Advertisement

জয়নুল আবেদীন


প্রকাশিত: ০০:৫৬, ১৯ জানুয়ারি ২০২৫

প্রবন্ধ

স্মরণীয় জার্নি: মক্কা টু মদিনা

স্মরণীয় জার্নি: মক্কা টু মদিনা
ছবি: সবার দেশ

(শেষ পর্ব)

ভূপ্রকৃতি হিসেবে সমগ্র আরবকে উত্তর আরব, মধ্য আরব ও দক্ষিণ আরব এ তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। উত্তর আরব বলতে গেলে পুরোটাই মরুভূমি। মধ্য আরবে আরবের বৃহত্তর মরুভূমি ‘দাহানা’র বেশকিছু অংশ বিদ্যমান। মক্কা ও মদিনা মধ্য আরবে অবস্থিত। আরবের এক-তৃতীয়াংশ মরুময়, প্রকৃতির রুদ্রলীলাস্থল ও মনুষ্যবাসের সম্পূর্ণ অযোগ্য। আর এ কারণেই এ দেশের মোট জনসংখ্যার চার-পঞ্চমাংশ মরুবাসী অর্থাৎ যাযাবর। যাযাবর বা বেদুঈনদের প্রধান কাজ পশু পালন করা। তাদের চলার পথে পানির বড় অভাব। তাই তারা পশুর মাংস খায় এবং পানির অভাব দূর করতে পান করে পশুর দুধ। শিকার ও লুটপাট তাদের পেশার অন্তর্গত। বিশেষ করে এই ধূসর মরুর উপযোগী করেই তাদের জীবন বৈচিত্র্য গড়ে উঠেছে। নানা কারণে এ দেশ ভৌগোলিক দিক দিয়ে এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকা, মহাদেশের মিলন কেন্দ্র হলেও এ দেশ যেন বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন। উত্তর ভাগে ‘নফুদ’ মরু। নফুদ মরু এলাকা থেকে শুরু করে দক্ষিণ ভাগ পর্যন্ত ৬০০ মাইল এলাকা জুড়ে রয়েছে ‘আল দায়না' মরুভূমি। আরবের পশ্চিম দিকেও ‘আল হারবাহ' নামে একটি মরুভূমি রয়েছে। ঐতিহাসিক হিট্টির ভাষায় ‘আরব অন্যতম সর্বাপেক্ষা শুষ্ক ও গরমপ্রধান দেশ।

বেদুঈনদের মাথার উপরে সুবিশাল নীলাকাশ এবং পায়ের তলায় সীমাহীন মরুভূমির স্বাধীন আবহাওয়াই তাদের স্বাধীনচেতা করে দিয়েছে। মরুর পরেই পাহাড়ের অবস্থান। এসব মরু ও পাহাড় এলাকার বিরান ভূমি নিয়ে উত্তর ও মধ্য আরব। দক্ষিণ আরবের চিত্র সম্পূর্ণ আলাদা। দক্ষিণ আরব এলাকার মাটি ও প্রকৃতি ফসল উৎপাদনসহ মানুষ বাসের অনুকূল পরিবেশ থাকায় প্রাচীনকাল থেকেই অত্র এলাকা ঘনবসতিপূর্ণ। আর সুপ্রাচীন কাল থেকে উত্তর ও মধ্য আরবের অস্বাভাবিক মানুষ হলো বেদুঈন বা যাযাবর। এ কারণেই প্রাচীন আরবের শতকরা আশিজন লোকই যাযাবর। যাযাবর ও মরুময় এলাকা পারস্য উপসাগরের উপকূল জুড়ে মাটির তলায় লুকানো ছিল তেলের সাগর। পারস্য উপসাগরের পশ্চিম-দক্ষিণ দিক থেকে উত্তর-পশ্চিম সীমানা ছাড়িয়ে ইরাকের বাগদাদ পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকা ভেসে রয়েছে তেলের উপর। তাই তাদের ঐ দেশে তিন বোতল তেলের দাম দিয়েও এক বোতল পানি পাওয়া যায় না।

চলার পথের দুপাশে কোনো কোনো নিম্ন এলাকায় রয়েছে সবুজ মরূদ্যান। মরূদ্যানের পাশে রয়েছে নানা প্রকারের অচেনা বৃক্ষসহ গোচ্ছাকারের ছোট-বড় খেজুরগাছ। খেজুরগাছের গোড়ায় রয়েছে গুল্ম জাতীয় এক প্রকার মরু উদ্ভিদ। ঝাউগাছের পাতার ন্যায় সূচাগ্র পাতা বিশিষ্ট গুল্মের মাঝে মাঝে আকাশের দিকে মাথা উঁচু করা দু'একটি খেজুরগাছও দেখা যায়। ধূসর মরুবালির উপর কালের সাক্ষী হিসেবে নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকা একেকটি খেজুরগাছ যেন একেক এলাকার সকল উদ্ভিদকে জানিয়ে দিচ্ছে শুষ্ক বালির ভেতর থেকে রস শোষণ করে কিভাবে টিকে থাকতে হয়। মরূদ্যানে রয়েছে হালকা জনবসতি। তবে এর পরিমাণ খুবই নগণ্য। রাস্তার পাশে অনেক দূরে ছোট ছোট আশ্রয়কেন্দ্র। পাথরের দেয়ালের উপর খেজুর পাতার ছাউনি দিয়ে নির্মিত কোনো কোনো আশ্রয় কেন্দ্রের আয়তন এক-দেড়শো বর্গফুটের বেশি মনে হলো না। মেষ পালক রাখালদের রোদ ও মরুঝড় থেকে বাঁচানোর জন্য নির্মিত এসব আশ্রয় কেন্দ্রে প্রতি সপ্তাহে একবার করে খাবার ও পানীয় সরবরাহ করা হয়। কোনো কোনো আশ্রয় কেন্দ্রের উপরে রয়েছে পানির ট্যাংক। মাঝে মাঝে পানি ভর্তি গাড়ি ট্যাংকে পানি ভরে রেখে যায়। মরুভূমিতে অবস্থানরত প্রাণী ছাগল, মেষ ও উটের জন্যে ট্যাংকে পানি ভরে রাখা হয়। চলার পথে কয়েক স্থানে ছোট-বড় মেষের পাল দেখতে পেয়েছি। মাঝে মাঝে বাইপাস সড়ক সর্পিল গতিতে চলে গেছে ডান দিক থেকে বাম দিকে। এর মধ্যে দু'একটি বাইপাস চোখে পড়ার মতো। যে বাইপাসটি বাম দিক চলে গেছে জেদ্দায় সে বাইপাসটিতে দূরত্ব লেখা রয়েছে ১০৭ কিলোমিটার। জেদ্দা থেকে একটি এক্সপ্রেস হাইওয়ে লোহিত সাগরের পার ঘেষে মদিনার পথে বের হয়ে ১০৭ কিলোমিটার এসে মক্কা-মদিনা এক্সপ্রেস হাইওয়ের সাথে মিলিত হয়ে প্রধান সড়কটি পুনরায় চলে গেছে লোহিত সাগরের পারে। হাইওয়েটি সাগর পারের সব সামুদ্রিক বন্দরের সাথে দেখা করে ১৫০ কিলোমিটার উত্তর দিকে ঐতিহাসিক বদর প্রান্তরের এখানে এসে দিক পরিবর্তন করে। তারপর পূর্বদিকে মুখ করে সোজা মদিনায় প্রবেশ করেছে। 

এই জেদ্দা-মদিনা ও মক্কা-মদিনা দুই এক্সপ্রেসওয়ের মিলনস্থল থেকে কয়েক কিলোমিটার পশ্চিমেই লোহিত সাগর। অর্থাৎ এখানে আমরা লোহিত সাগরের খুব কাছাকাছি চলে এসেছি। আমাদের বাম দিকে লোহিত সাগর আর সামনে যতদূর চোখ যায় কালো অজগরের মতো পথ আর পথ। আমাদের ঢাকা-চিটাগাং মহাসড়কের চেয়ে কয়েক গুণ চওড়া শুধু ওয়ান ওয়েগামী রাস্তা। এখানে এক্সপ্রেস ও হাইওয়ে এ দুই প্রকারের রাস্তা রয়েছে। এ দুই প্রকার রাস্ত াকে ডিভাইডেড ও আনডিভাইডেড নামে আরো দুই প্রকারে ভাগ করা হয়েছে। ডিভাইডেড সড়কের একদিকের রাস্তা থেকে অপর দিকের রাস্তা বেশ দূরে। মনে হয় একই প্রস্থের তিন খ- থেকে মাঝখানের খ-টি খালি রেখে ডান দিক দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে মদিনার দিকে আর বাম দিক দিয়ে গাড়ি আসছে মক্কার দিকে।

দশ বারো কিলোমিটার চলার পর ড্রাইভার পুনরায় গাড়ি থামিয়ে দেয়। ইঞ্জিনের মাথায় পানি না ঢেলে আর গাড়ি চালানো যাবে না। তা করতে গেলে গাড়িতে হঠাৎ আগুন লেগে যেতে পারে। মরুর মাঝে নির্ধারিত স্থান ছাড়া যেখানে-সেখানে পানি পাওয়া যায় না। ড্রাইভারকে এদিক ওদিক তালাশ করে পানি আনতে হয়। এক জায়গায় গিয়ে একইভাবে পানি খুঁজতে গিয়ে পানি না পেয়ে ড্রাইভার বিষণ্ন মনে ফেরত আসে। তা দেখে কে একজন বুদ্ধি দেয়, যাত্রীদের সাথে যে পানীয়জল রয়েছে- বিপদের সময় যাত্রীদের পানীয়জল ইঞ্জিনের মাথায় ঢেলে গাড়ি চালানো জন্য। কারণ, এই মরুর মাঝে মাথা নেড়া করে বিলাপ করলেও এক ফোঁটা পানি পাওয়া যাবে না। যাত্রীর বুদ্ধি নিয়ে তাই করা হলো। মিনিট দশেক চলার পর পুনরায় একই অবস্থা হয়। গাড়ি থামিয়ে পেছনের ডালা উঠাতে গিয়ে দেখতে পায়, ইঞ্জিন থেকে গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে। এ অবস্থায় গাড়ি চালাতে গেলে আগুন ধরে যেতে পারে। গাড়িতে আগুন ধরে যাওয়াসহ দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য ড্রাইভার গাড়ি রাস্তার পাশে থামিয়ে দেয়। গাড়ির যখন এ অবস্থা, তখন সারা দিনের রুপালি সূর্যটা ঘন লাল হয়ে পশ্চিমাকাশের দিকচক্রবাল রেখার দিকে ঢলে পড়ছিল। মরুর মাঝে রাত কাটাতে গেলে ভয়ংকর বিপদের আশংকা বিদ্যমান রয়েছে। নির্জন মরুর মাঝখানে গাড়ি আটকে গেলে অসহায় যাত্রীদের কি অবস্থা হবে? সবচেয়ে বেশি ভয় বেদুঈনদের। তারা এখনো আরবের আদিম অধিবাসী। তাদের আইয়ামে জাহেলিয়ার পুরানো অভ্যাস এখনো পাল্টায়নি। আরবের ধূসর মরু, কঠিন পাহাড়, রুদ্র আবহাওয়া ও রৌদ্রদগ্ধ লুহ্ হাওয়ার সাথে বেদুঈনদের স্বভাবের পুরোপুরি মিল রয়েছে। তাদের আরেক পরিচয় ‘আহল-উল-বাদিয়া'। আমাদের দেশের বাদিয়াদের যেমন কোনো বাড়িঘর নেই- বেদুঈনদেরও তেমন বাড়িঘর নেই। আমাদের বাদিয়ারা যেমন সাপ, বানর ও মন্ত্র-তন্ত্র নিয়ে নানা স্থানে ঘুরে বেড়ায় বেদুঈনরাও উট, মেষ ও ছাগল-বকরী নিয়ে নানা স্থানে ঘুরে বেড়ায়। শিকার ও লুণ্ঠন তাদের প্রধান পেশা। পেশার অংশ হিসেবে যাত্রীর সর্বস্ব লুণ্ঠন করতে তাদের হাত একটুও কাঁপে না। ধর্মীয়, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কোনো প্রকার মূল্যবোধই তাদের জীবনে ছায়াপাত করে না। উট ও ছাগলের মাংস খায় এবং দুধ পান করে মাসের পর মাস পানীয় জল ছাড়াও কাটিয়ে দিতে পারে। ওদের সঠিক কোনো ঠিকানা না থাকায় তাদেরকে বিচারের জন্য আইনের আওতায় আনাও কষ্টকর। প্রাচীন আরবদের স্বভাবে তিনটি ‘ডব্লিউ'র অবস্থান ছিল। তিন ‘ডব্লিউ'-এর প্রথমটি দিয়ে ‘উইমেন’, দ্বিতীয়টি দিয়ে ‘ওয়াইন’ ও তৃতীয় ডব্লিউ দিয়ে ‘ওয়ার', অর্থাৎ ‘নারী, মদ ও যুদ্ধ’ এই তিন বিষয় নিয়ে আইয়ামে জাহেলিয়ার আরবরা লিপ্ত থাকতো। সে স্বভাবটা বেদুঈনদের মধ্যে কিনা এখনো রয়ে গেছে। এ কথা মনে পড়ায় ভয় আরো বেড়ে যায়। কারণ, জানমাল ছাড়া আমাদের গাড়িতে গোটা তিনেক ‘উইমেন'ও ছিল। তিন উইমেনের মধ্যে দুজন উইমেনই আমাদের। ভাগ্যিস বেদুঈনদের সম্পর্কে ‘উইমেনদের জানা নেই' নয়তো এতক্ষণে হাউমাউ শুরু হয়ে যেতো। রাতের অন্ধকার ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে আতংকের ঘনঘটাও ঘনিয়ে আসতে শুরু করে। যাত্রীরা গাড়ির ড্রাইভারের ওপর চটাচটি করতে আরম্ভ করে দিয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন দেশের ভিন্ন ভিন্ন যাত্রী তাদের নিজ নিজ ভাষায় ড্রাইভারকে আক্রমণসহ গালমন্দ করতে আরম্ভ করে। যার যার মাতৃভাষায়-
গালমন্দের বাংলা করলে যা দাঁড়ায় তা হলো-
- শালার পুতের বস্তা পচা গাড়িতে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দে। সিল হুয়া (ওকে উঠিয়ে নিয়ে চল)।
সিল আইনাক হাগাল হুয়া (ওর চোখ উঠায়ে ফেল)।
- হারাকো নি হাজা ছাইয়ারা (ওর গাড়িতে আগুন লাগিয়ে দে)।
- ইয়া আব্বুয়ান সবুরলাক। রাসূল (স.) হিসি বিররিজলী হাজাল তারিখ মাআ সবুর না হানো। মা এগদার ওয়াক্ত আল ছাত সবুরওলিও...। ভাইসব ধৈর্য্য ধরুন, আমাদের নবী করিম (স.) এ পথে কখনো পায়ে হেঁটে, কখনো উটের পিঠে আরোহণ করে অনেক সময় কাটিয়েছেন। 

ভাইসব, আমাদের প্রিয় নবী করিম (স.) এর ধৈর্য্যের কথা একবার ভাবুন। যে নবী (স.)-এর ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই পিতৃ বিয়োগ ঘটে। জন্মের চৌদ্দ দিন পর মাতৃকোল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ধাত্রীমাতা বিবি হালিমার কাছে আশ্রয় পান, পাঁচ বছর পর মা আমিনার কোলে ফিরে আসার কিছুদিন পর মা আমিনা ছয় বছরের শিশুপুত্রকে সাথে করে মদিনা যান। মদিনা গিয়ে বাবা আবদুল্লাহর কবর জিয়ারত করেন। কবর জিয়ারত শেষে ফেরার পথে মক্কা ও মদিনার মাঝামাঝি পৌঁছলে মা আমিনা হঠাৎ রোগে আক্রান্ত হয়ে শিশুপুত্র মুহম্মদ (স.)-এর সামনেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আমরা এখন মক্কা-মদিনার মাঝামাঝি এমন এক স্থানে রয়েছি যে স্থানের কাছাকাছি কোথাও মা আমেনার সমাধি রয়েছে। যে সমাধির পাশে ৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে নির্জন মরুতে ছয় বছরের শিশুর চোখের সামনে মা পরলোক গমন করেছিলেন। পরলোক গমনের পর মাকে দাফন-কাফন সম্পাদন করা ছয় বছর বয়সের একজন সন্তানের পক্ষে কী যে মর্মভেদী ও হৃদয়বিদারক তা মনে করলে হৃদয়হীনার হৃদপদ্মেও হৃৎকম্পন শুরু হয়ে যায়। নবী করিম (স.) কোরেশদের অত্যাচারে আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-কে সাথে নিয়ে এই পথে মক্কা থেকে মদিনা হিজরত করতে গিয়ে কয়েক দিন কাটিয়েছিলেন। পরিণত বয়সে মক্কা বিজয়ের প্রাক্কালে দশম হিজরির জিলক্বদ মাসের ২৬ তারিখ রোজ শনিবার রাসূল করীম (স.) জোহর নামায আদায় করার পর মদিনা থেকে দু'মাইল দূরে জুলহুলাইফা নামক স্থানে হজ্জ্বব্রত পালন করার ঘোষণা দিয়ে মদিনা থেকে মক্কা আসতে এই পথেই কেটেছিল ৯ দিন। নবী করীম (স.) যে রাস্তায় ৯ দিন অবস্থান করতে পেরেছিলেন সেখানে আমরা ৯ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে পারবো না কেন? আমরা সেই হযরত (স.)-এর উম্মত হয়ে তাঁর জননীর সমাধির কাছে এসে কি সব আজেবাজে ভাষায় বাক-বিতন্ডা শুরু করে দিয়েছি।

এতোবড় সান্তনা বাক্য শোনার পরেও, জনমানবহীন এ স্থানটি কারো কাছে মোটেও নিরাপদ মনে হলো না। এখানে অবস্থান করতে হলে, হয়তো নিকটবর্তী পুলিশ স্টেশনে টেলিফোন করে নিরাপত্তা চাইতে হবে, নয়তো কোনো পেট্রোল পাম্পের নিকট নিয়ে গাড়ি রাখতে হবে। ড্রাইভার গাড়ির পেছনের ডালা উঠিয়ে হাওয়া লাগিয়ে ইঞ্জিন ঠান্ডা করছিল। মক্কার দিক থেকে ভলভো গাড়ি আসতে দেখলেই ড্রাইভার রাস্তায় দাঁড়িয়ে গাড়ি থামানো জন্য সিগন্যাল দিত। অনেক সাধনার পর একটি গাড়ি থামাতে সক্ষম হন। গাড়ি থেকে এক গ্যালন পানি রাখা ছাড়া আর কোনো সাহায্যই পাওয়া যায়নি। বাতাস করাসহ এক গ্যালন পানি ইঞ্জিনের মাথায় ঢেলে ঠা-া করে আবার চালাতে শুরু করে। দশ-পনের মিনিট পরেই বড় রকমের একটা পেট্রোল পাম্পের কাছে নিয়ে গাড়ি রাখা হয়। স্থানটি মদিনা থেকে কম-বেশি ১২০ কিলোমিটার দক্ষিণে হেরাত রাহেদ এলাকায় অবস্থিত। আমাদের বাম দিকে কমবেশি ১০০ কিলোমিটার পশ্চিমে ঐতিহাসিক বদর প্রান্তর। বিশাল এলাকা জুড়ে পাম্পের বৈদ্যুতিক আলোতে সমগ্র এলাকা আলোকিত হয়ে রয়েছে। অপর একটি গাড়ি এসে আমাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য অনেক আগেই খবর পাঠানো হয়েছিল ৷ খবর পেয়ে দু'ঘণ্টা পর আসলো- তবে গাড়ি নয়, গাড়ির পরিবর্তে একজন মেকানিক এসে পরীক্ষা-নিরীক্ষা আরম্ভ করে দিল। কতোক্ষণ পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ঘোষণা দিল-
-গাড়ি সম্পূর্ণ সুস্থ ॥ ইঞ্জিনে কোনো রোগ-বালাই নেই।

তবে নিরোগ ইঞ্জিন এমন করছে কেন? প্রশ্ন ভুক্তভোগী উৎসুক যাত্রীদের।
- কারণ হচ্ছে, ইঞ্জিনে মবিল লাগানো হয়নি। ইঞ্জিনের বল-গিয়ারসহ নাট-বল্টুর জয়েন্টে জয়েন্টে মবিল লাগিয়ে রাখতে হয়। মানুষের কোনো কোনো ভিটামিনের অভাবে যেমন জয়েন্টে জয়েন্টে সমস্যা দেখা যায়- ইঞ্জিনের বেলায়ও তাই হয়। ইঞ্জিনের ভিটামিন হলো মবিল। জয়েন্টে জয়েন্টে মরিল না লাগিয়ে রাখলে গাড়ির এ অবস্থা হয়ে থাকে। এর জন্য দায়ী চালকের অপরিপক্বতা।

আর পটর পটর দরজা খুলে যাওয়ার কারণ কি? প্রশ্ন করে যাত্রীরা।
অটোগাড়ির দরজা নিয়ন্ত্রণের সুইচও থাকে ড্রাইভারের ডান হাতের তলায় ৷ গাড়ি চালানোর সময় অসাবধানে সুইচে চাপ পড়লেই দরজা খুলে যাবে ৷ সম্ভবত চালকের অদক্ষতার কারণেই এমনটা হয়ে থাকতে পারে।

যাত্রীরা এতোক্ষণ মনে করেছিল যে, ড্রাইভার বেচারা সম্পূর্ণ নির্দোষ, ইঞ্জিনের হারামির কারণেই এমন হচ্ছিল। গাড়ি যতটুকু আসতে পেরেছে সবই ড্রাইভারের উপস্থিত বুদ্ধির কারণেই। নয়তো এখনও জনমানবহীন অন্ধকার মরুভূমিতেই থাকতে হতো ৷ তাই শেষ দিকে যাত্রীগণ বেচারা ড্রাইভারের দিকে নেক নজরে তাকাতে শুরু করেছিল। এখন সবাই বুঝতে পারলো বেচারা ইঞ্জিন সম্পূর্ণ নির্দোষ। সব দোষ ঐ সুদৰ্শন কেনিয়ান ড্রাইভারের। সব যাত্রী ঈদের দিন এই অসহনীয় দুর্ভোগের কারণে শালার বেটা ড্রাইভারকে খুঁজতে শুরু করে। ড্রাইভার গণধোলাইয়ের ভয়ে নিজের ভুল বুঝতে পারার সাথে সাথেই সটকে পড়েছিল। রাগান্বিত যাত্রীগণ হাওয়ার উপর আরেক দফা গালমন্দ শুরু করে দিল। সমস্যা বের করা গেলেও মবিলের অভাবে সহসাই সমাধান বের করা গেল না। কোথাও মবিল পাওয়া যাচ্ছিল না। মবিলের কাজ তেল দিয়ে বেশি দূর চালানো যাবে না। মদিনা থেকে অপর একটি গাড়ি পাঠানোর কথা বলে আমাদের গাড়ির মেকানিক গাড়িতে উঠে আবার ড্রাইভারকে ডাকাডাকি আরম্ভ করে। মেকানিকের সাথে মাথা নত করে ড্রাইভার গাড়িতে স্টার্ট দেয়। শম্বুক গতিতে মদিনার দিকে চলতে শুরু করে গাড়ি।
মদিনা থেকে নব্বই কিলোমিটার দূরে পৌছার পর অপর গাড়িতে করে যখন মদিনার পথে রওয়ানা হই তখন রাত একটা। কিছুক্ষণ চলার পর চারপাশের অবস্থা দেখে বুঝতে পারি আমরা মদিনার কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। সামনেই কিং খালিদ নামে একটি রিং রোড। মদিনা মনোয়ারাকে বেষ্টন করে কম-বেশি দশ কিলোমিটার ব্যাসার্ধ নিয়ে একটি বৃত্ত অঙ্কন করলে বৃত্তের যে পরিধি পাওয়া যাবে সে পরিধি বা রিংয়ের নামই ‘থার্ড রিংরোড অব কিং খালিদ'। এর কয়েক কিলোমিটার পরেই একইভাবে মদিনাকে বেষ্টন করে রেখেছে আরো একটি রিংরোড। এই রিংরোডটির নাম ইউনিভার্সিটি রোড। 

ইউনিভার্সিটি রোড অতিক্রম করে পাঁচ/সাত কিলোমিটার সামনেই আমির সুলতান রোড। আমির সুলতান রোডের পর থেকে মক্কা মদিনার প্রধান সড়কটির নাম হয়ে যায় হিজরা রোড। হিজরা রোডটি ডানদিকে মোড় ঘুরে পূর্বদিকে অগ্রসর হয়েই আমির আবদুল্লাহ রিংরোড। আমির আবদুল্লাহ রোডটি দ্বিতীয় রিংরোড নামে পরিচিত। কম-বেশি আড়াই কিলোমিটার ব্যাসার্ধ নিয়ে অঙ্কিত বৃত্তাকার রাস্তাটির নামই ‘সেকেন্ড রিংরোড অব আমির আবদুল্লাহ' রোড। মূলত দ্বিতীয় রিং রোড দিয়ে বেষ্টিত এলাকাকেই বলা চলে মদিনা মনোয়ারা এলাকা। অত্র এলাকা সরকার কর্তৃক পরিকল্পিতভাবে নির্মিত সংরক্ষিত এলাকা (প্রটেক্টেড এরিয়া)। এ এলাকার যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই আলো। কখনো কখনো আলোর তীব্রতায় চোখ খোলা রাখা দায় হয়ে পড়ে। খোলা আকাশে ভর দুপুরে সূর্যের দিকে তাকালে চোখের যে হাল হয় এখানে প্রবেশের পর মাঝে মাঝে আমার চোখেরও সে হাল হতে শুরু করে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই চিরচেনা মসজিদে নববীর দীপ্তিমান সুউচ্চ মিনার ও বিশ্ববিদিত সবুজ গম্বুজ চোখে পড়ে। ইতোপূর্বে মদিনা না এলেও এ মসজিদটি আমি বহুবার দেখেছি। বাংলাদেশের অনেক মসজিদসহ টেলিভিশনের পর্দায় এ মসজিদটি এতো বেশিবার দেখেছি যে বাসের জানালার পাশে বসে এক নজর দেখতে-না-দেখতেই চিরচেনা ছবিটি মানসপটে আঁকা হয়ে যায়। বিদ্যুৎ চমকানোর মতো এক ঝল্ক চকায়ে বাস মোড় ঘুরে যায়। বাস কিং ফয়সাল বিন আবদুল আজিজ নামক প্রথম রিং রোড ঘুরতে গেলে পুনরায় নববীর ঔজ্জ্বল্য চোখকে আরেকবার চমকে দেয়। পলকের তরে দেখা এর প্রদীপ্ত রূপের সাথে উপমা কি হতে পারে ভেবে পাচ্ছিলাম না। একবার মনে হলো, জ্যোতির্ম-লের সব জ্যোতিষ্ক একসাথে ভূতলে নেমে এসে নববীকে জ্যোতিষ্মান করে তুলেছে।

২০০৩ খ্রিস্টাব্দে বিলেত গিয়েছিলাম। ইচ্ছে করলো বিলেতের কেন্দ্রস্থল এক নাম্বার জোনে যাব। লন্ডন শহরের কেন্দ্রবিন্দু এক নাম্বার জোনে অবস্থিত। এ উদ্দেশ্যে যতোই লন্ডন শহরের কেন্দ্রের দিকে যাচ্ছি ততোই যানবাহন ও লোকসংখ্যা কমতে শুরু করেছে। এর কারণ হিসেবে জানা গেল ব্রিটিশরা তাদের মাথা খাটিয়ে বিশ্বের ঘরে ঘরে জট বাঁধায়ে নিজের ঘর জট মুক্ত করে রেখেছে। নিজের ঘর জট মুক্ত রাখার জন্য লন্ডন শহরকে কয়েকটি জোনে ভাগ করেছে। এক জোন থেকে আরেক জোনে প্রবেশ করতে হলে কঠিন বাধ্যবাধকতা পালন করতে হয়। মূল লন্ডন শহরকে কেন্দ্র করে আবশ্যকীয় ব্যাসার্ধ নিয়ে যদি পর পর কয়েকটি বৃত্ত অঙ্কন করা হয়, এর মধ্যে লন্ডন শহর থেকে ভেতরের প্রথম বৃত্তটিকে বলা হয় ১ নাম্বার জোন। এ ভাবে বাইরের দিকে একেকটি পরিধির চক্রাকার এলাকাই একেকটি জোন।

মদিনার সংরক্ষিত এলাকাসহ তিন-তিনটি রিংরোড পরিবেষ্টিত ১নং জোনের ভেতর মসজিদে নববীকে ডিমের ভ্রুণের সাথে তুলনা করা চলে। ডিমের আবরণসহ অপরাপর অংশ যেভাবে ভ্রুণকে আগলে রাখে ঠিক সেভাবে মদিনার সংরক্ষিত এলাকাসহ তিন-তিনটি রিংরোড মদিনার প্রাণ মসজিদে নববীকে ভ্রুণের মতো সযত্নে আগলে রেখেছে।

মসজিদে নববী থেকে প্রথম রিংরোডের গড় দূরত্ব কম-বেশি এক কিলোমিটার। প্রথম রিংরোড থেকে দ্বিতীয় রিংরোডের গড় দূরত্ব কম-বেশি চার কিলোমিটার এবং দ্বিতীয় রিংরোড থেকে তৃতীয় রিংরোডের গড় দূরত্ব কম-বেশি দশ কিলোমিটার।

মক্কা মোকাররমার মসজিদে হারামের মতো মদিনা মনোয়ারার মসজিদে নববীই যেন সব। সরকারি-বেসরকারি যাবতীয় স্থাপনা, চিন্তা-চেতনাসহ সকল প্রকার ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে উঠেছে মসজিদে নববীকে কেন্দ্র করেই। ভ্রুণ ছাড়া ডিম যেরকম অর্থহীন মসজিদে নববী ছাড়া সেরকম অর্থহীন হয়ে পড়ে মদিনা মনোয়ারাও। মদিনা মনোয়ারার মসজিদে নববীর পশ্চিম দিকে রাস্তার পাশে হোটেলে প্রবেশ করে যখন খেতে বসি তখন রাত প্রায় তিন ঘটিকা। ব্রেকফাস্ট করার চিন্তা মাথায় ঢুকিয়ে সেহরির সময় খেতে বসে বলাবলি করেছি-
‘ম্যান্ প্রপোজ্ বাট গড ডিসপ্রপোজ়’। ভলভো গাড়ির গড় গতিবেগ ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার। মক্কা থেকে মদিনার দূরত্ব ৪২৭ কিলোমিটার। ৪২৭ কিলোমিটার পাড়ি দিতে যে সময় লেগেছে- এই সময়ের মধ্যে একটি ভলভো গাড়ি জেদ্দা সামুদ্রিক বন্দর থেকে দাম্মাম সামুদ্রিক বন্দরে (১৩৭০ কি. মি.) পৌঁছতে পারে।

এক মাস সিয়াম সাধনার পর ঈদের আনন্দের দিনে এক রাজ্যের ক্ষুৎপিপাসা নিয়ে মাত্র পাঁচ ঘণ্টার পথে উনিশ ঘণ্টা অবস্থান না করলে এতো কিছু জানা কিছুতেই সম্ভব হতো না। তাই ‘জার্নি বাই বাস- মক্কা টু মদিনা’ আমার কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। (সমাপ্ত)

সবার দেশ/কেএম