প্রবন্ধ
মানুষের ছবি
(১ম পর্ব)
ঈদের দিন মক্কা থেকে মদিনা এসে যখন খেতে বসি তখন রাত তিন ঘটিকা। এমন সময় নজরুলের টেলিফোন আসে-
- ভাই, আপনি এখন কোথায়?
- কে বলছেন, প্লিজ?
- ভাই, আমি নজরুল।
ও আচ্ছা। আমি এখন মদিনায়, তুমি এখন কোথায়?
- এখন আমিও মদিনায়।
- বলো কি তুমি? তুমি তো মক্কায় থাকার কথা? তা মদিনায় এলে কখন এবং কিভাবে?
- এই মাত্র গাড়ি থেকে নামলাম। নেমেই আপনার কাছে ফোন করেছি। - তুমি ঢাকা হোটেলের কাছে চলে এসো। খানাপিনা প্রস্তুত, তুমি এলে একসাথে খাবো, খুব মজা হবে। ঢাকা হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে ফোন দিলেই আমার লোক তোমাকে নিয়ে আসবে।
- ভাই, আসা যাবে না। আমার সাথে লোক আছে।
- সাথের লোক নিয়েই এসো।
সম্ভব নয়। সাথে লোকজন অনেক বেশি। আপনি নবী করিম (স.)-এর মাজার জিয়ারতসহ নববী মসজিদে নামায আদায় করতে এসে আমাকে কল দিলে আমি আপনাকে খুঁজে নেব।
আজানের অনেক আগেই আমরা কল্পলোকের মসজিদ মদিনা মনোয়ারার নববীতে চলে যাই। সম্ভবত পশ্চিম দিকের তৈয়বা রেসিডেন্সিয়াল অ্যান্ড কমার্শিয়াল সেন্টার বরাবর যে গেট রয়েছে সে গেটের কাছে গিয়ে-
নজরুল আমরা এসে গেছি, তুমি এখন কোথায়?
- আমরা সবুজ গম্বুজ বরাবর আছি।
- সবুজ গম্বুজ কোন দিকে?
কারো কাছে জিজ্ঞেস করলেই বলে দিবে। ভ‚বনমোহিনী বিশ্ববিখ্যাত সবুজ গম্বুজ। যে কোনো লোক এ গম্বুজ চেনে। তা আপনি এখন কোথায়? - আমি হাম্মামখানার দক্ষিণ পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছি।
- এখানে বহু হাম্মামখানা আছে। এভাবে ঠিকানা দিলে সারাদিনেও খুঁজে পাবো না। হাম্মামখানার নাম্বার বলতে হবে।
- ৪ নং হাম্মাম খানার কাছে এসো।
মিনিট কয়েকের মধ্যেই নজরুল এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে,
ভাই আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না পবিত্র মদিনা মনোয়ারার চত্তরে আমি আপনার সাথে কোলাকুলি করছি। ঈদের নামায আদায় করে আপনি মদিনা চলে আসবেন একবারও জানতাম না। অনেক দিন পর ঈদসহ তিন দিনের ছুটি পেয়েছি। আপনাদের সাথে ঈদের ছুটি কাটানোর জন্য মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে পড়েছি। হঠাৎ দর্শন দিয়ে চমকে দেওয়ার জন্য মক্কা নেমেই আপনাকে ফোন করি। ফোন করে জানতে পারি আপনি মদিনার পথে। তা শুনে আপনাকে চমকে দেয়ার পরিবর্তে আমি নিজেই চমকে উঠি। মরিয়া হয়ে মদিনার টিকেট কিনতে বের হই। হায় আল্লাহ। বাসস্ট্যান্ডে এসে দেখি সব কাউন্টার ফুল। অনেক কষ্টের পর টিকেট পেয়ে কালবিলম্ব না করে চলে এসেছি মদিনায়।
- ভালই হয়েছে। গতকালের বর্ষসেরা আনন্দের দিনটা বর্ষসেরা বিষন্ত্রের দিন হিসেবে চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে। চলো, সবাই একসাথে আজকের দিনটা আনন্দ করে কাটাই।
-সম্ভব নয়। আপনার সাথে মাত্র ঘণ্টা কয়েক কাটাতে পারবো। কারণ, কিছুক্ষণ পরেই বাস ছেড়ে দিবে। আমরা কয়েকজন মক্কা থেকেই রিয়াদের টিকিট বুকিং দিয়ে রেখেছি। কারণ, এ সময় প্রবাসীদের সবাই মক্কা-মদিনা ঘুরতে আসে। মক্কা থেকে অগ্রিম বুকিং দিয়ে না এলে এখন টিকিটই পেতাম না। আপনার সাথে অনেক কথা আছে। টেলিফোনে বলবো। এখন তাড়াতাড়ি আপনার সাথে কয়েকটা ছবি তুলে রাখুন।
- আমার সাথে কোনো ক্যামেরা নেই। তোমার সাথে আছে কি?
আমার সাথে নয়, আপনার সাথেই ক্যামেরা থাকার কথা। কারণ-
- কারণ আমি পর্যটক। পর্যটনকালে একজন পর্যটকের কাছে সব ধরনের ক্যামেরা থাকা চাই। দেশ দেখার উদ্দেশ্যে বের হয়ে হজ্জ্বব্রত পালন করা আর হজ্জ্বব্রত পালন করার উদ্দেশ্যে বের হয়ে দেশ দেখা এক কথা নয়।
কি রকম?
কারণ, নিয়তের ওপর বরকত (পুণ্য) নির্ভর করে। হজ্জব্রত পালনের নিয়তে বের হয়ে দেশ দেখতে এক ফোঁটাও নিষেধ নেই। আবার দেশ দেখার কথা বলে হজ্জব্রত পালনে তিলমাত্র বাধা নেই। দুই প্রকারের নিয়তে ফলাফল এক ও অভিন্ন হলেও বরকতের পাল্লা কিন্তু এক ও অভিন্ন নয়। বাড়ি থেকে হজ্জব্রত পালনের উদ্দেশ্যে বের হওয়ায় আমার ছোট মেয়ে ব্যাগ থেকে ক্যামেরাটাও নামিয়ে রেখেছে। তার মতে, আমার নিয়তটাই কিনা আন্তরিক নয়। নিয়ত আন্তরিক হলে মন ক্যামেরার দিকে না গিয়ে টুপি-তবিহ'র দিকে যেতো। আমার মনের সাথে কাজের মিল নেই। হজ্জব্রত পালনকারী কখনো ক্যামেরা সাথে রাখে না। শুধু ছোট মেয়ে কেন! ধর্মীয় ব্যাপারে আমার পরিবারের সবাই আমাকে সন্দেহের চোখে দেখে। ভিসা প্রাপ্তির পর পর নানা প্রকারের তালিমসহ সবাই আমার পেছনে চৌকিদারি শুরু করে দিয়েছে। এ যাত্রায় ঘরের সবাই মিলে আমাকে মানুষ বানিয়ে ছাড়তে চায়।
সত্যি বলতে কি- এই দেশে, এই বেশে এবং এই পবিত্র নববী এলাকায় আপনাকে এভাবে দেখতে পাবো তা অভাবনীয়। সবই আল্লাহর ইচ্ছা। আল্লাহ পাহাড় ভেঙে সাগর এবং সাগর ভেঙে পাহাড় বানাতে পারে। আমার শৈশব ও তারুণ্য কেটেছে আপনার সাথে। আমার বুঝমান অবধি লক্ষ্য করেছি, মানুষের প্রতি আপনার যতোটুকু মনুষ্যত্ববোধ ছিল আল্লাহর প্রতি ততোটুকু কৃতজ্ঞতাবোধ ছিল না।
ও
তার কারণ হলো, মানুষ ‘স্রষ্টা’ এবং ‘সৃষ্টি’ উভয়ের কাছে ঋণী। স্রষ্টার ঋণ শোধ করলে সৃষ্টি কতটুকু লাভবান হয় আমার জানা নেই। কিন্তু সৃষ্টির ঋণ শোধ করলে স্রষ্টার খুশিসহ সৃষ্টি লাভবান হওয়ার বিষয়টি কোরআনুল করিমের বহু জায়গায় উল্লেখ রয়েছে। স্রষ্টার ঋণ ক্ষমাযোগ্য কিন্তু সৃষ্টির ঋণ ক্ষমাযোগ্য নয়। সৃষ্টির কাছের অপরিশোধিত কোনো কোনো ঋণ পরম করুণাময় আল্লাহও করুণা করেন না। তাই আমি আমার জ্ঞানমান অবদি সৃষ্টির ঋণ আদায়ে সচেতন থাকি। তা ছাড়া আমার কাছে সৃষ্টির ঋণ অতি সামান্য এবং তা আদায়ের পদ্ধতিও অনেক সহজ। মনে করো ক্ষুধার্ত মা তার অভুক্ত সন্তান কোলে নিয়ে তোমার দরজায় দÐায়মান। তুমি এমনই অসহায় যে, একসাথে দু'জনের ক্ষুধা নিবৃত্ত করার ক্ষমতা নেই। এখন তুমিই বলো তোমার কি করা উচিত?
না।
- ‘স্রষ্টা আর সৃষ্টি’র সাথে ‘মা আর শিশু’র উপমাটা ঠিক বোধগম্য হচ্ছে
- তোমার বোধগম্য করার জন্য কিছু প্রেসক্রাইব করতে হয়,
১. ‘জীবে প্রেম করে যেইজন
সেইজন সেবিছে ঈশ্বর।'
২. ‘হাশরের দিন খোদা বলিবেন- হে আদম সন্তান,
তুমি মোরে কর নাই সেবা যবে ছিনু রোগে অজ্ঞান।
মানুষ বলিবে, তুমি প্রভু করতার,
আমরা কেমনে লইব তোমার সেবার ভার।
খোদা বলিবেনÑদেখনি মানুষ কেঁদেছিল রোগের ঘোরে,
তাকে সেবা করিলে তথায় পাইতে মোরে।
৩. ‘মানবতাই মানুষের একমাত্র ধর্ম হওয়া উচিত।'
৪. ‘মানুষের জন্য যাহা কিছু কল্যাণকর তাহাই ধর্ম।'
৫. ‘ধর্ম মানুষের প্রয়োজনে সৃষ্ট, তাই ধর্ম মানুষের মঙ্গলের কথাই বলে।
৬. ‘কোথায় স্বর্গ কোথায় নরক
কে বলে তা বহুদূর?
মানুষের মাঝে স্বর্গনরক
মানুষেতে সুরাসুর।'
৭. ‘সকল ধর্মের মূল কথাই হচ্ছে মানুষ হিসেবে মানুষের সেবা করা।
এই কয়েকটি আপ্তবাক্যের ওপর তোমার শ্রদ্ধা আছে?
অবশ্যই আছে। মহাজ্ঞানী ও মহাজনদের অভিজ্ঞতা নির্যাস এসব নির্মোঘ বাণীর ওপর শ্রদ্ধা-ভক্তি কমে যাচ্ছে বলেই তো আমাদের এই অধঃপতন। তারপরেও এসব আপ্তবাক্য মানুষের মাঝে কোনো প্রকার বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করে না।
- এবার আমাকে বাধ্যবাধকতায় আসতে হচ্ছে
১. “ভাল করবে খোদার সৃষ্ট জীবকে, যেহেতু খোদা তাদেরকে ভালবাসেন যারা অপরের ভাল করে।'
২. ‘যারা আল্লাহকে ভালবাসতে চায়, তাদের সর্বাগ্রে উচিত মানুষকে ভালবাসতে শেখা।
৩. ‘মানবকল্যাণ কর।'
৪. ‘পবিত্র হৃদয় ছাড়া একজনও আল্লাহর নৈকট্যলাভ করতে পারবে না। এসব তো মনে হয় পবিত্র কোরআনুল করিমের উক্তি।
- অবশ্যই কোরআনুল করিমের উক্তি। খাজা মঈনউদ্দিন চিশতি (র.) তাঁর এক দিওয়ানে আল্লাহকে খুঁজে খুঁজে পেরেশান হয়ে বলেছিলেন-
আমি তোমাকে অন্বেষণ করি আর তুমি আমাদের থেকে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াও।
চিশতি (র.) একই দিওয়ানে নিজেই আল্লাহর পক্ষে উত্তর দিয়ে বলেছেন- আমি পর্দাবিহীন, যদি কোনো পর্দা দেখো তবে তা তুমিই।
- আল্লাহ প্রেমিক বান্দাগণ যখন আল্লাহর দিদার লাভের প্রত্যাশায় পাগল হয়ে বন-জঙ্গল,পাহাড়-পর্বত, সাগর-মহাসাগরসহ বিশ্বব্রহ্মা পাতিপাতি করে অন্বেষণ করতে থাকে তখন আল্লাহ বলেন-
- ‘আমি তোমাদের সাথে আছি।’ তা শুনে বান্দা যখন বলে-
- তুমি কোনখানে? আমরা তোমাকে দেখতে পাই না কেন? আল্লাহ আবারো বলেন-
যেদিকে তোমরা মুখ ফিরাও না কেন, সেদিকেই আমার চেহারা বিরাজমান, আমি তোমাদের গীবাস্থিত ধমনী অপেক্ষাও নিকটতর এবং আমি তোমাদের নফসের সাথে মিশে আছি।
এই হলো পবিত্র কোরআনুল করিমে স্রষ্টার সরল স্বীকারোক্তি বিশ্বচরাচরের যেদিকে মুখ ফিরাই সে দিকেই বিশ্বেশ্বরের বিশ্বাশ্লেষী ও বিস্ময়কর বিচক্ষণতা বিলোকন করে বিস্ময়াভিভ‚ত হয়ে পড়ি। বাড়ির সামনে একটি তেঁতুল গাছ। প্রকৃতির অতি তুচ্ছাতিতুচ্ছ একটি তেঁতুল পাতা হাতে নিই। উদ্ভিদবিজ্ঞানের স্বীকৃতমতে একেকটা পাতা একেকটা ফ্যাক্টরি। কাÐের ভেতর দিয়ে মূলের পাঠানো কাঁচা খাদ্য পাতায় পৌছে বিশেষ প্রক্রিয়ায় পাকা খাদ্যে পরিণত হয়। গাছের খাদ্য উপযোগী পাকা খাবার বানিয়ে যেখানে যতটুকু দরকার সেখানে ততটুকু খাবার পাঠিয়ে দেয়। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ মানুষ খাদ্যের সুষম বণ্টনে ভুল করতে পারে- কিন্তু তুচ্ছ তেঁতুল পাতার খাদ্যের সুষম বণ্টনে চুল পরিমাণ ভুল হয় না। খাদ্য প্রস্তুত এবং বিতরণের কাজ ছাড়াও শ্বাসক্রিয়ার কাজও করে থাকে পাতা। শুধু কি তাই, শ্বাসক্রিয়ার সময় পাতা কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে ত্যাগ করে অক্সিজেন।
প্রাণীর বেলায় যা সম্পূর্ণ বিপরীত। যার ফলে উদ্ভিদ আর প্রাণীর মধ্যে শ্বাসক্রিয়ার ন্যাচারাল ভারসাম্য রক্ষা হয়ে থাকে। ক্ষুদ্র একটি তেঁতুল পাতার মধ্যে যে পরিমাণ কলকবজা ও প্রযুক্তি রয়েছে, কোনো প্রকৌশলী সে পরিমাণ কলকবজা ও প্রযুক্তি বাইরে স্থাপন করতে চাইলে (যদিও সম্ভব নয়) আদমজী মিলের জন্য যতটুকু স্থানের আবশ্যক হয়েছিল তার চেয়েও দশগুণ বেশি স্থানের আবশ্যক হবে। আর বিশ হাজার লোক বাইশ বছরে তাজমহল নির্মাণ করে বিশ্বের মধ্যে যে বিস্ময় সৃষ্টি করেছে তার চেয়েও হাজার গুণ বেশি বিস্ময় রয়েছে প্রতিটি তেঁতুল পাতার ভেতর। মনুষ্য সৃষ্ট তাজমহলে নয়- দিব্যদৃষ্টি মেললে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র তেঁতুল পাতার মাঝেই স্রষ্টার লীলা দেখতে পাওয়া যাবে। আল্লাহর স্বীকারোক্তি মোতাবেক এ কথা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত যে, স্রষ্টার নিবাস তার সৃষ্টির মাঝে। স্রষ্টাকে খুঁজে পেতে হলে স্রষ্টা যেখানে বাস করে সেখান থেকেই তাকে খুঁজে বের করতে হয়। ‘স্রষ্টা ও সৃষ্টির’ সম্পর্ক ‘আত্মা ও দেহের সম্পর্কের মতোই। পবিত্র কোরআনুল কারিমের অনেক মিস্ট্রিক্যাল ও আধ্যাত্মিক গূঢ় শব্দের আধ্যাত্মিক অর্থ বের করতে গিয়ে রাসূল কারিম (স.) এর হাদিসে এ উক্ত প্রকাশ পেয়েছে। সবার দেহের মাঝেও আত্মা রয়েছে, সুফি-সন্ন্যাসীদের অনেকে ‘মান আরাফা নাফসাহু ফাকাদ আরাফা রাব্বাহু' এই উক্তির ওপর নির্ভর করে বাইরে খোঁজাখুঁজি না করে নিজের দেহের ভেতরই তাকে খুঁজে পেয়েছেন বলে দাবি করেন।
- স্রষ্টা প্রকৃত অর্থেই মানুষের মাঝে বাস করে।
শুধু মানুষের মাঝে বাস করে বললে খাটো করে বলা হবে। স্রষ্টা তার সকল সৃষ্টি কর্মের ভেতরেই বাস করে।
আমাদের ধর্ম তো তাই বলে।
- শুধু আমাদের ধর্ম বলবে কেন? বিশ্বের প্রধান প্রধান সব ধর্মই বলে ‘ধর্ম মানুষের জন্যÑ ধর্মের জন্য মানুষ নয়'। যেমন-
‘ক্ষুধিত অবস্থায় তোমার বড় শত্রæকেও আহার দাও এবং সে যদি পিপাসার্ত হয় তাকে পান করাও।' (বাইবেল)
‘যে সৎপথে চলে, অন্যায় করে না, পরস্ব অপহরণ করে না, মানুষের মনে দুঃখ দেয় না, জীব হত্যা করে না, এরূপ ব্যক্তিগণকে আমি নির্বাণ লাভ করাই।' (ত্রিপিটক)
পরমেশ্বর সকল প্রাণীতে আছেন সমানভাবে অথচ সকল কিছু নষ্ট হয়ে গেলেও তিনি নষ্ট হন না। যে আমাকে (ভগবান) সকল প্রাণীর মধ্যে দেখতে আমি (উপলব্ধি) পারে এবং সকল প্রাণী আমারই মধ্যে আছে বুঝতে পারে, তার কাছে প্রত্যক্ষ হই। আর সেও আমার কাছে অদৃশ্য থাকে না।' (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা)।
‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে' মধ্যযুগের ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বিষয়ক সমগ্র মঙ্গলকাব্যকে মহিমান্বিত করে রেখেছে ভগবতীর কাছে ভক্তের এই একটি মাত্র দাবি।
ধর্ম এসেছে সৃষ্টির সৌন্দর্য ও কল্যাণের জন্য। সৃষ্টির প্রতি দৃষ্টিহীন শ'শ' ধর্ম ও কৃষ্টি অনাছিষ্টি দোষে দুষ্ট হয়ে সৃষ্টির উচ্ছিষ্ট হিসেবে দৃষ্টির বাইরে ডাস্টবিনে আশ্রয় নিয়েছে কবেই। তাই ধর্ম, সংস্কৃতি ও কৃষ্টির মূল শর্ত ‘সত্যমঃ শিবমঃ সুন্দরমঃ'। সৃষ্টির কল্যাণ বলতে প্রথমেই আসে আশরাফ-উল- মাখলুকাতের কথা। ধর্ম যখন আশরাফ-উল-মাখলুকাতের কল্যাণের কথা বলে তখন কে হিন্দু, কে খ্রিস্টান, কে বৌদ্ধ এবং কে মুসলমান তা চিহ্নিত করে বলে না। ধর্মের নামে যারাই যখন আশরাফ-উল-মাখলুকাতকে বিভাজন করতে গিয়েছে তারাই তখন ‘শিব গড়তে বানর' গড়ে নিজেরাই বিভাজিত হয়ে গেছে। ত্রয়োদশ শতাব্দীর ঋষি, কবি ও আধ্যাত্মিক সম্রাট মাওলানা জালালুদ্দিন মোহাম্মদ রুমি বলে গেছেন ‘অবিশ্বাস এক ধরনের ধর্ম, এবং ধর্মীয় গোঁড়ামি এক ধরনের অবিশ্বাস'। রুমির এ দর্শন মুসলমান ছাড়াও বিভিন্ন গোত্র, ধর্ম ও বর্ণের মানুষ গ্রহণ করেছে। তাঁর এ দর্শন সর্বজনস্বীকৃত এবং বিশ্বজনীনতা লাভ করেছে বলেই সারা বিশ্ব জুড়ে এখনো রুমি, তাঁর কবিতা ও আধ্যাত্মিকতার ওপর সেমিনার-সিম্পোজিয়াম অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ইউনেস্কো তাঁর ৮০০তম জন্মবার্ষিকীর বছর ২০০৭ সালকে ‘স্মরণ বছর’ ঘোষণা করে তাঁকে আধ্যাত্মিক গুরু হিসেবে চিরস্মরণীয় করে রেখেছে। এক কালের বিশাল পৃথিবীটা যেখানে দিনদিন আঙুলের ডগা হয়ে আলপিনের মাথায় চলে আসছে- সেখানে আধুনিক বিশ্বায়ন প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে স্বর্গ-নরকের লোভ-আতংকের কথা রেখে ধর্ম থেকে মানুষের কল্যাণের কথা বের করতে হবে। মনে রাখতে হবে, হুজুরের ‘চালপড়া’ আর কবিরাজের ‘বাটি চালান' দিয়ে চোর শিকার করার দিন ফুরিয়ে গেছে।
আমাদের ধর্মপদ্ধতির উদ্ঘাটিত কিংবা অনুদ্ঘাটিত এমন কোনো দিক নেই যা কোনো না কোনো ভাবে মাখলুকাতের কল্যাণে আসে না। অসংখ্য উদাহরণের মধ্যে যেমন, পাঁচ ওয়াক্ত নামায ও অজু করার ফলে যে যে উপকার হয় তা নিম্নরূপ :
অজু করার ফলে বহিরাঙ্গ বাইরের জীবাণুমুক্ত থাকে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন বস্ত্রাদি স্বাস্থ্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অনেক প্রকার ব্যায়ামের চেয়ে নামায একটি উৎকৃষ্ট ব্যায়াম। এ রকমের ব্যায়াম শরীরের ভেতর-বাহির সকল অঙ্গেরই উপকারে আসে। বাতব্যথা, ডায়াবেটিস, হাইপ্রেসারসহ হৃদরোগের মহৌষধ হলো নিয়মিত নামায আদায় করা। নামাযে বহুবার হাত ওঠানামা, সিজদা ও রুকুর ফলে ফুসফুস প্রশস্ত হয়, মস্তিষ্কে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করে ও পাকস্থলী সবল হয়ে হজমে সহায়তা করে। নামাযের সময় বিশেষ ভঙ্গিতে আসন গ্রহণ করার ফলে পায়ের পাতা ও গোড়ালিতে সুষম রক্তসঞ্চালন হয়, ডান-বামে সালাম ফিরানোর কারণে যোগমার্গসহ গ্রীবার রক্তবাহী নাড়ির রক্তসঞ্চালন সহজ ও সুগম হয়। শারীরিক দিক ছাড়াও জামায়েতে নামায আদায়ের পদ্ধতি মানুষে মানুষে ছোট-বড় বৈষম্য দূর করে ভেদাভেদহীন সাম্যবাদ শিক্ষা দেয়। নিয়মিত নামায আদায় দেহমনে এক ধরনের অতীন্দ্রিয় পুলক ও সুখানুভূতি বয়ে আনে। দেহমনের অতীন্দ্রিয় পুলক ও সুখানুভূতি মানসিক অশান্তি ও বিষণ্ণতা দূর করে শাশ্বত সুখ-স্বস্তি ফিরিয়ে দেয়। প্রকৃত রোজা পালন বলতে উপবাসের সাথে ষড়রিপু থেকে সংযম থাকাকে বুঝায়। আজকাল ভূড়িবহুল কোন লোক চিকিৎসকের কাছে গেলেই বলতে শোনা যায় “বেশিদিন বাঁচতে চাইলে কম কম খান।” বেশিদিন বাঁচার জন্য কম করে খাওয়ার বিষয়টি ঊনবিংশ শতাব্দীতে এসে চিকিৎসাবিজ্ঞান আবিষ্কার করলেও আলেম-উল- গায়েব জানতেন সৃষ্টির শুরু থেকেই। আর সে কারণেই পরিপূর্ণ ভোজ ইসলাম ধর্মে সিদ্ধ নয়। একবার কোন এক অনুষ্ঠানে জাকির নায়েককে প্রশ্ন করা হয়েছিল,-‘মুসলমানগণ নন-ভেজিটেরিয়ান, বিধায় তারা নির্দ্বিধায় গরু-ছাগল-ভেড়া ইত্যাদি পশুর মাংস ভক্ষণ করে। ফলে খাদ্যবস্তুর ছায়াপাত তাদের বাস্তব জীবণেও পতিফলিত হয়। পক্ষান্তরে, যারা ভেজিটেরিয়ান, তাদের স্বভাবে প্রতিফলিত হয় ভেজিটেবলের মতো নম্র ও উপদ্রহীনতার ছায়াপাত। এ বিষয়টি কতটুকু সঠিক?” এ প্রশ্নের উত্তরে জাকির নায়েক বলেছিলেন, “আপনার এ যুক্তি মোটেও সঠিক নয়। কারণ, ইসলাম ধর্মে মাদকদ্রব্য চরমভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ধূম্রজাতসহ যেকোন মাদক ভেজিটেবলজাত সামগ্রী থেকেই তৈরি হয়ে থাকে।” জাকির নায়েক যতো সহজে এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পেরেছেন, অনেকের পক্ষেই ততো সহজে উত্তর দেয়া সম্ভব ছিল না। তিনি ইসলামের বিভিন্ন দিক অনুসন্ধান করেন বিধায় ইসলামের প্রতিটি অঙ্গের আবশ্যকতার বিষয় বলতে পেরেছেন। পবিত্র কালামের ভাষার মধ্যে শাব্দিক এবং ভাবার্থ ছাড়াও অসংখ্য রূপক অর্থ রয়েছে। দিন যতোই যাবে, রূপক শব্দ ও অক্ষরের রহস্য ততোই উম্মোচিত হচ্ছে, রহস্য যতোই উম্মোচিত হচ্ছে, ততোই জানা যাচ্ছে, ইসলামের বিধি- বিধানে উল্লেখিত সব কিছুই মানব জীবনে আবশ্যক-কোন বিষয়ই অহেতুক ও অমূলক নয়।
প্রকৃত রোজা পালনে পারলৌকিক কল্যাণ ছাড়াও দৈহিক ও মানসিক কল্যাণের বর্ণনা দু'চার কথায় শেষ করা যাবে না। ইসলাম ধর্মের নিয়মানুসারে রোজার মাসে খানাপিনা বেহিসেবী করার সাথে কম-বেশি চৌদ্দ ঘণ্টা উপবাস কাটাতে হয়। চৌদ্দ ঘণ্টা উপবাস কাটানোর পর পর অতিরিক্ত নামায যুক্ত হওয়ার সুফল চিকিৎসা বিজ্ঞান আবিষ্কার করতে পেরেছে। চিকিৎসা বিজ্ঞান সূত্রে প্রকাশ, রমজান মাসে বেহিসেবী রসনা পূজোর সাথে অতিরিক্ত ব্যায়াম যুক্ত না হলে শরীরে চর্বিসহ মেদ-ভুঁড়ি জমতে পারে। আর সে কারণেই প্রতি বছর অলস রসনা পূজারীদের মধ্য থেকে যে পরিমাণ মানুষ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে নিয়মিত ধর্মচর্চাকারীদের মধ্য থেকে এর সিকি পরিমাণ মানুষও ঘাতকব্যাধি হার্টঅ্যাটাক বা ব্রেইনস্ট্রোকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে না। সা¤প্রতিক চিকিৎসা বিজ্ঞান এও স্বীকার করেছে যে, সাধারণত অলস ভোজন বিলাসীর চেয়ে নিরলস উপবাসী মানুষ দীর্ঘজীবি হয়ে থাকে।
আমাদের ধর্ম পদ্ধতিগুলো প্রবর্তনকালে কোরআনের অনেক অর্থসহ চিকিৎসা বিজ্ঞানের নানা দিক অনুদ্ঘাটিত ছিল। যার ফলে আমাদের ধর্মবেত্তাগণের নিকট থেকে আমরা শুধু উদ্ঘাটিত বিষয়ের উপর উপকারের বর্ণনা শুনে থাকি। ধর্মের অনুদ্ঘাটিত দিকগুলো মানুষের অজানা থাকলেও “আ'লা কুল্লি শাইয়্যিন আ'লিম' ঠিকই জানতেন। ‘আ’লা কুল্লি শাইয়্যিন আ'লিম' ঠিকই জানতেন, অধিক পরিমাণে মুখরোচক খাবার ব্যায়ামহীন শরীরে কোলেস্টেরল বা চর্বি জমে রক্তনালী বন্ধ করে দিতে পারে। হঠাৎ রক্তনালী বন্ধ হয়ে শারীরে ভ‚মিকম্পের দ্বারা এক পলকে ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যাওয়ার কথা ‘আলেম উল গায়েব' সৃষ্টির শুরু থেকেই জানতেন। জানতেন বলেই সবার অজান্তে শারীরিক মহাপ্রলয়ের নিয়ামকও দিয়ে রেখেছেন। এ অজানা নিয়ামকের সুফল শুধু তারাই পেয়েছে যারা স্রষ্টার আদেশ-নির্দেশ পালন করেছিল। পবিত্র কোরআনুল কারিমে এখনো প্রকাশের অঘোচরে এমন সব মিস্টিক বা অতীন্দ্রিয় বাণী, শব্দ ও অক্ষর রয়েছে যেসব মিস্টিক্ বাণী, শব্দ ও অক্ষরের গুপ্ত রহস্য ধীরে ধীরে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সংস্পর্শে এসে উদঘাটন হচ্ছে। আধ্যাত্মিক রহস্য উদ্ঘাটনের ফলে এর জাগতিক কল্যাণের দিক লক্ষ্য করে আধুনিক বিশ্বের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি হতবাক্। তাই অনেক অমুসলিমও কোরআনকে চিকিৎসা বিজ্ঞান ও মানব কল্যাণের আধার হিসেবে চিহ্নিত করে এর গুপ্ত রহস্য বের করার জন্য গবেষণা শুরু করে দিয়েছে। উপরে শুধু নামায ও অজুর জাগতিক কল্যাণের দিক দেখানো হলোÑ এ রকম হজ্জ, যাকাত, রোজাসহ ইসলামের পরতে পরতে রয়েছে মানুষের ইহলৌকিক কল্যাণের সুব্যবস্থা মানুষের আবিষ্কৃত এক ঘন মিলিমিটার ধাতব নির্মিত প্রযুক্তির ভিতর যদি এক মহাসমুদ্রের সাহিত্যভান্ডারর লুকিয়ে থাকতে পারে তবে ‘খায়রুল মালিকিন’-এর নির্মিত প্রযুক্তির (কোরআন) ভেতর বিশ্বজনীন জ্ঞানভাÐারসহ মানব কল্যাণের সকল রহস্য লুকিয়ে থাকতে পারবে না কেন? ইসলাম বিশ্বমানবের শান্তি ও স্বস্তির মহীরুহ। ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে আরবের ধূসর মরুতে যে মহীরুহের বীজ রোপিত হয়েছিল মাটি ও মানুষের সাথে সম্পর্ক ছিল বলেই সে বীজ আজ বিশ্বব্যাপী বিশ্বজনের শান্তি ও স্বস্তির মহীরুহে পরিণত হয়েছে। এই মহীরুহ যদি কোনো কারণে মাটি ও মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে তবে মাটি ও মানুষের সাথে সম্পর্কহীন অপরাপর যেসব ধর্ম বিশ্ব থেকে শতাব্দীর ঘূর্ণাবর্তে হারিয়ে গেছে ইসলামও সেভাবে ঘূর্ণাবর্তে পড়ে যেতে পারে। নদী হারিয়ে গেলে মাছের যে অবস্থা হয় ধর্ম হারিয়ে গেলে ধর্মজীবীদেরও সে অবস্থা হবে। তাই আমাদের ধর্মবেত্তাগণের প্রতি অনুরোধ, ধর্মজীবী পেশা ছেড়ে ধর্ম বিশারদ ও ধর্ম গবেষক হন।
শৈশবে সব পারিবার প্রধানই তাদের সন্তানকে শাসন-নিয়ন্ত্রণের দ্বারা পথে রাখতে চায়। পরিবার প্রধানের কঠোর শাসন-নিয়ন্ত্রণ সব সন্তান পছন্দ করে না। তাই অধিকাংশ সন্তান পরিবার প্রধানের শাসন নিয়ন্ত্রণের বাইরে বিপথে চলে যায়। পরিণত বয়সে সব সন্তানই পরিবার প্রধানের শাসন নিয়ন্ত্রণ মানা- নামানার ফলাফল টের পেতে শুরু করে। শৈশবের পরিবার প্রধানের মতো বিশ্ব মানবতারও প্রতিপালক প্রধান রয়েছেন। বিশ্বব্রাহ্মান্ডের প্রতিপালকও বিশ্ব মানবতাকে শাসন নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়। বিশ্ব প্রতিপালকের কঠোর শাসন- নিয়ন্ত্রণও সবাই পছন্দ করে না। তাই অনেকেই বিশ্ব নিয়ন্ত্রকের শাসন- নিয়ন্ত্রণের বাইরে বিপথগামী হয়ে পড়ে। এককালে শিশুর মতোই বিশ্ব নিয়ন্ত্রকের শাসন-নিয়ন্ত্রণ মানা-নামানার ফলাফল টের পেয়ে যায়। টের পাওয়ার পর ঢের চেষ্টা করেও ফের সারানো যায় না। একজন শিশু আর একটি মানব সভ্যতা এ দু'য়ের পরিণত হওয়ার দূরত্ব এবং কালও এক নয়। তাই পরিবার প্রধানের শাসন-নিয়ন্ত্রণ মানা না মানার ফলাফলটি যত তাড়াতাড়ি টের পাওয়া যায় বিশ্ব নিয়ন্ত্রকের শাসন-নিয়ন্ত্রণ মানা না মানার ফলাফলটি তত তাড়াতাড়ি টের পাওয়া যায় না। (চলবে,,,)
লেখক : আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক