Header Advertisement

Sobar Desh | সবার দেশ জয়নুল আবেদীন


প্রকাশিত: ০০:৪২, ২৭ এপ্রিল ২০২৫

প্রবন্ধ

জান্নাতুল বাকী ও প্রসঙ্গান্তর

জান্নাতুল বাকী ও প্রসঙ্গান্তর
ছবি: সবার দেশ

(৫ম পর্ব)

যেখানে হযরত আবু বকর ও হযরত ওমর (রা.)-কে দাফন করা হলো রাসূল (স.)-এর পাশে, সেখানে রাসূল (স.) প্রাণ প্রিয় আওলাদ, যার আকৃতি রাসূল (স.)-এর সদৃশ, তাঁর নূরের অংশ, বেহেশতীদের সর্দার বা ইমাম, যাদের প্রতি মহব্বত রাখা উম্মতের জন্য ওয়াজিব, যারা কোরানের সাথে এবং কোরান যাদের সাথে চিরবর্তমান, নাজাতের কিস্তি বা নূহের নৌকা সদৃশ, যারা আল্লাহর সৃষ্টির মূল অস্তিত্বের ধারক-বাহক, পৃথিবীতে ফুটন্ত বেহেশতের ফুল, ত্যাগ, ন্যায় ও শান্তির প্রতীক রাসূলের (স.) আহলে বাইয়েতের তৃতীয় সদস্য ইমাম হাসান (রা.)-কে রাসূল (স.)-এর পাশে দাফন করতে দেওয়া হলো না, ব্যক্তিস্বার্থ, গোত্রস্বার্থ, প্রতিহিংসার কুটকৌশল এবং রাজনৈতিক কারসাজিতে বিজয়ী হয়ে উমাইয়া গোত্রের মুনাফিক মুয়াবিয়া ও তার অনুসারীগণ।

যুগে যুগে সমস্ত মহাপুরুষগণই আহলে বাইয়েতের পরিচয় নিয়েছেন এবং তাদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেছেন এবং মানব সমাজকেও তাঁর পরিচয় দিয়েছেন। তারা তাদের সমস্ত বিপদাপদ হতে মুক্তির জন্য আহলে বাইয়েতের উছিলায় প্রার্থনা করেছেন। কারণ, প্রতিটি সৎ মানুষের মাঝেই জাগ্রত আছে রাসূল (স.)-এর আহলে বাইয়েত এবং নূর সেতারা আহলে বাইয়েতের মাধ্যমেই প্রকাশ হচ্ছে- যা মুমিনের চেহারায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে (ফি উজুহিহিম মিন আছারিজ সজুদি)। আল্লাহপাক হতে রাসূল (স.) ও তাঁর আহলে বাইয়েতের মাধ্যমে সৃষ্টিতে নাযিল হচ্ছে ইলেম, মারেফাত, সায়াদাত, খায়ের ও ছালামত যা লাভ করার জন্য একজন মুক্তিকামী সাধক সর্বদা প্রার্থনা করে থাকে। আর উক্ত পাঁচটি বিষয়ের মাঝে আল্লাহর সমস্ত রহমতই নিহিত আছে- যা পাক পাঞ্জাতন বা রাসূলের আহলে বাইয়েতের মাঝে রয়েছে তথা পাক পাঞ্জাতনের মাধ্যমে লাভ করে থাকে।

হযরত আদম (আঃ) পৃথিবীতে এসে পাক পাঞ্জাতনের উছিলায় প্রার্থনা করেই বিপদমুক্ত হয়েছিলেন। হযরত সোলায়মান (আঃ) সহীফা “গজলুল গজলাত”-এর ৫ম অধ্যায়ে রাসূল (স.) ও তাঁর আহলে বাইয়েতের প্রশংসার বর্ণনা রয়েছে (এলিয়া- ৭ পৃঃ) এবং তিনি তাদেরকে উছিলা করে আল্লাহ পাকের দরবারে প্রার্থনা করতেন। কিন্তু বাইবেলের নতুন অধ্যায় হতে “গজলুল গজলাতের” প্রার্থনা অংশটি বাদ দেওয়া হয়েছে।
ইসলামের প্রাথমিক যুগ হতেই রাজশক্তির পোষা মোল্লাগণ দ্বারা ইসলাম ও কোরান-হাদিসের আক্ষরিক ব্যাখ্যার নামে বিকৃত স্রোত প্রবাহিত হয়েছে, বিকৃত হয়েছে ইতিহাস ও তার শিক্ষা পদ্ধতি। তারা আল্লাহদ্রোহী, রাসূলদ্রোহীদেরকে “জলীলুর কদর' সাহাবী হিসাবে স্থান দিয়েছে, মর্যাদা দিয়েছে; আর প্রেমিক ও জ্ঞানী অনেক সাহাবাগণই হয়েছে চরম অবহেলিত, নির্যাতিত, নির্বাসিত এবং রাজশক্তির দ্বারা নিহত। 

যারা রাসূল (স.) এর হুকুমকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়েছে, তাঁরা পবিত্র আহলে বাইয়েতকে হত্যা করেছে তাদের নামের আগে 'হয়রত' এবং শেষে 'রাদিআল্লাহ আনহু' লিখতে বিন্দুমাত্র লজ্জাবোধটুকুও তারা করেনি। রাসূল (স.) এর আহলে বাইয়েতের গুরুত্ব, ফজিলত মুছে ফেলার সব পথই তারা অবলম্বন করেছে এবং তাদেরকে বিষ খাইয়ে নয়তো গুপ্ত ঘাতকের মাধ্যমে হত্যা করা হয়েছে। অথচ রাসূল (স.) বলেছেন : আহলে বাইয়েতের পরিচয় লাভ করা দোযখ মুক্তির উছিলা [মাদারেজুন নবুয়ত- ৩য় খন্ড, ১১৫ পৃষ্ঠা] এবং রাছুলের আহলে বাইয়েতগণ হাশরের দিন রাসূল (স.)-এর সম মর্যাদায় অবস্থান করবে [মাদারেজুন নবুয়ত; ৩য় খন্ড, ১১৮ পৃষ্ঠা]।

কারবালায় ইয়াজিদের লোকসংখ্যা ৩০ হাজার। এরা সাবই কালেমা, নামায, রোজা, হজ্জ ও যাকাত পালন করতো, ইমামতি করতো, খুৎবাহ দিত। ঐ ৩০ হাজার ইয়াজিদের সৈন্যদের মধ্যে আড়াইশত কোরানে হাফেজ ছিল, তাফসীরকারকও ছিল। অপর পক্ষে হুসাইন (রা.)-এর পক্ষে ছিল ৭২ জন। অথচ ইমাম হুসাইন (রা.) তাদেরকে মুসলমান বলে স্বীকার করলেন না। তিনি তাদেরকে প্রশ্ন করেছিলেন : আলইছা ফি মুসলিমুন? তোমাদের মধ্যে কি একজনও মুসলমান নেই? 

সেনাপতি হুর তার ভাই, গোলামসহ ত্রিশ জন অনুচর নিয়ে ইমাম হুসাইন (রা.)-এর পক্ষে এসে যোগদান করলেন। এখানেই আসল ও নকল মুসলমানের পরিচয় করিয়ে দিলেন ইমাম হুসাইন (রা.)। ইমাম হুসাইন (রা.) শহীদ হবার পর ইয়াজিদ এবং তার সহযোগীরা ইসলামের মূল শিক্ষা বর্জন করে তাদের মতবাদ তাদের স্বার্থের অনুক‚লে ব্যবহার ও প্রচার করেছিল, প্রয়োজনে হাদিস তৈরি করত। ফতোয়া দিত তার স্বার্থ ও তার প্রচারিত মতবাদের পক্ষে। ঐ শিক্ষাই অদ্যাবধি অধিকাংশ মানুষ দিচ্ছে এবং গ্রহণ করছে। কারণ ইয়াজিদ ও তার সতীর্থরা মৃত্যুর করাল গ্রাসে পতিত হলেও তাদের অশরীরীগুলো সহস্র-লক্ষ ভাগে বিস্তার লাভ করে আছে মুসলিম সমাজে।

রাসূলের এ জীবন্ত সুন্নাহকে ত্যাগ করে মুর্দা সুন্নাহকে প্রাধান্য দিয়ে মৌলবাদ খারিজী ওহাবীগণ মুর্দারের পরিণত হচ্ছে। রাসূল (স.) বলেছেন : কাফের মৃত আর মুমিন জীবিত। এ মুর্দা সুন্নাতকে প্রাধান্য দিয়ে ফল দাঁড়াচ্ছে বাহ্যিক ভাবে ধর্মীয় ভ‚ষণ, জুব্বা, পাগড়িওয়ালা সাইনবোর্ড সর্বস্ব মুসলমান। কথিত সুন্নাতধারীর পুর্বানুসারীগণই কারবালায় নবী বংশ ধ্বংসের বিকৃত তাÐবে মত্ত ছিল এবং তারাও নামায, রোজা, হজ্জ, যাকাত আদায় করতো, কালেমা পাঠ করতো, কোরআনে হাফেজ ছিল, তফসিরকারক ছিল, ইমামতি করত, আর ইসলামকে ধ্বংস করার নেশায় হিংস্র পশুর মতো নবী বংশ এবং পরবর্তীতে পীর, আউলিয়াগণের বিরুদ্ধে হায়েনার মতো আক্রমণ করত, দিত চরম লজ্জাহীনতার পরিচয়। তাছাড়া কোরআনের সূরা শামছের ৯ নং আয়াত, সূরা শুরার ৭৯, ৮০ নং আয়াত এবং মুসলিম শরীফের উক্ত হাদিস মোতাবেক বাহ্যিক ভ‚ষণের কোনোই মর্যাদা আল্লাহপাকের কাছে নেই, একমাত্র পরিশুদ্ধ অন্তর ব্যতীত। এ কথা অন্ধ, বধির, বোবা, দজ্জাল, মূর্খ মোল্লার দল কখনো বুঝেনি।

মুনাফেকির মাধ্যমে কোরআনের দোহাই দিয়ে উমাইয়া প্রধান ও আমর ইবনুল আস যেমন মুসলমানদেরকে ধোঁকা দিয়েছিল এবং হযরত আলী (আ:)-এর দলে অবস্থান করা বৃহৎ একদল তাদের লেবাছ দেখে, কোরানের দোহাই দিতে দেখে যেমন ভুল করেছিল, সেই ধর্মান্ধদের মতো ইমাম হুসাইন (রা.)-এর বিরুদ্ধে ত্রিশ হাজার লেবাছধারী তথাকথিত আড়াইশত কোরানে হাফেজ, কোরানে মুফাস্সিরগণকে দেখে, তাদের ফতোয়া শুনে, অর্থের লোভে বা ভয়ে কুফাবাসীগণ ভুল বুঝেছিল ইমাম হুসাইন (রা.)-কে এবং তাকে নির্মমভাবে শহীদ করেছিল ধর্মান্ধ ইয়াজিদ ও তার হায়েনার দল। মুনাফিক ওমর বিন সাদ কোরানে মুফাস্সির হয়ে বুঝতে পারেনি “হুসেইন আমা হতে এবং আমি হুসাইন হতে”- রাসূলের (স.) এ বাণীর রহস্য। এ ধরনের লক্ষ লক্ষ মুফাসির বর্তমান মুসলিম সমাজে অলিতে-গলিতে তাদের মুফাসিরগিরীর ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।

আবদুল্লাহ ইবনে জোবায়ের আহলে বাইয়েতের বিরুদ্ধে চরম শত্রæতা প্রদর্শন করেছিল এবং স্বীয় আত্মাকে প্রতিহিংসার আগুনে কলুষিত করেছিল। সে ৪০ জুমার নামাযে দুরূদ পড়া ত্যাগ করেছিল এ জন্য যে, দরূদে আহলে বাইয়েতগণ সংযুক্ত আছে। আবদুল্লাহ ইবনে জোবায়ের ছিলেন হযরত আবু বকর (রা.)-এর দৌহিত্র। পরে আহলে বাইয়েতকে বাদ দিয়ে বা আলে রাসূলকে বাদ দিয়ে দরূদ পড়ার রীতি প্রবর্তন করা হয়েছিল। অথচ রাসূল (স.) এ ধরনের লেজকাটা (আহলে বাইয়েতকে বাদ দিয়ে) দরূদ পড়তে নিষেধ করে দিয়েছেন। [আশ শেফ- প্রথম খন্ড]

অন্তর্দ্বন্ধের কারণেই ইসলামের নিম্নগতির সৃষ্টি হয়েছিল। হযরত আলী (ক.) তা পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নিতে গিয়েই পড়েছিলেন মহাবিপাকে। ব্যক্তি স্বার্থ, গোত্র স্বার্থ এবং প্রতিহিংসার বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে শেষে শাহাদাত বরণ করতে হয়েছিল। দীনহীন বুভুক্ষু লোকেরা যখন এক টুকরো রুটির জন্য হাহাকার করছিল, উমাইয়া গোত্রের লোকেরা তখন সম্পদের স্তূপে গড়াগড়ি দিয়ে চলছিল। খেলাফত পরিণত হয়েছিল উদর-পূর্তি আর সম্পদ স্তূপীকরণের হাতিয়ার হিসেবে। নবী বংশের প্রতি প্রত্যেক শুক্রবারে খুৎবার মাধ্যমে গালাগালি করা নিয়ে উমাইয়া সুন্নাত চলছিল ৮৩ বছর ৪ মাস পর্যন্ত। এ সময় ভারতে আর্য বংশের রাজা ঘোরের শাসন চলছিল। তিনি এ ধরনের কুপ্রথা জানতে পেয়ে অতিশয় দুঃখিত ও মর্মাহত হয়েছিলেন এবং তার প্রতি নিন্দা জ্ঞাপন করেছিলেন। [তারিখে ফেরেস্তা, ১ম খন্ড : ২৭ পৃষ্ঠা]

চিশতি সাহেবের আহলে বাইয়েতের কালেকশনকৃত উপরে উল্লেখিত বিষয় নিয়ে জনৈক ফয়সাল আহমদ, অধ্যক্ষ জামেয়া ইসলাময়িয়া সিনিয়র মাদ্রাসা এবং মহাপরিচালক সুলাইমানিয়া ইসলামিক মিশন-এর কাছে জানতে চেয়েছিলাম। কারণ, আমার জানা মতে তাঁর বাবা আলহাজ মাওলানা সোলাইমান (পীরসাহেব) সিলেটী, রাসূল করিম (স.)-এর ৪৩ তম ছিলছিলার দাবিদার। তৎপুত্র ফয়সল আহমদ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দাওয়া অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ-এ সম্মানসহ এম. এ ডিগ্রিপ্রাপ্ত। ‘আমার দেখা আরব’ গ্রন্থের পান্ডুলিপি চূড়ান্ত করার পর তাকে দেখতেও দিয়েছিলাম। তিনি গ্রন্থের বেশকিছু শব্দ ও বাক্য পরিবর্তন করে ‘বেহুশের চৈতন্য দান' গ্রন্থ থেকে নেওয়া উদ্ধৃতির সাথে দ্বিমত প্রকাশ করে বলেন-
এ সব শিয়া ও সুফি পন্থীদের লেখা গ্রন্থ।
প্রতি উত্তরে হাসতে হাসতে আমি বলি-
- তা হলে এর সাথে ভিন্নমত পোষণকারীদের বলা চলে মাবিয়াপন্থী লেখক। শিয়া কিংবা মাবিয়া প্রন্থীদের কথা বাদ দিয়ে যদি ইতিহাসের দিকে তাকাই- ইতিহাস ফাতেমী পরিবারের বঞ্চনার কথা স্বীকার করেছে।

ফাতেমী পরিবারের বঞ্চনার কথা সত্য। তখনকার পরিবেশে হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) এবং হযরত উমর (রা.)-এর খিলাফত গ্রহণও যুক্তিসঙ্গত ছিল। রাসূল কারিম (স.)-এর পরলোকগমনের পর নতুন রাষ্ট্র ও ধর্মের ওপর যেসব আক্রমণ হয়েছিল- তারা তা যোগ্যতার সাথেই মোকাবেলা করেছেন। উদাহরণ ইতিহাস থেকে দেয়া যায়-
আবদুল্লাহ-বিন-মসউদ নামক জনৈক সাহাবী বলেছেন, ‘এরূপ মুসিবতের সময় হযরত আবুবকরের (রা.) মতো খলিফা না থাকলে ইসলাম ও ইসলামী রাষ্ট্র কোনোটাই রক্ষা পেত না- অনিবার্য ধ্বংসের কবলে পড়ে যেত মুসলিম ধর্ম ও সমাজ।’ তিনি খলিফা হবার পূর্বে এবং পরে ইসলামের খেদমতের জন্য যা কিছু করে গিয়েছেন তৎপরিপ্রেক্ষিতে তাঁকে ন্যায়সঙ্গতভাবে ইসলামের পরিত্রাণকর্তা বা Saviour of Islam  বলা হয়। (চলবে,,,)

লেখক: আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক