মুক্ত জীবনে বাল্যবিবাহের যাঁতাকল
অধরার গ্রামটা খুব ছোট ছিলো। গ্রামের বৈচিত্র্যে অধরা দুচোখ মেলে সৌন্দর্য্য দেখেছে। বুক ভরে নিয়েছে দূষণমুক্ত বাতাস। মাঠের চাষের শস্যকণা, বাগানের ফলমূল দিয়ে মিটিয়েছে ক্ষুধার চাহিদা ও পুষ্ট করেছে দেহ।
আম, জাম, কাঁঠাল, কলা সব রকমের ফলমূল নিয়েই অধরার গ্রামটি ছিলো। অধরার গ্রামটি ছায়া শীতল শান্ত পরিবেশে অবস্থান। আশেপাশে প্রচুর চাষের জমি নিয়ে বেষ্টিত গ্রাম।
ছোট ছোট পুকুর, কোথাও আবার পায়ে হাঁটা সরুপথের ধারে বাঁশের ঝাড়। কোথাও আবার ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে বটগাছ। মুক্ত বাতাসে মনের আনন্দে চাতকের কাতর ধ্বনি, ঘুঘুর ক্লান্ত স্বর। গ্রাম্য প্রকৃতির রুপে অধরা প্রাণচঞ্চল দিন কাটায়।
শুরুটা ছিলো প্রচন্ড রম্যরসে ভরা। প্রকৃতির উপর ছেড়ে দেয়া এক নীল কন্ঠ পাখির ন্যায় মনে যা ইচ্ছে ডানা মেলে উড়িয়ে দিয়েছে আকাশে। স্তব্ধতার ছোঁয়া কখনোই গভীরে আলোড়ন তুলতে পারেনি। পরিরা যেমন ইচ্ছে করলেই নিজের ইচ্ছেকে পূর্নাঙ্গ রূপ দিয়ে যখন খুশি সাজতে পারে, তেমনি সাজার ইচ্ছে ছিলো অধরার।
ছোট থেকেই মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মে খুব হাসিখুশি চালচলন ছিলো তার। সংকীর্ণতার ছোঁয়া কখনো আঘাত করতে পারেনি তাকে। অধরার গ্রামটা ছিলো প্রকৃতির এক অপরুপ দৃশ্য নিয়ে ভরা। গ্রামের প্রতিটা বাড়ি খুব সুন্দর ও সারিবদ্ধ ছিলো। দুইপাশে ঘর মাঝখানে বড় উঠান। একপাশে দাঁড়ালে বাড়ির অন্য পাশের বিরাট উঠান মনে হতো বাড়ির পাশে রাস্তা।
একটা জমি পেরুলেই বড় কাঁচা সড়ক। ঘরের পাশে মসজিদ। সড়কের কাছেই হাই স্কুল। প্রাইমারী স্কুলও আছে গ্রামের আরেক পাশে। প্রতিদিন সকালে উঠেই মসজিদে আরবি পড়া দিয়ে সকাল শুরু হয়। চঞ্চল প্রকৃতির ছিলো বলে মসজিদের হুজুর খুব পছন্দ করতেন অধরাকে। পড়াশোনায় বেশ মনোযোগী ছিলো অধরা।
খেলাধুলায় তো আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। মসজিদ থেকে এসেই মায়ের হাতে কোনরকম খানা শেষে খেলায় পারি জমাতো। দুই ঘন্টা বাড়ির এদিক সেদিক বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলা শেষে আবার স্কুলের জন্য প্রস্তুতি নেয়া। তবে বর্ষাকাল হলে তো কথাই নেই। স্কুলে পারি জমাতো সময়ের একঘন্টা আগে। কারন হলো স্কুলে যাওয়ার পথে ছোট্ট একটা আনা পরে। যেখানে বাঁশের সাঁকো। যাওয়ার পথে পানিতে গোসল করা ছিলো এক তৃপ্তিময় আনন্দ। বর্ষাকালের নতুন স্বচ্ছ পানি। মনে হতো সারাদিন সেখানেই দিন কাটায়।
তবে স্কুল কামাই করেনি কখনো। যত অনিচ্ছাই হোক সময় মতো স্কুলে যাওয়া, ঠিকমতো পড়াশোনা করা তার আরেকটা নেশা ছিলো। স্কুলের শিক্ষকরাও খুব আদরে রাখতেন। বন্ধুদের সাথে ছিলো খুব সখ্যতা। স্কুলে গিয়েও খেলাধুলার জন্য পাগল ছিলো।
অধরা আস্তে আস্তে বড় হতে লাগলো। বয়স সবে ১৩ হয়েছে। কৃষক পরিবারের মেয়ে ছিলো অধরা। সল্প আয়ে জীবন চলতো তার বাবার। তাই একসময় সংসারে অভাব দেখা দিল। পরিবারে আরো চার ভাইবোন। অধরা ও তার বাবা-মা সহ সংসারে সাতজন সদস্য। খুব টানাটানি পরে সংসারে।
বাবা-মা ভেবে নিলো অধরাকে বিয়ে দিয়ে দিবে। বিয়ে দিলে অন্তত ঘরের একজন সদস্য কমবে। পাশের বাড়ি মনির হোসেনের ছেলে আলীর সাথে বিয়ে ঠিক করে।
বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ১৩ বছরের একজন শিশুকে বিয়ের পিরিতে বসানো শাস্তিযোগ্য অপরাধ তা মানতে রাজি নয় অনেকেই। বাবা-মা না বুঝে একজন ১৩ বছরের শিশুকে যৌন নির্যাতনের মতো এত অমানবিক কাজে ঠেলে দিলেন। আর বুঝলেও তা মানার চেষ্টা করেন না। কারণ গ্রাম বাংলার বাল্যবিবাহটা একধরনের প্রথা মনে করেন।
বিয়ে ঠিক হলো অধরার। কিছু শিক্ষিত লোক এসে বিয়ের সময় বাধা দিলেন। কিন্তু অধরার বাবা-মা তাদের ভুল বুঝলেন। নানা ধরনের অশালীন কথা বলে তাদের তাড়িয়ে দিলেন। অধরাকে বাঁচাতে তারা আইনের আশ্রয় নিতে গেলেন। কোন লাভ হলো না। আলীর বাবা ছিলো একটু বিত্তশালী।
আজকাল টাকায় সব অবৈধ বৈধ হয়ে যায়। সে পুলিশদের টাকা দিয়ে মিমাংসা করে নিলো। ১৩ বছরের শিশুর বয়স কাবিনের খাতায় লিখে নিলো ১৮। হায়রে মানুষ টাকার খেলায় হয়ে যায় ফানুস। পুলিশও এটা ভাবলো না একজন শিশু কে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে তারা পুলিশকে ডেকেছিলো। গ্রাম্য প্রথায় বাল্য বিবাহ একটা সামাজিক ব্যাধি। এটাকে রুখতে হলে সমাজের সকল শ্রেণীর লোককে এগিয়ে আসতে হবে।
অধরার বিবাহ হয়ে গেলো খুব সহজে। অধরা বুঝতে পারলো না বিয়ের পরিপূর্ণ স্বাদ। শশুর বাড়ি গেলো।
নতুন ঘর নতুন বর
পর হলো বাবা মার ঘর।
নানা বৈচিত্র্যের দেখা পেলো নতুন করে। শিশু বয়সে এখনো যেখানে তার খেলাধুলার বয়স শেষ হয়নি, সেখানে তার সংসারের ঘানি। অল্প বয়সে অধিক চাপ তাকে ঘিরে ধরলো।
একদিকে স্বামীর অধিকার নামে যৌন হয়রানি, অন্য দিকে কাজের চাপ। কৃষি কাজ করতো মনির হোসেন। প্রচুর জমির মালিক। অনেক শ্রমিক নিয়ে কাজ করে ঠিকই কিন্তু ছেলের বৌয়ের কোন কদর ছিলো না। তাকেও অল্প বয়সে শ্বাশুড়ির সাথে কাজে নেমে পরতে হয় সমানে সমান।
নানা শারীরিক জটিলতা দেখা দিলো। বছর না ঘুরতেই অন্তঃসত্তা। স্বাভাবিক ভাবেই বয়স কমের কারণে সমস্যা তৈরির কথা। তার উপর কাজের তাগিদে দিন দিন চরম অসুস্থ হয়ে পরলো অধরা।
অধরার জীবন থেমে যাওয়ার যোগাড়।
শৈশবে সকলের আনন্দ সুন্দর না হলেও অধরার শৈশবটা প্রাণবন্ত ছিলো। প্রতিটা শিশুর শৈশব এমনটা হলে হয়তো শিশুদের বিকাশ ঘটে ভালোভাবে।
স্বপ্নগুলো বেড়ে উঠে তার আপন গতিতে। সাজাতে পারে নিজের বৈচিত্র্য প্রকৃতির মতো করে। দীর্ঘ দিনের অবহেলা আর বঞ্চনা কাটিয়ে উঠা একটা শিশুর পক্ষে সত্যি-ই জটিল। তাই প্রকৃতির উপর যত্ন নিলে আমাদের প্রকৃতি যেমন সুন্দর হয়, সম্মৃদ্ধ ও সাম্রাজ্য সম্প্রসারণে ভূমিকা রাখে, ঠিক তেমনি একটা শিশুর বিকাশে শুরুটা অধরার মত বৈচিত্র্যময়ী বৈশিষ্ট্য সুন্দর ভুমিকা রাখতে পারে।
তবে সঠিক সময়ে অভিভাবকদের জন্যেও থাকতে হবে সঠিক সিদ্ধান্ত। নইলে অধরার মতো সুন্দর ও প্রাণবন্ত জীবন থামার জন্য দায়ি থাকতে হবে বাবা-মার।
লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক