শব্দ বিভ্রাট
হঠাৎ ভারী কিছু পড়ার শব্দে আচমকা ঘুম ভেঙ্গে উঠে বসল রুমি। ইস! ঘুমটা কেবল ধরেছিল মাত্র। এত জোরে শব্দ হলে কি ঘুমানো যায়? মনে হলো ট্রাকটা মাথার উপর দিয়ে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর পর ভো-ভো, হুস-হাস শব্দে মাথাটা ধরে আছে, আজ রাতে আর সহজে ঘুম আসবে না। নাহ, এভাবে আর সম্ভব না। এই বাসাটা খুব তাড়াতাড়ি বদলাতে হবে।
গলির শেষ মাথায় পুরনো ধাঁচের তিনতলা বিল্ডিঙের ছাদের চিলেকোঠা। ভবনটির পাশ ঘেঁষে সরু একটি প্লটে একসারি টিনসেড দোকান, তার পরেই বড়রাস্তা। এই রাস্তায় বিরামহীনভাবে গাড়ি চলাচল থাকে দিবারাত্রি। ছাদে কিংবা রুমির রুমের জানালা দিয়েই রাস্তাটি বেশ ভালোমতোই চোখে পড়ে। রুমের ঠিক বরাবর রাস্তার উপরে একটা স্পীড ব্রেকার। যখন গাড়িগুলো সশব্দে স্পীড ব্রেকার পার হয়, মনে হয় মুহুর্তেই গাড়িটা মাথার উপর দিয়ে চলে গেল! বিশেষ করে যখন ট্রাক চলাচল করে। সাথে সাথে ঘুমটা ভেঙ্গে যায়। একবার ঘুম ভাঙলে সারা রাতে আর ঘুম হয় না রুমির। পরদিন একটা যন্ত্রণা মাথায় তাড়া করে ফেরে।
রুমি এ শহরে এসেছে মাত্র আট মাস হলো। এতদিন বন্ধু নেহালের সাথে তার মেসে বেড শেয়ার করে থেকেছে। তবে নেহালের রুমমেটদের আপত্তির কারণে সেখান থেকে চলে আসতে হলো। পনেরদিন অনেক খোঁজাখুঁজির পর এই বাসাটা পেয়েছে। নিজের সাধ্যের মধ্যে ভালো একটি বাসা পাওয়া সহজ ব্যাপার না। তারপর সে তো ব্যাচেলর। শুনলেই বাড়িওয়ালারা এমন ভাব করে যেন কোনো আজব প্রাণির সাথে কথা বলছে। গত পনেরদিন খোঁজাখুঁজির পর এই বাসাটা পেয়েছে রুমি। তিনতলা বাড়ির ছাদের উপরে একটি রুম, এটাচড বাথ। রুমের বাইরে একটা ছোট্ট বারান্দা মতো, তারই এক কোণে রান্নার ব্যবস্থা আছে। রুমের সামনে খোলা ছাদ। একা বসবাসের জন্য চমৎকার আয়োজন। তবে রুমের সামনে খোলা ছাদটা দেখে ভীষণ ভালো লেগে গিয়েছিল রুমির। বাসাটা মেইন রোডের পাশে হওয়ায় আর কোন চিন্তা না করেই ভাড়া ভাড়া নিয়ে নিলো সে।
প্রথম সন্ধ্যাটা ছিল অন্যরকম! মালামাল আনা, গোছানো আর টুকটাক জিনিসপত্র কিনতেই সারাদিন চলে যায়, আর সন্ধ্যার পর ছাদে খোলা হাওয়ায় বসে সব ক্লান্তি যেন দূর হয়ে গিয়েছিল! বাড়ির দক্ষিণ পাশটা ফাঁকা থাকায় প্রচুর বাতাস। রুম থেকে বের হলেই খোলা ছাদ আর মাথার উপর বিশাল আকাশটা মন ভরিয়ে দিয়েছিলো। ছাদের পূর্ব পার্শ্বে দাঁড়ালে চোখে পড়ে মেইন রোড দিয়ে ছুটে চলা সারি সারি গাড়ি।
তবে বিপত্তি দেখা দেয় ঘুমাতে গেলেই। গত কয়েকদিন ধরে একেবারেই ঘুমাতে পারছে না রুমি। ঘুমটা যখন কেবল জড়িয়ে আসে, তখনই দেখা যায় বিকট শব্দে গাড়ি ছুটে যায়। অনেক সময় ঘুম থেকে জেগে উঠে বসে গাড়ির শব্দে। এ এক মহা যন্ত্রণা! এভাবে রাতের পর রাত নির্ঘুম কাটালে সে তো অসুস্থ হয়ে পড়বে। নাহ! এই স্বর্গ থেকে ঘুমটা শরীরের জন্য অতীব জরুরি।
পর পর কয়েকদিন আবার বাসার খোঁজে বের হলো রুমি। পুরো এলাকা ঘুরে পছন্দসই একটি বাসাও খুঁজে পেল না। ভার্সিটি ক্লাস শেষে দু’টো টিউশানি শেষ করে যেটুকু সময় মিলে বাসা খোঁজে। মন মতো একটা বাসাও মেলে না। হয় টিনসেড, নিচতলার অন্ধকার স্যাঁতসেঁতে ঘর, নয়তো সাত-আট তলা বিল্ডিঙের টপ ফ্লোরে। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে নামতে রুমির শরীরের শক্তি আর অবশিষ্ট থাকবে না। তবে এগুলো ছাপিয়েও আরেকটা বড় সমস্যা দেখা দিলো- ব্যাচেলর শুনলে অনেক বাড়িওয়ালা বাসা ভাড়া দিতে রাজি হয় না। প্রায় দিনই হতাশ হয়ে বাসায় ফেরে সে।
রুমির টিউশানি দু’টো বিকেলে। একটা ফার্মগেটে এবং অন্যটা ঢাকা ক্যান্টমমেন্ট এরিয়ায়। রুমি ভার্সিটি থেকে সোজা ফার্মগেটে চলে গেল। ছাত্রটি ক্লাস নাইনে পড়ে। সরকারি বিজ্ঞান কলেজে। ছাত্র মন্দ নয়, তবে কথা একটু বেশি বলে। প্রায় দেড় ঘন্টা পড়িয়ে বেরিয়ে আসবার সময় ছেলেটি বলল, ‘স্যার, বাসা পেয়েছেন?’
‘না, এখনও পাইনি।’
‘আমাদের এলাকায় দেখতে পারেন।’
‘না। এদিকে ভাড়া অনেক বেশি। আমার পোষাবে না।’
‘ও। তাহলে থাক।’
রুমি আর কথা না বাড়িয়ে চলে এলো। ফার্মগেট থেকে ক্যান্টনমেন্টের বাস পেতে মাঝে মাঝে বেশ বেগ পেতে হয়। তবে আজ খুব সহজেই পেয়ে গেল। দ্বিতীয় টিউশানিতেও প্রায় ঘণ্টা দেড়েক পড়িয়ে বের হলো সে। এখান থেকে কচুক্ষেতের মধ্যে দিয়ে কখনও রিকশায় আবার কখনও হেঁটেই শ্যাওড়াপাড়ায় চলে আসে।
আজ বাসায় ফিরতে সন্ধ্যা হলো রুমির। সারাদিনের কর্মক্লান্তি শেষে বাসায় এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই রাজ্যের ঘুম এসে জড়ো হলো চোখে। নিজের অজান্তে কখন যেন দু’চোখ বন্ধ হয়ে এলো। একসময় ঘুমিয়েও পড়ল সে। তবে বেশীক্ষণ নয়, ঘণ্টাখানেক পরেই ঘুম ভেঙে গেল। খোলা ছাদে হালকা বাতাস বইছে। ছাদে কিছুক্ষণ পায়চারি করে। রুম থেকে ফোনের শব্দ আসছে। মায়ের ফোন। ওপাশ থেকে মায়ের চিন্তাযুক্ত কণ্ঠ।
‘খেয়েছিস বাবা?’
হ্যা-সূচক জবাব দিয়ে মায়ের চিন্তা দূর করার চেষ্টা রুমির। তবে মায়ের মন শান্ত হয় না। সাথে সাথেই প্রশ্ন আসে-
‘তোর গলা এমন লাগছে কেন?’
‘কই, ঠিকই তো আছে।’
‘না, ঠিক নাই। অনেক শুকনো শুকনো লাগছে। আমাকে ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করে লাভ নাই। কী হইছে খুলে বল।’
‘বললাম না, কিছু হয় নাই। অনেক গরম পড়েছে তো! তাছাড়া সারাদিন বাইরে ছিলাম, তাই একটু টায়ার্ড লাগছে।’
‘আচ্ছা, ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করে শুয়ে পড়।’
মাকে কখনও নিজের সমস্যার কথা বলা হয় না রুমির। তাহলে মা যে আর মনে শান্তি পাবে না! তবুও কেমন করে যেন মা সবকিছু টের পেয়ে যায়। অনেক কথা বলে শেষে সামলাতে হয়।
মায়ের মুখে খাবারের কথা শুনে মনে পড়ে গেল বাসায় ফেরার সময় আজ বাজার করে এনেছে রুমি। এখন রান্না বসাতে হবে। মনে মনে বলল, এত পরিশ্রমের পর আজ বাইরে থেকে খেয়ে আসলেই ভালো হতো।
প্রতিদিন হোটেলের রান্না খেতে খেতে মুখে অরুচি ধরে গেছে। আজ নিজে রান্না করে তৃপ্তি সহকারে খেলো। গরম ভাতের সাথে করলা ভাজি আর ডিম ভুনা। খুব আহামরি কিছু না, তবে সারাদিন পরিশ্রমের পর রুমির কাছে এই খাবারই অমৃতের মতো লাগল। তবে গাড়ির শব্দ ও ঘুম না আসার কথা মনে হতেই আবার বিরক্তিতে ছেয়ে গেল মনটা।
এখন জুন মাস। প্রচণ্ড গরমে ছাতি ফাটার দশা। টিউশানিগুলো থেকে ছুটি নেয়ারও কোনো সুযোগ নেই, কারণ ছাত্রগুলোর সামনে পরীক্ষা। দু-দু’টো টিউশানি শেষ করে বাসার সন্ধান করে ঘরে ফিরে আজ শান্তি মিললো। বাইরে থেকে গরম কিছুটা কম হলেও ঘরের ভেতরেও অস্থির লাগছে। রুমের উপরে সরাসরি ছাদ থাকায় গরমের মাত্রাটা কিছুটা বেশি।
সিঁড়িঘরের দরোজায় আওয়াজ শুনে বাইরে বেরিয়ে এলো রুমি। মনে মনে আওড়াল, ‘এই সময় আবার কে এলো! ছাদে তো কোনো কাপড়চোপড়ও নেই যে নিচতলা-দোতলা থেকে কেউ আসবে।’
দরোজা খুলতেই দেখল সামনে দাঁড়িয়ে আছে বন্ধু নেহাল। বন্ধুকে দেখে রুমির মুখে হাসি ফুটে উঠলেও নেহালের মুখ গম্ভীর। রুমি প্রমাদ গুনল। নেহালের মেস থেকে চলে আসার পর একবারও যোগাযোগ করেনি সে। তাইতো ক্ষেপে বুম হয়ে আছে বন্ধু। বুঝেও না বোঝার ভাণ করল রুমি।
‘কি রে, মুখ এমন ভার করে আছিস কেন?’
‘মুখ ভার করব না কি আনন্দে নাচব নাকি বেটা বজ্জাতের হাঁড়ি।’
‘আরে আগে শুনবি তো আমার অবস্থা! তারপর না হয় রাগ করিস।’
‘শোনার কী আছে? তুই প্রতিদিন আমার বাসার সামনে দিয়ে ফিরিস, অথচ একবার দেখা করার মতো সময় মেলে না? মাত্র এ ক’দিনেই ভুলে গেলি!’
রুমি তার অবস্থাটা ব্যাখ্যা করল। নেহাল শুনে বলল, ‘এটা তেমন কোনো সমস্যাই না। এই রাস্তার পাশে অসংখ্য বাড়ি আছে, সেখানে যারা বসবাস করে তারা সবাই তো একই সমস্যা ফেস করে। তারা থাকতে পারলে তুই কেন পারবি না?’
‘সবাই কেমনে থাকে জানি না। আমি একটা রাতও ঘুমাতে পারিনি।’
‘কিছুদিন যাক, দেখবি অভ্যাস হয়ে গেছে।’
‘তাহলে তুইও আমার এখানে চলে আয়। দু’ই বন্ধু মিলে একসাথে থাকা যাবে।’
‘সেটা সম্ভব না। রুমমেট রমজান ভাই আমাকে ছাড়বে না।’
কথা বলতে বলতে রুম থেকে খোলা ছাদে এসে দাঁড়াল নেহাল। রাস্তার দিক থেকে হু-হু ঠান্ডা একটা হাওয়া দিচ্ছে। গায়ে লাগতেই শরীরটা জুড়িয়ে গেল। তাছাড়া ছাদের উপর থেকে চারপাশের ভিউটাও চমৎকার।
‘এ বাসাটা কিন্তু দারুণ। রুমের সামনে এমন একটা খোলা ছাদ, ফুরফুরে বাতাস আর এখান থেকে রাস্তার দিকে দৃশ্যটা কী সুন্দর! তুই এমন একটা বাসা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাবি?’
‘বন্ধু, বাসাটা তো আমারও খুব পছন্দের, কিন্তু ঐ যে বললাম একদম ঘুমাতে পারি না।’
‘কষ্ট করে পনেরোটা দিন পার কর। তারপর দেখবি ঐ বিরক্তিকর শব্দগুলোই তোর কাছে মধুর মতো লাগবে। আরও কিছুদিন পরে ওগুলো তোর মনে কোনো প্রভাবই ফেলবে না।’
‘তুই দাঁড়া। আমি ভাতটা দেখে আসছি।’
নিজের জন্য রান্না করতেও ইদানীং বিরক্ত লাগে রুমির। আজ অনিচ্ছা সত্তেও রান্না বসিয়ে দিয়েছে রুমি। ভাত আর আলু সেদ্ধ। নেহালের জন্য কিছু বাড়তি চাল দিয়ে দিয়েছে। আলু ভর্তার সাথে ডিম ভাজি- নেহালের ভীষণ পছন্দের। যদিও তার এখানে বন্ধুটা আজ প্রথম এলো, ওর জন্য ভালো কিছু করা উচিত ছিল। কিন্তু এই মুহূর্তে তো আর কিছু করার নেই।
সন্ধ্যার পর থেকে গরম কিছুটা কমেছে। সেইসাথে বাতাস ছেড়েছে, কিছু ঝড়ো হাওয়া। মনে হয় বৃষ্টি নামবে। রুমি মনে মনে খুশি হলো।
রুমি দেখল নেহাল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে। রমজান ভাইয়ের সাথে থেকে এই বদ অভ্যাসটা হয়েছে ওর। আজকাল অবশ্য অনেকেই খায়, তবে রুমি কখনও খায়নি। ইচ্ছেও নেই। নেহালের কাছে গিয়ে বলল,
‘ছাইপাঁশ খাওয়ার অভ্যাসটা তো ভালোই রপ্ত করেছিস।’
‘আরে, তোর খোলা ছাদে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাওয়ার মজাটাই আলাদা। একটা রোমাঞ্চকর ব্যাপার আছে। ভাবছি মাঝে মাঝে তোর এখানে এসে থাকব।’
‘তাহলে তো ভালোই হয়। মাঝে মাঝে একা একা খুব বোর লাগে।’
‘কী রান্না হচ্ছে রে?’
‘ভাল-আলু ভর্তা-ডিম ভাজি; চলবে?’
‘চলবে মানে! দৌড়াবে। তুই জানিস না?’
রুমি মৃদু হাসল। ‘জানি তো।’
সামান্য আলু ভর্তা আর ডিম ভাজি দিয়ে কি তৃপ্তি সহকারেই যে খাচ্ছে নেহাল! দেখে রুমির কিছুটা লজ্জা লাগছিল। আজ তার এখানে প্রথম এলো নেহাল, অথচ ওকে কোনো আপ্যায়নই করতে পারল না। নেহাল যেন তার মনোভাব বুঝতে পারল। সে বলে উঠল,
‘আরেকদিন এসে থাকব। সেদিন তোর যেমন ইচ্ছে তেমন আয়োজন করিস। আজ মুখটা আর ভার করে রাখিস না।’
আটটা বাজতেই নেহাল চলে গেল। রুমি খোলা ছাদে দাঁড়িয়ে রইল অনেকক্ষণ। আকাশে মেঘ জমেছে, মনে হয় যখন তখন বৃষ্টি নামবে। বৃষ্টি নামলে আজ অনেকক্ষণ ভিজবে সে। কতদিন বৃষ্টিতে ভেজা হয় না। যখন গ্রামে ছিল, বৃষ্টির মধ্যে কখনও ভেলা কিংবা ছোট নৌকা নিয়ে বিলে চলে যেত। কতদিন বিল থেকে শাপলা তুলে এনেছে! রুমি নিজে নিজেই হাসে। সেই দিনগুলোই অনেক ভালো ছিল। বাধা-বন্ধনহীন মুক্ত স্বাধীন জীবন। চোখের সামনে খোলা দিগন্ত- চারিদিকে প্রাণের ছড়াছড়ি। আজ এই শহুরে খাঁচায় বন্দী দিনগুলোতে বড় হাঁসফাঁস লাগে।
দেখতে দেখতেই বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা পড়া শুরু হলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝমঝমিয়ে নামল। মুহূর্তেই ভিজে একাকার। কী দারুণ প্রশান্তি! অনেকদিন পর এমন বৃষ্টিভেজা হলো। নিমেষেই যেন দূর হয়ে গেল সারাদিনের ক্লান্তি। সামনের রাস্তায় চোখ বোলালো একবার। ল্যাম্পপোষ্টগুলোর নিয়ন আলোয় বৃষ্টির ধারা দেখতে ভীষণ ভালো লাগছে তার। নিচে ভেজা রাস্তায় সাঁ সাঁ করে ছুটে যাচ্ছে লাল-নীল-সবুজ বাতি জ্বেলে বাহারি রঙের গাড়ি। অন্যান্য দিনের তুলনায় গাড়ি চলাচলের এই দৃশ্যটা অন্যরকম লাগল রুমির কাছে। প্রায় বিশ-পঁচিশ মিনিট বৃষ্টিতে ভিজল সে। তারপর ঘরে ফিরে কাপড় বদলে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। এখান থেকে দূরে সারি সারি বিল্ডিং আবছাভাবে চোখে পড়ছে। তবে আধো অন্ধকারে বিল্ডিংগুলোকে অদ্ভুত লাগছে।
বৃষ্টি থেমে গেলেও চারিদিকে একটা ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব। আর খোলা ছাদের দিক থেকে একটা হিমেল হাওয়ার পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে গায়। সারাদিন কাঠফাটা রোদ্দুরে নাভিশ্বাস হবার দশা, সে তুলনায় এখন পরম শান্তি। জানালা গলে বাইরে তাকিয়ে আছে রুমি। রাস্তার পাশের ল্যাম্পপোষ্টের পাশে তারের উপর দু’টা কাক জড়সড় হয়ে বসে আছে। তার ওপাশে আলোআঁধারি, উঁচু উঁচু বিল্ডিং থেকে আলো আসছে বাইরে। সেইসাথে রাস্তার নিয়ন আলোয় অদ্ভুত লাগছে শহরটাকে।
রাতের খাওয়া সেরে একটা বই নিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিল রুমি। এডগার অ্যালান পো’র ছোট গল্প। এই ভদ্রলোকের লেখায় এক অদ্ভুত জাদুকরী ক্ষমতা রয়েছে। রহস্য আর আদিভৌতিক গল্প ফাঁদার কৌশলটা যে কোনো পাঠককে নিমেষেই নিয়ে যায় অন্য এক ভুবনে। রুমি পড়তে পড়তেই হারিয়ে গেল তার লেখার জগতে।
বাইরে টুপটাপ জলের গান আর জানালা গলে শীতল হাওয়ার স্রোত, সেইসাথে অ্যালান পো’র অদ্ভুতুড়ে সব গল্প- রুমির মনটা আজ হারিয়ে গেল এক সুদূরলোকে। মুহূর্তে ভুলে গেল গাড়ির শো-শো শব্দ কিংবা স্পীড-ব্রেকারের স্বশব্দ ধাক্কা।
অ্যালান পো’র অদ্ভুতুড়ে গল্পের সব রোমাঞ্চকর জগৎ এক সময় রুমিকে ভুলিয়ে দিলো গাড়ির উচ্চ হর্ণ আর স্পীড ব্রেকারে দুমদাম গাড়ির চাকার শব্দ। রাত গভীর হওয়ার সাথে সাথে রুমির দু’চোখ জড়িয়ে আসে, এবং ধীরে ধীরে অ্যালান পো’র রোমাঞ্চকর জগৎ থেকে সে চলে যায় তার দীর্ঘদিনের প্রত্যাশিত ঘুমের জগতে। অনেকদিন পরে প্রশান্তির ঘুম।
পল্লবী, ঢাকা।