গল্প
বিষণ্ন বিকেল ও মায়ার গল্প
(শেষ পর্ব)
মৃদুল কিছুটা হতাশ হলো। ‘আমরা দু’জন যে একসাথে খেলা করতাম, তার কিছুই মনে নেই তোমার?’
মায়া মুচকি হাসল। কিন্তু মুখে কিছু বলল না। মৃদুলের খুব অভিমান হলো। সে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। মনে মনে ভাবল- খুব ভাব বেড়েছে মেয়েটার। মায়া মৃদুলের দিকে আড়চোখে তাকাল একবার। মৃদুলের গম্ভীর মুখ দেখেই মায়া বুঝল অভিমান হয়েছে তার ছেলেবেলার বন্ধুটির। মায়া ফিক করে হেসে ফেলল।
‘এভাবে ‘ওফ’ করে থাকা তোমাকে একদমই মানায় না।’ বলেই আনমনে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকার ভাণ করল মায়া।
চট করে ঘুরে তাকাল মৃদুল। ‘মানে! তুমি এতক্ষণ আমার সাথে মজা করছিলে?’
‘নাহ! মজা করব কেন? আমি কি তোমাকে চিনি? তাহলে মজা করব কীভাবে?’
‘আবার ফাজলামো হচ্ছে!’ মৃদুলের কণ্ঠে কপট রাগী ভাব।
‘শোনো, গতকাল মা যখন তোমার কথা বলছিল, তখনই তোমাকে মনে পড়েছে আমার। তবে বর্তমান চেহারাটা নয়, সেই ছোট্টবেলার তোমার মুখটা ভেসে উঠেছিল মনে। আজ দেখেই অবশ্য চিনে ফেলেছি। কিন্তু তুমি যেভাবে ড্যাবড্যাব করে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলে, তাতে তোমার সাথে এইটুকু মজা করার লোভ সামলাতে পারলাম না।’
‘বাব্বাহ! বাঁচালে। তুমি যেভাবে আমাকে না চেনার ভাণ করছিলে আর কেমন একটা ভাব নিয়ে ছিলে, আমি তো চিন্তায় পড়ে গেছিলাম। তবে তুমি দেখতে যে পরিমাণ সুন্দর হয়েছ, ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকা মোটেই অন্যায় নয়।’
‘তা ঢাকায় এমন ক’জনের দিকে তাকিয়ে থাকা হয়?’
‘একজনও না। আমি সবসময় বয়েজ স্কুল-কলেজে পড়েছি, তাই মেয়েদের সাথে মেশার সুযোগই হয়নি। তাছাড়া তোমার মতো সুন্দর কোনো মেয়ে আজ পর্যন্ত আমার চোখে পড়েনি।’
‘এহ! গুল মারার আর মানুষ পাও না, না?’
‘সত্যি বলছি।’
‘এতদিন তো আমার কথা মনে পড়েনি তোমার। এখন দেখা হওয়াতে এমন ভাব দেখাচ্ছ।’ কপট অভিমানের সুরে কথাগুলো বলল মায়া।
‘তোমার কথা পুরোপুরি মিথ্যা না। তবে এখান থেকে চলে যাওয়ার পর অনেকদিন তোমাদের কথা ভুলতে পারিনি। তারপর একসময় লেখাপড়ার চাপ বেড়ে গেল, স্কুল-কলেজ-কোচিং নিয়েই তো ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। তখন অবশ্য খুব একটা মনে পড়েনি। তবে এখন থেকে আর ভুলব না। এই ছবিটা মনে একেবারে গেঁথে গেল।’ মায়ার দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগল মৃদুল।
‘আমি জানি ঢাকা গেলে আবার ভুলে যাবে তুমি।’ নদীর দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলল মায়া।
‘একদম না। তুমি কি ভুলে যাবে?’ পাল্টা প্রশ্ন করল মৃদুল।
‘জানি না’
‘আচ্ছা, তোমার মোবাইল নম্বর আর ফেসবুক একাউন্ট দাও।’
মায়া হাসল। সে হাসিতে এক ধরণের রহস্য লুকিয়ে ছিল। মৃদুল বলল, ‘এখনও আমাকে বিশ্বাস করতে পারছ না তুমি?’
মায়া মুচকি হেসে উপরে-নিচে মাথা নাড়াল।
মৃদুল নদীর ঐ পাড়ে তাকাল। ‘এই নদীটা আগে অনেক বড় ছিল। আমি কয়েকবার ও-পাড় গিয়েছিলাম।’
‘কেন?’ মায়া প্রশ্ন করল।
‘বন্ধুদের সাথে। ও-পাড়ে আমাদের স্কুলের একজন টিচার ছিলেন। আজিম স্যার। আমাকে খুব ভালোবাসতেন। তার বাসায় গিয়েছিলাম।’
‘তাই?’
‘হুম। আচ্ছা এখন ও-পাড়ে যাওয়া যায় না? এখনও তো সুর্য ডুবতে অনেক সময় বাকি। যাবে নাকি?’
‘বাবা-মা খুঁজে না পেলে চিন্তায় পড়ে যেতে পারেন।’ মায়া বলল।
খুঁজে না পেলে তোমাকে তো ফোন করবে। সমস্যা কী?’ মায়ার কথার পিঠে বলল মৃদুল।
মায়া মৃদুলের আবদার মেনে নিয়ে সহাস্যে বলল, ‘তা ঠিক। আচ্ছা চল।’
‘আচ্ছা ও-পাড়ে কীভাবে যাবে?’ মৃদুল জানতে চাইল।
মায়া হাতের আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, ‘ঐ দিকে একটা বাঁধ আছে। ওটা পার হয়েই যাওয়া যাবে।’
মায়া হাতের ইশারায় ডান দিকে দেখাল। দু’জনে বাঁধের দিকে হেঁটে চলল। খুব বেশি সময় লাগল না। দশ মিনিটের মধ্যে ওরা নদীর অন্য পাড়ে চলে গেল। কিছুদূর এগিয়ে মৃদুল সবকিছু গুলিয়ে ফেলল।
‘এখন তো দেখছি সবকিছু বদলে গেছে। এই এলাকাটা আর আগের মতো নেই। দাঁড়াও, লোকজনকে জিজ্ঞেস করে দেখি।’ মৃদুল বলল। কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করে বাড়ির লোকেশনটা জেনে নিলো মৃদুল। তারপর তাদের দেয়া নির্দেশনা অনুযায়ী অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর আজিম স্যারের বাড়িটার সন্ধান পেল সে। অনেক বছর আগে দেখা বাড়িটা এখন আর আগের মত নেই। আশে পাশে নতুন নতুন বাড়িঘর উঠে এলাকার চিত্র বদলে দিয়েছে বেশ। বাড়ির ভিতরে ঢুকে মনে হলো কেমন যেন থমথমে পরিবেশ। উঠানটা আগাছায় পরিপূর্ণ। চারিদিক নীরব-নিথর। উঠানে এসে অনেকক্ষণ দাঁড়ানোর পর দশ-এগারো বছরের একটি ছেলে এসে জানতে চাইল
‘কার দারে আইছেন?’
‘এটা আজিম স্যারের বাড়ি না?'
ছেলেটি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়তেই মৃদুল বলল, ‘স্যার কি আছেন?’
‘জে আছে, আফনে আয়েন।’
মৃদুল আর মায়া ভিতরে প্রবেশ করল। ভেতরে ঢুকে মনে মনে মোটামুটি একটা ধাক্কা খেল। অনেক পুরানো ধাঁচের একটা খাটের উপর শীর্ণদেহী যে মানুষটি শুয়ে আছে তাঁকে সে কিছুতেই তার ছেলেবেলায় দেখা আজিম স্যারের সাথে মেলাতে পারল না। স্যারও মৃদুলকে চিনতে পারলেন না। অবশ্য চেনার কথাও না। কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করলেন,
‘আপনে কেডা বাবা?’
মৃদুল তার নাম বলে বলল। আরও জানাল একসময় সে তার ছাত্র ছিল। আজিম স্যার কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। মনে হল স্মৃতি হাতড়ে চেনার চেষ্টা করলেন। কিন্তু চিনতে পারলেন কিনা বোঝা গেল না।
ছেলেটার সাথে কথা বলে মৃদুল জানতে পারল- প্রায় এক বছর ধরে আজিম স্যার প্যারালাইসড হয়ে বিছানায়। চিকিৎসা প্রায় হচ্ছে না বললেই চলে। পেনশনের টাকায় কোনোরকম জীবন চলছে। মৃদুলের কাছে তেমন টাকা পয়সা ছিল না দেখে তার খুব আফসোস হচ্ছিল। সে তো তখনও ছাত্র, তার পক্ষে কীই-বা করার ছিল!
‘আমার যতটুকু মনে পড়ে স্যারের দু'জন ছেলে ছিল, তারা এখন কোথায়?’ মৃদুল-মায়াকে যে ছেলেটা এখানে নিয়ে এসেছে তার উদ্দেশ্যে প্রশ্নটা করল মৃদুল।
ছেলেটি জানাল- তারা দুজনে এই শহরেই চাকরি করে। তবে তারা নাকি নিজেদের সংসার চালাতেই হিমশিম খায়, তাই বাবার চিকিৎসা করার সামর্থ্য নেই তাদের।
মৃদুল মনে মনে ভাবল- হায়রে নিয়তি! যে মানুষটা কতশত ছেলেমেয়েকে শিক্ষার আলো জ্বেলে মানুষ করল, অথচ নিজের সন্তানরাই রয়ে গেল অমানুষ হয়ে।
মৃদুল আনমনা হয়ে জানালা দিয়ে দূরে ধানক্ষেতের দিকে তাকিয়ে রইল। মনে পড়ল আজিম স্যার কী যে আদর করত তাকে! ছেলেবেলায় ভালো ছাত্র হিসেবে স্কুলে বেশ সুনাম ছিল মৃদুলের। সে কারণেই অনেক শিক্ষকদেরই প্রিয় ছাত্র ছিল সে। তাদের মধ্যে আজিম স্যার ছিলেন অন্যতম। হালকা পাতলা গড়নের মানুষটি খুব হাসিখুশি আর প্রানোচ্ছল একজন শিক্ষক ছিলেন। তখন মাঝে মধ্যেই স্যারের বাড়িতে আসা হতো মৃদুলের। বন্ধুদের সাথে নদীর ওপাড় থেকে নৌকা দিয়ে পার হয়ে এপাড়ে আসত। হঠাৎ মায়ার কণ্ঠ শুনে ভাবনায় ছেদ পড়ল।
‘বেলা তো পড়ে এলো, ফিরবে না?’
‘হুম। চলো যাই।’
স্যারের দিকে তাকিয়ে নিজেকে বড় অসহায় মনে হলো মৃদুলের। কিন্তু সে এখন কী করবে? তার কাছে তো টাকাপয়সাও নেই তেমন। স্যারের জন্য কিছু করতে না পারার কষ্ট নিয়েই ফিরে এলো।
পরের দিন পটুয়াখালী থেকে ঢাকার বাস ধরল মৃদুল। বরিশাল-পটুয়াখালী জেলায় জালের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নদী ও খাল। তাই বাসে চলাচলের ক্ষেত্রে ছোট-বড় অনেক ব্রিজ পেরুতে হয়। একসময় এই রুটে পটুয়াখালী থেকে ঢাকা আসতে বেশ কয়েকটা ফেরি পার হতে হতো। তবে এখন সবগুলো নদীর উপর ব্রিজ হয়ে গেছে। সর্বশেষ পদ্মা সেতু দক্ষিণাঞ্চলে বাস যাত্রা অনেক সহজতর করে দিয়েছে। ঢাকায় ফেরার সারাটা পথজুড়ে দু’টো মুখচ্ছবি মৃদুলের মনে গেঁথে রইল। মায়া ও আজিম স্যার। একটি মুখ দর্শন তার এই দুই দশককাল অতিক্রান্ত জীবনে বসন্তের শুভ্র সুবাতাস বইয়ে দিয়েছে, অথচ আরেকটি মানুষের জীবনের ক্রান্তিকালের চিত্র এবং তাঁর জন্য কিছু করতে না পারার কষ্ট মৃদুলের ভিতরের মানুষটাকে অপরাধী করে তুলেছে।
ঢাকায় ফিরে কোচিং নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল মৃদুল। তারপর ভর্তি পরীক্ষা, ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি, নতুক ক্লাস শুরু হওয়ায় লম্বা একটা সময় ঢাকা থেকে নড়বার কোনো সুযোগ মেলেনি তার।
কয়েক মাস পরের কথা। বেশ কিছু সময় অতিক্রান্ত হবার পর বাবার অফিসের আরও কিছু অসমাপ্ত কাজ শেষ করার জন্যে আবার পটুয়াখালী যেতে হলো মৃদুলকে। এবার অবশ্য বেশ খুশি মনে রাজি হয়ে গেল সে। কারণ সেই দু'টো- এক মায়ার সাথে দেখা হবে আর দ্বিতীয়ত আজিম স্যারের জন্য কিছু আর্থিক সাহায্য নিয়ে যাওয়া। বাবার কাছে পটুয়াখালী যেতে হবে শুনেই দ্রুত কাছের বন্ধুদের কাছ থেকে স্যারের জন্য একটা ফান্ড গঠন করে ফেলেছে মৃদুল। অবশ্য বিশেষ একজনের জন্যও উপহার কিনতে ভুলেনি সে। অবশেষে নিজের কিছু সম্বল আর বন্ধুদের কাছ থেকে পাওয়া সাহায্য নিয়ে মৃদুল রওনা দিলো স্যারের জন্যে কিছু করার উদ্দেশ্যে।
দিনের প্রথম প্রহরেই বাবার অফিসের কাজ শেষ হয়ে গেল। বাবা এবারও আকবর চাচার জন্য একটা ঔষধের প্যাকেট দিয়ে দিয়েছিলেন। মৃদুল সেটা অফিসেই আকবর সাহেবকে দিলে তিনি বলল,
‘তুমি আমার বাড়িতে চলে যাও। তোমার চাচি ও মায়া তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।’
মৃদুল নিজেও মায়াকে সামনাসামনি দেখার জন্য ছটফট করছিল। তাই আকবর সাহেবের বাসায় যেতে আপত্তি জানাল না। অবশ্য এ ক’মাসে মায়ার সাথে নিয়মিত মোবাইলে যোগাযোগ রেখেছে মৃদুল। প্রায়ই অডিও-ভিডিও কলে কথা হয় তাদের মধ্যে। ইদানীং দু’জনের মধ্যে সম্পর্কের গভীরতা অনেক বেড়েছে। দিনে একবার হলেও ফোনে কথা বলা চাই-ই।
আগেরবারের মতো এবার আর মৃদুলকে দরোজায় কড়া নাড়তে হলো না। হয়ত আকবর সাহেবের কাছে থেকে মোবাইলের বদৌলতে মৃদুলের আসার খবর ইতিমধ্যে তাদের বাড়িতে পৌঁছে গেছে। বাড়ির সামনে আসতেই চোখে পড়ল দরোজায় দাঁড়িয়ে মায়া। মুখে ছড়ানো রহস্যময় হাসি। মৃদুল কাছে যেতেই মায়ার চোখ দু’টো যেন চঞ্চল হয়ে উঠল। মৃদুল তার দিকে অবাক নয়নে তাকিয়ে রইল। সে তাকানোতে অপার মুগ্ধতা ছিল। ছিল এক উঠতি বয়সী যুবকের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। মৃদুলের অবস্থা দেখে মায়া হেসে ফেলল। মৃদুল আবারও লক্ষ করল হাসলে মায়ার গালে খুব সুন্দর টোল পড়ে। ইচ্ছে করে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেয়।
মায়া মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করে, ‘কী দেখছ এমন করে?’
মৃদুল বিড়বিড় করে আওড়াও-
তোমার বুকে পদ্মপুকুর
অথৈ জলের ঢেউ,
মনের মাঝে উথাল পাথাল
জানলো না তো কেউ।
মায়া হাসে। হাসতে হাসতেই বলে, ‘হয়েছে। এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি ঘরে আসবে?’
মায়ার কথা শুনে বাস্তবে ফিরে এলো মৃদুল। মায়ার পিছু পিছু সে ঘরে প্রবেশ করল। ওদের কথা শুনে মিসেস আকবর সামনের ঘরে এসে দাঁড়ালে মৃদুল সালাম দিলো। মিসেস আকবর মৃদুলের বাবা-মার খোঁজখবর নিয়ে শেষে বলল,
‘আমরা খুব খুশি হয়েছি যে তুমি ঢাকা মেডিকেলে চান্স পেয়েছ। দোয়া করি তুমি একদিন খুব বড় ডাক্তার হও, দেশ ও দশের সেবা করো।’
আপনারা শুধু দোয়া করবেন।
মিসেস আকবর ভেতরে চলে গেলে- রূপালি রঙের ফয়েল পেপারে মোড়ানো একটা প্যাকেট মায়ার হাতে দিয়ে মৃদুল বলল,
‘তোমার জন্য।’
মায়া দু’চোখ বড় বড় করে মৃদুলের দিকে তাকিয়ে রইল। মৃদুল লক্ষ করল সে চোখের দৃষ্টিতে গভীর মায়াজাল, ও আবেগঘন প্রেমের আহ্বান; আর মায়া দেখল এই প্রথম কোনো উপহার নিয়ে তার দোরে দাঁড়িয়ে উদগ্রীব এক প্রেমিক পুরুষ, যাকে উপেক্ষা করার সাধ্য এবং স্পৃহা কোনোটাই তার নেই।
দু’জন দু’জনের দিকে ঠিক কতক্ষণ তাকিয়ে ছিল কেউ বলতে পারবে না, তবে তাদের সম্বিৎ ফিরল ভেতরের ঘর থেকে মায়ার নাম ধরে মিসেস আকবরের ডাক শুনে।
বিকাল হলে মায়াকে নিয়ে স্যারের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো মৃদুল। এবার আর বাড়ি চিনতে সমস্যা হলো না ওদের। স্যারের বাড়িতে পৌঁছে মৃদুল লক্ষ করল বাড়িটা যেন আগের চেয়েও নীরব। জনমানবের কোনো সাড়া নেই। কিছুক্ষণ ডাকাডাকি করে কাউকে পেলো না ওরা। অনেকক্ষণ বাইরে অপেক্ষা করার পর অল্প বয়সী একটা ছেলে দেখে কাছে ডাকল মায়া। ছেলেটি কাছে এলে মৃদুল জিজ্ঞেস করল,
‘আজিম স্যার কি বাড়িতে নেই?’
ছেলেটি স্বাভাবিকভাবে উত্তর দিলো, ‘উনি তো মইরা গ্যাছে।’
‘কী! স্যার মারা গেছেন?’ মৃদুল চমকে উঠে বলল।
‘এক মাস আগে আজিম ছারে মইরা গ্যাছে।’
শ্রী-হীন বাড়িটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল মৃদুল। তারপর মায়াকে নিয়ে ওখান থেকে দ্রুত বেরিয়ে এলো। মৃদুলের খুব আফসোস হচ্ছিল এই ভেবে যে আর এক মাস আগে কেন সে এলো না!
মায়া মৃদুলকে নানাভাবে সান্ত্বনা দিচ্ছে। তোমার আর কীই-বা করার ছিল। তুমি তো আর কাছাকাছি থাকো না। তারপরো এতদূর থেকে স্যারকে সাহায্য করার জন্য এসেছ। এভাবেই বা ক’জন চেষ্টা করে!
মৃদুল জানে মায়া ঠিকই বলছে, কিন্তু মৃদুলের একটাই আফসোস, আরও কিছুদিন আগে হলে স্যারের জন্য হয়ত কিছু করা সম্ভব ছিল। মায়াদের বাড়িতে ফিরে মৃদুল আর বেশি দেরি করল না। সেদিন রাতের লঞ্চেই ঢাকায় রওনা দিলো।
বিদায় বেলায় মায়া মলিন মুখে দাঁড়িয়ে রইল। মৃদুলও তেমন কিছু বলতে পারল না। মিসেস আকবর বলল,
‘আবার এসো বাবা। এবার তোমার বাবা-মাকে নিয়ে আসবে। কতদিন তোমার মায়ের সাথে দেখা হয়নি!’
মৃদুল ছোট্ট করে বলল, ‘আচ্ছা।’
কিছুদূর গিয়ে আবার ঘুরে তাকাল মৃদুল। মায়া তখনও দরোজায় দাঁড়িয়ে আছে। সামনে ঘুরতে যাবে এমন সময় চোখে পড়ল মায়া তার দিকে হাত নাড়ছে। মৃদুল একবার হাত নাড়ল শুধু। সামনে জোর পায়ে হেঁটে চলল বড় রাস্তার দিকে।
মৃদুল বসে আছে লঞ্চের বারান্দায়। সামনে বিস্তীর্ণ জলরাশি। আরও দূরে নদীর পাড়ে আবছা গ্রামটাকে অদ্ভুত লাগছে। মৃদুলের মনে দু’টো মুখচ্ছবি ভাসছে। আজিম স্যারের শীর্ণ দেহটা আর বিদায়কালে মায়ার মলিন মুখ।
অনেক বছর আগে-সেই ছেলেবেলায় আজিম স্যার একদিন মৃদুলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেছিলেন- ‘তুমি একদিন অনেক বড় হবে।’ স্যারের গানের গলা বেশ ভাল ছিল। স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোতে তিনিই ছিলেন সবার মধ্যমণি। সবাই চলে যাবে এটাই স্বাভাবিক কিন্তু একজন মানুষ গড়ার কারিগর এভাবে বিনা চিকিৎসায় চলে যাবেন এটা মেনে নেয়া খুব কষ্টকর। বিশেষ করে আজিম স্যারের মত একজন আলোকিত মানুষ। (সমাপ্ত)
হাসান জাকির
পল্লবী, ঢাকা।