের ভিতর প্রবেশ করালেন। এভাবে ইমাম হুসাইন, ফাতেমা ও আলী (ক.)-কে সে চাদরে ঢুকিয়ে নিয়ে প্রার্থনা করলেন, ‘হে আল্লাহ! এরাই আমার আহলে বাইয়েত, এরাই আমার একান্ত আপনজন পরমাত্মীয়। এদেরকে সব ধরনের অপবিত্রতা হতে দূরে রাখুন।” মোহাম্মদ (স.), আলী (ক.), ফাতেমা (রা.), হাসান (রা.) ও হুসাইন (রা.)-এ পাক পাঞ্জাতনের সংলীন অবস্থাটিই ‘এক’ এর পরিচয় তথা ঐক্য তথা আহাদ আর ঐক্যই বাস্তব যা পাঁচ দেহের এক দেহ অহেদাতুল অজুদ। ধর্ম কর্মের উদ্দেশ্য বা ছালাত দ্বারাও পাক পাঞ্জাতনকেই চেনানো হয়েছে, যেমন : ফজর নামায- ‘হুসাইন’, জোহর নামায- ‘হাসান’, আছর নামায- ‘ফাতেমা’, মাগরিবের নামায- ‘আলী এবং এশার নামায- মোহাম্মদ, তাছাড়া কলেমা, নামায, রোজা, হজ্জ, যাকাত- এ পাঁচটিও পাক পাঞ্জাতনের মোকামে প্রতিষ্ঠিত আছে যা চেনা জানা দরকার। যারা রাসূল (স.) ও তাঁর আহলে বাইয়েতের পরিচয় জানে না ও মহব্বত করে না তারাই তথাকথিত মুসলমান, শুধু নামাযি (?) মুসলমান। আর তাদের পূর্বসূরিরাই কারবালায় রাসূল (স.)-এর আহলে বাইয়েত ও তাদের সাথীদেরকে হত্যা করে পবিত্র মস্তক মোবারক পাশে রেখে নামায পড়েছিল এবং তাশাহুদে দরূদে বলেছিল- “আল্লাহুমা ছাল্লে আ'লা মোহাম্মাদেও ওয়া আলা আলে মোহাম্মাদিন অর্থাৎ হে আল্লাহ! মোহাম্মদ (স.) এবং তাঁর বংশধরদের উপর শান্তি বর্ষণ করো এবং বরকত দান করো।’

‘মেশকাত’ এর ৫৮৪১ নং হাদিস, আহমদ ও তিরমিযীর সূত্রে উম্মে ছালমা (রা.) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত রাসূলুল্লাহ (স.) বলেছেন: কোনো মুনাফিক আলীকে মহব্বত করে না এবং কোনো মুমিন আলীর প্রতি হিংসা রাখে না।

উহুদ যুদ্ধে হযরত আলী (ক.) যখন পূর্ণ বীরত্ব প্রদর্শন করলেন, তখন হযরত জীবরাইল (আ:) তাঁকে বললেন, আলী তো আপনার জন্য বড়ই বাহাদুরী প্রদর্শন করলেন। রাসূল (স.) তখন বললেন : ইন্নাহু মিন্নী ওয়া আনা মিনহু’ অর্থাৎ নিশ্চয় সে (আলী) আমার এবং আমি তাঁর (আলীর)। তখন জিবরাইল বললেন : ‘ওয়া আনা মিনকুমা’ অর্থাৎ আমি আপনাদের দু'জনেরই। বর্ণিত আছে, ঐ সময় গায়েব থেকে একটি আওয়াজ এলো –“লা ফাতা ইল্লা আলী লা সাইফা ইল্লা জুলফিকার” অর্থাৎ আলী ব্যতীত কোনো বিজয় নেই, জুলফিকার ব্যতীত কোনো তরবারী নেই।

হযরত রাসূলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক নবীর আওলাদ তাদের পৃষ্ঠ হতে, আর আমার আওলাদ আলী (ক.)-এর পৃষ্ঠ হতে।’ ‘খাসায়েসুল কোবরা’ ২য় খÐের ২৭০ পৃষ্ঠায় বর্ণিত আছে যে, হযরত রাসূল (স.) বলেছেন : ‘আলীর তুলনা একমাত্র আমার সাথে।’

‘জযবুল কুলুব ইলা দিয়ারিল মাহবুব’ কিতাবের ২৭-২৮ পৃষ্ঠায় হযরত জাবের (রা.) হতে বর্ণিত আছে যে, একদা হযরত মোহাম্মদ (স.) হযরত আলী (ক.)-এর হাত ধরে মদীনা শরীফের কোনো এক বাগানের দিকে তাশরিফ নিয়ে যেতেছিলেন। হঠাৎ একটি খেজুর গাছ থেকে আওয়াজ শুনা গেলÑ ‘ইনি হলেন পয়গাম্বরগণের সর্দার হযরত মোহাম্মদ (স.) আর ইনি আল্লাহর অলীদের সর্দার এবং পবিত্র ইমামগণের পিতা হযরত আলী (ক.)। তাঁরা যখন অপর একটি গাছ অতিক্রম করছিলেন তখন শব্দ হলো ‘ইনি হযরত মোহাম্মদ (স.) আর ইনি হযরত আলী (ক.) আল্লাহর তলোয়ার।

‘আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ কিতাবের ৮ম খÐের ৩৬০ পৃষ্ঠায়, হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, হযরত রাসূলুল্লাহ (স.) বলেছেন ‘আমি জ্ঞানের শহর, আলী তার দরজা। অতএব যে ইলম অর্জন করতে ইচ্ছুক সে যেন শহরের তোরণ পথেই প্রবেশ করে।’

হাফেজ ওবাইদুল্লাহ হাকিম হাসকানী হানাফীর রচিত ‘শাওয়াহেদুত তানযিল’ কিতাবের সূত্রে ‘পবিত্র কোরানে আহলে বাইয়েত’ গ্রন্থে ১১৮ পৃষ্ঠায় বর্ণিত আছে যে, হযরত রাসূল (স.) বলেছেন: মেরাজের রাত্রিতে আল্লাহপাক আমাকে জিজ্ঞেস করলেন যে, পৃথিবীতে আপনি কাকে নিজের প্রতিনিধি করে এসেছেন এবং সে কে? রাসূলে করিম (স.) বললেন: আমার বংশের সবচেয়ে নেক এবং উত্তম ব্যক্তি আলী বিন আবি তালিবকে আমার প্রতিনিধি করে এসেছি। সে আমার ভাই, আমার প্রিয় জামাতা। তারপর আল্লাহপাক জিজ্ঞাসা করলেন: হে মোহাম্মদ! আপনি কি তাকে ভালবাসেন? আমি উত্তর করলাম: জি হ্যাঁ, অবশ্যই হে আমার প্রতিপালক।

‘জামুল জাওয়ানী’” ৬ষ্ঠ খন্ডে ১৫৬ পৃষ্ঠায় আছে রাসূলুল্লাহ (স.) বলেছেন : ‘হযরত আলীর প্রতি ভালবাসা হচ্ছে ঈমান এবং তাঁর প্রতি শত্রæতা হচ্ছে বিদ্রোহ।’

মাওলা আলী (ক.)-এর খেলাফত : হযরত রাসূলুল্লাহ (স.) এর নিযুক্ত খলিফা মাওলা আলী (ক.)-কে পরিত্যাগ করে গোত্রীয় দ্বন্দের ফলশ্রুতিতে ব্যক্তি স্বার্থের কারণে, আহলে বাইয়েতের প্রতি বিদ্বেষের কারণে হাশেমী বংশের বিরোধিতা সত্তে¡ও এবং তাদের পরামর্শ ব্যতিরেকে স্বীয় উদ্দেশ্য চারিতার্থ করার জন্যে, রাসূল (স.)-এর ‘খলিফা’ বিষয়টিও জাগতিক মনে করে মসজিদে নব্বী ফেলে রেখে মদীনার বাহিরে জাহিলীয়াত যুগে ডাকাতের মাল বণ্টন করার গোপন আস্তানা “সকিফায়ে বনি সায়েদা” নামক স্থানে গিয়ে মাত্র ৩ জন মুহাজির ও ৩০/৩২ জন আনসার মিলে ঝগড়া ঝাটির পর হযরত আবু বকর (রা.) হলেন নির্বাচিত খলিফা।

ঐতিহাসিক ইয়াকুব লিখেছেন, মুহাজির ও আনসারগণ হযরত আলী (ক.)- কে খলিফা নিযুক্ত করার জন্য হযরত ফাতেমা (আ:)-এর গৃহে সমবেত হয়েছিলেন। এ দলে খালিদ বিন সাইদও ছিলেন। এ বর্ণনাতে এটাও জানা যায় যে, হযরত আবু বকর (রা) ও ওমর (রা.) এ পরামর্শ সভার সংবাদ পেয়ে একদল সৈন্যসহ এসে মা ফাতেমা (রা.)-এর বাসগৃহে আসেন এবং হযরত ওমর (রা.) হযরত আলী (ক.)-কে হযরত আবু বকর (রা.)-এর খেলাফত সংক্রান্ত বিষয় সংবাদ দিয়ে আবু বকর (রা.)-এর বায়াত হওয়ার কথা বলা হলে তিনি জবাবে বললেন :
‘আমি তোমাদের বায়াত সমর্থন করি না। কেননা, আমিও তোমাদের নিকট সেই দাবীই পেশ করছি যে, তোমাদের চেয়েও আমি রাসূলুল্লাহ (স.) এর অধিক নিকটতম। সুতরাং খেলাফত আমারই প্রাপ্য।’
এর জবাবে বললেন : বায়াত না করা পর্যন্ত আমি আপনাকে ছেড়ে দেবো না। তখন হযরত আলী (ক.) রাগান্বিত হয়ে বললেন : ওমর, তুমি সুন্দর এক কৌশল অবলম্বন করেছো। খেলাফতে তোমারও অংশ আছে। আজ তুমি এ জন্যই আবু বকর (রা.)-এর খেলাফত মেনে নিয়েছো, পরে যাতে তোমার হাতেই খেলাফত চলে আসে। কিন্তু জেনে রাখো আমি বায়াত হবো না।

মাওলানা মাজাহার উদ্দিন আহমদ রচিত ‘নবী নন্দিনী ফাতেমা যোহরা (রা.)’ গ্রন্থের ৫৯-৬১ পৃষ্ঠার বর্ণনার সংক্ষিপ্ত রূপটি হলো : রাসূল (স.)-এর ইন্তেকালের পর হযরত আলী (ক:)-ই খলিফা হবেন মা ফাতেমা (রা.) এবং অন্যান্য সাহাবাগণও তাই জানতেন। মা ফাতেমা (রা.) ও আনসার মুহাজিরগণকে ডেকে তাঁর অভিমত পেশ করলেন। অভিমত শুনে আনসার মুহাজিরগণও বললেন : হযরত আলী (ক.)-ই খলিফা হবার উপযুক্ত এবং তাঁর হাতেই বায়াত হওয়া প্রয়োজন ছিল।

অন্য এক বর্ণনায় আছে, মা ফাতেমা (রা.)-এর অসন্তুষ্টি ও রাগের কথা শুনে হযরত আবু বকর (রা.) ও হযরত ওমর (রা.) হযরত ফাতেমা (রা.)-এর গৃহে উপস্থিত হলেন। হযরত ফাতেমা (রা.) তাদেরকে দেখে কান্না জড়িত কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ’ আপনি আমাকে একা ফেলে যাবার পরই আমি আবু বকর (রা.) ও ওমর (রা.)-এর দ্বারা উৎপীড়িত হচ্ছি। ফাতেমা (রা.)-এর কাছে ঘরে যাবার অনুমতি চাওয়া হলে, তিনি অনুমতি প্রদান না করে তাদেরকে লক্ষ্য করে বললেন : আল্লাহ এবং আল্লাহর ফেরেশতাগণকে স্বাক্ষী রেখে বলছি- আপনারা আমাকে নাখোশ করেছেন, আপনারা আমাকে আঘাত দিয়েছেন। হাশরের দিন আমি আপনাদের বিরুদ্ধে রাছুলুল্লাহ (স.)- এর কাছে তার নালিশ পেশ করবো।

মাওলানা সফিউদ্দীন আহামদ রচিত ‘হযরত আলী মৌরতুজা’ গ্রন্থের ১১৫ পৃষ্ঠায় আরো বর্ণিত আছে যে, হযরত মা ফাতেমা (রা.) বা আলী (ক.) হযরত আবু বকর (রা.) এর খেলাফতের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন মনে করে মা ফাতেমা (রা.) এর সাথে কেউ কেউ অসদাচরণ করে এবং ফাতেমা (রা.)-এর মহলে আগুন দিয়েছিলেন এবং ধাক্কা দিয়ে তাঁর উপরে ঘরের দরজা ফেলে দিয়েছিলেন। তাতেই মা ফাতেমা (রা.)-এর গর্ভপাত হয় [হযরত মুহসীন ভ‚মিষ্ঠের কিছুক্ষণ পর মারা গেল। এর ফলে কয়েকমাস পর মা ফাতিমা (রা.) ও পরলোক গমন করেন।

হযরত আবু বকর (রা.) ইন্তেকালের পূর্বে হযরত ওসমান (রা.)-কে ডেকে এনে খেলাফতনামা লিখে দেবার কথা বললেন। হযরত ওসমান (রা.) খেলাফতনামা লিখতে থাকাবস্থায় যখন নাম লেখা হবে এর পূর্বে হযরত আবু বকর (রা.) অসুস্থতার কারণে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন এবং এ অবস্থায় হযরত ওসমান (রা.) হযরত ওমর (রা.)-এর নাম খেলাফতনামায় বসিয়ে দেন। জ্ঞান ফিরলে আবু বকর (রা.) জিজ্ঞাসা করলেন, কার নাম লিখেছো? হযরত ওসমান (রা.) বললেন, ‘ওমরের’ নাম লিখেছি, শুনে আবু বকর (রা.) খুব খুশী হলেন। আবু বকর (রা.) এর খলিফা হবার প্রথম এবং প্রধান অবদানটি হলো হযরত ওমর (রা.)-এর এবং আবু বকর (রা.) পরে তার স্থানটিও এতে পাকাপোক্ত হবার পথ হলো। আর সেজন্যেই আবু বকর (রা.)-এর ইন্তেকালের পূর্বে হযরত ওমর (রা.)-এর অবদানটির কথা স্মরণ রেখে ঋণ শোধ করার জন্য স্বীয় মতামতে খলিফা নিযুক্ত করে গেলেন হযরত ওমর (রা.)-কে।

মূলত : হযরত ওমর (রা.)-এর নিযুক্ত করে যাওয়া হযরত ওসমান (রা.)- এর পর পরই শুরু হলো উমাইয়াদের কাল। ‘কারবালা ও ইমাম বংশের ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থের ১৭৬ পৃষ্ঠায় মোহাম্মদ বরকতুল্লাহর ভাষায়, ‘গোটা উমাইয়া রাজত্ব ছিল পৌত্তলিক যুগের ভোগসর্বস্ব সমাজনীতির একটি প্রতিক্রিয়া এবং সেই প্রতিক্রিয়ার জয়যাত্রা।’ উমাইয়াদের সরকারী ইসলামই অদ্যাবধি অধিকাংশ মুসলমান মোহাম্মদী ইসলাম বলে, আল্লাহর বিধান বলে জেনে এবং মেনে আসছে। পরবর্তীতে একইভাবে একই বিকৃতির স্রোতে ভেসে আসছে আব্বাসিয়া রাজশক্তি যাদের যুগে আওলাদে রাসূল ও অলী-আউলিয়াগণকে তাদের কুৎসিত ব্যক্তিস্বার্থের, গোত্র দ্বন্দ, তাদের কথিত মতবাদের প্রতিদ্ব›দ্বী মনে করে দেশান্তরিত করছে, গুপ্ত ঘাতকের মাধ্যমে হত্যা করছে।
ইমাম হাসান (রা.)-এর শেষ ইচ্ছা ছিল তাঁর প্রিয় নানা হযরত রাসূল (স.)-এর পবিত্র রওজা মোবারকের সাথেই চির শায়িত হওয়া। কিন্তু ইমাম হাসান (রা.)-এর লাশ মোবারক হযরত রাসূল (স.) পরিত্র রওজা মোবারকের নিকট আনা হলে মুয়াবিয়ার নির্দেশ মোতাবেকই তাঁর পবিত্র লাশ মোবারকের উপর তীর নিক্ষেপ করেছিল। মারওয়ান ও তার দলের লোকজন বললেন, ‘আমাদের ওসমান যেখানে শয়ন করতে পারেনি সেখানে অন্য কাউকে শয়ন করতে দিব না।’ (চলবে)

লেখক: আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক