আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে
কবি রায়গুনাকার ভারতচন্দ্র রায়ের বিখ্যাত কাব্য "অন্নদামঙ্গল - এ প্রধান চরিত্র ঈশ্বরী পাটনী বলেছিলেন, 'আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে'। প্রবাদ বাক্যটি লোকশ্রুতি হিসাবে মানুষের মুখেমুখে প্রচলিত হয়ে আসছে আবহমান কাল থেকে। সন্তানরা যাতে সুষম খাবারে পরিপুষ্ট হয়ে সুস্বাস্থ্যে বেড়ে উঠতে পারে। মা-বাবার এই নিঃস্বার্থ চাওয়া মূলত বাঙালির ঐতিহ্যের একটা অংশও বলা চলে।
অপ্রিয় হলেও সত্য এই যে, সম্প্রতি 'আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে' কিংবা 'মাছে-ভাতে বাঙালি' কথাটা এখন আমাদের অনেকের কাছে সেকেলে মনে হচ্ছে। তাই এ সব খাবারে আমরা এখন অধিকাংশই তৃপ্ত নই। প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় এখন বিদেশী কালচারের খাবারের প্রতি অনেকেই আসক্ত। তাই অধিকাংশ মা-বাবা ফাস্টফুডেই সন্তানের সুস্বাস্থ্যের নির্ভরতা খুঁজেন। কর্মজীবী মায়েদের সময় বাঁচাতে বিকল্প হিসাবে ফাস্টফুড বা বাইরের খাবারের চাহিদা বেড়েই চলেছে। তাছাড়া গৃহিনীদের রান্নার ঝামেলা এড়াতে এটি আরো প্রসার বেড়েছে অনলাইন খাবারের সহজ-সুলভতায়।
এ ছাড়া বিশেষ দিবস বা বিভিন্ন উপলক্ষ্যে উচ্চবিত্ত, এমন কী মধ্যবিত্তরাও অভিজাত রেস্টুরেন্টে সপরিবারে খাওয়া এখন ফ্যাসনে রূপ নিয়েছে। গ্রামেও পিছিয়ে নেই। পিঠাপুলি, চিড়ামুড়ি, ফিরনী-পায়েস ফাস্টফুডের আগ্রাসনে প্রায় বিলুপ্তির পথে। এখন ফাস্টফুডের জয়জয়কার গ্রামীণ কালচারেও ।
পক্ষান্তরে, বিশ্বের সচেতন মানুষেরা এখন প্রাকৃতিক খাবারের প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছেন। কারণ, চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ ও পুষ্টিবিজ্ঞানীদের মতে, প্রক্রিয়াজাত খাবার বিভিন্ন রোগ-ব্যাধি এমন কী ক্যানসার সৃষ্টিরও কারণ হতে পারে। তাই পাশ্চাত্যে স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ এখন টিনজাত, প্রক্রিয়াজাত ও পরিশোধিত খাবারের বদলে স্বাভাবিক খাবারের দিকে ঝুঁকে পড়ছেন।
কারণ হিসাবে বলছি, পশ্চিমা সংস্কৃতি আদলে ফাস্টফুড শিল্পের আগ্রাসী বিকাশের রমরমা প্রসার বেড়েছে। ফলে সমান তালে বাড়ছে স্থূলতা আর জীবনঘাতী রোগব্যাধি। ফাস্টফুডে উচ্চমাত্রায় ক্যালরি, লবন চর্বি, চিনি ও চিনিযুক্ত খাবারের আধিক্যের কারণে এই সমস্যা হয় বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। যা শিশুর শরীর অস্বাভাবিক ওজন বৃদ্ধিতে সহায়ক। তাছাড়া খাবার সুস্বাদু করতে হরদম ব্যবহার করা হচ্ছে টেস্টিং সল্ট। কৃত্রিম স্বাদ বৃদ্ধিকারী টেস্টিং সল্ট নিয়ে বিশ্বব্যাপী একাধিক গবেষণার পর বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এ এক ভয়ানক নীরব ঘাতক! পাশ্চাত্যের একটি গবেষণা-প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টেস্টিং সল্টের আগ্রাসন বিশ্বজুড়ে এলকোহল ও নিকোটিনের চেয়েও বড় বিপদ ঘটাতে পারে। তাই তো গবেষণা প্রতিবেদনে একে অভিহিত করা হয়েছে 'স্নায়ু বিষ' হিসাবে। এটি মানব দেহের জন্যও ক্ষতিকর তবে শিশুদের জন্য আরো মারাত্মক।
ফাস্টফুড তৈরিতে ব্যবহৃত চিনিও এলকোহলের মতোই বিপজ্জনক আর আসক্তি সৃষ্টিকারী। তাই ফাস্টফুড একবার খেলে বারবার খেতে ইচ্ছে করে। একসময় তা আসক্তিতে রূপ নেয়। ফলে আনুপাতিক হারে বাড়তে থাকে ওজন। তাই তো বিশ্বজুড়ে গত কয়েক দশক ধরে এটি রূপ নিয়েছে ক্রমবর্ধমান স্বাস্থ্য জটিলতায়।
ফাস্টফুড শিশুর আইকিউ দুর্বল করে দিতে পারে। কারণ, শিশুর বড় হওয়ার সাথেসাথে তাদের কর্মক্ষমতা ও মস্তিষ্কের ধারণ ক্ষমতা হ্রাস পেতে থাকে। ফলে উচ্চ রক্তচাপ বৃদ্ধি পায়, রক্তে উচ্চমাত্রার কোলেস্টেরল দেখা দেয়। তাছাড়া এসব খাবার গ্রহণে শিশুরা প্রয়োজন অনুযায়ী ভিটামিন ও পুষ্টি পায় না। ২০০৮ সালে মিশিগান ইউনিভার্সিটির গবেষণায় প্রমাণিত হয় যে, ফাস্টফুড মাত্র ৩%পুষ্টিগুণ আছে। তাছাড়া, ফাস্টফুডে যেমন ফাস্ট স্বাদ পাওয়া যায়, তেমনই ক্ষতিটাও কিন্তু ফাস্ট অর্থাৎ দ্রুত হয়।
সঙ্গত কারণেই চাইনীজ বা প্রক্রিয়াজাত খাবারে শিশুরাই আছে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে। সুতরাং আজকের শিশুরা আগামীর বাংলাদেশ। একটা সুস্থ মেধাসম্পন্ন জাতি গঠন করতে হলে সচেতনতা এখনি জরুরী হয়ে পড়েছে। বাঙালি মাত্রই মায়ের হাতের সুস্বাদু রান্না খেতে অভ্যস্ত। তাই তো বলি, মায়ের হাতের রান্নার তুলনা, কারো সাথেই চলে না। এটাও আবহমান বাংলার একটা ঐতিহ্য এবং গর্ব। সুতরাং এটি যেন ফাস্টফুড আগ্রাসনের তোড়ে ভেসে না যায়। তাই শিশুদেরকে ঘরে তৈরি খাবারে অভ্যস্ত করুন। গুড়া মাছ, গোশত, দুধ, ডিম, টাটকা শাকসবজী, দেশীয় মৌসুমি ফলমূল খাওয়ায় আগ্রহী করে তুলুন।
বেঁচে থাকা মানুষের জন্মগত অধিকার। তাই তো বাঁচার জন্য মানুষ কী প্রাণান্তকর চেষ্টাটা-ই-না করে যাচ্ছে। দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে বুঝা যায় বাঁচার আকুলতার গভীরতা কতটা বেদনাব্যঞ্জক এবং কতটা স্পর্শকাতর! সুতরাং স্বাস্থ্যহানী ঘটে বা দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে এমন খাবার গ্রহণে সাবধানতার কোন বিকল্প নেই।
আরোগী হয়ে বেঁচে থাকার প্রয়োজনে ফাস্টফুড গ্রহণে সবাইকে সতর্ক হতে হবে। নতুবা শারীরিক ভাবে অসুস্থ একটি উত্তরপ্রজন্মের কাছ থেকে আমরা কখনোই সুস্থ ও সমৃদ্ধি জাতি আশা করতে পারি না।
রসনা তৃপ্তিদায়ক ফাস্টফুড -এর বিশ্বজুড়ে আরেক নাম 'জাঙ্ক ফুড'। যার ক্ষতিকর প্রভাব অনেক। এ প্রসঙ্গে দেশের বিশিষ্ট চিকিৎসক বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি প্রফেসর ডা. এ কে আজাদ খান তার একটি নিবন্ধে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন -- 'আমাদের ভবিষ্যত বংশধরদের এই ক্ষতিকর অবস্থা থেকে বাঁচাতে এখনই সচেতন হওয়া দরকার। এজন্যে প্রাথমিক শিক্ষা পর্যায়ে এই বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। ভবিষ্যতে একটি সুস্থ জাতি উপহার দিতে হলে এখন থেকেই উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে।'
লেখকঃ কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক