বিনে স্বদেশী খাবার
(প্রথম পর্ব)
(ওমরাহ ও যিয়ারত উপলক্ষে ১৪ সেপ্টম্বর থেকে ২০০৯ থেকে ২৫ সেপ্টম্বর ২০০৯ তারিখ পর্যন্ত সউদী আরব ছিলাম। প্রত্যক্ষ্য অভিজ্ঞতার আলোকে লেখা হয়েছিল ‘আমার দেখা আরব’; যা হজত্রীদের জন্য সহায়ক হবে)
জেদ্দা থেকে মক্কা আসার পথে ইফতারের জন্য অনুশোচনা শুরু করে দিয়েছিলেন হামিদ দম্পতি। বিমানে যে ইফতার দেওয়া হয়েছিল সে ইফতার নেয়া শুরু করতে না করতেই বিমান অবতরণ শুরু হয়ে যায়। বিমান অবতরণকালে নানা রকমের ঝাঁকুনিসহ যাত্রীগণ আগে বের হবার জন্য হুড়োহুড়ি শুরু করে দেয়। এ কারণে ইফতার করতে গিয়ে পানি ছাড়া তাদের আর কোনো ইফতারই গ্রহণ করা হয়নি। দাম্মাম নেমে আরামসে ইফতার করা যাবে, এ রকম চিন্তা করে বাকি ইফতার হাতে করে বিমান থেকে নেমে আসে। নামতে না নামতেই ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদের নানা রকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয়ে যায়।
ততক্ষণ পর্যন্ত ইফতার বগলদাবা করে রেখেছিল। ফিংগার প্রিন্ট গ্রহণ করা কালে আঙ্গুলের ইম্প্রেশন নেয়ার সময় বগলের প্যাকেট এলোমেলো হয়ে যায় প্যাকেট দুটি এক জায়গায় রেখে দিয়েছিল। কঠিন পরীক্ষা ও কাগজ-পত্র জমা দেওয়া-নেওয়ার ধকল সামাল দিতে গিয়ে ব্রেনও বেসামাল হয়ে পড়ে। এ কারণে ইফতার প্যাকেট আর নেয়া হয়নি। টানা দেড় দিন রোজা রাখার পর নাকের ডগা থেকে ইফতার সরে গেলে কার না হা-পিত্যেস শুরু হয়। শুরু হওয়া হা-পিত্যেস কমানোর জন্য সান্তনা দিতে গিয়ে বলি-
জীবনে ইফতারের সাধারণ সময় বহুবার আসা যাওয়া করবে। কিন্তু অসাধারণ সময় বারবার আসে না। বিরল ও বৈচিত্র্যময় ঘটনার নাম অসাধারণ ঘটনা। গতানুগতিক ও বৈচিত্র্যহীন বিষয় কখনো স্মৃতিপটে রেখাপাত করে না। আঠার হাজার মাকলুকাতের মধ্যে মানুষ অধিকতর বৈচ্যিময় ও জটিল। বৈচিত্র্যময়তা থেকে জটিলতর জটিলতার উৎপত্তি। যে জীবন যতো বেশি বৈচিত্র্যময় তার জীবন ততো বেশি জটিল। যার জীবন যতো বেশি জটিল ও বৈচিত্র্যময় তার জীবন ততো বেশি স্মরণীয়। জীবনে সবাইতো স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে থাকতে চায়। তবে বরণীয় হওয়ার চেয়ে স্মরণীয় হওয়া অনেক সহজ কাজ। এক সাথে স্মরণীয় ও বরণীয় হওয়া অনেক বেশি কঠিন কাজ। - কি রকম?
এই ধরুন, আমাদের হযরত মুহম্মদ (স.)-কে শুধু ‘স্মরণীয়’ ও ‘বরণীয়’ বলতেও বিবেকে বাধে। তাই তাঁর পরিচয়ের আগে এ দুটি বিশেষণের সাথে ‘চির' নামক বিশেষণের বিশেষণটি যুক্ত করে ‘চিরস্মরণীয়' ও ‘চিরবরণীয়’ ভূষণে ভূষিত করতে হয়। হালাকু খান, নাদির শাহ, চেঙ্গিস খানসহ পাকিস্তানের টিক্কা খান এরা স্মরণীয় কিন্তু বরণীয় নয় কিছুতেই। বর্তমান ও অনাগতদের জন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে ইতিহাস তাদের স্মরণীয় করে রাখতে পারে কিন্তু বরণীয় করে রাখতে পারে না।
তবে কি স্মরণীয়' বিশেষণটি শুধু নেগেটিভ অর্থে ব্যবহৃত হয়?
জ্বী না। বিশেষণ বলতে বিশেষ্যের দোষ, গুণ ও অবস্থা নির্ণয় করাকে বুঝায়। যে ব্যক্তির নামের সাথে স্মরণীয় যুক্ত হয় এবং সে ব্যক্তি যেসব দোষ, গুণ ও অবস্থার জন্য স্মরণীয় হয়েছেন, স্মরণীয়' শব্দটিও সেসব দোষ, গুণ ও অবস্থার সামর্থক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ কাজটি ভালো হোক কিংবা মন্দ হোক স্মরণ রাখার মতো হলেই স্মরণীয় হয়। যেমন আপনাদের আজকের ইফতার না করতে পারার বিষয় নিয়ে যে কারণটা দায়ী সে কারণটাই আপনাদের জীবনে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
আমাদের আজকের সুদীর্ঘ সময় রোজা রাখার কারণটি স্মরণীয়, তার চেয়ে বেশি স্মরণীয় রোজার শেষে ইফতার বিভ্রাটের ঘটনা। সতের ঘণ্টা কষ্ট রোজার শেষে ক্ষুৎপিপাসায় যে কষ্ট পাচ্ছেন এবং যে কারণে কষ্ট পাচ্ছেন, এবং কারণটা পাল্লায় তুলে ওজন করলে ওজনের দিক দিয়ে 'কষ্ট' বিশেষণটির ওজনের চেয়ে ‘স্মরণীয়' বিশেষণটির ওজন অনেক বেশি হবে।
- আপনার এই তাত্বিক যুক্তির অর্থ বুঝলাম না।
না বুঝলে সাম্প্রতিক ঘটনাবলি থেকে একটা উদাহরণ দিয়ে বোঝাচ্ছি- এই তো কয়েক দিন আগে ভারতের নায়ক শাহরুখ খান আমেরিকান ইমিগ্রেশনে ইমিগ্রেশন পুলিশ কর্তৃক অপদস্ত হয়েছিল। এই অপদস্ত হওয়ার বিষয়টি সারা বিশ্বের পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ পায়। এতে শাহরুখ খানের নতুন করে যে পাবলিসিটি লাভ হয়েছে তা বিশ্বনন্দিত নায়ক হিসেবে পাবলিসিটির চেয়ে খুব একটা কম কিসে? এ জাতীয় ঘটনায় শাহরুখ খান কষ্ট ও অভিজ্ঞতা দুটোই লাভ করেছিলেন। কষ্টটা কিছুক্ষণের মধ্যে শেষ হয়ে গেলেও অভিজ্ঞতাটা শেষ হয়ে যায়নি। প্রত্যেক দেশের ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি, আইন- কানুন ও রীতি-নীতি ভিন্নতার কারণে বহিরাগতগণ অহরহ সমস্যায় পড়ছেন। আমি যখন যে দেশে যাই তখন সে দেশের পিচ্ছিল স্থানের উপর দিয়ে চলি। অনেকটা ইচ্ছে করেই অসাবধানে পা ফেলি। অসাবধানে পা ফেলতে গিয়ে বারবার হোচট খাই। এতে জামা-কাপড় ও হাতে-পায়ে কাদা লাগে। কাদা লাগাটা সাময়িক ব্যাপার। পিচ্ছিল স্থানটা চিহ্নিত করতে পারাটা সাময়িক নয়। আমার মতো একজন হোচট খেয়ে যদি সকলের জন্য পিচ্ছিল স্থানটা চিহ্নিত করে দেয়া যায় তবে কোনটায় লাভ বেশি?
এ-বি-সি'র মতো সহজ করতে আরও একটা ঘটনা বলি-
একবার লেখক হুমায়ূন আহমদ লন্ডনের কোনো এক বিমান বন্দরে যাত্রা বিরতি কালে আরামসে সিগারেট টানতে টানতে ভুল করে এয়ারপোর্টের বাইরে চলে এসেছিলেন। ঢুকতে গেলে আটকে দেয় ইমিগ্রেশন পুলিশ। অনেক মিষ্টি মাধুর ভাষায় বুঝিয়ে বলার পরেও লন্ডনের পুলিশ তাঁকে হাজতে ঢুকিয়ে দরজায় তালা লাগিয়ে দেয়। লেখকের ভাষায় 'হতভম্ব হয়ে লক্ষ্য করলাম এটা একটা হাজত। ব্যাটা ফাজিল আমাকে হাজতে ঢুকিয়েই দিয়েছে। ইমিগ্রেশনে কাগজপত্র ঠিকমতো বুঝাতে না পারায় ইমিগ্রেশনে পুলিশের লোকেরা লেখককে জোর করে লকাপে ঢুকিয়ে তালা লাগিয়ে রেখেছিল। হুমায়ূন আহমদের ‘মে ফ্লাওয়ার’ গ্রন্থের যে অংশে এ লেখাটুকু স্থান পেয়েছে সে অংশের রসের ওজন বাকি সমগ্র অংশের রসের ওজনের চেয়ে অনেক বেশি। তাঁর 'মে ফ্লাওয়ার' ভ্রমণ কাহিনীর এ রসালো অংশটুকু বাদ দিলে বইয়ের কাটতিও কয়েকগুণ বাদ পড়ে যাবে। এবার আপনিই বলুন, ভ্রমণকালীন হাজতবাস তাঁর জন্য বিষাদে হরিষ হয়েছে কিনা?
- যারা আদালতে যুক্তি দিয়ে মানুষকে মুরগি বানাতে পারে তাদের সাথে তর্কে পেরে ওঠা সহজ কথা নয়- তা এ বিষয়ে যুক্তিতর্ক রেখে হোটেলে উঠে তাড়াতাড়ি খানাপিনার ব্যবস্থা করতে বলুন।
জেদ্দা থেকে মক্কার পথে আসন স্বল্পতার কারণে আমাদের গাইড সামসু ভাই আমাদের সাথে ট্যাক্সিতে করে আসতে পারেনি। আমাদের পৌছার ঘন্টা খানেকের মধ্যেই সে চলে আসে। ক্যাব থেকে লাগেজপত্র হোটেলে ওঠানোর সামায় সামসু ভাই এসে হাজির। খাবারের মেন্যু বর্ণনা করে তাকে তাড়াতাড়ি খাবারের জোগাড় করতে বলে আমরা ওজু গোসল করে পাক-পবিত্র হতে শুরু কারি ৷
সামসু ভাই ঘণ্টা খানেকের মধ্যে পলিথিন ব্যাগে করে খাবার নিয়ে আসে। খাবার ছিল, গরম ভাতের সাথে কেচকি মাছ, সবজি, গরুর মাংস, ভাজি ও ডাল। যাকে এক কথায় বলা চলে, কম দামে হাই পাওয়ারের বাংলা খাবার। বিদেশের মাটিতে পা রেখেই প্রথম বাংলা খাবার! ক্ষুধা তাড়াতে বাংলা খাবার! একেবারে মার্ভেলাস। খাবারের মধ্যে সবজি আর ডাল একেবারে সুপার-ডুপার হিট হয়েছে। সুপার-ডুপার হিটের কারণে রাতের খাবার এতো বেশি খেয়েছিলাম যে সেহরির কাজও চলে গিয়েছিল।
কা'বা শরীফের পাশে অবস্থান করা কালে আজ প্রথম ইফতারের দিন। প্রথম ইফতার একটু ভালো করে করা দরকার। আমাদের হোটেল যে এলাকায় সে এলাকার নাম গাজা। গাজা এলাকার চারপাশে ইফতার খুঁজতে বের হয়ে পড়ি। আমরা ইফতার বলতে বুঝি স্পেশাল হালিম, মোটা জিলেপি, ছোলা, বেগুনি, পিয়াজী, আলুচপ, মোগলাই, ডাল পুরিয়া, শশা, ইছবগুলের ভ‚সি, আখের রস, ডাবের পানি ইত্যাদি। আমাদের দেশে ইফতারের সময় এসব নিয়ে রাস্তার মোড়ে মোড়ে ইফতার সামগ্রির মেলা বসে যায়। অনেক বেকার লোক রমজানের সময় তেল কড়াই নিয়ে রাস্তার পাশে বসে থাকে। তাদের ইফতার সামগ্রী সরিয়ে রাস্তায় হাঁটা-চলাই মুশকিল হয়ে পড়ে। আরবের মাটিতে এসে অনেক খোঁজা-খুঁজি করেও এ রকমের ইফতার সামগ্রীর একটা দোকান বের করতে পারলাম না। পাহাড়ের পাশ ঘেঁষে অনেক দূর যাওয়ার পর দেখি বাঙালি বাঙালি চেহারার এক লোক। লোকটি চেয়ার টেবিল সাজিয়ে কিছু পুরিয়া পিয়াজী নিয়ে বসে আছে। প্রতিটি পুরিয়া-পিয়াজীর দাম এক রিয়েল করে। ইফতারের পেছনে খরচ করতে গিয়ে কেউ দাম নিয়ে মাথা ঘামায় না। আমিও মাথা না ঘামিয়ে দশ রিয়েল দিয়ে গোটা দশেক পুরিয়া- পিয়াজী ও এক বোতল আমের জুস কিনে হোটেলে ফিরে আসি। বাংলা ইফতার মুখে তুলতে গিয়ে বুঝতে পারি শালার ব্যাটা আমাকে ঠকিয়েছে, ভীষণভাবে ঠকিয়েছে। ভালোর সেরা ইফতার করতে গিয়ে বাজের সেরা ইফতারির আয়োজন হয়েছে। বাঙালিদের কাছে বাঙালিরা যতো সহজে মার খায় অন্যদের কাছে ততো সহজে মার খায় না।
জানতে পারি, প্রতিদিন আমাদের পাশে হারাম শরীফের ময়দানে তৃপ্তিসহকারে ইফতার করেছে হাজার হাজার লোক। তা শুনে আমি নাক সিঁকিয়েছিলাম। মনে করেছিলাম, দানের ইফতারি। হাজার হাজার লোক এক সাথে দান সামগ্রী নিতে গিয়ে পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে মারা পড়ার ঘটনাও ঘটতে পারে। প্রতি রমজানে আমাদের দেশের ধনীদের দান নিতে গিয়ে এ রকম ঘটনা অহরহ ঘটে থাকে।
ভাবলাম ইফতার যাই হোক, সেরা ও মনের মতো সেহরি খেয়ে পুষিয়ে দেবো। আমাদের হোটেলের সামনেই আল-সিডানা হাউজ, ব্রোস্ট হাউজ, আল-সাফা সুপার স্টোর নামীয় বেশ কয়েকটা খাবারের দোকান। দোকানগুলো দিনের বেলা ঝিম্ মেরে থাকে, আড়মোড়া দিয়ে জাগতে থাকে বিকেলের দিকে। সামসু ভাই আগের দিন বলে দিয়েছিল এসব খাবারের দোকান থেকে খাবার সংগ্রহ করতে হলে বিকেলের দিকে সংগ্রহ করে রাখবেন। এর কারণ বুঝতে পারিনি। বুঝতে পারি যখন সন্ধ্যা ঘনাতে আরম্ভ করে তখন। নিয়মানুসারে কাউন্টারে খাবারের মেন্যু দেখে টাকা জমা দিয়ে কুপন নিতে হয়। কর্মচারিগণ কুপন দেখে খাবার বিলি করে। সরকারি টেনডার বিতরণ করার সময় যেমন ভিড় হয় তেমন ভিড় লেগে থাকে এসব খাবারের দোকানে। সন্ধ্যার দিকে ২২ রিয়েল জমা দিয়ে কুপন কিনতে সক্ষম হই। ডাল-ভাত, সবজি ও মাংস নিয়ে হোটেলে এসে খেতে বসি। খেতে বসে বুঝতে পারি, সুন্দর ডাল-ভাতের মতো দেখতে এসব স্বাভাবিক বাঙালি ডাল-ভাত নয় ৷ খাদ্য সামগ্রীগুলো দেখতে লোভনীয় হলেও খেতে গিয়ে বুঝতে পারি এসব অবাঙালি খাবার। খাবারগুলো তেল চটচটে ও ডালডা সয়াবিনের ঘিনঘিনে গন্ধ মেশানো। খাদ্যসামগ্রীর প্রায় সবই অভুক্ত রয়ে যায়। এত রাতে কি আর করতে পারি? সেদিন নানা প্রকারের ফল ও ফলের জুস খেয়ে রোজা রাখতে হয়েছে। গিন্নী মন কালো করে জানায়।
এসব খাবার এনে নষ্ট করে আর লাভ নেই, তার চেয়ে মুরগির ফ্রাই- রোস্ট পাওয়া যায় কিনা খুঁজে দেখবেন।
গিন্নীদের মুখ কালো দেখলে কোনো স্বামীর মাথাই ঠাÐা থাকার কথা নয়। আমিও আমার গরম মাথা নিয়ে পরদিন আগেভাগে পাশের এক খাবারের দোকানে গিয়ে বাঙালি চেহারার এক ছেলের কাছে জানতে চাই-
- তোমাদের এখানে মুরগির রোস্ট কিংবা ফ্রাই পাওয়া যায়?
- কি বললেন?
- ফ্রাই, মুরগির ফ্রাই।
- বাঙালি ভাত খেতে ভাত পায় না, আবার ফ্রাই বিচড়ায়!
- এই বেটা, তুই কথাটা কইলি কি? তুই যে দোকানের নফর আমি সে দোকানের খরিদ্দার। খরিদ্দারের পয়সা দিয়ে তোর মনিব বাঁচে, বাঁচে তোর মা- বাপ, বউবেটিসহ চৌদ্দ গোষ্ঠী। তোর এ রকম ন্যাক্কারজনক কথার কারণে আমি তোর মনিবের কাছে রিপোর্ট করবো। তখন তোর চাকরি বাঁচানোই দায় হয়ে পড়বে।
আমার কথা শুনে ছেলেটি ভড়কে গেলো। নতশির হয়ে বললো-
- কিছু মনে করবেন না মুরব্বি। নানান দেশের মানুষ নানান ভাষায় নানান কিছু চেয়ে বিরক্ত করে। বিরক্ত হয়ে ভিন দেশের লোকদের বাংলা ভাষায় ইচ্ছামতো গালাগালি দিই। তারা গালি শুনে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে, বোকার মতো হাসে। কেউ কেউ গালির অর্থ জানতে চায়- গালির অর্থ উল্টা করে শোনাই। তারা অর্থ শুনেও হাসে, তা দেখে আমরা মজা পাই। বিদেশি মনে করে বেখেয়ালে আপনাকেও গালি দিয়ে বসেছি। মাফ করে দিবেন।
তুমি গালিটা আমাকে দাওনি, দিয়েছ আমাদের জাতিকে। বাঙালি বলতে তুমি আমিসহ তোমার বাবা-মাকেও বুঝায়। মনে রেখো, উপরের দিকে থুথু ফেললে সে থুথু নিজের মুখেই ফিরে আসে। আর গালাগালির ভাষায় মস্করা করা খুবই নিচু স্বভাবের পরিচয়।
গাজা এলাকার পূর্ব দিকে মনের মতো খাবার না পেয়ে চলো গোলাম পশ্চিমের মার্কেটে। সারা মার্কেট পইপই করেও মনের মতো খাবার পেলাম না। তাজা ফলের জুস, নানা রকমের রুটি, টিনজাত পানীয় ও বোতলজাত জুসে বাজার ও খাবারের দোকান সয়লাব। প্রত্যেক খাবারের দোকানে ছিলা ভীষণ চাপ। আমাদের হোটেলের সামনে যে কয়টা খাবারের দোকান মানুষের রয়েছে সে কয়টা দোকানে সন্ধ্যার পর থেকে সেহরির সময় পর্যন্ত খাদকের চাপ থাকে। মধুসহ চাক নিচে খসে পড়লে মৌমাছিরা চাকের ওপর যেভাবে কিলবিল করে ঠিক সেভাবে অভুক্ত মানুষেরা খাবারের দোকানে কিলবিল করতে থাকে। কিলবিল করা এতো লোকের কেউ হোটেল বা দোকানে বসে খাবার খায় না। দোকানে বসে খাবার খাওয়ার মতো পরিবেশও নেই সম্ভবও নয়। বিক্রেতারা খাবার বিক্রির সময় খাবারের সাথে ভাঁজ করা এক টুকরো ছোবড়া ধরিয়ে দেয় (এক প্রকার বর্গাকারের হাল্কা পলিখিন কাগজকে ছোবড়া বলে)।
খাবারের পরিমাণ কম-বেশির ওপর ছোবড়ার আকারও ছোট-বড় হয়ে থাকে। ক্রেতাগণ ছোবড়াসহ খাবার হাতে নিয়ে বেরিয়ে যায়। হোটেলোর আশপাশের খোলা চত্বর, রাস্তা, ফুটপাথ, লবি, দেয়াল এমনকি আবর্জনার স্তূপের পাশে ছোবড়া বিছিয়ে এর চারপাশে সবাই বসে পড়ে। ছোবড়ার মাঝখানে খাবার ঢেলে গোল হয়ে খেতে শুরু করে। ভুক্তাবশিষ্ট খাবার ছোবড়ার ভেতর রেখে পুটলি বেঁধে ফেলে দেয় পাশের ডাস্টবিনে কিংবা ফেলে রাখে রাস্তার পাশে। ময়লাবাহী গাড়িসহ শেষরাতে আসে পরিচ্ছন্ন কর্মীরা। ডাস্টবিনের আবর্জনাসহ ভুক্তাবশিষ্ট খাবার যেখানে যা পায় ময়লার গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। তাদের ভক্ষণকৃত খাবারের চেয়ে ভুক্তাবশিষ্ট খাবারের পরিমাণ মোটেও কম নয়। আল্লাহ তাঁর পাক কালামে বলেন, 'খাও এবং পান কর; কিন্তু জিনিসের অপব্যয় করিও না; অবশ্যই তিনি (আল্লাহ) আমিতাচারীকে ভালোবাসেন না।' (সূরায়ে আল-আরাফ, আয়াত ৩১)
‘খাবার নষ্ট করা বড়ই গুনাহের কাজ, খাবার বিনষ্টকারী গরিবত্বের লক্ষণ’। এই প্রচলিত প্রবাদ প্রবচনগুলো আমরা খুব মেনে চলি। আলেমগণ বলেন , ‘কেউ খোরাক নেয়ার সময় খোরাকের কোনো অংশ যদি নষ্ট করে স্বয়ং আল্লাহ তার খোরাক বরাদ্দসহ রুজি-রোজগারের পরিমাণ কমিয়ে দেয়’।
মা-বাবার নিকট থেকেও আশৈশব এসব কথাই শুনে আসছি। তাবলিগ জামায়াতের লোকেরা এ ব্যাপারে খুবই সতর্ক তারা খাবার খেতে বসে নিজের প্লেটের পাশে পড়ে থাকা ভাত ছাড়াও পাশের জনের প্লেটের পাশে পড়ে থাকা ভাতও কুড়িয়ে তুলে খেয়ে ফেলে। এখানে আরব দেশে এসে দেখলাম তার উল্টোটা।
একবার মদিনায় অবস্থান কালে মসজিদে নববী থেকে নামায আদায় করে হোটেলে ফিরছিলাম। ফেরার পথে খোলা মাঠে গাড়ির পাশে দেখি এক কার্টুন আঙ্গুর। তা দেখে ভাবলাম, কেউ হয়তো রেখে দিয়েছে। কার্টুন পেছনে ফেলে চলে আসতেই খট্কা লাগতে শুরু করলো। খট্কার কারণ- আশপাশে কোথাও লোকজন নেই। জনমানবহীন প্রান্তরে, নতুন কার্টুন এবং খোলা আকাশের নিচে কে রেখে গেলো এতোগুলো আঙ্গুর!
মনের খট্কা দূর করতে আবার ফিরে যাই আঙ্গুরের কাছে। আঙ্গুরের কার্টুন থেকে সন্দেহমুক্ত দূরত্বে দাঁড়িয়ে ‘আঙ্গুরগুলো পরিত্যক্ত কিনা' পরিদর্শন করতে শুরু করি। লক্ষ্য করলাম, কার্টুনের আঙ্গুরগুলো পাকা এবং কড়কড়ে তাজা। যে ছড়িতে ঝুলে থাকে সে ছড়িও রয়েছে আঙ্গুরের সাথে। কার্টুনের চারপাশে খালি ছড়ি পড়ে থাকতে দেখে বুঝতে পারি কিছুক্ষণ আগে কে বা কারা পরিত্যক্ত ছড়ি থেকে আঙ্গুর ছিড়ে খেয়ে গেছে। তা ছাড়া কার্টুনের অর্ধেক অংশ খালি। তাতে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয় কে বা কারা ভ্রাম্যমান গাড়ি থেকে পাইকারী দামে আঙ্গুর কিনে যতোক্ষণ পেরেছে খেয়ে বাদবাকিগুলো ফেলে রেখে চলে গেছে।
পরিত্যক্ত কার্টুনে আঙ্গুরের পরিমাণ হবে কম-বেশি আড়াই কেজি। আরবের মাটিতে খাবারের দানা ও গোটা যতো বেশি নষ্ট হতে দেখেছি আর কোনো দেশে ততো নষ্ট হতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। সেই চির পুরাতন কথা, ‘বাতির তলায়ই অন্ধকার'। যত্রতত্র খাবার ফেলে নষ্ট করার বিষয়ে সৌদি প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছে প্রশ্ন করেছিলাম। তাদের উত্তর ছিল পজেটিভ। পজেটিভ উত্তরের অর্থ খাবার নষ্ট না করার চেয়ে নষ্ট করাটাই অধিকতর যৌক্তিক ও পুণ্যের কাজ। আমি লক্ষ্য করছি- সৌদিয়ানদের সব কাজের পেছনেই নির্বিচারভাবে আমরা একটা পজেটিভ যুক্তি খুঁজে বের করি।
মদিনার আঙ্গুরের কার্টুন ফেলে রেখে আবার ফিরে আসি মক্কার খাবারের দোকানে। মক্কায় শপিং সেন্টারগুলোর মধ্যে সব চেয়ে বেশি ভিড় হয় খাবারের দোকানে। এত খাবারের মাঝে সারা বাজারে তিন চক্কর ঘুরেও আমাদের খাবার খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়ে বাংলা ছায়াছবির বিচ্ছেদ কাতর নায়িকার গানের সাথে তাল মিলিয়ে আমারও গলা ফাটিয়ে গাইতে ইচ্ছে করে -
‘কত রকম খাবার আছে দুনিয়া বোঝাই
এই খাবারের ভীড়ে আমার সেই খাবার নাই।
তরল খাবার, গড়ল খাবার
খাবার উষ্ণ ঠান্ডা,
টাকায় বাঘের দুধ খাওয়া যায়
আরো ঘোড়ার আন্ডা।
তার পরেও যায় না খাওয়া কাটা ইলিশ নোন্তা
শুঁটকী ভরতা কাক্তির জাউ, মরিচ পোড়া পান্তা।
গানের কলি ভাজতে ভাজতে ভাবলাম, কয়েকটা ডিম নিয়ে গেলে কেমন হয়! হোটেলে গ্যাসের চুলা চাক্কি সবই আছে। বড়ির বাবুর্চি তো বগলে করে নিয়েই এসেছি। একদিকে পয়সার সাশ্রয় হবে, আর অপর দিকে বাড়ির মতো মজা করে খাওয়াও চলবে। কিন্তু যদি উল্টাপাল্টা কিছু ঘটে যায়! গিন্নী আমার গ্রামবাংলার চিরাচরিত কঠিন কোমলের দ্বৈত মিশ্রণে গড়া খাঁটি চরের বধূ। তার কদুর মতো নরম ও চন্ডীরর মতো চরম হৃদয়খানা আড়ি হলে আর নারী থাকে না। তাদের মাটির মতো খাঁটি ও কবিতার মতো পরিপাটি শরীর খানা যখন কটি বেঁধে বটি হাতে চন্ড মূর্তি ধারণ করে সামনে এসে দাঁড়ায়, তখন মধু মাখা বধূর কণ্ঠে আর যাদু থাকে না- ধান শালিকের মতো ঘরের বউকেও পরের মতো লাগে। আরবের হোটেলে আমার হাতে পাকের সরঞ্জাম দেখে গিন্নী যদি বিন্নী ধানের খইয়ের মতো ঠাস করে বিষ্ফোরিত হয়ে ওঠে। কিংবা যদি মাথার ঘোমটা পাতায় রেখে এবাদতের ভাবগম্ভীর গন্ডী ছেড়ে আদি ও আসল চন্ডী মূর্তি ধারণ করে বলতে শুরু করে-
- পেয়েছেন কি? বলি আমাকে পেয়েছেন কি? বাড়িতে আপনার হেসেল ঠেলতে ঠেলতে অকালে বুড়িয়ে যাচ্ছি, কালো চুলে পাক ধরে গেছে, পারিবারিক তাড়নায় সময় মতো আল্লাহ-রাসূলের নামটাও মুখে আনতে পারি না। আল্লাহ মুখ তুলে তাকানোর পর ওমরাহর ভিসা পেয়েছি। বাড়ি থেকে নিয়ত করে বের হয়েছি, যে কয়দিন মক্কা-মদিনা আছি সে কয়দিন আর দুনিয়ার কাজে মন দেবো না। এই নিয়ত করে ঠাÐা মাথায় যেইনা ধর্মকর্ম করতে শুরু করেছি আর সেইনা আমাকে আবার চুলায় পাঠানোর...।
না না গিন্নীকে মক্কা এনে ধাক্কা দিয়ে চুলায় ঢুকানো কিছুতেই ঠিক হবে না। তাই গতকালকের হোটেল থেকে তেল মাখানো ডাল-ভাতের সাথে বেশি করে কাঁচা মরিচ নিয়ে যাই। মজা না লাগলে প্রতি কামড়ে কাঁচা মরিচ খেলেই চলবে।
মান্নান মিয়া নামে আমাদের গ্রামের এক যুবক হারাম শরীফের পাশে এপার্টমেন্ট হোটেলে চাকরি করে। মান্নান তার বাড়ি থেকে জানতে পেরেছে আমরা ওমরাহ করতে এসেছি। সে আমার বর্তমান ফোন নাম্বার যোগাড় করে ফোন করতে করতে একেবারে আমাদের হোটেলে চলে আসে। আমাদের দেখে সে কী খুশি। আমাদের কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা জানতে চায়। খানাপিনার বিষয়ে মহাসমস্যার কথা তার কাছে জানাই। সবকিছু শোনার পর-
বলেন কি ভাই! আমি থাকতে আপনাদের এই কষ্ট। আপনার হোটেলের কাছেই আমার হোটেল। হজ্জের মওসুমে নতুন হাজীদের দ্বারা আমাদের হোটেল বোঝাই থাকে। হাজীদের দেখাশুনা পাকশাক আমরাই করে থাকি। এসব হোটেলের খাবার বাঙালিরা খেতে পারে না। হজ্জের সময় অধিকাংশ হাজী সাহেব পাক করে খান। আপনারা কিছু মনে না করলে আমার এখানে গিয়ে খাওয়া দাওয়া করতে পারেন।
- তা হয় না। আমরা দুজন ছাড়াও আমাদের সাথে আরো দুজন লোক আছে। তাদের ফেলে আমাদের খেতে যাওয়াটা স্বার্থপরের মতো ঠেকে।
তবে কথা দেন, এক দিন আমাদের হোটেলে গিয়ে আমার হাতের পাক খেতে হবে। এখান থেকে আমাদের হোটেল মাত্র দশ মিনিটের পথ।
- শোন, গতকাল একটি গ্যালন নিয়ে পানি আনতে গিয়েছিলাম। জমজমের পানি। হেরামের উত্তর-পূর্ব সাইডে নবীজীর বাড়ির পাশে গোটা বিশেক পানির টেপ থেকে লোকজন সারাদিন পানি নেয়। তা দেখে আমিও গিয়েছিলাম পানি আনতে। গিয়ে দেখি একেক জন ১০/১২টি করে গ্যালন নিয়ে সব পানির টেপ দখল করে রেখেছে। কাঠফাঠা রোদের মাঝে দেড়-দু ঘণ্টা অপেক্ষা করেও পানির সিরিয়াল পাইনি। বিরক্ত হয়ে দোকান থেকে পানির বোতল কিনতে হয়েছে।
- ওরা পানির ব্যবসা করে। ওদের গ্যালনের লাইন শেষ হবে না জীবনেও। বড় গ্যালন পনের টাকা (রিয়েল) আর ছোট গ্যালন দশ টাকা। পানি ভর্তি গ্যালন নিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। প্রাইভেট গাড়িতে করে বহুদূর থেকে লোকজন এসে জমজমের পানি কিনে নিয়ে যায়। আমি আপনাদের জন্য বড় গ্যালনে এক গ্যালন পানি দিয়ে যাবো যা বহু দিন খাওয়া চলবে।
এ কথা বলেই বাইরে চলে গেলো মান্নান। কতোক্ষণ পর ফিরে এলো এক ব্যাগ ফল ও এক টিন ফলের জুস নিয়ে। হোটেলে প্রবেশ করে হাসতে হাসতে-
-ভাই, আমি কম মাইনের মানুষ। আপনাদের জন্য আর কি আনতে পারি!
আরে, কে বলে তুই কম মাইনের মানুষ? আমাদের জন্য তুই যা এনেছিস আমাদের দেশের ধনী লোকেরাও এতো কিছু নিয়ে আসে না। এখন তো আমরা লাভ-লোকসানের হিসেব-নিকেশ না করে লেনদেনই করি না। মেয়ের বিয়ে, ছেলের বৌভাত, জন্মদিন, মৃত্যুবার্ষিকী, ম্যারেজডে-ডিভোর্সডে সব অনুষ্ঠানেই টেবিল পেতে পানের বাটা সাজিয়ে আদায়কারিরা খাতা কলম নিয়ে বসে থাকে। মিলাদ-মাহফিলসহ মসজিদ মাদ্রাসার বেলায়ও একই অবস্থা, আদায়ের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায় না। এসব প্রতিষ্ঠানের জন্য যে মাওলানা যতো বেশি টাকা আদায় করে দিতে পারে তার কদর এবং ডিমান্ডও বেশি।
- এই দেশে এখনো এই চল (প্রচলন) শুরু হয় নি। তারপর ভাই অনেক দিন দেশে যাই না। আর গিয়েই কি করবো? এখানে সব খায়-খরচা করে প্রতি মাসে ৫/৬ হাজার টাকা বাড়িতে পাঠাতে পারি। দেশে তো হাজার টাকা মাইনে দিয়েও আমাকে কেউ রাখবে না। তাছাড়া আছি আল্লাহ পাকের পবিত্র জায়গায়। প্রতিদিন হারামে গিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ি। মানুষ তো ২/৩ লক্ষ টাকা খরচ করেও এখানে আসতে পারে না। এতো বছর পর আপনাকে দেখে নিজের গ্রামের মতো লাগছে। আপনার খাওয়ার সমস্যার কথা শুনে খুব খারাপ লাগছে। সবাইকে তো খাওয়াতে পারবো না। তার পরেও আগামীকাল আপনাদের দাওয়াত। দয়া করে গরিবের থাকার জায়গাটা একবার দেখে আসবেন। দেশে গেলে পরিবারের লোকজন জানতে চাইলে বলতে পারবেন আমি কেমন জায়গায় থাকি।
