বিনে স্বদেশী খাবার
(শেষ পর্ব)
ইরানী হজ মিশনের চিত্র: ‘প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠেই দেখবেন খাদেম এসে বিরাট ট্রে ভর্তি নানা ধরনের ফল কামরায় রেখে গেছে। সঙ্গে ফল খাওয়ার যাবতীয় সরঞ্জাম, চা ভর্তি বিরাট ফ্লাক্স, চিনি, চা ব্যাগ, টিস্যু পেপার ইত্যাদি। ফজর নামাজের পর বেলা উঠতেই ডাইনিং হলে গিয়ে নাস্তা করবেন। নাস্তায় রুটি, দুধ, চা, ফলের রস, ফল প্রভৃতি। নাস্তা শেষে রুমে ফিরে দেখবেন রুম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, বিছানাপত্র সাজানো গুছানো। দুপুরে ডাইনিং হলে খানাদানা করবেন বাবুর্চীর হাতের ভাত, রুটি, মাছ, গোশত, ঠ্যাঙ্গা পানীয়, ফলমূল এবং চা চিনি। রাতের খানাও ভাই, তবে প্রত্যেক দুপুরে এ রকম নয়। সপ্তাহের একেক বেলায় একেক রকম। রুটিন মাফিক ব্যবস্থা। বন্ধুদের জিজ্ঞাসা করেছিলাম, রাজকীয় মুলুকে এ রাজকীয় হাল-অবস্থা কি শুধু আমাদের কাফেলার বেলাই ঘটছে? বন্ধুরা হেসে জবাব দিলেন, বরং আমদের অবস্থাটাই সর্ব নিম্নমানের।
এই খাদেমগণ কিন্তু চিরাচরিত বদবখত চাকর নওকর নয় বরং বড় বড় আলেম ওলামা পদস্থ কর্মকর্তা থেকে আরম্ভ করে সমাজের সর্বস্তরের লোক। স্বেচ্ছায় খাদেমের খাতায় নাম লেখিয়েছেন তারা। তাদের উদ্দেশ্য দু'টি, হজ্জ করা, হাজীদের সেবাও করা। তবে খেদমত যাখনা করেন তখন খাদেম ছাড়া তাদের অন্য পরিচয় তারা দেন না ৷ সেই পায়খানা পরিষ্কার, থালা-বাসন ঘষামাজা, ধোয়া থেকে শুরু করে কাফেলার নেতৃত্ব, নিয়ন্ত্রণ পর্যন্ত সমস্ত কাজে তারা আঞ্জাম দেন। হাজীরা শুধু ইবাদত বন্দেগী, জিয়ারত, কান্নাকাটি, তবলিগ, যোগাযোগ প্রভৃতি কাজে ব্যস্ত থাকেন। আর এতোসব কাজের মূল কেন্দ্র হচ্ছে এই হজ্জ মিশন।
ফরিদউদ্দিন খান সাহেবের দেখা হয়েছিল বাংলাদেশি হজ মিশনে তার শ্বশুর বাড়ির এক লোকের সাথে। হজ্জ করতে গিয়ে শ্বশুর বাড়ির মেহমান কেমন আছে- জানতে চাইলে- উত্তরে ছিলা নিম্নরূপ :
বাংলাদেশি হজ মিশনের চিত্র: 'আমরা তো বাসস্থানের ব্যাপারে পরাধীন। মুয়াল্লেমদের হাতের পুতুল। আমাদের যে রুম দেওয়া হয়েছে তা কাগজে কলমে ছয়জনের অথচ বর্তমানে পনেরো জনাকে তাতে ঠাসানো হয়েছে। বড় জোর পাঁচজন লোক ঘুমাতে পারে এ রুমে। তার কথায় বিস্ময় প্রকাশ করে প্রশ্ন করলাম, মাত্র পাঁচজন লোকের থাকার জায়গায় পনেরো জন কি করে আছেন? এ ধরনের রুমে না উঠলেই পারতেন! আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললেন, সে কথা আর বলবেন না ভাই। আমাদের কোনো হাতই নেই। জেদ্দা এয়ারপোর্ট থেকে গরু-ভেড়ার মতো বাসে বোঝাই করে মুয়াল্লেমদের হাতে আমাদের সোপর্দ করেছে বাসওয়ালারা। মুয়াল্লেমদের হাতেই পাসপোর্ট জমা দিয়েছে। ওদের এজেন্ট এসে এসব কামড়ায় আমাদের ঢুকিয়েছে। হাজার রিয়ালও নগদ কেটে রেখেছে। মেসফালার প্রথমদিকেই আত্মীয়ের ঘর। ঘিঞ্জি গলির ফাঁক দিয়ে একটি দালানের তিন তলায় উঠলাম। তিনতলা পর্যন্ত উঠতে গিয়ে কত বাংলাদেশীর উঠানামা যে দেখলাম তা আল্লাহ মালুম। সিঁড়ির গোড়ায় থাকার জন্যে মুয়াল্লেমদের এজেন্টদের ভাড়া দিচ্ছেন! তার ঘরে পৌঁছে দেখি ছয়-সাত জন স্বদেশী ভাই। কেউ বসে আছেন, কেউ শুয়ে, কেউ বা রান্নাবান্না করছেন। কোনো মতে এক জায়গায় বসলাম। ছোট্ট রুমটিতে এহেন ঠাসাঠাসি দেখে আশ্চর্য হলাম। সবাইকে সালাম কালাম জানিয়ে একে একে পরিচয় নিতে লাগলাম। ইরানে থাকি জেনে বেশ উৎসাহের সঙ্গে হরেক রকমের খবর জানতে চাইলেন। এক সময় তাদের জিজ্ঞেস করলাম, রুমের বাসিন্দা কত? বললেন, পনেরো জন। তা বাকি লোকেরা কোথায়? থাকেনই বা কেমন করে এ রুমে? তাদের এখন হারাম শরিফে থাকার পালা। ওখানেই আছেন। আমাদের পালা আসলে আমরা ওখানে চলে যাব, আর তারা রুমে অবস্থান করবেন।
তাদের কথা শুনে আমার আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেলো। ঠিকমতো বুঝতে না পেরে প্রশ্ন করলাম। পালাবদল মানে? পনেরো জন লোক তো এ রুমে থাকতে পারবে না। তাই এ ব্যবস্থা। দিন-রাতের সময়কে ভাগ করে নিয়েছি। অবশ্য যারা যারা জয়েন্ট খাওয়া-দাওয়া করেন তাদের কেউ মসজিদের পালায় থাকলে খাওয়ার সময় এসে খেয়ে যান। কি আর করবো ভাই। হজ্জ করতে এসেছি, হজ্জ করে চলে যাবো। এই মাত্র কয়টা দিন কষ্ট না হয় সহ্য করলাম।
টয়লেট, গোসল, কাপড়-চোপড় ধোয়ার ব্যবস্থা এখানে আছে তো ঠিকমতো? টয়লেট বাথরুম বলতে এখানে কোনো কিছুই নেই। সে কাজ মসজিদুল হারামের পাশে গণটয়লেট-বাথরুমে সেরে নিতে হয়। বাথরুম টয়লেটওয়ালা ঘর নিতে গেলে পনেরোশ' রিয়ালের উপর খসে যাবে পকেট থেকে। তাতে খাওয়া-দাওয়া ও কোরবানীর টাকা-পয়সা থাকবে না।
খরচ: ইরানীদের কাফেলায় আছি বলে তারা সেখানকার থাকা-খাওয়ার অবস্থা জানতে চাইলে মোটামুটি যা জানি তা বলায় তারা যেনো বিশ্বাসই করতে পারছে না। খরচ- সব মিলে গড়পরতা সাতান্ন আটান্ন হাজার টাকা। অর্থাৎ সর্বমোট প্রায় ছয় হাজার সৌদী রিয়াল। এর মধ্যে নগদ হাতে পেয়েছি ছাব্বিশশো রিয়াল। অথচ ইরানীদের দিতে হয়েছে সাতাশ হাজার তুমান অর্থাৎ তিন হাজার সৌদী রিয়াল। এর থেকে হাতে নগদ পেয়েছি তেরোশ সৌদী রিয়াল। তবে এ দেড়শো রিয়াল হাজীদের একান্ত ব্যক্তিগত খরচ। খাবার- দাবার, বাসস্থান, ট্রান্সপোর্ট, চিকিৎসা, বীমা প্রভৃতিসহ যা যাবতীয় খরচ আছে বাকি আঠারোশ' রিয়ালের মধ্যে।
একজন হিসাব করে প্রশ্ন করলেন, এ কি করে সম্ভব? তেরশো' রিয়ালেই বা হাত খরচ হিসেবে থাকে কি করে তিন হাজার রিয়াল থেকে? তাদের বুঝিয়ে বললাম যে, মুয়াল্লেমরা যে বিরাট ভাগ বসিয়েছে আপনাদের উপর তা ওদের বেলায় হয়নি। তাছাড়া কাফেলা ভিত্তিক সব ব্যবস্থাপনা হওয়ায় এবং সরকারি ও বেসরকারি তদারকি থাকায় এদের ঘর ভাড়া, খাওয়া-দাওয়া ও অন্যান্য খরচ সীমার ভেতর থাকছে।
ইরান ও বাংলাদেশের হজ মিশনের সেবার মান ও খরচ পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে দেখলাম। সেবার পেছনে উভয় দেশের মোয়াল্লেমদের উদ্দেশ্য এবং আদর্শও অজানা রইলো না। ইরানীদের হজ্ব বিষয়ে আলোচনার পর আবার চলে আসি স্বদেশের প্রসঙ্গে। উচ্চহারে বিমান ও বাড়ি ভাড়ার টাকা বাদ দিয়ে অবশিষ্ট টাকা নেয়া হয় ট্যাক্স, ভ্যাটসহ ইত্যাদি ইত্যাদির নাম করে। যাকে এক কথায় বলা চলে 'মুলার চেয়ে ধেরা (চোকলা) ডাঙ্গর। এর পরেও প্রতি বছর যে হারে হজ্জযাত্রীর সংখ্যা বাড়ছে সে হারে বাড়তে থাকলে ট্যাক্স-ভ্যাটের পরিমাণ আরো বৃদ্ধি পেতে পারে। হাজীদের ট্যাক্স-ভ্যাটের টাকা সরকারের পেটে ঢুকতে পারলে সরকারের চেলাচামু-াসহ চুনোপুঁটিদের পেটে ঢুকতে দোষ কি? তবে সচেতন নাগরিক হিসেবে তোমার প্রতিবাদী মন এসব লুটপাটের কাজে সায় দিতে পারছে না। শরীরের নির্দিষ্ট কোনো অঙ্গে ব্যথা হলে মলম লাগানো যায়- সর্বাঙ্গে ব্যথা হলে মলম লাগানো যায় না।
মানুষের মূল্যবোধ কমতে থাকলে অপরাধ প্রবণতা বাড়তে শুরু করে। রাষ্ট্র পরিচালক কিংবা ধর্মবেত্তাগণ রাষ্ট্র ও ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে স্বীয় উদ্দেশ্য সাধন করতে শুরু করলে সাধারণ মানুষের কাছে রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় মূল্যবোধ কমে যায়। পরিবারের প্রধান ও সমাজপতিদের মূল্য থেকে বৃদ্ধি লাভ করে পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ। এ চারটির যেকোনো একটি মূল্যবোধ যার মধ্যে না আছে তাকে নিরেট বলা চলে। একজন নিরেট লোক কর্তৃক কৃত অপরাধ আর ধর্ম ও রাষ্ট্র পরিচালকের পোশাক অঙ্গে ধারণ করে কৃত অপরাধ কিন্তু এক কথা নয়। একই অপরাধ কর্মের জন্য নিরেট লোকটির শাস্তি এক বছর হলে পোশাকধারী লোকটির শাস্তি দশ বছর হওয়া আবশ্যক। প্রকৃতপক্ষে হচ্ছে এর উল্টোটা। আরো বিস্ময়ের বিষয় এই যে, নিরেট লোকটাই বারবার বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াচ্ছে আর ঘুরে ফিরে বিচার, আইন, শাসন, রাষ্ট্র ও ধর্মের পোশাকধারীগণই থাকে চালকের আসনে। বিজ্ঞ বিচারকের যেমন ‘কনটেম্পট’ পাওয়ার আছে তেমন মোল্লাদেরও ‘কনটেম্পট’ পাওয়ার রয়েছে। তুমি এসব কথা প্রকাশ করতে গেলে মোল্লাদের রিলিজিয়ন কনটেম্পট-এর বলি হয়ে ইহকালে মুরতাদ আখ্যাসহ পরকালে গোর-জানাজা থেকে বঞ্চিত হতে পারো।
এই তোমার কথাই ধরো, তুমি যা বলেছ তা যদি সত্য হয়, তবে স্বীকার করতে হবে হাজীদের নিয়ে যারা ব্যবসা করে তাদের অনেকেই বের হয়েছে হাজীদের ভেতর থেকেই। হজ্জ চলাকালে প্রায় প্রতিদিনই পত্র-পত্রিকায় হজ্জ বিষয়ে সংবাদ ছাপা হয়। হাজীদের জন্য কম টাকায় বাড়ি ভাড়া, নিম্নমানের খাবার পরিবেশন, দূষিত পানি সরবরাহ এবং নানা অজুহাতে অতিরিক্ত টাকা আদায় এসব খবরে পত্রিকার পাতা ঠাসা থাকে। হজ্জব্রতকালে হাজীদের কোরবানীর টাকাসহ কোনো কোনো কাফেলা হবু হাজীর পুরো টাকাটাই কিনা লোপাট করে দেয়। পত্রিকায় প্রকাশ, বাংলাদেশের শীর্ষ ইসলামী নেতৃবৃন্দ কর্তৃক পরিচালিত কোনো এক ‘হজ্জ কাফেলা প্রত্যেক হবুহাজীর নিকট থেকে ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা আদায় করেছিলেন। উল্লেখিত টাকার মধ্যে হজ্জকালে কোরবানীর টাকাও যুক্ত ছিল। প্রায় দু'শ হাজীর কোরবানীর টাকা দিয়ে আল্লাহর নামে কোরবান না করে পুরো টাকাটাই কিনা নিজেদের মাঝে কোরবান করে ফেলেছে। কাফেলা কর্মকর্তা গতানুগতিকভাবে আত্মসাতের বিষয়টি অস্বীকার করে আত্মপ্রশংসামূলক পাল্টা বিবৃতি দিলেও সংবাদপাঠ শেষে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে ‘ডালমে কুছ কালা হ্যায়।’
একবার পুরান ঢাকার কোন এক সুপরিচিত উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা হজ্জ শেষে দেশের মাটিতে পা রাখতে না রাখতেই তাদের মুয়াল্লিমের বিরুদ্ধে মামলা করার জন্য আমার পরামর্শ চেয়েছিলেন। তার অভিযোগ, ‘মুয়াল্লিম আত্মীয়সহ আমাদের একই পরিবারের ৭ জনকে কা'বাগৃহের ২০০ মিটারের ভেতরে আবাসিক হোটেলে রাখার কথা বলে রাখা হয়েছিল ২০০০ মিটার বাইরে। শুধু তাই নয়, গরু কোরবানির জন্য আমাদের কাছ থেকে টাকা আদায় করে শেষ মুহূর্তে জানায়, ‘শত সন্ধান করেও গরু সংগ্রহ করা গেল না। এখন ছাগল ছাড়া উপায় নেই', তখন পরিস্থিতি এমনই জটিল হয়ে উঠেছিল যে, তাদের কথার বাইরে গিয়ে বিকল্প কিছু করার ছিল না। তারপর যা হওয়ার তাই হলো। প্রথমতঃ আমাদের অগোচরে আমাদের নামের পশু কোরবানি হয়ে থাকলে কোন কথা নেই, আর না হয়ে থাকলে আমাদের হজ্জের-ফজিলতের কি হতে পারে? দ্বিতীয়তঃ পবিত্র হজের সময় নবী করিম (সা.) এর দেশে, হারাম এলাকায় দাঁড়িয়ে যারা প্রতারণামূলকভাবে হাজীদের হজ্জ বিষয়ের টাকা আত্মসাৎ করে তাদেরই বা কি শাস্তি হতে পারে?
ম্যাডামের অভিযোগ শ্রবণ করার পর আমার পরামর্শ ছিল নিম্নরূপঃ পাঁচ দিনব্যাপী হজ্জের মূল কর্মসূচীর তৃতীয় দিন অর্থাৎ ১০ই জিলহজ্জ মিনায় পৌঁছে ছোট, মেঝো ও বড় এই তিন প্রকারের শয়তানকে ৭টি করে মোট ২১ টি কংকর নিক্ষেপ করতে হয়। কংকর নিক্ষেপের পর হাজীদের জন্য কোরবানি করা আবশ্যক হয়ে পড়ে। “দিওয়ান-ই-খাজা মুঈনুদ্দিন ‘গন্থে’ ‘হজ্জের হকিকত' অধ্যায়ে উল্লেখ আছে: ‘হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর সময় থেকে কুরবানি প্রচলন হয়। কুরবানি বা উৎসর্গ ইসলামের চূড়ান্তরূপ এবং মানব জীবনের উৎকর্ষ। ইসলামের সকল শিক্ষা, আমল ও ইবাদত মানুষকে একটা কেন্দ্রবিন্দুর দিকে নিয়ে যায়; আর তা হলো আমিত্বসহ সকল প্রকার কুপ্রবৃত্তি বা ষড় রিপুকে জবাই বা কুরবানি করা। এ কুরবানির ফলে মানুষ হয় সত্যিকারের মুসলিম, আর মুসলিমের সমাজ হয় শান্তিময়, সুখময় ও পরমানন্দের, যাতে মানুষ স্বর্গ সুখ ভোগ করে। সম্ভবতঃ এ কারণে অনেক হাজীর হজ্জ ঠিক মতো হলেও আমিত্ব কুরবানি ঠিকমত হয় না।
বোখারী শরীফের ৮৮৭ নং হাদীছের বর্ণনা থেকে জানা যায়, করা ওয়াজিব। আতা (রা.) বলেছেন. 'তামাত্তো বা কেরান হজে কোরবাণী করা ওয়াজিব। -উহার গোস্ত কোরবানি দাতা খেতে পারে। আপনারা কোরবানি দিতে দেখলেন না, মাংস খেতে পারলেন না এতে সন্দেহের উদ্বেগ হতেই পারে। যথাযথভাবে এ আবশ্যকীয় ওয়াজিব কর্মটি সম্পাদিত না হলে এর ফলাফল কি হতে পারে তা একজন আইন বিশারদের চেয়ে ধর্ম বিশারদ ভাল বলতে পারবেন। আপনার হজ্জের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ সঠিক হলে আত্মসাতকারির বিচারের অবস্থাকে ‘ধর্মীয়, আইনী ও বাস্তবতা' এ তিন প্রেক্ষাপটের তুলাদন্ডে ওজন করতে পারি। ধর্মীয় আইনে হাজীদের টাকা হাজীগণ আত্মসাৎ করে এ টাকা দিয়ে হাসরের মাঠ থেকে কতটুকু জমি কিনতে পারবে এ বিষয়টি দেখার বা জানার সুযোগ নেই কারো। ধর্মের পরেই আসি আমাদের আইনের বিচারে। বাংলাদেশ দন্ডবিধি আইনে চৌর্যবৃত্তি অপরাধের চেয়ে আত্মসাৎবৃত্তি অপরাধের শাস্তি অনেক বেশি। মসজিদের জুতাচোরের যে শাস্তি প্রাপ্য তার চেয়ে অনেক বেশি শাস্তি প্রাপ্য হাজীদের টাকা আত্মসাৎকারির। হজ্জের টাকা নেয়া হয়েছিল বাংলাদেশে এবং আত্মসাতের ঘটনাটি ঘটেছে আরবের মাটিতে। সে হিসেবে উভয় দেশেই বিচার দায়ের করা যেতে পারে। আরব দেশের ইসলামী আইনে চুরির শাস্তি হাত কেটে দেয়া। সে হিসেবে আত্মসাতকারির শাস্তি হাতকর্তনসহ আরো বেশি কিছু হতে পারে।
পরিশেষে, ফিরে আসি বাস্তবে। বাস্তবে অধিকাংশ অপরাধী তিরস্কারের পরিবর্তে পুরস্কারে ভূষিত হয়ে থাকে। কখনও কখনও দেখা যায়, ধর্মের নামে যে যতো বেশি বাণিজ্য করতে পারে তার ধর্মীয় হুজুরগিরিও যেন ততো বেশি উজ্জ্বল হয়। এ বছর যারা হাজীদের হজ্জের টাকা আত্মসাৎ করেছে বাস্তবে তাদের কোন জবাবদিহিতা করতে হবে বলে মনে হয় না বরং পরবর্তী হজ্জ মৌসুমে হুজুরদের নতুন হাজীসহ- বাড়ি-গাড়ি বৃদ্ধির সাথে সাথে কোন কোন উজ্জ্বল হুজুরের হুজরায় হুজুরাইনের সংখ্যাও হু হু করে বেড়ে যেতে পারে।
আল্লাহর ঘর যিয়ারত করানোর নাম করে, যারা কোরবানীও হজ্জের টাকা আত্মসাৎ করে, যেন- তাদের কাঁধেই ভর করে চলছে ইসলাম।
তবে তোমরা বাবা গরিব মানুষ, অনেক কষ্ট করে এখানে আসতে পেরেছ। আমাদের দেশ গণন্ত্রের দেশ। গণতন্ত্রের দেশে মতামত প্রকাশের মৌলিক অধিকার রয়েছে। এ দেশ রাজতন্ত্রের দেশ। এক দেশের ‘বুলি’ আরেক দেশের ‘গালি' হয়ে পড়ে। তাই এই দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে এ সব বিষয়ে কথা বলতে যেও না। এতে শ্যাম-কুল দুই হারাতে পারো। কাকের গোস্ত কাক না খেলেও হাজীর গোস্ত কোনো কোনো হাজী খায়।
অধ্যাপক মুহম্মদ ফরিউদ্দিন খান তাঁর যিয়ারত কাহিনীর একাংশে কোনো কোনো হাজীর বিষয়ে বলতে গিয়ে একজন হাজীর সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন-
‘চারজন লোক এগিয়ে আসতে দেখে দাঁড়ালাম। দূর থেকেই চেনা চেনা মনে হচ্ছে। কাছে আসতেই দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম তাদের। মদীনা শরীফে দেখা ইমাম সাহেব ও তার সঙ্গীরা। সালাম কালামের পর পরস্পরের খবর নিলাম। তারা এক আত্মীয়ের বাসায় উঠেছে জানালেন। তবে সাবধান করে দিলেন কাউকে না জানাতে। কারণ এ বছর সৌদী সরকার নাকি হুকুম জারি করেছে রেজিস্ট্রিকৃত মুয়াল্লেম ছাড়া ব্যক্তিগতভাবে কোনো লোকই হাজীদের বাসা দিতে পারবে না। আপন মা-বাপও না। এ নির্দেশ ভঙ্গ করলে জরিমানা এবং বিদেশী হলে বহিস্কার করে দেয়া হবে! ‘কাউকে তাদের অবস্থান জানাবো না' কথা দিয়ে জিজ্ঞাস করলাম, আপনাদের পাসপোর্ট কি করেছেন? পাসপোর্ট তো মুয়াল্লেম বেটার হাতে আটকা পড়ে আছে। তার দেশের বাড়ি চিটাগাং। হাজী সলিমুদ্দিন। তাকে গিয়ে পাসপোর্ট দিতে বললে, ব্যাটা আমাদের হাইকোর্ট দেখালো। কোথায় আছি জানাতে বললো। অবশেষে কেবল আমারটাই ফেরত দেবে বলে আপাতত কথা দিয়েছে। তবে তাও হাজ্জের পর, দেশে যাওয়ার আগে। অন্যদের ব্যাপারে বললো, পাসপোর্ট প্রতি আড়াইশ রিয়াল সেলামী দিতে হবে। এ পর্যন্তই কথা। বাকি আল্লাহর ইচ্ছা। হজ্জে এসে ঘুষ দিতে হলে তা যে কতো বড় খারাপ হবে তা ভাবতেই পারছি না।'
তার যিয়ারত কাহিনী ও পত্র-পত্রিকা থেকে এসব ঘটনা পাঠ করার পর আমার নিজের ব্যবসায়ের কথা মনে পড়ে। আমার চেয়ে অনেক বুদ্ধিমান লোক থাকার পরেও তাদের কাছে কেউ পয়সা দিয়ে বুদ্ধি কিনতে যায় না- আমার মতো লোকের কাছেই আসে পয়সা খরচ করে বুদ্ধি খরিদ করতে। কারণ, আমাদের বুদ্ধি বিক্রির সদনপত্র রয়েছে। আমরা যেভাবে বুদ্ধির সনদটাকে ব্যবসায়ের হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগাই- কোনো কোনো ওলামা-আলীম ও মোল্লা-মুন্সি ধর্মটাকেও ব্যবসায়ের হাতিয়ার হিসেবে সেভাবেই কাজে লাগায়। বাইরে থাকা খাওয়ার কারণে যে মোয়াল্লেম পাসপোর্ট আটক রেখে- আড়াইশ রিয়াল আদায় করতে পারে, তার দিকে তাকিয়ে কারো ঘৃণা ছাড়া শ্রদ্ধা জাগতে পারে না কিছুতেই।
হোটেলে দেশি ছেলেদের সাথে কথাবার্তা বলে পথে বের হই। হাঁটতে হাঁটতে মান্নান বলে-
ভাই আপনারা যে এলাকায় হোটেল নিয়েছেন সে এলাকার নাম গাজা এলাকা। গাজা এলাকায় ভালো বাংলা খাবার পাওয়া যায় না। বাংলা খাবার পেতে হলে মেসফালাহ এলাকায় যেতে হবে। হেরেম শরীফের দক্ষিণ দিকে মেসফালাহ এলাকা।
পরদিন বিকেলে আমি ও হামিদ ভাই মেসফালাহ রওয়ানা হই। মেসফালাহ এলাকার দেশি খাবারের খবর সামসু ভাই দিয়েছে। সামসু ভাইয়ের দেওয়া খবর পেয়ে হামিদ ভাই অনেক আগেই মেসফালাহ এলাকা থেকে খাবার আনতে শুরু করে দিয়েছিল। আছরের নামায আদায় করে হামিদ ভাইকে নিয়ে মেসফালায় প্রবেশ করি। মেসফালায় প্রবেশ করে মনে হলো ঢাকা শহরের নাজিমউদ্দিন রোডের খাদ্য-খাবারের মাঝখান দিয়ে হাঁটছি। বাংলায় লেখা অনেক সাইনবোর্ডে ‘চিটাগাং হোটেল' ও 'ঢাকা হোটেল' এর নামও রয়েছে। এ দুটি হোটেলে লোকের প্রচুর ভীড় দেখলাম। তা ছাড়া এ এলাকার বিপুল পরিমাণ জনসাধারণের অধিকাংশই বাঙালি। হোটেল কর্মচারিদের সবাই বাংলাদেশী। আশেপাশে রয়েছে অনেক হোটেল ও বাংলা খাবার। মেসফালায় ঢাকার মতোই গ্রিল চিকেন, টিক্কা করাব, ঝাল ফ্রাই, মোঘলাই পরোটা, নানরুটি ছাড়াও বাসমতি চালের ভাত থেকে শুরু করে চিংড়ি, করলাসহ সকল রকমের খাবার সুলভে পাওয়া যায়। বলতে গেলে সেখানে বাংলাদশী খাদ্যদ্রব্যের কোনো কিছুরই অভাব নেই। এখানে আর একটি মজার ব্যাপার হলো- বাংলাদেশে যখন ডালের দাম পাঁচ সিকি ছিল, তখন মেসফালার বাংলা হোটেলে ডাল ফ্রি করা হয়েছিল যা বর্তমানের পাঁচকুড়ি টাকা দামের সময়ও অপরিবর্তিত রয়েছে। মেসফালায় এখনও অপরাপর তরকারির সাথে ডাল ফ্রি।
২২ রিয়েল দিয়ে আমরা আমাদের মনের মতো খাবার নিয়ে হোটেলের পথে রওয়ানা হই। আমরা যখন মেসফালাহ এলাকা থেকে বের হই তখন মাগরিবের নামায শেষ হয়েছিল। খাবার নিয়ে আমাদের কা'বার মাঠ পার হয়ে গাজা এলাকায় যেতে হবে। মাগরেবের পর নামাযিরা বের হওয়ার সময় ভেতর থেকে বাইরের দিকে তীব্র জনস্রোত থাকে। জনস্রোতের উল্টো দিক থেকে ভেতরে প্রবেশ করার সাধ্য কারো নেই। প্রায় ত্রিশ মিনিট পর্যন্ত রাস্তার এক পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে গিয়েও চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে পড়ার উপক্রম হয়েছিল। এ কয়দিন মনে করতাম গাজা এলাকা অধিক জনবহুল, এখন বুঝতে পারি, সবচেয়ে জনবহুল এলাকা হলো মেসফালাহ এলাকা। যানবাহন খানাপিনাসহ সব রকমের সুযোগ সুবিধা রয়েছে মেসফালাহ এলাকায়ই। তাই পুরানো ও অভিজ্ঞ হাজীগণ সবাই মেসফালাহ এলাকার সাথে সুপরিচিত এবং সবাই মেসফালাহ এলাকাকে বেশি পছন্দ করে।
পলিথিন ব্যাগে করে মেসফালার খাবার গাজা এলাকার হোটেলে এনে ফ্লোরের উপর ছোবড়া বিছিয়ে দু'জন ছোবড়ার দুদিকে বসে পুরানো শ্বশুর বাড়ির মতো গ্রামবাংলার অতি পরিচিত আভিজাত্যহীন খাবার খেতে বসে যাই। মুখ ভরে খাবার খেতে খেতে গিন্নীর সোহাগী কণ্ঠস্বর-
দেখুন তো কতো ভালো ভালো খাবার। এতো ভালো ভালো খাবার থাকতে এই কয়টা দিন কি কষ্টই না করেছি।
- মজার পেছনে সাজাও আছে।
সাজা আবার কিসের?
রোজা রমজানের শেষ বিকেলে কাঠফাঁটা রোদের ভেতর দিয়ে কা'বা মাঠের দক্ষিণে আসা-যাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়।
তারপরেও পাওয়া গেলো। ঠিক যেনো নিজের জমির করল্লা দিয়ে মেঘনা নদীর চিংড়ি মাছ খাচ্ছি। সাথে রয়েছে কেমিক্যালমুক্ত বাসমতি চালের ভাত।
- চালটা মনে হয় পাকিস্তানী। পাকিস্তানের বাসমতি চাল বিশ্ব বিখ্যাত। পাকিস্তানী বাসমতি চালে লন্ডনের বাজার ভর্তি। ভারতেও প্রচুর বাসমতি চাল হয়। তবে বিলেতী বাঙালির পছন্দ পাকিস্তানী বাসমতি। আমার ধারণা, পাকিস্তানী বাসমতি সবার পছন্দ বলে ব্যবসায়িদের হাতে এসে সব দেশের বাসমতি চালই পাকিস্তানী হয়ে যায়। লন্ডনের দোকানে ইংরেজিতে ‘বাসমতি ও ব্রোকেন বাসমতি, মেইড ইন পাকিস্তান' লেখা রয়েছে।
থাক্ থাক্ কা'বা এলাকায় বসে বিলেতের ব্যবসায়িদের নামে গীবত করা ঠিক হবে না।
গীবত করা ঠিক নয় কোনো খানেই। ঝালকে ঝাল বলা, টককে টক বলা ও চোরকে চোর বলা গীবতের মধ্যে পড়ে না। একজন প্রতারক ‘হালাল শপ' সাইনবোর্ড টানিয়ে সরল মানুষের সাথে বে-হালালী কাজ করা, তা ধরিয়ে দেওয়া বা প্রকাশ করা যদি গীবত হয়, তবে এসব দেখে মুখ বুজে থাকাও
অন্যায় ও অপরাধ।
- উকিল-মোক্তার ও দারোগা-পুলিশরা অপরাধ আর নিরাপরাধ ছাড়া কিছু চোখে দেখে না। দারোগা পুলিশ দেখে দুনিয়াটা চোর বাটপারে ভরে উঠেছে- আর উকিল মোক্তারগণ দেখে সবকিছু সম্পূর্ণ নির্দোষ। উকিলদের খরচপত্র ঠিকমতো চালিয়ে যেতে পারলে সাত খুনের খুনীও সম্পূর্ণ নির্দোষ হয়ে যায়। - তোমার এ অভিযোগ পুরাপুরি সত্য নয়। কারো কারো মাঝে এ রকম দোষ থাকলেও সে দোষের জন্য তার স্ত্রী পরিবারও দায়ী।
- স্বামীর অপরাধের দায় স্ত্রী পরিবার নিতে যাবে কেন?
- নিতে যাবে এ কারণে যে, ‘নগরে আগুন লাগলে দেবালয় এড়ায় না’ এই ফতোয়ার আলোকে।
- চাপার জোরে পুঁথিপাঠ চলে না। স্বামীর কাছ থেকে খাবার আদায় করা স্ত্রীর কোরআনিক হক। স্বামী কোনখান থেকে কিভাবে খাবার সংগ্রহ করে তার দায়ভার স্ত্রী নিতে যাবে কেন?
- দায়ভার নিতে যাবে নয়- বহন করতে বাধ্য হবে। তবে তা সব স্ত্রীদের ক্ষেত্রে নয়। দায়ভার বহন করতে বাধ্য হবে তাদের- যাদের স্বামীরা দশ হাজার টাকা মাইনে পেয়ে প্রতি মাসে ত্রিশ হাজার টাকা খরচ করার পরেও স্ত্রীর একাউন্টে লক্ষ লক্ষ টাকা জমা রাখে। আর স্ত্রী সবকিছু জেনেও না জানার ভান করে সে টাকা ব্যবহার করে। আর যেসব স্ত্রী স্বামীর সামর্থ্যের বাইরে অন্যায় আব্দার-অভিলাস করে দাম্পত্য জীবন বিষিয়ে তোলে। স্বামীকে অন্যায় উপার্জনে নামতে বাধ্য করা স্ত্রীদের অবশ্যই স্বামীর অপকর্মের দায়ে দায়ী হতে হবে।
- আমি কি তেমন স্ত্রী?
- মহিলাদের ভোগ-বিলাস যে স্তর থেকে শুরু তুমি সে স্তরের মহিলাদের সাথে পরিচিত নও। পরিচিতির পর বুঝতে পারতাম তুমি তেমন রকম স্ত্রী কি-না।
- সে স্তরের মহিলা কারা?
- ওদের পরিচয় ও জগতটা জানা না থাকাই ভালো।
নানা রকমের খোশালাপের ভেতর দিয়ে বাঙালি আহার পর্ব শেষ হয়। বাঙালি আহারের সন্ধান লাভের পর মক্কার বাকি দিনগুলোয় খানাপিনা নিয়ে আর কোনো সমস্যা হয় নি।
মদিনায় থাকে আবদুল আলী ও কাউসার। তাদের একজন আমার ভাগিনা আর অপরজন ভাগিনাপুত্র। আমরা ওমরা করতে আরব দেশে আসছি শুনে তারা খুব খুশি। দেশে থাকা কালে তারা প্রতিরাতে ফোন করতো। ফোন করে আমাদের ওমরাহ-এর তফসিল জানতে চাইতো। তফসিল প্রাপ্তির পর জানিয়ে দিয়েছি, আমরা ঈদের নামায আদায় করেই মদিনা রওয়ানা হয়ে যাবো। ঈদের নামায ফজরের নামাযের পর পরই আদায় হয়ে গেছে। মক্কা থেকে মদিনা বাস যোগে বড়জোর চার ঘণ্টার পথ। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে বেলা বারোটার মধ্যেই মদিনা পৌঁছে যাওয়ার কথা। তাই তারা দু'জন দুপুরের আগেই নিজেদের হাতে আমাদের পছন্দমতো কয়েক প্রকারের খাবার পাক করে রাখে। যার মধ্যে মাংস, ইলিশ মাছের ফ্রাই, পাবদা মাছের ঝোলসহ নানা প্রকারের দেশি খাবারও ছিল। পাক-শাক শেষ করে আমাদের জন্য অপেক্ষা করতে শুরু করে।
রাস্তায় গাড়ি বিপত্তির কারণে দিন বারোটার স্থলে রাত দুটায় মদিনা পৌঁছতে পারি। দুপুরের রান্না করা খাবার নষ্ট হওয়ার আশংকায় তাদের পরিচিত জনের মধ্যে বিলিবণ্টন করে খেয়ে ফেলে। আবার নতুন করে আমাদের পছন্দ মোতাবেক দু প্রকারের সবজি, চিংড়ি মাছের করলা, খাসির মাংস, টমেটো দিয়ে ডাল, কেচকি মাছের দোপিয়াজো রেঁধে রাখে। কাউসার আমাদের বাস থেকে নামিয়ে হোটেলে নিয়ে যায়। ভাগিনা আবদুল আলী বারো বছরের অধিক কাল থেকে মদিনায় আছে। মাথার সব চুলে পাক ধরে গেছে। মাথার দিকে তাকিয়ে-
- কিরে আমি তোর মামা, না তুই আমার মামা?
বিমর্ষ ও নিরোত্তর আবদুল আলী আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই আমাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে।
ঠিক এ মুহূর্তে ওর কাছ থেকে এ কান্না আশা করছিলাম না। সৃষ্টির ‘চিন্তা’ ছক বেঁধে চলে। স্রষ্টার কর্মও ছক বেঁধে চলে। দু'জনের ছকবাঁধা চিন্তা ও কর্ম চলতে গিয়ে, কর্ম লক্ষ্যে অবিচল থাকলেও চিন্তা আহত পাখির মতো পথের ধুলায় লুটিয়ে পড়ে। স্কুল জীবনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘পোস্টমাস্টার' গল্পের রতনের চরিত্র মুখস্ত করতে গিয়ে ‘বিয়োগান্তক’ শব্দটার সাথে পরিচিত হই। পরবর্তীতে কলেজ জীবনে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'কমলাকান্তের দপ্তর' পড়তে পরিচিত হই 'হাস্যরস' বা কমেডি' শব্দটির সাথে। তখন বুঝতাম পরস্পর বিপরীতধর্মী এ দুটি শব্দের অবস্থান দুই মেরুতে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে প্রবেশ করে বুঝতে পারি শব্দ দুটি একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। একটা সীমা পার হলেই আরেকটা শুরু হয়। ঠিক যেমন, সুখের পরে দুঃখ, রাতের পরে দিন, উত্থানের পরে পতন এবং হাসির পরে কান্নার মতো একটার পর একটা আসতেই থাকবে। বহু বছর পর বিদেশের মাটিতে একান্ত আপনজনকে কাছে পেলে কার না আনন্দ হয়! শোকের বহিঃপ্রকাশ কান্না, আবার অন্তহীন আনন্দের বহিঃপ্রকাশও কান্নার দ্বারাই হয়ে থাকে। বয়স শৈশবের বালখিল্যতা পেড়িয়ে যতোই পরিণতের দিকে যাচ্ছে, আমার এসব তাত্ত্বিক চিন্তা ততোই পরিষ্কার হয়ে উঠছিল। আমার এই তাত্ত্বিক চিন্তার ফর্মায় ফেলে ভাগিনা এ কান্না 'শোকের নয় বরং সুখের' বুঝে ওঠার আগে-
- মামা, শুনলাম ওরাও কিনা ভাইয়ের নামে আগুনের মামলা করেছে?
আমার তাত্ত্বিক চিন্তার ফর্মুলার জাল ঝরঝর করে ছিঁড়ে গেল। মনে পড়লো ভাগিনাদের বাড়ির একান্ত ব্যক্তিগত ও পারিবারিক ঘটনার কথা। বিদেশ অবস্থান কালে দেশের আত্মীয়-স্বজনদের সাথে বিরহ-মিলন, আনন্দ- বেদনা, মান-অভিমান ও হিংসা-বিদ্বেষ বিষয়ে অসংখ্য বাষ্প নিঃসঙ্গতার শীতল ছোঁয়ায় বরফের মতো প্রবাসির বুকে জমাট বেঁধে থাকে। হঠাৎ করে অতি নিকট আত্মীয়ের কাউকে কাছে পেলে মিলনের উষ্ণতায় বুকের জমাট বাঁধা বরফ গলে চোখের ঝর্ণা বেয়ে বের হতে শুরু করে। ভাগিনার কান্নার কারণটা এখানেই। ভাগিনার ধারণা, তার একমাত্র মামার হাতে যে লাঠি রয়েছে— সে লাঠি দিয়ে একটা টিকটিকিও মারা চলবে না- চলবে না শত্রুর হাত থেকে আত্মরক্ষা করাও। মামা নিজের লাঠির জোর সম্পর্কে টের পেয়ে গেছে বহু দিন আগেই। তাই লাঠির জোরের আশা বাদ দিয়ে হাতে কলম তুলে নিয়েছেন। ভাগিনার ধারণা, মামার কলমে অনেক ধার। তাই বহু বছর পর মামা-ভাগিনার প্রথম দর্শনেই- ভাগিনাদের একান্ত পারিবারিক ঘটনায় মামার ধারালো কলম কতোদূর কাটতে পেরেছে চোখের জলে জানতে চায় ভাগিনা। ভাগিনাকে সান্তনা দিতে মামার ব্যর্থতা ভরা জবাব-
কিছুই করতে পারছি না রে বাবা, কিছুই করতে পারছি না। আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা ঠিক আলাদিনের চেরাগবাতির ইচ্ছাপূরণ দৈত্যের মতো। চেরাগবাতি যখন যার হাতে থাকবে ইচ্ছাপূরণ দৈত্য তখন তার নিয়ন্ত্রণে থাকবে। আইন, শাসন, বিচার ও প্রশাসন কেউ চেরাগবাতির বেষ্টনীর বাইরে বের হতে পারে না- পারবেও না কোনোদিন। এদের বিপরীত স্রোতের উল্টোদিকে সাঁতার কাটা কি যে কষ্ট- তা ভুক্তভোগী ছাড়া আর কেউ টের পায় না। আমাদের দুর্বল শরীর এখন স্রোতের প্রতিকূলে সাঁতার কাটছে। শরীরের সকল শক্তি খরচ করে তিল তিল করে এগুচ্ছি। সত্য-মিথ্যার লড়াই চলছে। মাঝখানের সাময়িক উত্থান-পতন দিয়ে জয়-পরাজয় নিশ্চিত হয় না। চূড়ান্ত ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করতে হয় দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, এমনকি শতাব্দীর পর শতাব্দী। নিয়তির পাতায় তাই লেখা রয়েছে। নিয়তির রায়ের কাছে সাধারণ মানুষতো তুচ্ছাতিতুচ্ছ। স্বেচ্ছাচার উমাইয়া, ভোগ বিলাসী আব্বাসীয়, পরাক্রমশালী অটোমান, জগজ্জয়ী মোঘল, নিষ্ঠুর হালাকু খান ও নির্মম নাদির শাহ এ রকম হাজার হাজার শক্তি নিশ্চিহ্ন হয়েছে নিয়তির নির্মম বিচারে। নিয়তির বিচারের নির্মম রায় থেকে কেউ রেহাই পায়নি। বিশ হাজার লোক দিয়ে বাইশ বছরে বিশ্বের বিস্ময়কর স্থাপত্য শিল্প আগ্রার তাজমহল নির্মাতা সম্রাট শাহজানের বর্তমান প্রজন্ম এখন অজ্ঞাত পরিচয়ে অন্যের সাহায্যে বেঁচে রয়েছে। তাই সব কথার সার কথা, নিয়তির নির্মম রায় থেকে কেউ রেহাই পায় না।
ভাগিনার সাথে প্রথম মিলনের আনন্দ-বেদনার যবনিকাপাতের পর বাথরুমে প্রবেশ করি।
ফ্রেশ হয়ে আসতে না আসতেই দেখি গাঁও-গেরামের মিলাদের মোল্লা- মুন্সিদের খানাপিনার আসরের মতো খাবার সামগ্রী ঘিরে সবাই বসে রয়েছে। গতকাল মক্কার মাঠে একসাথে ফজর ও ঈদের নামায আদায় করেছি। উভয় নামাযের মাঝখানে মাত্র পনের মিনিট বিরতি ছিল। বিরতির সময় নামাযিদের মাঝে কেউ কেউ ঈদের মিষ্টি, খুরমা-খেজুর ও ফলের জুস বিলিয়েছিল। সকালের তিন চারটি খুরমা-খেজুর, জমজমের কয়েক গ্লাস পানি, ফলের জুস, পথে কেনা কিছু চিপস ছাড়া টানা সতের ঘণ্টা আর কোনো দানাপানি পেটে পরেনি। প্রচন্ড ক্ষিধের সময় টেলিফোন যোগে রাত আটটায় খাবারের মেন্যু জানিয়ে দিয়েছি। পেটের নাড়ি-ভূড়ি হজম করা ক্ষুধার সময় কবি সুকান্তের নিকট যেমন করে পূর্ণিমার চাঁদ ঝলসানো রুটি হয়ে যায় তেমন করে সেদিনের চিংড়ি মাছের করল্লা, বাইন (পাঁকাল) মাছের দো-পিঁয়াজো এবং টমেটো ডালের স্বাদ ফাইভ স্টার হোটেলের বুফে খাবারের স্বাদকে পেছনে ফেলে দিয়েছিল।
পরবর্তী যে কয়দিন ছিলাম সে কয়দিনের মধ্যে একদিন এরাবিয়ান খবুজ অন্যদিন এরাবিয়ান কাচ্চি বিরিয়ানী ছাড়া সব সময় দেশিয় খাবার খেয়েছি। তাও হোটেলের খাবার নয়- ভাগিনা আবদুল আলীর পরামর্শে ও নাতী কাউসারের নিজ হাতে পাক করা খাঁটি বাঙালি খাবার। যার মধ্যে পাবদা মাছের ঝোল সবার কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। শেষ দিন বাঙালি খাবার খেতে বসে নাতী কাউসারকে উদ্দেশ্য করে হাসতে হাসতে বলি-
- নাতীরে নাতী, তোর হাতের পাঁকাল মাছের পাক খেয়ে বেবাক মাথা ঘুরপাক শুরু করে দিয়েছে। তুই নাতী না হয়ে নাত্নী হলে তোর পাঁকাল পাকে নাকালসহ ঘোরপাঁকে পঙ্কিল হয়ে কবির সুরে সুর মিলিয়ে বলে ওঠতাম- মায়ের আসন হয়কি পূরণ বউ শাশুড়ি শালিকায়?
মালঞ্চ পায়কি শোভা তিন ফুলের ঐ মালিকায়?
চাচী বলো মাসী বলো
মায়ের মতো নয়,
পিঠা বলো চিড়া বলো
ভাতের মতো নয়।
বিনে স্বদেশী ভাষা মেটে কি আশা
বিনে স্বদেশী খাবার মেটেকি আহার।
লেখক : আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক
০৬ জানুয়ারি ২০২৫