সাত সদস্যের উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন তদন্ত কমিটি গঠন
সচিবালয়ে অগ্নিকান্ড, নাশকতার গন্ধ!
বাংলাদেশ সচিবালয়ে মধ্যরাতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সন্দেহের ঢালপালা মেলছে। রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে এ ঘটনায় ষড়যন্ত্রের সন্দেহ করছেন খোদ অন্তর্বর্তী সরকারের একজন উপদেষ্টাও। এ অগ্নিকাণ্ড দুর্ঘটনা, নাকি নাশকতা, সে বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় কর্মকর্তারা তাৎক্ষণিকভাবে কিছু বলতে চাননি। ক্ষয়ক্ষতির তথ্যও তাৎক্ষণিকভাবে মেলেনি। তবে সাত সদস্যের উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন তদন্ত কমিটি করেছে সরকার। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব এ কমিটির নেতৃত্ব দেবেন।
সকাল ৯টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার পর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন একটি তদন্ত কমিটি করে দেয়া হয়েছে। সচিবালয়ের মতো সুরক্ষিত জায়গায় এত বড় আগুন লাগা নিয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দুর্ঘটনা তো সব জায়গায়ই ঘটতে পারে। সচিবালয়েও ঘটতে পারে। এ জন্যই তো এখানেও ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি রাখা হয়। এ ঘটনায় উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন তদন্ত কমটি গঠন করা হয়েছে।
এদিকে সচিবালয়ে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ জাহেদ কামাল সংবাদ সম্মেলনে জানান, ফায়ার সার্ভিসের ১৯টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করেছে। গেট ভেঙে দুটি গাড়ি ঢোকানো হয়। ফায়ার সার্ভিসে ২১১ কর্মী আগুন নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত ছিলেন।
অগ্নিকাণ্ড ঘটা ভবনে কী কী আছে?
ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ জাহেদ কামাল জানান, ৬, ৭, ৮ ও ৯ তলায় আগুন ধরেছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্যমতে, সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনে ছয়টি মন্ত্রণালয় ও একাধিক বিভাগের অফিস রয়েছে। সেগুলো হলো—যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এবং ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, অর্থ বিভাগ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ, সড়ক পরিবহণ ও সেতু মন্ত্রণালয়, সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগ।
আগুন কোথায় লেগেছিল?
ফায়ার সার্ভিসের তথ্যমতে, রাত ১টা ৫২ মিনিটে তারা মেসেজ পায় যে সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনে আগুন লেগেছে। ১টা ৫৪ মিনিটের মধ্যে তাদের ইউনিট পৌঁছে যায়। তবে ভবনের বাইরে থেকে ৬ থেকে ৮ তলায় আগুনের চিহ্ন বেশি দেখা গেছে।
১০ ঘণ্টায় আগুন নেভানোর কারণ
নেভানোর দেরির কারণ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক জাহেদ কামাল জানান, সচিবালয়ের ফটক দিয়ে ফায়ার সার্ভিসের বড় গাড়ি ঢুকতে না পারায় কাজ করতে বেগ পেতে হয়েছিল। সে কারণে সামনের ফটক ভাঙতে হয়েছিল তাদের। সচিবালয়ে ঢোকার মোট পাঁচটি ফটক রয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঢোকার ফটক আছে দুটি। তবে সে দুটি দিয়েও বড় গাড়ি ঢোকানো যাচ্ছিল না। ৪ নম্বর ফটক দিয়ে ঢুকতে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসের একটি গাড়িও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা জানান, আগুন নেভানোর জন্য দুটি টার্নটেবল ল্যাডার (টিটিএল) ভেতরে ঢোকাতে পেরেছিলেন তারা। আরও বেশি টিটিএল ঢোকাতে পারলে আগুন আরও আগে নেভানো যেতো। তারা আরও জানান, মন্ত্রণালয়গুলোতে সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ চলছিল। তাতে ব্যবহার হচ্ছে কাঠ। সে কারণে আগুন ছড়িয়েছিল। এ ছাড়া মন্ত্রণালয়ের প্রতিটি কক্ষ বন্ধ ছিল বলে তালা ভেঙে, জানালা ভেঙে তাদের ঢুকতে হয়।
ষড়যন্ত্রের গন্ধ?
আগুনের ঘটনা গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করতে সরকারের প্রতি পরামর্শ দিয়েছে বিএনপি, জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। আগুনের ধরন দেখে নাশকতার বিষয়কে গুরুত্ব দিচ্ছেন অনেকে। বলা হচ্ছে- কোনো পক্ষ নথিপত্র ধ্বংস করে দেয়ার জন্য এই চেষ্টা চালাতে পারে। আগুন লাগার পর প্রথমে ভবনটির দুই পাশের ভিন্ন তলায় আগুন জ্বলতে দেখা যায়।
অনেকে বলছেন, বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে আগুন ধরলে সেটা একস্থান থেকে হতে পারে। কিন্তু ভবনের দুই পাশের ভিন্ন তলায় আগুন সন্দেহ তৈরি করেছে। কয়েকদিন ধরে প্রশাসন ও অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যে পাল্টাপাল্টির মধ্যে সচিবালয়ে আগুনের ঘটনা ঘটলো। বড়দিনের ছুটিতে বুধবার প্রশাসন ক্যাডারের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তারা সভা করে প্রশাসন সংস্কার কমিটির প্রধানের পদত্যাগ দাবি করেন।
গতকাল অন্যান্য ২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তারাও সারা দেশে মানববন্ধন করেছেন। সচিবালয়ে আগুনের পর ক্যাডার কর্মকর্তাদের এই পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি নিয়েও নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এতে ক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষ। আগুনের ঘটনায় ঘাপটি মেরে থাকা কোনো পক্ষের দোসররা জড়িত থাকতে পারে এমনটিও সন্দেহ করছেন অনেকে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই নানা ষড়যন্ত্র চলার কথা বলছেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা। সচিবালয়ে আগুন লাগার খবর শুনেই তেমন ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত দিয়ে ফেইসবুকে পোস্ট দিয়ে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, সরকারের প্রশাসনিক সদর দপ্তর সচিবালয়ের যে ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে সেখানে মন্ত্রণালয় ছিল স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ ভূঁইয়ার। আগুনের ঘটনায় হুঁশিয়ারি দিয়ে তিনি বলেন, আমাদের ব্যর্থ করার এ ষড়যন্ত্রে যে বা যারাই জড়িত থাকবে তাদের বিন্দু পরিমাণ ছাড় দেয়া হবে না। ফেসবুকের নিজস্ব আইডিতে দেয়া এক স্ট্যাটাসে তিনিএ হুঁশিয়ারি দেন।
আসিফ মাহমুদ বলেন, ‘স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের বিগত সময়ে হওয়া অর্থলোপাট, দুর্নীতি নিয়ে আমরা কাজ করছিলাম। কয়েক হাজার কোটি টাকা লুটপাটের প্রমাণও পাওয়া গিয়েছিল। অগ্নিকাণ্ডে কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এখনও জানা যায়নি। এ মুহূর্তে আছি নীলফামারীতে, যত দ্রুত সম্ভব ঢাকায় ব্যাক করছি।’
এর আগে ঢাকার জেলা প্রশাসক তানভীর আহমেদ সাংবাদিকদের জানান, রাত পৌনে ২টার দিকে ওই ভবনে আগুন লাগে। তবে আগুন লাগার কারণ জানা যায়নি। আগুন লাগার কারণ ফায়ার সার্ভিসের বিশেষজ্ঞরা পরে বলতে পারবেন বলে জানান তিনি।
এদিকে ফায়ার সার্ভিসের ডিজি বলেন, তদন্তের মাধ্যমে জানা যাবে অগ্নিকাণ্ড কীভাবে ঘটেছে।
ক্ষয়ক্ষতি
আগুন নেভানোর সময় সচিবালয়ের পাশের রাস্তায় ট্রাকচাপায় ফায়ার ফাইটার সোহানুর জামান নয়নের মৃত্যু হয়েছে। এ সময় আহত হয়েছেন আরও দুইজন ফায়ার ফাইটার।
বেলা পৌনে ১১টায় সচিবালয়ে ভেতর থেকে বেরিয়ে নৌবাহিনীর সিনিয়র চিফ পেটি অফিসার মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, আগুনের সূত্রপাত সম্পর্কে এখনও কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। রাতে সংবাদ পাওয়ার পর আমাদের ফায়ার টিম সচিবালয়ে চলে আসে৷
সচিবালয়ে মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে একটি ভবনের নানা জায়গায় কীভাবে আগুন লাগল জানতে চাইলে আমিনুল ইসলাম বলেন, আমি তো দেখিনি কীভাবে আগুন লেগেছে। তবে আমরা ভেতরের পরিস্থিতি দেখে ধারণা করছি কোনো শটসার্কিট থেকে আগুন লাগেনি।
ভেতরে কী রকম ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে জানতে চাইলে আমিনুল ইসলাম বলেন, ক্ষয়ক্ষতি কী পরিমাণ হয়েছে সেটা এ মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়। যে সব স্থানে আগুন লেগেছে সেখানে কোনো নথিপত্র নেই, সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। যেখানে আগুন লেগেছে সেখানে মোটামুটি সবই পুড়ে গেছে। আমরা সব এখনও চিহ্নিত করতে পারিনি৷ আমরা কাজ করছি।
সবার দেশ/এওয়াই