তিন সাংবাদিক চাকরিচ্যুত
দীপ্ত টিভির সংবাদ প্রচার বন্ধ

বাংলাদেশের বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল দীপ্ত টিভি তাদের সংবাদ সম্প্রচার কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করেছে। এর পাশাপাশি দুইজন সাংবাদিককে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। একই সঙ্গে এটিএন বাংলার একজন সাংবাদিক এবং চ্যানেল আইয়ের একজন রিপোর্টারও তাদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন।
সোশ্যাল মিডিয়ায় এ ঘটনার মূল কারণ হিসেবে সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সারোয়ার ফারুকীর সংবাদ সম্মেলনে ‘জুলাই অভ্যুত্থান’ নিয়ে করা বিতর্কিত প্রশ্নকে চিহ্নিত করা হচ্ছে।
মঙ্গলবার (২৯ এপ্রিল ২০২৫) দীপ্ত টিভি তাদের স্ক্রলে এক ঘোষণার মাধ্যমে জানায়, ‘অনিবার্য কারণে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত সমস্ত সংবাদ সম্প্রচার স্থগিত থাকবে।’ চ্যানেল কর্তৃপক্ষ এ সিদ্ধান্তের পেছনে কোনও বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রকাশ করেনি।
তবে, সূত্র মতে, সম্প্রতি ফারুকীর সংবাদ সম্মেলনে দীপ্ত টিভির সিনিয়র রিপোর্টার মিজানুর রহমানের করা একটি প্রশ্ন বিতর্কের সূত্রপাত করে। প্রশ্নটি ছিলো ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন বা ‘জুলাই অভ্যুত্থান’-এ নিহত ১,৪০০ শহীদের তালিকা এবং তাদের শহীদ হিসেবে ঘোষণার বৈধতা নিয়ে। এ প্রশ্নকে ‘অবমাননাকর’ এবং ‘গণহত্যার পক্ষে অবস্থান’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।
এ ঘটনার জেরে দীপ্ত টিভি অভ্যন্তরীণ তদন্ত শুরু করে এবং দুই সাংবাদিক—মিজানুর রহমান এবং মাহমুদ শাওনকে চাকরিচ্যুত করে। একইভাবে, এটিএন বাংলার বিশেষ প্রতিনিধি মো. ফজলে রাব্বি এবং চ্যানেল আইয়ের একজন রিপোর্টার (নাম প্রকাশিত হয়নি) তাদের পদ থেকে অব্যাহতি পান।
চ্যানেল আই এক ফেসবুক বার্তায় জানায়, তাদের রিপোর্টারের ‘অপেশাদার আচরণের’ কারণে তদন্ত শুরু হয়েছে এবং তাকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে।
তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সচিবালয়ে ‘ফ্যাসিবাদের ১৫ বছরে গণমাধ্যমের বাস্তবতা’ শীর্ষক এক মতবিনিময় সভায় এ বিষয়ে বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, দীপ্ত টিভির সাংবাদিক গণহত্যার পক্ষে প্রশ্ন করার প্রেক্ষিতে তারা নিজেরাই সংবাদ কার্যক্রম বন্ধ করেছে। সরকার এখানে কিছু বলেনি, কাউকে কলও দেয়া হয়নি। তিনি আরও উল্লেখ করেন, মন্ত্রিত্বের ছয় মাসে আমরা কোনও সাংবাদিক বা গণমাধ্যমের সঙ্গে যোগাযোগ করে কোনো নির্দেশনা দিইনি। তবে, তিনি স্বীকার করেন যে এ ঘটনা সরকারের ওপর দায় চাপাতে পারে।
এ ঘটনা সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। একাধিক পোস্টে দাবি করা হয়েছে, দীপ্ত টিভির সংবাদ প্রচার বন্ধ এবং সাংবাদিকদের চাকরিচ্যুতি বাকস্বাধীনতার ওপর হুমকি।
অন্যদিকে, কেউ কেউ এই পদক্ষেপকে সমর্থন করে বলেছেন, সাংবাদিকরা ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী খুনি হাসিনার প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে জুলাই অভ্যুত্থানের শহীদদের অবমাননা করেছেন। একটি পোস্টে বলা হয়, তিনজন সাংবাদিক—মিজানুর রহমান (দীপ্ত টিভি), বাশার (চ্যানেল আই), এবং ফজলে রাব্বি (এটিএন বাংলা)—স্বৈরাচার হাসিনার প্রতি আনুগত্যের কারণে চাকরিচ্যুত হয়েছেন।
‘জুলাই অভ্যুত্থান’ বা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, যেখানে সরকারি হিসেবে ১,৪০০-এর বেশি মানুষ নিহত হন। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কমিশনের রিপোর্টেও প্রায় দেড় হাজারের মতো আন্দোলনকারীর নিহত হওয়ার তথ্য এসেছে। এ আন্দোলনের ফলে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে এবং অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসে। এ প্রেক্ষাপটে, আন্দোলনের শহীদদের নিয়ে যেকোনও প্রশ্ন বা মন্তব্য অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
দীপ্ত টিভির সাংবাদিক মিজানুর রহমান, যিনি আগস্ট ২০২৪-এর আগে প্রধানমন্ত্রীর বিট কভার করতেন, ফারুকীকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘জুলাই মাসে ১,৪০০ শহীদের কথা আপনি বলছেন, তার তালিকা কোথায়? বিচারের আগে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করছেন কীভাবে?’ এ প্রশ্নকে অনেকে আন্দোলনের ত্যাগের প্রতি অবমাননাকর হিসেবে দেখেছেন, যা চ্যানেলের উপর জনরোষের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এতে স্বপ্রনোদিত হয়েই চ্যানেল কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট সাংবাদিককে তার দায়িত্ব থেকে অব্যহতি দেন এবং চ্যানেলের সংবাদ প্রচার সাময়িক স্থগিত রাখার ঘোষণা দেন।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, এ ঘটনা বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং সাংবাদিকদের পেশাগত দায়বদ্ধতার উপর নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে। একদিকে, সাংবাদিকদের চাকরিচ্যুতি এবং দীপ্ত টিভির সংবাদ প্রচার বন্ধ করা বাকস্বাধীনতার উপর চাপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। অন্যদিকে, জনগণের একাংশ মনে করে, গণমাধ্যমের কিছু অংশ পূর্ববর্তী ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে জনগণের আন্দোলনের প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করেছে।
সবার দেশ/কেএম