Header Advertisement

Sobar Desh | সবার দেশ সবার দেশ প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১৫:৪২, ৭ মার্চ ২০২৫

আপডেট: ১৫:৪৩, ৭ মার্চ ২০২৫

নাটাই কোলকাতায় আর ঘুড়ি উড়ছে ঢাকায়

আওয়ামী মাফিয়াদের ‘হেডকোয়ার্টার’ এখন কোলকাতা

তাদের ইশারায় অশান্ত হয়ে উঠছে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল। সংক্রিয় হচ্ছে নিষিদ্ধ সর্বহারা গ্রুপ। রোহিঙ্গা ক্যাম্পসহ পার্বত্য অঞ্চল অশান্ত করার পেছনেও আছে তাদেরই হাত। এসব করতে বিনিয়োগ করছেন বিপুল পরিমাণ অর্থ। যা গত ১৬ বছরে অবৈধভাবে আয় করেছেন।

আওয়ামী মাফিয়াদের ‘হেডকোয়ার্টার’ এখন কোলকাতা
ফাইল ছবি

ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের পলাতক নেতাদের অনেকেই ভারতের দিল্লি, পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসামে ঘাঁটি গেড়েছেন। ফ্যাসিস্ট লীগের পলাতকদের ‘হেডকোয়ার্টার’ হচ্ছে কোলকাতা। খুনি হাসিনার নেতৃত্বে এখানে বসেই যাবতীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন করছেন তারা।

৫ আগস্টের পর পতিত শাসক দলের প্রায় ৪৫ হাজার নেতাকর্মী ভারতে এসেছেন। তার মধ্যে অধিকাংশই কোলকাতায়। এরা ফেসবুক, মেসেঞ্জার, টেলিগ্রাম, সিগন্যাল, হোয়াটসআপ গ্রুপসহ বিভিন্ন ডিজিটাল এবং সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখছেন। 

শুধু তাই নয়, শান্তিতে নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ করতেও পরাজিত এ চক্রটির সদস্যরা কষছেন নানা ছক। অপকর্ম বাস্তবায়নের নির্দেশও দিচ্ছেন এসব মাধ্যম ব্যবহার করে।

ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরের চিহ্নিত শীর্ষ সন্ত্রাসী, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী, ভাড়াটে কিলার, মাদক ব্যবসায়ী, সোনা কারবারি, সীমান্তবর্তী এলাকার চিহ্নিত স্মাগলার, সশস্ত্র সর্বহারা গ্রুপের সদস্যসহ বিভিন্ন গ্রুপের সঙ্গে এ নেতারা যোগাযোগ রাখছেন। তাদের ইশারায় অশান্ত হয়ে উঠছে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল। সংক্রিয় হচ্ছে নিষিদ্ধ সর্বহারা গ্রুপ। রোহিঙ্গা ক্যাম্পসহ পার্বত্য অঞ্চল অশান্ত করার পেছনেও আছে তাদেরই হাত। এসব করতে বিনিয়োগ করছেন বিপুল পরিমাণ অর্থ। যা গত ১৬ বছরে অবৈধভাবে আয় করেছেন।

আওয়ামী লীগের পলাতক নেতাদের ধারণা, দেশ অস্থিতিশীল হলে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ব্যর্থ হবে। এতে করে শেখ হাসিনাসহ দলের নেতাদের বিরুদ্ধে যে বিচার প্রক্রিয়া চলছে তা বাধাগ্রস্ত হবে। নির্বাচন প্রক্রিয়াকেও বানচাল করা যাবে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এ মুহূর্তে কোলকাতায় অবস্থান করা দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দীন নাছিম বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমকে বলেন, এটাকে ঠিক পালিয়ে আসা বলা যায় না। কৌশলগত কারণে সাময়িকভাবে আমরা আত্মগোপনে আছি।

কোলকাতার সল্ট লেকে আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক সংসদ-সদস্য পঙ্কজ নাথ বলেন, আমরা আপাতত আন্ডারগ্রাউন্ড আছি, ডিজিটাল মাধ্যমেই নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে বাধ্য হচ্ছি। 

তিনি দাবি করেন, আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে দলের সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ আছে। শেখ হাসিনাকে অ্যাপের মাধ্যমে মেসেজ দিয়ে রাখলে তিনি তার সময়মতো জবাব দেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পলাতক নেতাদের অনেকেই দিল্লি, পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসামে ঘাঁটি গেড়েছেন। কোলকাতার রাজারহাট-নিউটাউন, পার্ক স্ট্রিট, সল্টলেক, নিউ আলীপুর, ভবানীপুর, বালিগঞ্জ প্রভাবশালীদের ঠিকানায় পরিণত হয়েছে। কোলকাতা শহর ও শহরতলিতে আছেন অনেকে। এদের প্রায়ই দেখা-সাক্ষাৎ হয়, চলে আড্ডাবাজি, খাওয়া-দাওয়া। পলাতকদের ভাষায় তাদের ‘হেডকোয়ার্টার’ হচ্ছে কোলকাতা। এখানে বসেই যাবতীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন হচ্ছে।

এদের মধ্যে দলীয় কর্মকাণ্ড দেখভাল করছেন আ ফ ম বাহাউদ্দীন নাছিম। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনীর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। সরকারের গোপন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছেন। 

এছাড়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমের নেতৃত্বে একটি কোর কমিটিও গঠন করা হয়েছে।

জাহাঙ্গীর কবির নানক কলকাতা থেকে কয়েক দফা ভিডিও বার্তা দিয়ে নিজের এবং দলের অবস্থান পরিষ্কার করেছেন। কলকাতায় বসে দলীয় ভেরিফাইড ফেসবুকে বিভিন্ন সময়ে কর্মসূচিও ঘোষণা করতে দেখা গেছে পলাতক নেতাদের। 

জানা গেছে-আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, শ্রমিক লীগ, কৃষক লীগ, যুব মহিলা লীগ, অনেক জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি-সম্পাদক, জেলা পরিষদ ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান, পৌরসভার মেয়র, কাউন্সিলর এবং আওয়ামী লীগের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর শীর্ষ নেতা, সাবেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা, পুলিশের সিনিয়র কর্মকর্তা, আইনজীবী, চিকিৎসক, শিক্ষক, সাংবাদিক ভারতে অবস্থান করছেন। 

সম্প্রতি ভারতের দিল্লির প্রেস ক্লাব অব ইন্ডিয়ার সভাপতি গৌতম লাহিড়ী একটি বিদেশি গণমাধ্যমে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, আওয়ামী লীগের প্রায় ৪৫ হাজার নেতাকর্মী এখন ভারতে অবস্থান করছেন। তার দাবি, ভারতে আশ্রয় নেয়া আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বেশিরভাগই কোলকাতায় অবস্থান করছেন। কোলকাতা থেকে প্রকাশিত একটি দৈনিক পত্রিকার এক সিনিয়র সাংবাদিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এখন কোলকাতা হচ্ছে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের অভয়ারণ্য। 

তিনি বলেন, নাটাই কোলকাতায় আর ঘুড়ি উড়ছে ঢাকায়। অর্থাৎ এরা কোলকাতায় বসেই ঢাকায় যাবতীয় কলকাঠি নাড়ছেন।

ছাত্র-জনতার নজিরবিহীন গণ-অভ্যুত্থানের মুখে ৫ আগস্ট পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে পালিয়ে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। এর পরপরই তার পথ অনুসরণ করেন আওয়ামী লীগ নেতারা। বৈধ কিংবা অবৈধপথে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে তারা আশ্রয় নেন ভারতে। দেশ থেকে পালানোর ক্ষেত্রে তারা সিলেটের কানাইঘাট, জকিগঞ্জ, সনাতনপুঞ্জি ও ডোনা, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া, হবিগঞ্জ, ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট, নেত্রকোনা, দিনাজপুরের হিলি, যশোরের বেনাপোল ও পুটখালী ঘাট, পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা ও লালমনিরহাটের দহগ্রাম সীমান্ত ব্যবহার করেন বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।

সূত্র জানায়, সম্প্রতি দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে নিষিদ্ধ ঘোষিত সর্বহারা পার্টির সদস্যরা সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। নিজেদের মধ্যে হানাহানির ঘটনাও ঘটিয়েছেন তারা। অভিযোগ রয়েছে, দেশের পরিস্থিতি অশান্ত করতে আওয়ামী লীগের পলাতক নেতারাই এ ঘটনার পেছনে ইন্ধন জুগিয়েছেন। 

কোলকাতায় অবস্থানরত আওয়ামী লীগের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের গোপন আস্তানা এখন কোলকাতা লাগোয়া রাজারহাট-নিউটাউনের বিভিন্ন আবাসনে। এ অঞ্চলে গত এক দশকে তৈরি হয়েছে প্রচুর বিলাসবহুল বাড়ি। এসব বাড়ির অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা বেশ আঁটোসাঁটো। ভারতীয়দের কেনা বহু ফ্ল্যাট খালি থাকে। দালাল ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের মাধ্যমেই সেগুলোতে তারা এখন নিশ্চিন্তে বসবাস করছেন। 

প্রবাসী বাংলাদেশিদেরও বেশ কিছু ফ্ল্যাট ভাড়া নেয়া রয়েছে এ সব এলাকায়। প্রবাসী বাংলাদেশের ব্যবসায়ী আখতারুজ্জামান শাহিনের ভাড়া নেয়া সঞ্চিতা আবাসনের একটি ফ্ল্যাটেই গত বছর মে মাসে খুন হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের সংসদ-সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার। সম্প্রতি নিউটাউনের বিলাসবহুল সঞ্চিতা আবাসন থেকে সিলেট আওয়ামী লীগের চার শীর্ষস্থানীয় নেতাকে মেঘালয় পুলিশ গ্রেফতার করে। সে আবাসনেই সে সময় উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক এবং সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল। দুজনই গত ৬ মাস ধরে কলকাতাতেই রয়েছেন।

গত অক্টোবরে একটি ছবি ভাইরাল হয়েছিলো যে, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান দলবলসহ নিউটাউনের ইকো পার্কে ঘোরাফেরা করছেন। তার সঙ্গে ছিলেন দলটির সদস্য অসীম কুমার উকিল, তার স্ত্রী ও সংরক্ষিত আসনের সাবেক সংসদ-সদস্য অপু উকিল। অনেক মাঝারি স্তরের নেতা শহরতলিতে আশ্রয় নিয়েছেন। 

কোলকাতার স্থানীয় রাজনৈতিক সূত্রের খবর, আওয়ামী নেতাদের আশ্রয়ের ব্যাপারে তারা বা প্রশাসন কোনো ঝামেলা চান না। তাই তারাও চুপ রয়েছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী ও প্রভাবশালী নেতাদের মধ্যে এ মুহূর্তে দিল্লিতে অবস্থান করছেন সাবেক চিফ হুইপ আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ, তার ছেলে ও বরিশাল সিটির সাবেক মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহ, সাবেক চিফ হুইপ নূর ই আলম চৌধুরী লিটন, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সংসদ-সদস্য শামীম ওসমান ও তার ভাই সেলিম ওসমান, শেখ হাসিনার চাচাতো ভাই শেখ হেলাল উদ্দীন, তার আরেক ভাই খুলনা-২ আসনের সাবেক সংসদ-সদস্য শেখ সালাউদ্দীন জুয়েল, শেখ হেলালের ছেলে সাবেক সংসদ-সদস্য শেখ সারহান নাসের তন্ময়, আওয়ামী লীগ নেতা মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাস, কুমিল্লা সদর আসনের সাবেক সংসদ-সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার ও তার মেয়ে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র তাহসিন বাহার, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি লিয়াকত শিকদার, সাবেক সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম এখন কোলকাতায় অবস্থান করছেন।

সবার দেশ/এনএন