দর্পচূর্ণ
(শেষ পর্ব: জেদ্দা থেকে মক্কা)
দোয়া-দরুদ দেখে মনে করতাম, গাইডে উল্লেখিত দোয়া-দরুদ ঠিকমত পড়া না পড়ার সাথে আল্লাহর কাছে হজ্জ মঞ্জুর হওয়া না হওয়ার বিষয়টি জড়িত। ‘আমার দেখা আরব’ গ্রন্থ’ লেখতে গিয়ে আমাকে এসব বিষয়ে অনেক বই-পুস্তক দেখতে হয়েছে। আমার জানামতে, বোখারী শরীফ একটি ছহিহ্ হাদীছ গ্রন্থ’। হামিদিয়া লাইব্রেরি কর্তৃক প্রকাশিত বোখারী শরীফের ২য় খন্ডের ১০ম অধ্যায়ে ‘হজ্জ' বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। এ অধ্যায়ে ৭৯৩ থেকে ৯৫০ নং পর্যন্ত দেড়শতাধিক হাদীছে হজ্জের ফরজ, ফজিলত, মীকাত, এহরাম, হায়েজ-নেফাজ, হজ্জের প্রকার, কা'বা, গেলাফ, হাজারে আসওয়াদ, তওয়াফ, জমজম, সাফা-মারওয়া, মিনা, আরাফা, মুজাদালেফা, কোরবানী, মাথা মু-ানো, কংকর নিক্ষেপ, রাসূল (সা.)-এর বিদায় হজ্জ, ইসলামের মূলনীতির উপর ভিত্তি করে রাসূল (সা.)-এর ভাষণ, ওমরা ও ওমরার উত্তম সময়, হজ্জ থেকে প্রত্যাবর্তনকালে হাজীদের সম্বর্ধনা, এহরাম বাঁধা অবস্থায়য় রীতি-নীতি ও হেঁটে কা'বা শরীফে যাওয়ার মানত ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা, ব্যাখ্যা ও মাসআলা-মাসায়েল রয়েছে। এরপর ৯৫১ থেকে ৯৭০ নং হাদীছে অনুরূপভাবে পবিত্র মদিনার ফজিলত, মদিনার হারাম এলাকা, মদিনার জন্য রাসূল (সা.)-এর দোয়া, এবং মদিনার প্রতি প্রতিটি মুসলমানের অনুরাগ ও ভালবাসার কারণ বর্ণিত রয়েছে। এর মধ্যে ৮১০ ও ৮১১ নং হাদীছে দোয়া সম্পর্কিত ‘তালবিয়ার' বিষয়ে উল্লেখ আছে।
আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, রাসূল (সা.) এহরাম বাঁধা থেকে আরম্ভ করে ১০ তারিখ সকাল বেলায় জমরা আকাবা তথা বড় শয়তানকে কংকর মারার পূর্ব পর্যন্ত তালবিয়ার ‘লাব্বায়েকা আল্লাহুম্মা লাব্বায়েকা। লাব্বায়েকা লা-শারীকা-লাকা লাব্বায়েকা ইন্নাল হামদা ওয়ান-নেমাতা লাকা’ এ অংশটুকু যথাসম্ভব পাঠ করতেন। এ ছাড়া দোয়া-দরুদ হিসেবে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও মহানত্ব ঘোষণা করণ ছাড়া হজ্জ বিষয়ে আর কোন সুনির্দিষ্ট দোয়া-দরুদের উল্লেখ পাওয়া যায় না। আমাদের হাট-বাজার এবং লাইব্রেরীতে যেসব হজ্জ-গাইড পাওয়া যায় সেসব হজ্জ গাইডে যেসব দোয়া-কালামের বর্ণনা রয়েছে আরবি ভাষায় দক্ষ ব্যক্তি ছাড়া সেসব দোয়া-কালাম মুখস্ত করা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। কা'বাগৃহ সাতবার প্রদক্ষিণের সময় সাত রকমের দোয়ার বিষয়টি বোখারী শরীফের কোথাও উল্লেখ নেই। অথচ গাইড বইয়ের বর্ণনা মোতাবেক দোয়া পাঠ করার জন্য পৃথকভাবে মোল্লা ভাড়া করতে হয়। তওয়াফকালে ভাড়া করা মোল্লা দিয়ে দোয়া পাঠ করা কতটুকু ঝুকিপূর্ণ তা ভুক্তভোগী ছাড়া আর কেউ বুঝতে পারবে না। বোখারী শরীফ পাঠ করে মনে হলো, আমাদের ধর্মের সহজ বিষয়গুলো এক শ্রেণীর মোল্লাগণ কঠিন ও জটিল করে তোলে।
এ রকম মোল্লার অবস্থান কম বেশি সব ধর্মেই আছে। তাদের কাজই হলো সহজকে জটিল, মোলায়েমকে কঠিন এবং নির্ভয়কে ভীতসন্ত্রস্ত করে তোলা। এক সময় ভারতবর্ষের ব্রাহ্মণ-বর্ণদ্বিজগণও সাধারণ মানুষ থেকে নিজেদের দুর্বোধ্য এবং মূল্যবৃদ্ধিসহ বর্ণবৈষম্য ঠিক রাখতে ভাষাবৈষম্যের সৃষ্টি করেছিল। ব্যবসায়ী হিসেবে আমরাও কম করি না। মক্কেলের সামনে ইংরেজিতে গটাগট্ বেইল পিটিশন লিখে ও শুনানী করে মক্কেলকে বুঝিয়ে দিই-সবার কাছে 'ল' লোহার মতো শক্ত হলেও আমাদের কাছে ‘ল’ মাখনের মতো নরম। মক্কেলকে বাঁচতে হলে আমাদের কাছে আসতেই হবে। কারণ আমরা ব্যবসায়ী, ব্যবসায়ী মাত্রই জানে, জলঘোলা না করা পর্যন্ত মাছ-ফাঁদে ঢোকে না। আমাদের মোল্লাদের মধ্যে এ মনোভাব না থাকাই ভালো। তার পরেও সাত সাগর তের নদী পার হয়ে বিপুল দান, দয়া, প্রতিপত্তি ও ঐশ্বর্যের মহান মালিক ও অন্তর্যামীর কাছে ভিক্ষা চাইতে এসে দরজায় দাঁড়িয়ে একেবারে মুখ বন্ধ করে থাকলে চলে না। মুখ ফুটে কোনো না কোনো কিছু চাইতে হয়। চাওয়া-পাওয়ার বিষয়টি একেক জনের একেক রকমের হয়ে থাকে। চাওয়া-পাওয়ার কোনো কোনো বিষয় প্রকাশ যোগ্য নয়। মনের কথা মাতৃভাষায় যতো সহজে প্রকাশ করা যায়- অমাতৃভাষায় ততো সহজে প্রকাশ করা যায় না। সাত পাক শেষ করে হাজরে আসওয়াদ ও কা'বা শরীফের মধ্যবর্তী স্থানে দাঁড়িয়ে, সাফা মারওয়া পাহাড়ে ৭ (সাত) প্রকারের অনুরূপ দোয়া পাঠ শেষে নিচের দোয়াসহ যমযমের পানি পান করতে হয়।
‘হে আল্লাহ, আমি তোমার নিকট ফলপ্রসূ ইল্ম, স”ছল জীবিকা এবং সকল রোগের নিরাময় কামনা করি।’ মূল হজ্জের সময় আরাফাতের ময়দানে, মোজদালাফায়, মিনায় ও শয়তানকে পাথর মারার সময় তিন জায়গায় ৩ (তিন) প্রকারের দোয়া পাঠ করতে হয়।
অনুরূপ দোয়া পাঠ করতে হয় মদিনা যিয়ারত কালেও। শ'খানেক দোয়া মিলে ছোটখাটো একটা পুস্তিকা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে, আমি অনেক অধ্যবসায়ের পর ‘লাব্বায়ক, আল্লাহুম্মা লাব্বায়ক' এই দোয়াটি ছাড়া আর কোনো দোয়া আরবিতে মুখস্ত করতে না পেরে মাতৃভাষায় দোয়ার মর্ম রোমন্থনসহ সকলের সাথে সুরে সুরে 'আল্লাহুম্মা লাব্বায়ক দোয়াটি বারবার পাঠ করেছি। কোনো কোনো সময় সামান্য রদবদলসহ একই দোয়া পুনরাবৃত্তি করতে হয়।
সহিশুদ্ধভাবে তওয়াফ সম্পন্ন করানোর লক্ষ্যে সামসু ভাই আমাদের সাথে একজন অতিশয় বৃদ্ধ লোক পাঠিয়েছিলেন। প্রফেশনাল সাহায্যকারী বৃদ্ধ লোকটি হামিদ ভাইয়ের কাঁধের পেছনে বই খুলে কানের কাছে মুখ রেখে শপথ বাক্য পাঠের আদলে আমাদের সবাইকে দোয়া পাঠ করাতে শুরু করেছিলেন আমরা সাহায্যকারীর মুখ থেকে শুনে না শুনে ভয়ভীতির সাথে দোয়ার সমোচ্চারিত ধ্বনি উচ্চারণ করছিলাম। এ রকম করতে গিয়ে একজনের পায়ের উপর অন্যজনের পা জড়িয়ে যাচ্ছিল। আমাদের পরস্পরের শরীরও বারবার ঠোকাঠুকি শুরু করে দিয়েছিল। ভীষণ চাপের কারণে এবং ঠোকাঠুকি ঠেকাতে আমরা কখনো কখনো পরস্পর থেকে দূরে সরে পড়ছিলাম। এর ভেতরে প্রতি প্রদক্ষিণে একবার করে কালো পাথরের দিকে ইশারায় চুম্বন করাসহ কা'বা গৃহের বিশেষ বিশেষ স্থানন বরাবর পৌঁছে বিশেষ বিশেষ দোয়া পাঠ করতে গিয়ে বারবার খেই হারিয়ে ফেলতে শুরু করি। শুধু তাই নয়, এভাবে তওয়াফ করতে গিয়ে ধরাশায়ী হওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছিল। তওয়াফ এলাকায় ধরাশায়ী হলে বিপদের সমূহ সম্ভাবনা থাকে। সহিশুদ্ধভাবে হজ্জব্রত আদায় করতে গিয়ে বিকৃত উচ্চারণে ঠোঁট নাড়ার চেষ্টা করে যাওয়া ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার ছিল না। এ পদ্ধতিতে কোনো ক্রমেই শেষ রক্ষা না হওয়ায় বিশেষ করে মারাত্মক ঝুঁকি থেকে প্রাণ বাঁচানোর জন্য একান্ত বাধ্য হয়েই দোয়া কালামের মর্ম মাতৃভাষায় পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
প্রথম দিকে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলাম। কারণ, বাংলায় জন্মে এবং বাংলার খেয়ে ধর্মীয় কিংবা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত জনেরা যেখানে বাংলায় কথা বলতে কুণ্ঠাবোধ করে সেখানে আরবের মাটিতে, কা'বার পাশে এবং খাস হারাম এলাকার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আরবি ভাষার পরিবর্তে আঞ্চলিক ভাষায় আল্লাহর কাছে মনের কথা কইতে গিয়ে ভয়ে আমার হৃদস্পন্দন বেড়ে গিয়েছিল। বিজ্ঞ ছোট আদালতে বড় কর্তার সাথে বাংলায় বাৎচিত করতে গিয়ে যেখানে ঠোঁটের পানি শুকিয়ে নিজকে ভেড়ার মতো ভীতু মনে হয় সেখানে মালেক-উল-মুল্ক আলা কুল্লি শায়্যিন কাদিরের ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের গাঁও গেরামের ভাষায় মনের কথা কইতে গিয়ে কলিজার পানি শুকিয়ে যাবে না কেন? পরে মুফতী মুহাম্মদ হাবীব ছামদানীর ‘আল্লাহুমা লাব্বায়ক' নামক ক্ষুদ্র একটি পুস্তিকায় হজ্জব্রত কালে দোয়া-দরুদ বাংলায় পাঠ করার সমর্থনে বলেন ‘আল্লাহকে হাজির নাজির জেনে নিজের ভাষায় কাঙ্গালের মতো আল্লাহর সামনে অত্যন্ত বিনীতভাবে দোয়া করাই হচ্ছে দোয়ার আদব।
এ ক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার আরবিতে সাজানো কিছু দোয়া আনুষ্ঠানিকভাবে উচ্চ আওয়াজে জামায়াতবদ্ধ হয়ে আদায় করার মাধ্যমে প্রকৃত পক্ষে আল্লাহর কাছে কিছু পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। বরং তাতে মনের এখলাস ও আবেগ বিঘ্নিত হয়। এ মর্মে প্রচলিত ধারার বিরুদ্ধে এক টুকরো সাহসী বার্তা আমার শুষ্ক কলিজায় জল সিঞ্চনসহ হৃদয়ে আশার আলো জ্বালিয়ে দেয়। মনের ডর-ভয় ঝেড়ে ফেলে মায়ের ভাষায় মনের মতো করে আমার স্রষ্টা হাকিমুন আলিমের কাছে দাবি-দাওয়া পেশ করতে শুরু করি। তা করার আগে প্রথমে দোয়া-কালামের বাংলা অনুবাদ পাঠ করে পাঠের মর্ম উদ্ধার করি। এতে বেশ সফলতাও পাই। প্রতিকূল পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে একান্ত বাধ্য হয়ে, সাহায্যকারীর সাহায্যের আশা ছেড়ে দিয়ে দোয়া-কালামের সারমর্ম পাঠ করতে শুরু করে দিয়েছিলাম। কা'বা চত্বরে মাতৃভাষায় দোয়া-কালাম পাঠসহ সকল ইন্দ্রিয়কে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থেকে মুক্ত করে স্রষ্টার অপূর্ব সৃষ্টির প্রতি নিয়োগ করতে পেরে বেশ স্বস্তি বোধ করেছিলাম।
তওয়াফ কালে পবিত্র স্বর্গীয় পাথর হাজরে আসওয়াদের নিকট যাওয়ার জন্য অনেক চেষ্টা করেছি। অনেক চেষ্টার পরেও পবিত্র পাথরকে চুমো কিংবা স্পর্শ করতে ব্যর্থ হয়ে ইশারায় চুমো খেয়ে পাঠ করি-
‘হে আল্লাহ, আমি তোমার ঘরের চারপাশ ঘুরে ওমরার জন্য তওয়াফ করছি। তুমি আমার জন্য ওমরাহ সহজ ও কবুল করে নাও।’
তওয়াফের শুরুতে ছোট ছোট কদমে তিন পাক ঘুরি। বাকি চার পাক ঘুরার সময় কদমের গতি বাড়িয়ে দিই। কা'বা বাম দিকে রেখে পবিত্র পাথর হাজরে আসওয়াদ থেকে পাক শুরু করে পুনরায় পবিত্র পাথর বরাবর পৌঁছলে এক পাক। এভাবে সাত পাক ঘুরি। প্রতি পাকের সময় পবিত্র পাথর বরাবর এসে ‘আল্লাহু আকবার' (আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ) ঘোষণাসহ ‘হে আমাদের প্রতিপালক, দুনিয়া ও আখেরাতে আমাকে মঙ্গল দান কর। পরকালের শাস্তি থেকে বাঁচিয়ে পুণ্যবানগণের সাথী করে স্বর্গে প্রবেশ করাও।'
এই বলে বারবার আল্লাহর আনুগত্য প্রকাশ করি। তওয়াফ কালে কা'বার কাছাকাছি পৌছার জন্যে সাধ্যমতো চেষ্টা করি। তওয়াফ শেষ করে মাকামে ইব্রাহীমের পেছনে নামায আদায় করারও চেষ্টা করি। পাথরের কাছে পৌঁছতে কিংবা কা'বার পাশে ধনুকের মতো ঘেরাওকৃত অংশের (হাতিম) ভেতর নামায আদায় করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হই। পরিশেষে, তওয়াফ এলাকার পাশে দাঁড়িয়ে ইশারায় (প্রথম রাকাতে সূরা ফাতিহার সাথে কুল ইয়া আইয়ূহাল কাফিরুন, দ্বিতীয় রাকাতে সূরা ফাতিহার সাথে সূরা ইখলাছ পাঠ করে) দু'রাকাত নামায আদায় করি। তারপর 'সাফা' পাহাড়ের নিকট থেকে ‘মারওয়া’ পাহাড়ের দিকে নিয়ম মতো সাত বার দৌড়াদৌড়ি করি। ই”ছামতো দৌড়ালে চলবে না, নিয়ম হলো, মা হাজেরা সাফা-মারওয়া বরাবর দৌড়ানোর সময় শিশুপুত্র ইসমাইল (আ.)-এর দিকে নজর রাখতেন। দৌড়ের যেখানে গেলে শিশুপুত্র মা হাজেরা (রা)-এর নজরের বাইরে চলে যেতো সেখানে তাড়াতাড়ি দৌড়াতেন। শিশুপুত্র পুনরায় নজরে পড়তেই আস্তে আস্তে দৌড়াতেন। মা হাজেরা (রা.)-এর সেই নিয়ম আজও রক্ষা হয়। যতদূর সম্ভব মা হাজেরা (রা.)-এর নিয়ম মেনে দৌড় শেষ করে কেবলামুখী হয়ে বলি ‘আল্লাহ ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই। আল্লাহ মহান ও একক, তার কোনো অংশিদার নেই। সমস্ত বাদশাহী তাঁরই। তিনি জীবিত করেন ও মৃত্যু দান করেন। তিনি সকল বিষয়ের ওপর শক্তিশালী। তাকে ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই।’
সা’ফা থেকে মারওয়া পাহাড় বেয়ে সাত চক্কর পূরণ করার দৃশ্য
সাফা থেকে মারওয়া পাহাড়ে সাধ্যমতো দৌড় শেষ করে দু'হাত তুলে সৃষ্টিকর্তার কাছে দোয়া করি। সব শেষে, প্রাণ ভরে জমজমের শীতল পানি পান করার পর যেনো সব শ্রম ও কষ্ট দূর হয়ে যায়।
এবার বারবার শপে (সেলুন) প্রবেশের পালা। বারবার শপে ঢুকে মাথা না মুন্ডালে ওমরাহ্ সহি-শুদ্ধ হয় না। শৈশবে কবে মাথা মুন্ডিয়েছি ঠিক মনে করতে পারি না। চুলভর্তি মাথাসহ জোর করে বয়সটাকে আটকে রাখতে চেয়েছিলাম।
তারুণ্যের শেষে যৌবনের জোয়ারে ভাঁটার টান মারার বিষয়টি তখন থেকে বুঝতে পারি। যানবাহনের লোকেরা যখন থেকে 'চাচা' সম্বোধন করতে শুরু করে। 'চাচা' সম্বোধনের পর ‘মুরব্বি' সম্বোধন শুরু হতেই যৌবনের মৌবনে টনক নড়ে যায়। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে নিজের মুখোমুখি করি। নিজের শরীরের দিকে চেয়ে দেখি, টালমাটাল যৌবনের টানটান চামড়ায় শণৈঃশণৈঃ, ভাঁজ পড়তে শুরু হয়ে গেছে। কপালে বলিরেখা ভর করেছে কবেই। কুচকুচে কালো কেশের স্থান দখল করে নিয়েছে আঁশের মতো ধুলায়- ধূসর চুল। যৌবনের বেসামাল জোয়ারের পানি নামতে নামতে তলানিতে থিতিয়ে যাচ্ছে। টইটুম্বুর জীবৎ তারুণ্যের স্থান দখল করে নিয়েছে জীর্ণতা। রঙিলা নায়ের হাল-মাস্তুল চূর্ণবিচূর্ণ করে তলা দিয়ে ছলাৎ ছলাৎ জড়তার জোয়ার উঠতে শুরু করেছে। নৈঃশব্দ নোঙর ফেলেছে জীবনের ব্যস্ততম বন্দরে। আজ যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই দেখি বার্ধক্যের বিজয় কেতন পৎপৎ করে উড়ছে। অনাবশ্যক ও অনভিপ্রেত বার্ধক্য ঠেকানোর যুদ্ধে সবকিছু বেদখল হয়ে পড়ার পরেও যৌবনের শেষ প্রতীক মাথার চুল কয়টা ধরে রেখেছিলাম। ফিকে হয়ে পড়া চুল কালো রাখার জন্য যা যা করতে হয় তা তা শুরু করে বার্ধক্যকে আড়াল রাখার প্রয়াস চালাচ্ছি অহরহ। মাথা মুন্ডালে কৃত্রিম নেকাবের আঁড়াল থেকে কদাকার বার্ধক্য বেরিয়ে পড়বে। জরাজীর্ণ বার্ধক্যকে আমার ভীষণ ঘৃণা। আমি কখনো বুড়ো হতে চাই না।
কোনো এক বিদেশি লেখক এক সময় জীবনকে ভোগ করার জন্য- শৈশব বিলেতে, যৌবন আমেরিকায় ও বার্ধক্য ভারতবর্ষে' কাটাতে চেয়েছিলেন। কারণ, সারা বিশ্বের মধ্যে এক সময় ভারতবর্ষে বৃদ্ধদের কদর খুব বেশি ছিল। সেদিন বদলে গেছে। নিউইয়র্কের স্টোন ব্রুক ইউনিভার্সিটির মনোবিদ ড. আর্থার স্টোন তিন লাখ ৪০ হাজারেরও বেশি মানুষের উপর গবেষণা চালিয়ে দেখতে পেয়েছেন- ৫০ বছরের পর মানুষ জীবনের নেতিবাচক দিকগুলোকে তেমন গুরুত্ব দেয় না। এ সময় থেকে প্রাত্যহিক জীবনের ইতিবাচক দিকগুলোই তাদের কাছে মুখ্য হয়ে উঠতে থাকে। ৫০ বছর বয়স থেকে মানুষ পরিবার ও বন্ধু-বান্ধবের মতো ইতিবাচক বিষয়ের দিকে বেশি গুরুত্ব দিতে শুরু করে। ৫০-এ শুরু হওয়া সুখের এ ধারণা মোটামুটি ৮০ বছর পর্যন্ত বজায় থাকে। এ ছাড়া জীবনের শুরুর দিকে ঘটে যাওয়া নেতিবাচক ঘটনাগুলোও তাঁরা এই বয়সের পর তেমন স্মরণ রাখতে পারেন না কিংবা স্মরণ করতে চান না। এটাকে বলা হয় ‘পজিটিভিটি ইফেক্ট'।
‘প্রসিডিংস অব দ্য ন্যাশনাল একাডেমী অব সায়েন্স'-এ প্রকাশিত এই গবেষণা প্রতিবেদন থেকে আরো জানা যায়, এ বয়সে সুখের এ ধারণাটা নারীদের চেয়ে পুরুষদের মধ্যে বেশি দেখা যায়।
ড. আর্থার স্টোন এ পরীক্ষাটা চালিয়েছেন যাদের ৫০ বছর থেকে ৮০ বছর বয়স তাঁদের উপর। পেয়েছেন ইতিবাচক ফলাফল। বর্তমান আবাসিক সমস্যার যুগে যে পরিবারে ৭০ থেকে বেশি বয়সের লোক রয়েছে, এবং যাদের শরীরে জরা-ব্যাধি বাসা বাঁধতে শুরু করেছে- সে পরিবারের সদস্যদের উপর গবেষণা চালালে নেতিবাচক ফলাফল লাভের সমূহ সম্ভাবনা ছিল। অনেক ক্ষেত্রে এখন বুড়োরা কেবল কদরহীন জরা ও অথর্ব। পাশ্চাত্যের মতো আমাদের দেশেও বুড়োরা পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে পরিবারের বোঝা হতে শুরু করেছে। ধর্মের দোহাই কিংবা সকল রকমের আদেশ-উপদেশ এ হীনমন্যতা ঠেকাতে পারছে না। তাই আমার ইচ্ছে, ইহলোকে কারো বোঝা হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে সোজা হয়ে পরলোকে গমন করা উত্তম। তাই আমি এই কা'বার মাঠে দাঁড়িয়ে স্রষ্টার কাছে এই মর্মে প্রার্থনা করি-
‘আমার জীবনের ঘোর অমানিশা পার করে সূর্যোদয়ের সময় চলে গেলেন মা, অথর্ব ও সংসারের বোঝা হওয়ার আগেই চলে গিয়েছেন বাবা। ওদের ওজন কতো ভারি তা আমি পরিমাপ করতে পারিনি। হে জগৎসমূহের পালনকর্তা, আমার ওজনও যেন কেউ পরিমাপ করতে না পারে। হে পাপ মোচনকারী-সর্বশক্তিমান, তোমার ও তোমার সৃষ্টির কাছে আমার অনেক ঋণ আছে। তোমার ও তোমার সৃষ্টির ঋণ পরিশোধ করার সুযোগ ও সামর্থ্য আমায় দিও। হে আল্লা কুল্লি শায়্যিন কাদির, তোমার মহান সৃষ্টির ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কৃষ্টিও যেন আমার দ্বারা অকল্যাণ ও অনিষ্টের শিকার না হয়- সে বোধ আমায় দিও এবং আমাকে এমন কাজ করার ক্ষমতা দিও, যে কাজ তোমার মহান সৃষ্টির উপকারে আসে। হে সর্বশ্রেষ্ঠ বিচারক, আমার দ্বারা তোমার ও তোমার সৃষ্টির প্রয়োজন যখন ফুরিয়ে যাবে, যখন শোধ হয়ে যাবে সব ঋণ। তখন আমাকে আর মুহূর্তকালও অথর্ব করে রেখো না। হে আজিজুল জাব্বারুল মোতাকাব্বির, তোমার দেয়া এ সুন্দর শরীর কুৎসিত ও বোঝা হওয়ার আগেই আমাকে সেখানে এক টুকরো ঠাঁই দিও, যেখানে আমার বাবা-মাকে ঠাঁই দিয়েছো।’
আমাকে চুলে হাত রেখে পাথরের মতো দাঁড়ানো দেখে শিল্পী।
চুলে হাত রেখে কি ভাবছেন? এতো ভাবনা চিন্তার দরকার নেই। চুলের মায়া করেও লাভ হবে না। নাচতে নামলে আঁচল টানা চলবে না। ফাঁক- ফোঁকড় রেখে ওমরাহ করার চেয়ে না করাই ভালো। এ কথা বলেই আমাকে জোর করে সেলুনে ঢোকাতে চাচ্ছে। তাকে সমর্থন করছে বাকি সবাই।
১০ রিয়েল দিয়ে আমি কখনো মাথা ন্যাড়া করবো না।
এসব কি বলছেন? লোকে শুনলে বলবে কি? এসব কাজে মুলামুলি দরাদরি করলে লজ্জা হয়। দেশে গিয়ে মুখ দেখাতে পারবো না।
একি বলছো তুমি! নাপিতের কথামতো পয়সা না দিলে যে মানসম্মানের হানি হয় সে মানসম্মান দিয়ে আমার কাজ নেই। আমাদের দেশে মাথা মুন্ডাতে লাগে পনের টাকা। পনের টাকা তিনগুণ করে পঁয়তাল্লিশ টাকা নিলেও মনকে বুঝাতে পারতাম। কিন্তু ‘পনের টাকার স্থলে ১৮০ টাকা কিছুতেই মানা যায় না। তুমি দেখে নিও, অন্য খান থেকে আমি এক মাথা মুন্ডানোর টাকা দিয়ে তিন মাথা মুন্ডায়ে আনবো।
এতো লাভ-লোকসানের হিসেব করলে বর্তমান পেশা পাল্টিয়ে একটা বারবার শপ খুলে বসলেই পারেন!
- কথাটা অন্যদিকে নিয়ে যাচ্ছ কেন? আমি বরাবরই লক্ষ্য করে আসছি যেখানেই ধর্মালয় সেখানেই গজিয়ে উঠছে এক শ্রেণীর ভদ্রবেশী প্রতারক। এসব প্রতারকেরা ধর্মালয়ে আগত সাধারণ ও সরলপ্রাণ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতির কোমল অংশে প্রবেশ করে ফায়দা লুটে থাকে। শুধু ইসলাম ধর্মের ধর্মালয়ে নয়- সব ধর্মালয় এলাকায় একই অবস্থা।
আজমিরের খাজা মঈনউদ্দিন চিশতি (র.), দিল্লির নিজাম উদ্দিন আউলিয়া (র.), নেপালের শ্রীশম্ভুনাথজী, বারদির শ্রী শ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারী, মিরপুরের হযরত শাহ আলী (র.), সিলেটের হযরত শাহজালাল (র.) এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কল্লা শহীদ (র), সকলের মাজার এলাকার চিত্র এক ও অভিন্ন। ওসব এলাকায় পকেটমারের দৌরাত্মতো আছেই, দর-দাম না চুকিয়ে কেনাকাটা করা তো দূরের কথা, হোটেল-মোটেলে খেতে গেলেও পস্তাতে হয়। আল্লাহর পথে খরচ করলে পুণ্য হয় কিন্তু সহজ সরল মানুষের চোখে ধর্মের সুরমা লাগিয়ে যারা এক টাকার জায়গায় দশ টাকা আদায় করে তাদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত টাকা দিলে কখনো পুণ্য হয় না। কারণ, সাম্প্রতিক এক শ্রেণীর ছিনতাইকারী যেভাবে নিরীহ পথচারীদের চোখে যন্ত্রণাদায়ক মলম লাগিয়ে দু'চোখ অন্ধ করে ইচ্ছার বিরুদ্ধে পথচারীর সর্বস্ব ছিনিয়ে নেয়- ঠিক সেভাবে এক শ্রেণীর বকধার্মিক ধর্মের ছদ্মাবরণে সহজ-সরল ধর্মভীরু মানুষের মনে মরীচিকার ধুম্রজাল সৃষ্টি করে, চোখে চাতুর্য্যের সুরমা মেখে ও নাকে প্রণয়ের পারফিউম লাগিয়ে ধর্মভীরু মানুষের সর্বস্ব হাতিয়ে নেয়। ‘মাল পেলে কালের মুখেও দাঁড়িয়ে যায়’ এ মর্মে দুর্মুখরা আমাদের ব্যবসার নামে মেলা অপপ্রচার করা সত্ত্বেও এসব শঠ, ভন্ড, প্রবঞ্চক ও কপটের পক্ষে দাঁড়াতে গিয়ে আমাদের গাও ঘিনঘিন করে।
তারপরেও শেষ রক্ষা হলো না। মাথার চুল খাটো করার কথা বলে রাজি করিয়ে আমাকে বারবার শপে ঢুকিয়ে দেয়ার পর- বারবার বেটা সমস্ত মাথায় সাবান মেখে মাঝখানে খুর চালিয়ে প্রথমেই তালু বের করে ফেলে।
এভাবে ধর্মীয় অনুশাসন ও রীতি-নীতির কাছে আমার আমিত্বের সকল দর্প চূর্ণ হয়ে পড়ায় সবাই খুশিতে আটখানা।
লেখক : আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক
২৫ ডিসেম্বর ২০২৪
[email protected]