উপন্যাস
বঞ্চিত কৃষক
(৪র্থ পর্ব)
ফজর আলীর দক্ষিণমুখী একটা চৌচালা ঘর। সামনে একটা গোয়াল ঘর! পূর্ব পাশে রান্নাঘর। সখিনা লাকড়ি কুড়িয়ে রান্না করে। গাছের পাতা ঝাড়ু দিয়ে আনে! ছেলেমেয়ের আদর্শ মা৷ খাবার তৈরি করে নিয়মিত। লোকে বলে নারী বসে বসে খায়৷ কিন্তু ফজর আলী খেয়াল করেছে, সখিনা সারাদিন কাজ করে। উৎপাদনহীন হলেও নারীর শ্রমেই সংসার চলে। খাওয়া সহজ তবে জোগানের প্রক্রিয়া দীর্ঘ। বড্ড জটিল নারীর কাজ। খোলা চোখে সহজ মনে হলেও কাজগুলো সহজ নয়! ফজর আলী খাবার নিয়ে মন্তব্য পছন্দ করে না। কৃষক হলেও তার ধৈর্য অনেক, বিবেক শাণিত। একজন নারী ইচ্ছে করে লবণ না দিয়ে থাকে না। তার ধ্যানজ্ঞান এই সংসার। ভুল হতেই পারে। ফজর আলী চুপচাপ খেয়ে চলে যায়। সখিনা খেতে গিয়ে চিল্লায়। এই লোকটাকে নিয়ে আর পারা গেলো না। ছেলে সুজন বাপের উল্টো। তরকারিতে লবণ না থাকলে চিল্লাতে শুরু করে। মেয়ে পিপাসও ভাইয়ের মতো!
বর্তমানের ছেলেমেয়ে মনে করে সব দায় বাবামায়ের। তারা সব তৈরি চায়। সবকিছু আপ-টু-ডেট। মেঘনার কৃষক ফজর আলী। সে বিশ্ব চিনে না। বিশ্ব নিয়ে তার ভাবনাও নেই। সে যতটুকু দেখেছে ততটুকুই পৃথিবী। মৃত্যু জানে, গোরস্থান বুঝে; পরকাল বিশ্বাস করে। ছোটবেলায় মক্তবে গেলে হুজুর সেই কথা বলতেন। বেহেশতে গেলে নাকি আরও হুর পাবে! কিন্তু তার কাছে সখিনাই সব। ও তার সব হুর। মৃত্যুর পরেও সে সখিনাকে চায়! চাইলেই কি সব পায়? বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর।
বাংলাদেশের কৃষক প্রকৃতির উপর নির্ভর। বন্যা হলে কষ্টের শেষ নেই। মানুষ এর চেয়ে পশুর কষ্ট বেশি। তার থাকার জায়গা ফজরকেই করতে হয়। কোথায় সেই জায়গা? ফজর আলী আল্লাহকে ডাকে! স্বপ্নের ফসল শেষ। তারপর ফসল বেশি হবে তা ফজর আলী জানে। পানি বেশি হলে জমির শক্তি বাড়ে। সে পলি বুঝে না। শক্তি বুঝে। তার কাছে কোন রেডিও নেই! টর্চলাইট নেই। আকাশের তারা আছে। সকাল বিকাল আছে। সখিনা আছে। আর কিছু চায় না সে। ছেলে মেয়ে শিক্ষিত হলেই খুশি। ওরা একদিন সাহেব হবে! আচ্ছা তারা কি কৃষক হবে? বাবার পেশাটার কী হবে? আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। এখন বড়দের সম্মান নেই। কম বয়সীরা এখন বেশি বুঝে। মেঘনায় এখন চাষবাস কমে আসছে। বিদেশে যাওয়া একটা ট্রাডিশন। ৪/৫ লাখ টাকা খরচ করে গিয়ে মাসে ১৫ হাজার টাকা ইনকাম কি বৃথা শ্রম নয়? তাও সর্বোচ্চ দুই বছর! কে বলবে সেই উত্তর? সমাজে বুদ্ধিমান মানুষের বড় অভাব। (চলবে)
লেখক: কবি, কথাসাহিত্যিক ও গীতিকার