Advertisement

জয়নুল আবেদীন


প্রকাশিত: ২১:১১, ১৫ জানুয়ারি ২০২৫

আপডেট: ২১:১৩, ১৫ জানুয়ারি ২০২৫

প্রবন্ধ

স্মরণীয় জার্নি : মক্কা টু মদিনা

স্মরণীয় জার্নি : মক্কা টু মদিনা
ছবি: সবার দেশ

(১ম পর্ব)

আজ মক্কা থেকে মদিনা যাবো। সকাল সাতটায় ঈদের নামায আদায় শেষ করে প্রস্তুত হয়ে বসে আছি। লাগেজ গোছগাছ করে রেখেছিলাম রাতেই। কথা ছিল, দুপুরের খাবার খাবো মদিনায়। শুধু দুপুরের খাবার কেন! ভলভো পরিবহন যোগে মদিনা পৌঁছে ব্রেকফাস্ট করার চিন্তাও মাথায় ঢুকিয়ে রেখেছি। মাত্র ৪২৭ কিলোমিটার দূরত্ব। শক্তিশালী ইঞ্জিনযুক্ত ভলভো পরিবহন যোগে তিন/চার ঘণ্টার পথ। ঈদের দিনে আমাদের পছন্দের মেন্যু কি এবং আমরা কয়টায় বাসে উঠবো তা জানানোর জন্য মদিনা থেকে বারবার টেলিফোন আসছে। ব্রেকফাস্ট মদিনায় করবো এই চিন্তা মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়ার কারণ ছিল তিনটি।

প্রথম কারণ, মক্কায় ব্রেকফাস্ট না করে মদিনা গেলে বেশি করে ক্ষিদে পাবে। বেশি করে ক্ষিদে লাগিয়ে খেলে খাওয়ার পূর্ণাঙ্গ স্বাদ পাওয়া যায়।
দ্বিতীয় কারণ, আর্থিক সাশ্রয়। দু'জন লোক মনের মতো নাস্তা করতে গেলে পকেট থেকে কমসেকম শ পাঁচেক টাকা বের হয়ে যাবে। একটু ধৈর্য্য ধরতে পারলেই টাকাটা পকেটেই থেকে যায়।
তৃতীয় কারণ, ঈদের দিন হোটেলের কেনা খাবার খেলে ঈদের মজা থাকে না। প্রতি বছর দুটি করে ঈদ গণনা করলেও এ বয়সে উৎযাপন করেছি শতাধিক ঈদ। প্রত্যেক ঈদের দিন সবাইকে টানাটানি করে খাইয়েছি কিংবা টানাটানিতে অন্যের ঘরে খেয়েছি। এর মধ্যে মাত্র দুটি ঈদ ছিল ব্যতিক্রম। যার মধ্যে একটি ঈদ উৎসব উৎযাপন করেছিলাম নেপালের পোখারায়। পোখারার ঈদটাকে উৎযাপন না বলে উপলব্ধি বা অভিজ্ঞতা বললে ভালো হবে। কারণ, নেপালে মাত্র দুই পার্সেন্ট মুসলমান। সারা দেশে ঈদের জামায়েত হয় হাতেগোনা কয়েকটা। সেখানে সারাদিন রাস্তায় হাঁটলেও সালাম-কালাম বিনিময়ের জন্য একজন মুসলমান পাওয়া যায় না। পুলিশ পরিবেষ্টিত হয়ে ঈদের নামায আদায় করতে হয়। তাই ঈদের দিন সেখানে সেমাই-শিল্পী দূরের কথা- খানাপিনা নিয়ে টানাটানি করার লোকটাও পাওয়া যায় না।

দেশে জীবন থেকে আরো একটা ঈদের দিন মিসিং হয়ে গেছে শুভংকরের ফাঁকে। ২০০৪ সালে ঈদের নামায আদায় করে রাতের ফ্লাইটে মালয়েশিয়া যাবো বলে অগ্রিম টিকিট বুকিং করে রেখেছিলাম। প্রথম দিন চাঁদ না দেখায় ঈদ এক দিন পিছিয়ে যায়। বিমানের বুকিং এক দিন পিছাতে না পারায় মালয়েশিয়ায় ঈদের নামায আদায় করার ইচ্ছা করে টুপি পাঞ্জাবী সাথে নিয়ে নিই। বিমান থেকে সেপাং বিমান বন্দরে নেমে জানতে পারি তারা আগের দিন ঈদ পালন করে ফেলেছে। এ দুটি ঈদের দিন ছাড়া আর কোনো ঈদের দিনেই কেনাকাটা করে ঈদের খাবার খাইনি। আমরা দুপুরের খাবার মদিনা গিয়ে খাবো এই প্রত্যাশায় বাসের টিকেটের আশায় বসে রই। সকাল আটটার দিকে গাইড সামসু ভাই আসে। তার নিকট থেকে জানা যায়, অনেক কষ্টে টিকেট পাওয়া গেছে। ভলভো গাড়ির টিকেট। তবে ভিড়ের কারণে ভলভো মক্কা নগরীর ভেতরে ঢুকবে না। তাদের লাইনেরই ছোট গাড়িতে করে ছেবকো এলাকায় ভলভোর ডিপোতে নিয়ে যাবে। তা করতে হলে এখুনি রওয়ানা দিতে হবে।

এ কথা শুনে ভ্রমণের প্রাথমিক আনন্দটাই মাটি হয়ে গেলো। কারণ ছোট- বড় গোটা পাঁচেক লাগেজসহ দুটি ‘ম্যাডাম' নিয়ে দুবার করে গাড়িতে ওঠানো নামানো চাট্টিখানি কথা নয়। বিশেষ করে জনবহুল শহরে গাঁও-গেরামের একেকটা ম্যাডাম একেকটা ঢাউস আকারের লাগেজের চেয়েও সমস্যাসঙ্কুল। তাই বিষণ্ণ বদনে সকাল সাড়ে আট ঘটিকায় হোটেল থেকে বের হয়ে লাগেজ টানতে টানতে রাস্তায় নেমে আসি। রাস্তার বাম পাশে ক্যাবের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকি। রাস্তার পাশে দাঁড়াতে গিয়েও বারবার ভুল করে ফেলি। কারণ, ওদের বই-পুস্তকের মতোই রাস্তার নিয়ম-কানুনও আমাদের বিপরীত। ওদের গাড়িগুলো শুধু রাস্তার ডান দিক দিয়েই চলে না, ড্রাইভারগণও বসেন গাড়ির বাম পাশে। তাই রাস্তা পারাপার হতে গিয়ে প্রতিবারই ধোঁকা খাই এবং ভুল করে ফেলি। দুটি ক্যাবে করে মালামালসহ বাসস্টেশন এসে হাজির হই। হারাম শরীফের দক্ষিণ দিকে মেসফালাহর খাবারের দোকান। খাবারের দোকানের পরে বহুতল বিশিষ্ট বেশ কয়েকটা হোটেল। মক্কার সবচেয়ে উঁচু বিল্ডিং জমজম টাওয়ারও এখানেই। জমজম টাওয়ারের আরেক নাম মক্কা টাওয়ার। জমজম টাওয়ারের দক্ষিণে হোটেল দারুল তৌহিদ ও হোটেল হিলটন। ছোট-বড়সহ কয়েকটি তারকা চিহ্নিত হোটেল ও শপিং কমপ্লেক্স মিলে অত্র এলাকা ঢাকার মতিঝিলের বাণিজ্যিক এলাকার মতো জমজমাট। হোটেল দারুল তৌহিদ ও হোটেল হিলটনের মাঝামাঝি বাসস্টেশন। বাসস্টেশন এসে দেখি মানুষ আর মানুষ। এতো মানুষের জন্য যেখানে একসাথে ৫/৭ টি বাস প্রয়োজন সেখানে মাত্র দুটো বাস দরজা লক করা অবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম ঘণ্টা খানেক পরে বাস ছাড়বে। এর মধ্যে যাত্রীর সংখ্যা বেড়েই চলছে।