পরদিন রাতে মান্নান আমাদের নিয়ে যায়। একটি বহুতল ভবনে মান্নানের হোটেল। হোটেলে আমাদের দেশের আরো দুজন ছেলে রয়েছে। তারা কথায় কথায় জানায়-
- আমাদের দেশের পুরানো হাজীগণ এসব এপার্টমেন্ট লীজ কিংবা ভাড়া নিয়ে হোটেল হিসেবে ব্যবহার করে।
এসব কথোপকথনের মাঝে খাবার চলে আসে। মান্নান আমাদের দুজনের সামনে দু’থাল গরম ভাত এগিয়ে দিতে দিতে-
- ভাই, এগুলো হাজী সাহেবদের প্রিয় খাবার।
বড় সাইজের দুটি থালা ভাত দিয়ে কানায় কানায় ভর্তি করে ভাতের ওপর ডোবা ডোবা করে তরিতরকারি দিয়ে সহাস্যে আমাদের দিকে এগিয়ে দিয়ে সহাস্যে বলে-
ভাই, এ খাবার সবাই পাক করতে পারে না। হাজীগণ আমার পাক করা এ খাবারের খুব তারিফ করে।
হাজী সাহেবদের প্রিয় খাবারের দিকে এক নজর তাকিয়ে চক্ষু কপালে উঠে স্থির হয়ে রইলো। সামনে টেনে এনে বুঝতে পারলাম তরকারিতে রয়েছে যেমন ঝোল তেমন ঝাল। আগাগোড়া চর্বিযুক্ত মোটাতাজা ফার্মের মুরগি টাকুটি করে, গরম মসল্লার ভেতর ডুবিয়ে চুবিয়ে উত্তপ্ত তেলের মাঝে রেখে -ক্ষণ সিদ্ধ করলে যা হয় তার নাম হাজীদের প্রিয় খাবার। তা দেখে-
- ভাইরে, হাজীদের প্রিয় খাবার হাজীদের জন্য তুলে রেখে দে। আমি দুবার করে রিং লাগানো হার্টের রোগী। তেল-চর্বি জাতীয় খাবার আমার জন্য সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ৷ আমার প্রিয় খাবার শাকসবজি ও ডাল। বিশেষ করে মাসকলাইর ডাল আর মোটা চালের ভাত হলে এখনো এক থাল ভাত খেতে পারি।
আমার কথা শুনে মান্নানের মুখ কালো হয়ে গেলো। তার করুণ অবস্থা দেখে ঝোল সারিয়ে এক টুকরো মাংসসহ টমেটো মিলানো ডাল দিয়ে খেতে শুরু করি।
হোটেলে বাংলাদেশের ছেলেদের মধ্যে একটি লেখাপড়া জানা ছেলে ছিল। লেখাপড়া জানা ছেলেটি নিয়মিত বাংলা বই পুস্তকসহ পত্র-পত্রিকা পড়ে। আমি লেখালেখি করি জানতে পেরে আমাকে খুব সম্মান ও শ্রদ্ধা করে। ছেলেটি আমার কাছে কি যেন বলতে চায়। খাওয়া শেষে হাত মুখ মুছতে মুছতে-
- তুমি কি বলতে চাও বল?
বলছি কি, আপনি তো লেখালেখি করেন। আমাদের দেশের হাজীদের নিয়ে কিছু লিখবেন কি?
হাজীদের নিয়ে কি লেখার আছে?
- অনেক লেখার আছে। এ দেশে হোটেলের চেয়ে এপার্টমেন্টের সংখ্যা আনেক বেশি৷ হোটেলের মতো যা দেখছেন এর অধিকাংশই এপার্টমেন্ট। আমাদের দেশের এক শ্রেণীর লোকেরা পুরো এপার্টমেন্ট ভাড়া নিয়ে নেয়। হজ্জের মউসুমে কয়েকগুণ বেশি টাকায় ভাড়া আদায় করে। যে রুমে চারজন হাজী রাখার কথা সে রুমে পনের বিশজন হাজী রাখে। পালা করে পনের জন বাইরে অবস্থান করে। ৬০ জন হাজী সংগ্রহ করে দিতে পারলে একজন ফ্রি। আর লাইসেন্সধারীগণ ৬০ জন হাজী সংগ্রহ করে নিতে পারলে দশ লক্ষ টাকার ব্যবসা খাড়া।
- যারা সারা বছর খালি হোটেলের ভাড়া গুনতে পারে তারা হজ্জের সিজনে তো একটু এদিক-ওদিক করবেই।
- একটু এদিক ওদিক হলে কোনো কথা ছিল না, যাকে বলে একেবারে পুকুর.......।
-আরে শোন, যারা হজ্জে আসে তারা বড় লোক, কিংবা বড় লোকের বাবা-মা। তাদের পকেট থেকে দুচার দশ হাজার টাকা খসে গেলে তারা টেরও পাবে না। টের না পাওয়া টাকায় যদি চুনোপুঁটিদের অচল সংসার সচল হয়ে যায়, তাতে তেমন একটা ক্ষতি কি? এই আমাদের কথাই ধরো, একজনের আপ-ডাউন বিমান ভাড়া জনপ্রতি বায়ান্ন হাজার টাকা। কোনো কোনো বিমানে পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকায়ও আপ-ডাউন টিকেট পাওয়া যায়। নিজে ভিসা অফিসে না গিয়ে অন্যের মাধ্যমে ভিসা-বিমান ঠিক করলেও জনপ্রতি সর্বোচ্চ পচাত্তর হাজার টাকার বেশি লাগার কথা নয়। জোবায়ের আহমদ, আমার জুনিয়র আইনজীবী। সে তার হাড়কিপটে 'ক'জন বন্ধুসহ সুযোগ পেলেই পকেটে যা আছে তাই নিয়ে বিদেশ পাড়ি দেয়। বিদেশ ঘুরে এসে কে কত কম টাকায় বিদেশ ঘুরতে পেরেছে তার কাহিনী শোনায়। একবার জনপ্রতি দু'হাজার সাত'শ টাকায় পাক্কা পাঁচদিন পাঁচরাত দার্জিলিং- এ কাটিয়ে আমার চেম্বারে এসে ফাটাফাটি রকমের বিবরণ দিয়েছিল। জোবায়ের এবং তার এক বন্ধু ওমরা পালন করতে এসেছিল সৌদি আরব। মক্কা ও মদিনায় পাক্কা নয়দিন অবস্থানকালে তাদের জনপ্রতি খরচ পড়েছিল তিয়াত্তর হাজার টাকা। তাও রিয়েলের মূল্য ২০ টাকা হারের হিসেবে- রিয়েলের মূল্য ১৮ টাকা হারে ধরলে সত্তর হাজার টাকারও কম খরচে কীভাবে ওমরা পালন সম্ভব হলো সে হিসেবটাও নিম্নে প্রকাশ করা হয়েছে :
১. বিমান ভাড়া- ৫২,০০০.০০
২. ভিসা প্রসেস (মক্কা হোটেলে পৌঁছানো পর্যন্ত)- ১৩,০০০.০০
৩. মক্কা হোটেল ভাড়া (জনপ্রতি) প্রতিদিন- ৫০০.০০
৪. মদিনা হোটেল ভাড়া (জনপ্রতি) প্রতিদিন- ২৫০.০০
৫. খাওয়া প্রতিদিন- ৮০০.০০
৬. মক্কা থেকে মদিনা ভাড়া (জনপ্রতি)- ১২০০.০০
৯ দিনের মোট খরচ ৫২,০০০ + ১৩,০০০ + ১২০০ + (হোটেলের গড় খরচ ৩৭৫ * ৯ = ৩,৩৭৫ + খাওয়া খরচ ৪০০ * ৯ = ৩৬০০) + ৬৯৭৫ = ৭৩,১৭৫.০০ (তিয়াত্তর হাজার একশত পচাত্তর টাকা)।
একজন লোক একমাস রাজার হালে খেলেও খরচ পড়বে দশ হাজার টাকা। প্রতি রাতে পাঁচ'শ টাকা করে এক মাসে হোটেল ভাড়া পনের হাজার টাকা। মক্কা-মদিনাসহ সব রকমের পরিবহণ ভাড়া কোনো ক্রমেই পাঁচ হাজার টাকার বেশি লাগার কথা নয়। হালকা কেনাকাটাসহ সব মিলিয়ে একজন হাজীর এক মাসের খরচ কোনো ক্রমেই এক লক্ষ টাকার বেশি লাগার কথা নয়।
তবে হজ্জ মৌসুমের সময় সব হিসেব উলট-পালট হয়ে যায। কারণ বাংলাদেশ নতুন ও স্বল্প আয়ের দেশ। হজ্জ মৌসুমে হজ্জ যাত্রীদের বহন করার মতো পর্যাপ্ত পরিমাণ বিমান বাংলাদেশে নেই। তাই অধিক ভাড়া দিয়ে বহির্বিশ্ব থেকে বিমান ভাড়া করতে হয়। হজযাত্রীদের নিকট থেকে যে ভাড়া নেয়া হয় সে ভাড়ায় বিমান পাওয়া না গেলে কোনো কোনো বছর বাংলাদেশ বিমানকে লোকশান গুনতে হয়। বাসা ভাড়াও গুনতে হয় অন্য সময় থেকে দ্বিগুণ। ভাড়া করা একটি বোয়িং একসাথে কম-বেশি ৪৫০জন যাত্রী বহন করতে পারে। যে বিমানটি কমবেশি ৪৫০ জন যাত্রী বহন করতে পারে সে বিমানটির প্রতিঘণ্টায় ভাড়া কম-বেশি ৮ থেকে ১০ হাজার ডলার। একটি বিমান প্রতিদিন একবার আপ-ডাউন করতে পারে। বিমান ভাড়া এবং যাত্রীর সংখ্যা দিয়ে পুরণ-ভাগ করে সহজেই বিমানের খরচটা বের করা যায়। এ কারণেই প্রতিজন হজ্জযাত্রীর নিকট থেকে আদায় করা হয় সর্বোচ্চ দুই লক্ষ নব্বই হাজার থেকে সর্বনিম্ন দুই লক্ষ ত্রিশ হাজার টাকা।
পুরানো হাজী সাহেবগণ এই হিসেবের সাথে একমত প্রকাশ করে বলেন-
হজ্জ মউসুমে বিমান ভাড়া ১,০৩,০০০ টাকা
উভয় দেশের মোয়াল্লিম ফি ৩১,৫০০ টাকা
হজ্জ মউসুমে খানা ...... ১০০০ টাকা
ঘরভাড়া (মান অনুযায়ী-বেশি হতে পারে) ৫০,০০০ টাকা
ট্যাক্স ও সার্ভিস চার্জ ৮,০০০ টাকা
অন্যান্য ২৭,৫০০ টাকা
সর্বমোট ২,৩০,০০০ টাকা
হজ্জ এজেন্সিগুলো কম লাভ করলে ২,১০,০০০ টাকার হজ্জ করা যেতে পারে। এক কথায়, অমৌসুমের মোট ব্যয়কে ২ দিয়ে গুণ করলে হজ্জ মৌসুমের খরচটা বের হয়ে যায়। এত টাকা নেয়ার পরে সেবার মান নিয়ে একটু আলোচনা না করলেই নয়। অধ্যাপক মুহম্মদ ফরিদউদ্দিন খান ইরান থাকাকালে হজ্জ পালন করতে গিয়ে ‘চোখের জলে প্রেমের হজ্জ' নামক একটি যিয়ারত কাহিনী লিখছেন। তাঁর যিয়ারত কাহিনী থেকে ইরানী হজ্জ মিশন ও বাংলাদেশী হজ্জ মিশনের ব্যবধান পাশাপাশি তুলে ধরা হলো। তুলে ধরা হলো হজ্জের ব্যয়টাও। (চলবে,,,)
লেখক: আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক
০৬ জানায়ারি ২০২৫