Header Advertisement

Sobar Desh | সবার দেশ নিজস্ব প্রতিবেদক 

প্রকাশিত: ১৭:২১, ৮ এপ্রিল ২০২৫

আপডেট: ১৯:০২, ৮ এপ্রিল ২০২৫

ফ্যাসিবাদমুক্ত ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’

বৈশাখী র‌্যালির প্রস্তুতি: রঙ, রস, রূপে সাজছে নগরী

একটি ছাত্র সংগঠনের একজন মুখপাত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বৈশাখ আমাদের শেকড়, কিন্তু শেকড়ের মাটি যদি বিষে ভরে যায়, তবে প্রতিবাদও শিল্পের মধ্য দিয়েই আসবে। আমরা চাই আমাদের যন্ত্রণার ভাষা রঙে বলুক, কাঠে বলুক, মুখোশে বলুক।

বৈশাখী র‌্যালির প্রস্তুতি: রঙ, রস, রূপে সাজছে নগরী
ছবি: সবার দেশ

নববর্ষ আসছে। আর সে আগমনের আভাসে রাজধানী ঢাকায় বইছে এক অন্যরকম হাওয়া—রঙের হাওয়া, উৎসবের হাওয়া, অপেক্ষার হাওয়া। চারপাশে যেন এক অপার উল্লাসের ধ্বনি—‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো!’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা প্রাঙ্গণে দিন-রাত জেগে আছে রঙতুলি, কাঠ আর মাটির গল্প। শত শত হাত ব্যস্ত—কেউ তুলির ডগায় সূর্য আঁকছে, কেউ কাগজে হরিণ, কেউ কাঠে গড়ছে কৃষাণীর মুখ, কেউ রঙে রাঙাচ্ছে গ্রামীণ বাংলার বিস্ময়। এ সব সৃষ্টির ভেতর দিয়েই জন্ম নিচ্ছে বৈশাখী র‌্যালির আনন্দ শোভাযাত্রা—যা শুধু একটি র‌্যালি নয়, বরং একটি বাঙ্গালী চেতনার বহিঃপ্রকাশ।

চারুকলার এক ছাত্রীর চোখে ছিলো ঘুমহীন রাত্রির ছাপ, কিন্তু তাতে কোনো ক্লান্তি নেই—ছিল শুধুই দীপ্তি। সে বলল, আমরা শুধু মুখোশ বানাচ্ছি না, বানাচ্ছি স্বপ্ন। যে স্বপ্নে আছে এক বৈষম্যহীন, উজ্জ্বল, রঙিন বাংলাদেশ।

চারুকলার আর এক শিক্ষার্থী বলেন, বৈশাখ মানে শুধু উৎসব না, এটি একটি সাংস্কৃতিক প্রতিরোধও। এ শোভাযাত্রা আমাদের পরিচয় বহন করে। তাই আমরা মন-প্রাণ দিয়ে তৈরি করছি প্রতিটি উপকরণ।

মিছিলের রঙিন মুখোশ আর প্রতীকী শিল্পকর্মগুলোর ভেতরে স্থান পেতে পারে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রতিফলন—থাকবে একটি ফ্যাসিবাদের প্রতিচ্ছবি, থাকবে শহীদ আবু সাঈদের প্রতিকৃতি, যে প্রতিকৃতি আজ অনেকের কাছে প্রতিরোধের প্রতীক।

একটি ছাত্র সংগঠনের একজন মুখপাত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বৈশাখ আমাদের শেকড়, কিন্তু শেকড়ের মাটি যদি বিষে ভরে যায়, তবে প্রতিবাদও শিল্পের মধ্য দিয়েই আসবে। আমরা চাই আমাদের যন্ত্রণার ভাষা রঙে বলুক, কাঠে বলুক, মুখোশে বলুক।

শহীদ আবু সাঈদ—যিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় নিহত হন—তার ছবি বহন করা হবে বলে জানা যাচ্ছে। তার মুখ যেন হাজারো প্রতিবাদী তরুণের মুখ হয়ে উঠেছে। এই প্রতিকৃতি শোভাযাত্রায় শুধু একজন শহীদকে নয়, একটি সময়কে বহন করবে।

আকাশজোড়া নিরাপত্তা, মাটির নিচে প্রস্তুতি

শুধু রঙ নয়, এ উৎসবের পরতে পরতে জড়িয়ে আছে নিরাপত্তার সুতোও। শহরের ব্যস্ততম এলাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, রমনা, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান—সবখানে বসানো হচ্ছে সিসিটিভি, চলছে ব্যারিকেড নির্মাণ, পয়েন্ট চেকিংয়ের মহড়া।

ডিএমপি কমিশনার জানালেন, বাঙালির প্রাণের উৎসব হোক নির্বিঘ্ন। যে ভালোবাসা এ দিনে উথলে ওঠে, সেটাকে কোনো অন্ধকার ছায়া ছুঁতে দেবে না।

র‌্যালিতে কেউ মুখোশ পরে অংশ নিতে পারবে না—কেবল শোভাযাত্রার অংশ হিসেবেই মুখোশ থাকবে হাতে কিংবা গলায়। প্রবেশপথে তল্লাশি ছাড়া ঢোকা যাবে না কারও।

আলো-ছায়ার গানে নববর্ষ

রমনা বটমূলে ভোর হতেই গাইবে ছায়ানট—‘এসো হে বৈশাখ’। শহরের অলিগলি হয়ে উঠবে মঞ্চ, উঠোন হবে নাট্যমঞ্চ, হাটবাজার হবে গানের আসর।

আবৃত্তি, লোকগান, নাটক, নৃত্য—সব মিলিয়ে এক অপার মেলবন্ধন। বাঙালির আবহমান সংস্কৃতির ঝর্ণাধারায় কেউ হারাবে, কেউ খুঁজে পাবে নিজের শিকড়। নতুন শাড়ি, সাদা পাঞ্জাবি আর কাঁচা হলুদের গন্ধে ঘেরা সেই দিন—১৪৩২-এর পহেলা বৈশাখ—হয়ে উঠবে ইতিহাসের এক নতুন পৃষ্ঠা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সাংস্কৃতিক সংগঠনের সদস্য জানান, বৈশাখ মানেই প্রাণের উৎসব। সারাবছরের ক্লান্তি ভুলে এ একটি দিনে আমরা একসঙ্গে গাই, নাচি, এবং দেশজ সংস্কৃতিকে তুলে ধরি।

ইলিশ-পান্তার প্রতীক্ষা আর রোদঝলমলে সকাল

নববর্ষের সকালে ঘর থেকে বের হবেন সবাই, মুখে হাসি, মনে প্রার্থনা—ভালো হোক দিন, ভালো থাকুক দেশ। রেস্তোরাঁগুলো প্রস্তুত করেছে পান্তা-ইলিশ, আলুভর্তা, বেগুনভাজা—সবই যেন গ্রামীণ হৃদয়ের নাগরিক অনুবাদ।

পুরান ঢাকার অলিগলি, নিউ মার্কেটের গেট, বসুন্ধরার অভিজাত রাস্তা, ধানমণ্ডির সরোবর—সবখানে বৈশাখের একটাই রঙ, একটাই ভাষা—উৎসব।

শেষে এ কথাই—

পহেলা বৈশাখ কেবল একটি দিন নয়, এটি একটি জীবন্ত চেতনা, একটি জীবনের আহ্বান। প্রস্তুতি চলছে তারই আগমনের—রাত জেগে, ঘাম ছড়িয়ে, রঙ মেখে। আর এ প্রস্তুতির মধ্যেই নিহিত আছে বাঙালির আত্মপরিচয়, আত্মসম্মান, ও সাহসিকতা।

ঢাকা এখন শুধু শহর নয়—এ যেন এক শিল্পকর্ম। বৈশাখ তাকে আঁকছে নতুন করে, গড়ছে আরও একটু আপন করে।

সবার দেশ/কেএম