সূর্য যতোই মাথার উপর উঠছে তাপ ততোই বেড়ে চলছে। স্টেশনে যাত্রী ছাউনী না থাকায় আমরা রাস্তার দক্ষিণ পাশের বহুতল ভবনের ছায়ায় কার্টনের কাগজ পেতে বসে পড়ি। সূর্য উপরে ওঠার সাথে সাথে ভবনের ছায়া ছোট হয়ে রোদ বড় হতে থাকে। রোদ বড় হয়ে আমাদের ওপরে চলে আসছে দেখে আমরা বারবার পিছিয়ে বসতে থাকি। এভাবে আসন পিছাতে পিছাতে দোকান পাটের দোরগোড়ায় চলে এসেছি। ছায়া বিহীন রোদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কাস্টমারের ভান করে একটি বইয়ের দোকানে ঢুকে পড়ি। বই ঘাটাঘাটি করতে গিয়ে কিনে ফেলি বেশ কয়েকটি বই। মক্কা আসার পরপরই মক্কার ইতিহাস ও গাইড জাতীয় বই খুঁজতে শুরু করেছিলাম। কারো কাছ থেকে সঠিক সন্ধান না পেয়ে শবে-কদরের রাতে নিজেই বের হয়ে পড়েছিলাম। গাজা এলাকার পশ্চিম দিকের সমস্ত মার্কেট ঘুরেও কাঙ্ক্ষিত বই পাই নি। বই খুঁজতে গিয়ে নামাযের জামায়েত পাইনি। গাজা এলাকার পশ্চিম দিকের মার্কেটে গোটা পনের লাইব্রেরির সব কয়টিতেই কোরআনসহ শুধু ধর্ম-কর্ম, দোয়া-দরুদ, হাদিস-দলিল জাতীয় পুস্তকে ঠাসা। এতগুলো লাইব্রেরি তালাশ করে কাঙ্ক্ষিত বই না পেয়ে ভাবলাম, এদেশের মানুষের ধর্ম-কর্ম বিষয়ক বইয়ের বাইরে ইতিহাস ভূগোলের দরকারটা কি? দেশটা ভেসে রয়েছে তেলের উপর। পায়ের উপর পা রেখে কয়েক পুরুষ বসে খেলেও তেল ফুরাবে না। 

কিন্তু তাদের কালচারটা আমাদের ছা-পোষা গরিব দেশেও ঢুকে পড়েছে। শুনা যায়, আমাদের দেশের মাদ্রাসাগুলোতেও পত্রিকা পাঠ, টেলিভিশন দর্শন ও রেডিও শ্রবণ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তারা ১৬ ডিসেম্বর ও ২১ ফেব্রুয়ারির মর্ম জানে না। দেশে কওমি মাদ্রাসার সংখ্যা দশ হাজার। কওমি মাদ্রাসা ছাড়া অপরাপর মাদ্রাসার সংখ্যা সব মিলে কম-বেশি আরো দশ হাজার। কোনো কোনো বড় মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা আট হাজারের কাছাকাছি। এ বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর জন্য রেডিও শোনা, টিভি দেখা, সংবাদপত্র পাঠ করা, রাজনৈতিক আলোচনা নিষিদ্ধ। নিষিদ্ধ করার পেছনে যুক্তি হলো- এসব করতে গেলে মানুষের লোভ-লালসা শয়তানি প্রবৃত্তি বেড়ে যায়, মানুষ বেদাতী ও গুনাহ্র কাজ করে।

২১ ফেব্রুয়ারি, ৭ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বর ইত্যাদি দিবসের মূল্য ও মর্ম জানা না থাকার অপরাধে মাদ্রাসা পড়ুয়াদের একতরফাভাবে অপরাধী করা ঠিক হবে না। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে আধুনিক পড়ুয়াদের যদি প্রশ্ন করা হয় ১২ রবিউল আউয়াল, আখেরী চাহার সোম্বা, শবেকদর ইত্যাদি দিবসের মূল্য ও মর্ম কি? আমার ধারণা, মাদ্রাসা শিক্ষার্থীগণ ২১ ফেব্রুয়ারি সম্পর্কে যে রকম উত্তর দিতে পারে, আধুনিক শিক্ষার্থীগণও শবেকদর সম্পর্কে একই রকম উত্তর দিতে পারবে। যে মানসিকতায় মাদ্রাসা পড়ুয়াগণ আধুনিক শিক্ষার ধার ধারে না, সে একই মানসিকতায় আধুনিক পড়ুয়াগণও ধর্মীয় শিক্ষার ধার ধারে না। ফলে এক অদৃশ্য প্রাচীর একই মায়ের সন্তানকে ভিন্নমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার কারণে দুই মেরুতে মেরুকরণ করে চলছে।

ধর্ম প্রবর্তক, সর্বকালের মহাজ্ঞানী ও মহাজন হযরত মুহাম্মদ (স.) শুধু সত্য আর ন্যায় নহে- জ্ঞানেরও সমঝদার ছিলেন। জ্ঞান বিতরণের বিনিময়ে যুদ্ধবন্দী মুক্তির নিদর্শন তাঁকে ছাড়া আর কারো সময় দেখা যায়নি। জ্ঞান লাভের জন্য চীনদেশ যাওয়ার (কঠোর পরিশ্রম করা) উপদেশ দিয়ে জ্ঞানের সমঝদার হিসেবে রাসূল (স.) জ্ঞানের ভুবনে অমর হয়ে রয়েছেন। অপর দিকে আধুনিক কালের বিশ্ববিজ্ঞানী বলা হয় আইনস্টাইনকে। আইনস্টানইন ‘ধর্মহীন বিজ্ঞানকে পঙ্গু এবং বিজ্ঞানহীন ধর্মকে অন্ধ’ মর্মে ঘোষণা দিয়ে বিজ্ঞান ও ধর্মকে পরস্পরের পরিপূরক হিসেবে চিহ্নিত করে গেছেন। এখন বটতলার বৈজ্ঞানিক ও কড়ই তলার ধর্মবেত্তাগণ বিজ্ঞান বর্জিত ধর্ম ও ধর্ম বর্জিত আধুনিক বিজ্ঞানের প্রচলন করে আমাদের কোথায় নিয়ে চলেছেন তা বোধগম্য নয়। তা করতে গিয়ে বিশ্ব প্রতিযোগিতায় আরবরা টিকে থাকতে পারলেও, আমরা পারব না। কারণ আরবদের ধনের জোর আছে- বিশ্বায়ন মিছিলে টিকে থাকতে হলে আমাদের থাকতে হবে জ্ঞানের জোর।

আরব বহির্বিশ্বের কারো কাছে না গেলেও চলবে- তাদের যা আছে তার কারণে বহির্বিশ্বই তাদের কাছে এসে ধর্না দিবে। কিন্তু আমাদের দেশের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমাদের অহর্নিশি ধর্না দিতে হয় বিশ্বের দরবারে। বহির্বিশ্ব থেকে যে অর্থ আসে তা বন্ধ হয়ে গেলে আমাদের দেশ সোমালিয়া ও পাপুয়া নিউগিনির মতো হয়ে পড়বে। মাফ করবেন, মাফ্ করবেন এ কারণে যে, ভ্রমণকালে ভ্রমণ বর্ণনার খেই হারিয়ে নীতিবাক্যের খই ভাজতে শুরু করে দিয়েছিলাম।

এখানে বাসস্টেশনের পাশে বইয়ের কয়েকটি লাইব্রেরি। খুঁজতে খুঁজতে পেয়েও গেলাম আমার কাঙ্ক্ষিত বেশ কয়েকটা বই। এদিকে বাস ছাড়ার সময় সমাগত। দুটি মাত্র বাসকে ঘিরে যাত্রী কিলবিল করছে। দুটি বাসে এতো মানুষ কেমন করে যাবে! ভেবে উপায় খুঁজে পাচ্ছিলাম না। সামসু ভাইয়ের চোখেও হতাশা বাড়ছে। হতাশ চোখে আমাদের দুজনকে উদ্দেশ্য করে-
- বাসের দরজা খুলতে শুরু করলেই সবার আগে লাইনে দাঁড়িয়ে পড়বেন। ভাবীদের রাখবেন সবার সামনে। ভাবীদের ওঠার সুযোগ করে দিয়ে আপনারা দু'জন সিট নিয়ে নিবেন।
সামসু ভাইয়ের এ কথা শুনে জানতে চাই-
আপনি কি আমাদের সাথে মদিনা যাচ্ছেন না?
অবশ্যই যাচ্ছি। তবে লাগেজগুলো গাড়িতে ওঠাতে গিয়ে আমি আর সিট পাবো না।
লাগেজপত্র এখনই গাড়ির লাগেজ কেরিয়ারে ঢুকিয়ে দিন।
- এ গাড়িতে লাগেজ কেরিয়ার নেই।
- তা হলে এতো এতো লাগেজপত্র যাবে কি করে!
- আল্লাহ নিয়ে যাবে।

সবকিছুতো আল্লাই করেন। তার পরেও ইল্লাটা থাকতে হয় মানুষের। ইল্লা না থাকলে আল্লাহ নিজে নিজে কারো হতে উকিল-মোক্তার ও জজ- ব্যারিস্টারের সার্টিফিকেট ধরিয়ে দেয় না।

