পরবর্তী তারিখ ২১ মে
সাগর-রুনি হত্যা: তদন্ত প্রতিবেদন ১১৮ বার পেছালো

সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরোওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময়সীমা আবারও বৃদ্ধি করেছে ঢাকার একটি আদালত। ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট এম এ আজহারুল ইসলাম আগামী ২১ মে পর্যন্ত নতুন সময় নির্ধারণ করেছেন।
এ নিয়ে এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময়সীমা ১১৮তম বারের মতো পিছিয়েছে, যা দেশের ইতিহাসে একটি নজিরবিহীন ঘটনা। এ বিলম্বে ভুক্তভোগী পরিবার, সাংবাদিক সমাজ এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা আরও গভীর হয়েছে।
তদন্তের সর্বশেষ অগ্রগতি
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) গত বছরের ৪ নভেম্বর এ মামলার তদন্তভার গ্রহণ করে। তদন্ত কর্মকর্তা মো. আজিজুল হক, যিনি পিবিআই-এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন, আদালতের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে ব্যর্থ হওয়ায় এ নতুন সময়সীমা দেয়া হয়েছে। পিবিআই সূত্র জানায়, তারা ইতোমধ্যে অর্ধশতাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেছেন, যাদের মধ্যে আদালতের অনুমতি ছাড়াই জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
এছাড়া, পিবিআই সম্প্রতি ছয়জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে, যারা বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। এরা হলেন:
- বরখাস্ত সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান
- সাবেক অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক (এডিজি) মশিউর রহমান
- সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক
- প্রাক্তন নৌবাহিনী কর্মকর্তা মোহাম্মদ সোহেল
- জোড়া খুনের মামলার অভিযুক্ত হুমায়ুন কবির
- পলাশ রুদ্র পাল
এ জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে তদন্তে কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে কিনা, তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে, পিবিআইয়ের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তারা মামলার রহস্য উদঘাটনের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।
মামলার পটভূমি
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ভোরে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারে তাদের ভাড়া বাসায় নৃশংসভাবে খুন হন মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরোওয়ার এবং এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনি। ঘটনার সময় তাদের একমাত্র পুত্র, পাঁচ বছর বয়সী মাহির সরোওয়ার মেঘ, বাসাতেই উপস্থিত ছিলো। সকালে মাহিরই তার দাদিকে ফোন করে ঘটনাটি জানায়। এ হত্যাকাণ্ড দেশজুড়ে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং সাংবাদিক সমাজের মধ্যে ন্যায়বিচারের দাবি উঠে।
পরদিন, ১২ ফেব্রুয়ারি, রুনির ভাই নওশের আলী রোমান বাদী হয়ে শেরেবাংলা নগর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। প্রাথমিকভাবে শেরেবাংলা নগর থানা পুলিশ তদন্ত শুরু করে, তবে তিন দিন পর মামলাটি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হাতে হস্তান্তরিত হয়। ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল ডিবি তদন্তে ব্যর্থতার কথা স্বীকার করলে মামলাটি র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) কাছে হস্তান্তর করা হয়। দীর্ঘদিন র্যাবের তদন্তে কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় গত বছর হাইকোর্টের নির্দেশে মামলাটি পিবিআই-এর কাছে হস্তান্তরিত হয়।
গ্রেফতার ও তদন্তের চিত্র
মামলার তদন্তে এ পর্যন্ত আটজন সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা হলেন: কামরুল ইসলাম ওরফে আরুণ, আবু সাঈদ, রফিকুল ইসলাম, বকুল মিয়া, মাসুম মিন্টু, পলাশ রুদ্র পাল, হুমায়ুন কবির ওরফে এনামুল হক এবং তানভীর রহমান খান। এদের মধ্যে তানভীর এবং পলাশ বর্তমানে জামিনে রয়েছেন, বাকিরা কারাগারে। তবে, গ্রেফতারকৃত এ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনও শক্ত প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি, এবং মামলার মূল রহস্য—হত্যার উদ্দেশ্য—এখনও অজানা।
তদন্তে পুলিশ প্রাথমিকভাবে জানিয়েছিলো, ঘটনাস্থল থেকে কিছু চুরি হয়নি। তবে পরবর্তীতে সাগরের ল্যাপটপ এবং মোবাইল ফোন চুরির তথ্য পাওয়া যায়। এছাড়া, তিনটি মোবাইল ফোন প্রমাণ হিসেবে উদ্ধার করা হয়েছে বলেও দাবি করা হয়। তদন্তকারীরা ধারণা করছেন, হত্যাকাণ্ডটি পূর্বপরিকল্পিত ছিলো এবং এটি এমন কেউ ঘটিয়েছে, যারা সাগর ও রুনির সঙ্গে পরিচিত ছিলো।
সম্ভাব্য উদ্দেশ্য ও জনমত
সাগর ও রুনি তাদের সাংবাদিকতার মাধ্যমে বাংলাদেশের জ্বালানি খাতের দুর্নীতি এবং সংখ্যালঘু অধিকার নিয়ে স্পর্শকাতর প্রতিবেদন তৈরি করছিলেন। অনেকে মনে করেন, এ প্রতিবেদনগুলোই হত্যার পেছনে সম্ভাব্য কারণ হতে পারে। এছাড়া, ঢাকায় একটি গুজব ছড়িয়েছিল যে, তারা একটি শক্তিশালী করপোরেশনের জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত স্পর্শকাতর তথ্যের অধিকারী ছিলেন। তবে, তদন্তকারীরা এখনও এ দাবিগুলোর সত্যতা নিশ্চিত করতে পারেনি।
সাম্প্রতিক একটি বিতর্কিত দাবিতে বলা হয়েছে, ফাঁস হওয়া কল রেকর্ডের ভিত্তিতে এ হত্যাকাণ্ডে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে সংসদ সদস্য শাওনের একটি কিলার স্কোয়াড জড়িত ছিলো। তবে, এ দাবির পক্ষে কোনো শক্ত প্রমাণ পাওয়া যায়নি, এবং এটি মূলত রাজনৈতিক বিতর্কের অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
পরিবার ও সাংবাদিক সমাজের ক্ষোভ
সাগরের মা সালেহা মনির এবং রুনির ভাই নওশের আলী রোমান বারবার তদন্তের ধীরগতির বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। সালেহা মনির বলেছেন, এ হত্যার পেছনে বড় কেউ আছে। যদি এটি চোর বা ডাকাতের কাজ হতো, তাহলে এতদিনে প্রকাশ পেতো। নওশের আলী রোমান গত বছর শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর নতুন তদন্ত সংস্থার প্রতি আশা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, আমরা চাই, নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে হত্যাকারীদের পরিচয় প্রকাশ পাক। বর্তমান সরকারের কাছে এ রহস্য উদঘাটনের প্রত্যাশা রাখি।
সাংবাদিক সমাজ এ মামলাকে বাংলাদেশে প্রেস স্বাধীনতার ওপর একটি বড় আঘাত হিসেবে দেখছে। আন্তর্জাতিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এ মামলার দীর্ঘসূত্রিতার সমালোচনা করে একটি আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি জানিয়েছে।
তদন্তে বাধা ও সমালোচনা
এ মামলার তদন্তে বারবার বাধার সম্মুখীন হওয়ার কথা জানিয়েছে তদন্ত সংস্থাগুলো। প্রাথমিকভাবে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে হত্যাকারীদের গ্রেপ্তারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তবে, ১৩ বছর পরও মামলাটি সমাধানের কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। হাইকোর্ট গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর র্যাবের তদন্তে ব্যর্থতার বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছিলো, এ বিলম্ব দুর্ভাগ্যজনক এবং বিস্ময়কর, যা কেবল পরিবার নয়, পুরো জাতির জন্য ক্ষতিকর।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, এ মামলার পেছনে শক্তিশালী রাজনৈতিক বা বাণিজ্যিক স্বার্থ জড়িত থাকতে পারে, যা তদন্তকে জটিল করে তুলেছে। এছাড়া, তদন্ত সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব এবং সরকারি সদিচ্ছার ঘাটতিও এ বিলম্বের জন্য দায়ী বলে অভিযোগ উঠেছে।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
গত বছরের অক্টোবরে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এ মামলার তদন্ত ত্বরান্বিত করতে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন টাস্কফোর্স গঠন করে, যার নেতৃত্বে রয়েছেন পিবিআই প্রধান। টাস্কফোর্সকে ছয় মাসের মধ্যে তদন্ত শেষ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বাদীপক্ষের আইনজীবী এবং পিবিআই প্রধান আশা প্রকাশ করেছেন যে, এবার মামলার রহস্য উদঘাটিত হবে। তবে, পূর্বের বিলম্ব এবং ব্যর্থতার ইতিহাস পরিবার ও জনগণের মধ্যে সন্দেহের জন্ম দিয়েছে।
এ মামলা কেবল সাগর ও রুনির পরিবারের জন্যই নয়, বাংলাদেশের সাংবাদিকতা ও ন্যায়বিচার ব্যবস্থার জন্যও একটি বড় পরীক্ষা। দ্রুত, স্বচ্ছ এবং নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে এ হত্যাকাণ্ডের সত্য উদঘাটন না হলে দেশে প্রেস স্বাধীনতা ও আইনের শাসনের প্রতি আস্থা আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
সবার দেশ/এমকেজে