আমাদের সামনেই শতবর্ষের পুরানো এক জোড়া দম্পতি। সাথে ছোটবড় তিন-চারটে লাগেজ। কাত হয়ে পড়ে থাকা বড় লাগেজটি বুড়ো-বুড়ি দু'জন মিলেও সোজা করতে পারছে না। তা দেখে আমরা বলাবলি শুরু করি-
- তাদের মালামাল গাড়িতে উঠবে কিভাবে! তা ছাড়া যাত্রীদের মালামাল ঠাঁই করতেই এক গাড়ি ভরে উঠবে। মানুষ ঠাঁই নিবে কোথায়?
- এর মাঝেই জড়াজড়ি করে ঠাঁই করে নিতে হবে। আজ ঈদের দিন, অনেক সৌখিন ভ্রমণকারীও আজ মদিনা যাচ্ছে। এ দেশে কর্মরত বিদেশীরাও তিন দিনের ছুটি পেয়েছে। ঈদ ছাড়া এতো বড় ছুটি আর পাওয়া যায় না। তারাও আজ ঘুরতে বের হয়েছে। তাই লোকের এতো ভীড়। যতো ভীড়ই হোক বাঙালিদের জন্য বাসে আসন পেতে তেমন একটা সমস্যা হবে না। এই বিশ্বাসে বাংলাদেশী স্টাইলে বাসে উঠতে গিয়ে আমার সাথে এক নিগ্রোর অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে যায়। অপ্রীতিকর ঘটনার পরে বাইরের লাগেজের আশা বাদ দিয়ে বিষণ্ন মনে জান-মান নিয়ে বাসে উঠে চুপচাপ বসে রই। লাগেজসহ সামসু ভাই কখন কিভাবে গাড়িতে উঠতে পেরেছে তা আর দৃষ্টিগোচর হয়নি।

আমাদের ভলভো বাসের সাহায্যকারী বাস চলতে শুরু করেছে। আস- সাক্ক আস-সাগীর টানেল অতিক্রম করে সামনেই দ্বিতীয় রিংরোড। দ্বিতীয় রিংরোডটি উত্তর দিক থেকে এসে পূর্বদিকে অগ্রসর হয়ে কা'বা শরীফের হারাম এলাকা প্রদক্ষিণ করে আবার পশ্চিম দিকে এগুতে শুরু করেছে। আমরা এখন জাবাল-আল-কা'বা সড়কে। এখানে রাস্তার দুই পাশে মাঝারি আকারের অনেক এপার্টমেন্ট, কারপার্কিং, ওয়াটার অ্যান্ড সোয়ারেজ অথরিটির কার্যালয়সহ সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা রয়েছে। কা'বার হারাম এলাকার সীমানা থেকে শুরু হয় মক্কা আল-মদিনার প্রধান সড়ক এক্সপ্রেসওয়ে। হারাম এলাকা থেকে কিছু দূর গিয়েই তাইম এলাকা। বেলা দেড়টায় আমাদের গাড়ি তাইম বাসডিপোতে (কারো মতে হাফিল বাস ডিপোতে) পৌঁছে। ডিপোতে বেশ বড় আকারের কয়েকটি বাস দাঁড়ানো ছিল। টিকেট ক্রমিক অনুসারে আসন চিহ্নিত থাকায় সেখানে আসন পেতে আর কোনো ঝামেলাই হয়নি। হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে এসিযুক্ত ভলভো গাড়িতে উঠে বসি। 

সোয়ারেজ অথরিটির কার্যালয় ডানদিকে রেখে বামদিকে তায়সির সড়ক পথে পশ্চিম দিকে কিছুদূর পরেই তায়সির মিউনিসিপলিটি অফিস ও পাবলিক ট্রান্সপোর্ট সার্ভিস। রাস্তার দুপাশে বহুতল এপার্টমেন্টের ফাঁকে ফাঁকে নজর যায় শহর ও পাহাড়ের দিকে। আমাদের দেশে বহুতল ভবন বলতে যা বোঝায় সেরকম বহুতল ভবন এ দেশে নেই বললেই চলে। এখানে রয়েছে মাঝারি সাইজের বহু এপার্টমেন্ট ও বেশকিছু হোটেল রেস্টুরেন্ট। আর এসব কিছু আবর্তিত হচ্ছে মক্কার মধ্যমণি কা'বা শরীফকে ঘিরে। নির্ধারিত সময়ে পবিত্র হজ্জব্রত পালনসহ সারা বছরই আল্লাহর ঘর যিয়ারত করতে লক্ষ লক্ষ ধর্মপ্রাণ মুসলমান মক্কায় আসা-যাওয়া করে থাকে। তাদের ভরণ-পোষণ, আরাম- আয়েস, বিলাস-ভজনসহ ধর্মীয় অনুভূতির দিকে লক্ষ্য রেখেই সব রকমের স্থাপনা গড়ে উঠছে।

এক্সপ্রেসওয়ে সড়কটির অপর নাম মক্কা-মদিনা হার্টরিয়েল সড়ক। ‘হার্ট’ অর্থ রক্তবাহিকা নাড়ি। মক্কা-মদিনার প্রধান রক্তবাহিকা নাড়ি থেকেই প্রধান প্রধান রাস্তার এ রকম নামকরণ করা হয়েছে। সউদীর দূর পাল্লার সড়ক ও জনপথের প্রধান দুই প্রকার রাস্তার নাম এক্সপ্রেসওয়ে ও হাইওয়ে। উভয় প্রকারের মধ্যে ডিভাইডেড ও আনডিভাইডেড সড়ক রয়েছে। এক সময় মধ্য আরবের হিজাজ, নজদ, আন-আশা, দক্ষিণ আরবের হাজরামাউত, ইয়েমেন, ওমান ও উত্তর আরবের দাহনা মরু এলাকা নিয়ে বেশ কয়েকটি প্রদেশে বিভক্ত ছিল। মক্কা, মদিনা, তায়েফ ও জেদ্দা আরবের এ চারটি প্রধান শহর হিজাজের অন্তর্ভুক্ত ছিল। বর্তমানে সউদী আরবকে তাবুক, আল-জায়েফ, নর্দার্ন, মদিনা মনোয়ারা, হেল, আল-কাসিম, আশির, রিয়াদ, ইস্টার্ন ও নজদ এই কয়েকটি প্রদেশে ভাগ করা হয়েছে। মক্কা থেকে ৪টি এক্সপ্রেসওয়ে চারদিকে চলে গেছে। যার প্রথমটি মদিনায়, দ্বিতীয়টি তায়েফে, তৃতীয়টি জেদ্দায়, চতুর্থ ও আরবের সর্ব বৃহত্তর এক্সপ্রেসওয়েটি মক্কা থেকে তায়েফ ও রিয়াদ হয়ে পারস্য সাগরের পাড় দাম্মাম চলে গেছে।

আরব দেশে এক্সপ্রেস ও হাইওয়ের তুলনায় রেলওয়ে নেই বললেই চলে। এতবড় আরব জাহান জুড়ে মাত্র হাতেগোনা কয়েকটা রেলওয়ে রয়েছে। যার একটি দাম্মাম থেকে রিয়াদ ও অপরটি দাম্মাম থেকে ইস্টার্ন প্রদেশের রাজধানী হয়ে রিয়াদ চলে গেছে। তৃতীয় এবং সর্ববৃহৎ রেলওয়েটির দৈর্ঘ্য কমবেশি ৮০০ কিলোমিটার। ৮০০ কিলোমিটার রেলওয়েটি মদিনা থেকে শুরু করে মদিনা আল মনোয়ারা প্রদেশের মাঝখান দিয়ে উত্তর দিকে অগ্রসার হয় ॥ উত্তরদিকের তাবুক প্রদেশের রাজধানী হয়ে সোজা জার্মানের সীমানায় চলো গেছে। এ তিনটি লাইনের বাইরে আরব দেশে আর কোনো রেলওয়ের সন্ধান পাওয়া যায়নি।

এবার আমাদের গতিপথে ফিরে আসি। বাইবোনা ও হুজুনা এলাকার সীমানা দিয়ে সামান্য পশ্চিম দিকে এগিয়ে সোজা উত্তর দিকে চলে গেছে মক্কা- মদিনার প্রধান সঞ্চালক সড়ক বা এক্সপ্রেসওয়েটি। সামনে বামদিকে সিরাজ কাজী আইস ফ্যাক্টরি, মক্কা কমার্সিয়াল মার্কেট ও বিশ্ব বিখ্যাত উম্মুলা কোরা ইউনিভার্সিটি। সুবিশাল ভার্সিটি এলাকার পর বিখ্যাত কিং আবদুল আজিজ হাসপাতাল এলাকা। এখানে আল হুজান নামে একটি প্রধান সড়ক মক্কা-মদিনা সড়ককে অতিক্রম করে পশ্চিম দিক থেকে এসে সোজা পূর্ব দিকে চলে গেছে ৷ এখানে রয়েছে হাসপাতালের কাছাকাছি গ্যাস স্টেশন, মেডিকেল সার্ভিস, গভর্নমেন্ট ডিপার্টমেন্ট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কমিউনিটি সেন্টার। সাবকিছু মিলিয়ে মক্কার অত্র এলাকাকে ঢাকার কমার্শিয়াল এলাকার সাথে তুলনা করা চলে। মূলত এখান পর্যন্তই মক্কা শহরের শহুরে পরিবেশের সমাপ্তি। আমার ধারণা, যেখান থেকে বাস যোগে হারাম এলাকায় গিয়ে হাজীগণ নামায আদায় করতে পারে সেখান পর্যন্তই শহর। শহুরে পরিবেশ থেকে যতো দূরে যাচ্ছি ততোই বাড়ছে মরু, পাহাড়, পাথর, বালি আর বিরান ভূমি।

লক্ষ্যণীয় যে, পবিত্র মক্কা নগরীর চারপাশে রয়েছে ছোট-বড় অনোক পাহাড়। বলতে গেলে গোটা মক্কা নগরীকে ঘিরে রেখেছে পাহাড়। যো আল-সাক কয়েকটি পাহাড়ের নাম জানতে পেরেছি সে কয়টির নাম যোমানা, আস-সগীর টানেলের উপরে আবু কুবাইস পর্বত। কা'বা এলাকা থেকে উত্তর- পূর্ব দিকে জাবালে নূর বা হেরা পাহাড়, দক্ষিণ-পূর্ব দিকে সওর গিরি (পাহাড়),, দক্ষিণে তাওয়েত পাহাড় ছাড়াও মক্কা-মদিনা এক্সপ্রেস সড়কের দু'পাশে রয়েছে অসংখ্য গিরিমালা। এ রকমের ছোট-বড় বহু পাহাড় ঘিরে রেখেছে মক্কা নগরীকে। নানা আকারের পাহাড়সহ কা'বা এলাকাকে বেষ্টন করে রেখেছে তিন তিনটি রিংরোডও। রিংরোড বেষ্টিত শহর ও পাহাড় এলাকা ছেড়ে মরুময় পাহাড় এলাকায় ঢুকে পড়ে আমাদের গাড়ি ॥ মধ্যবয়সী সুদর্শন কেনিয়ান ড্রাইভারের হাতে সা সা করে ধাবমান ভলভো কয়েক কিলোমিটার যাওয়ার পর হুট করে ডানদিকের লক করা অটো দরজাটি খুলে যায়। দরজাটি খুলে গিয়ে সশব্দে আঘাতসহ গাড়ির ভেতর মরুর গরম বাতাস প্রবেশ করতে আরম্ভ করে। রাস্তার ডান পাশে গাড়ি থামিয়ে সিট থেকে ড্রাইভার উঠে আসে।

খোলা দরজাটি সজোরে টান মেরে চাপ দিয়ে পুনরায় লক করে সিটে এসে গাড়িতে স্টার্ট দেয়। কিছুদূর যেতে না যেতেই একই অবস্থা হতে শুরু করে। দড়ি-কাছি দিয়ে বাঁধাবাঁধিসহ নানা রকম কারিগরি কৌশল করেও দরজা বন্ধ রাখতে পারে না। গাড়ি স্টার্ট দিতে না দিতেই হুট করে দরজা খুলে মরুর লু হাওয়া সা সা করে গাড়িতে ঢুকতে থাকে। ‘এমতাবস্থায় ঝুঁকিপূর্ণ গাড়ি নিয়ে দূরপাল্লার যাত্রা কিছুতেই ঠিক হবে না' বলে ড্রাইভার গাড়ির গতি ঘুরিয়ে দেয়। গাড়ি পুনরায় চলে আসে ডিপোতে। লাগেজপত্র অন্য গাড়িতে উঠিয়ে একই পথে পুনরায় রওয়ানা হই মদিনার দিকে। দি ইলেকট্রিক কোম্পানি ওয়েস্টার্ন রিজিওন পার হয়ে মক্কা মেডিকেল সেন্টারের এখানে এসে ড্রাইভার পুনরায় গাড়ি থামিয়ে দেয়। দরজা খুলে পেছনে গিয়ে ইঞ্জিনের ডালা ওঠায় ফিলিং স্টেশনের এখান থেকে প্লাস্টিক কন্টেইনারে করে পানি এনে ইঞ্জিনের মাথায় ঢেলে পুনরায় গাড়ি ছাড়ে। রাস্তার দুপাশে পানি ও বৃক্ষলতাহীন সুবিশাল প্রান্তর, বিস্তীর্ণ বালুকাময় স্থান, তেলের পাম্প, পাম্প সংলগ্ন শপিং সেন্টার, মেডিকেল সার্ভিস ও কার পার্কিং ছাড়া দূরে শুধু পাহাড়, মরু বালি, পাথর ছাড়া আর কোনো কিছুই চোখে পড়ে না।

কয়েক বছর আগে পাহাড় দেখার জন্য পাহাড়-পর্বতের মাতৃভূমি নেপাল গিয়েছিলাম। আরবের পাহাড়গুলো নেপালের পাহাড়ের মতো নয়। নেপালের সুউচ্চ পাহাড় (পর্বত) গুলো শ্বেত বরফে আচ্ছাদিত এবং মাঝারি ও ছোট ছোট পাহাড় ঢেকে রয়েছে সবুজে-শ্যামলে। পাহাড়ের ঢালে, খাদে ও উপরে রয়েছে সবুজ বৃক্ষলতা আর ভেতরে রয়েছে রসগোল্লার মতো টটসে রস। কোথাও কোথাও ফাঁটল ও ছিদ্র পথে সুস্বাদু রস (পানির নহর) তীব্রবেগে বাইরে চলে আসছে। রয়েছে পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে বাড়িঘর, সবুজ ফসল, আঁকাবাঁকা মেঠো পথ আর রয়েছে পাহাড়-পর্বত থেকে নেমে আসা খরস্রোতা নদী। পর্বতহীন আরবের বৃক্ষলতাহীন পাহাড়ের কোথাও বাড়িঘরের চিহ্নটুকুও নেই, নেই ফল-ফসলাদিও। 

আরবের তামাটে বর্ণের পাহাড়গুলো ঝুনো নারিকেলের মতো। এখানে কঠিন পাহাড়ের কোথাও পানির নাম-গন্ধও নেই। সমভূমিতে বিছিয়ে রয়েছে পাথরের চাকলা। মাঝে মাঝে শা করে ছুটে আসে উত্তপ্ত মরুভূমির লু হাওয়া। আমাদের দেশে চৈত্র মাসে শক্ত এঁটেল মাটির জমি চাষ করলে লাঙ্গলের খোঁচায় যে রকম চাকলা উঠে আসে সে রকম পাথরের চাকলায় চাকলায় মাঠ ভর্তি। তবে আকার আয়তনে আমাদের এঁটেল মাটির চাকলার মতো ছোট ছোট আকারের নয়। কোনো কোনো চাকলার ওজন কয়েক টনেরও বেশি। নানা আকারের পাথরের মাঝে কয়লার মতো কুচকুচে কালো পাথরও রয়েছে। পাহাড় ও পাথরের দেশ মালয়েশিয়াও। মালয়েশিয়ার মতো এখানেও মাইন বিষ্ফোরণ ঘটিয়ে কঠিন পাহাড়ে ফাটলের সৃষ্টি করে। ফাটা পাহাড় থেকে বুলডোজার ও ক্রেনের সাহায্যে পাহাড় ভাঙ্গা পাথর ক্রাশ মেশিনে ঢুকিয়ে নিজেদের প্রয়োজন মতো আকার দিয়ে রাস্তাঘাটসহ নানা রকম উন্নয়ন কার্যাদি চলছে।

চলার পথে শহর-বন্দর দূরের কথা গাঁও-গেরামের চিহ্নটুকুও দেখা গেল না। রাস্তার পাশে কিছুক্ষণ পর পর ফিলিং স্টেশন দেখা যায়। ফিলিং স্টেশনের আশেপাশে রয়েছে শপিং সেন্টার। মরুভূমিতে ছড়ানো ছিটানো পাতাবিহীন কাঁটাযুক্ত এক প্রকার গাছ দেখা যায়। ভারতের জয়পুর থেকে আজমীর আসার পথে 'থর' নামক মরু এলাকায় এ রকমের গাছ দেখেছিলাম। সব মরুর মধ্যে চারিত্রিক মিল খুঁজে পাওয়া গেলেও সব পাহাড়ের মধ্যে চারিত্রিক মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। নির্জন মরুর বুকে বালি আর নুড়ির বিচিত্র ভাঁজ দেখলে মনে পড়ে সৈকতের কাকড়াশিশুদের কথা। কাকড়াশিশু মুখের লালামিশ্রিত বালির বল দিয়ে নির্জন সৈকতে যে আল্পনা আঁকে সে আল্পনা যেকোন শিল্পীর বিখ্যাত আল্পনাকে পেছনে ফেলে দিতে পারে। সমুদ্রপৃষ্ঠে টাইফুন বালকেরা যেভাবে জল নিয়ে খেলা করে, ঠিক সেভাবে সাইমুম বালিকারাও মরুপৃষ্ঠে বালি আর নুড়ি নিয়ে খেলা করে। সাইমুম বালিকাদের মনের অজান্তেই সোনালী বর্ণের বালি আর কুচিকুচি কাকড়ের নিসর্গের খেলা চলতে থাকে। ঘন নীল আকাশের নিচে নির্জন মরুর বুকে সোনালী বালি আর নুড়ি কাকড়ের গড়া নৈসর্গিক সৌন্দর্য্যও যেকোন স্থাপত্য শিল্পীর বিখ্যাত স্থাপত্যকর্মের সৌন্দর্য্যকে পেছনে ফেলে দিতে পারে। (চলবে...)

লেখক : আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক