ভূয়া মুজিবনগর কর্মচারী
ধুরন্ধর জাহাঙ্গীরকে দুদকের মহাপরিচালক নিয়োগ

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মহামান্য রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)-এর মহাপরিচালক হিসেবে ড. এস. এম. জাহাঙ্গীর আলমকে তিন বছরের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। সোববার (৭ এপ্রিল) জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন নিয়োগ-১ শাখা থেকে উপসচিব শবনম স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে এ আদেশ জারি করা হয়।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, জনস্বার্থে জারিকৃত এ আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে। তবে, এ নিয়োগকে কেন্দ্র করে ড. জাহাঙ্গীর আলমের অতীতের বিতর্কিত কর্মকাণ্ড এবং দুর্নীতির অভিযোগ সামনে এসেছে, যা জনমনে প্রশ্ন তুলেছে।
নিয়োগের বিবরণ
প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, ড. এস. এম. জাহাঙ্গীর আলমকে দুদকের মহাপরিচালক পদে তিন বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিকভাবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এ পদে তিনি দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করবেন। তবে, তার অতীতের কর্মজীবন এবং বিতর্কিত কার্যক্রম এ নিয়োগের যৌক্তিকতা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে যেখানে তিনি নিজেই মহা দুর্নীতিবাজ।
ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদে চাকরি ও দুর্নীতির অভিযোগ
ড. জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে, তিনি ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ ব্যবহার করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) চাকরি গ্রহণ করেছিলেন। বিভিন্ন তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, তিনি মুজিবনগর সরকারের কর্মচারী হিসেবে নিজেকে দাবি করে মুক্তিযোদ্ধা কোটা কাজে লাগিয়ে ১৯৯১ সালের ২ ডিসেম্বর সহকারী কর-কমিশনার পদে পদোন্নতি লাভ করেন। তার এসএসসি সার্টিফিকেট অনুযায়ী, জন্মতারিখ ১৯৫৫ সালের ১০ জুলাই, অর্থাৎ ১৯৭১ সালে মুজিবনগর সরকারের সময় তার বয়স ছিল মাত্র ১৫ বছর ৯ মাস। সে সময় চাকরিতে যোগদানের সর্বনিম্ন বয়সসীমা ছিল ১৮ বছর, এবং মুজিবনগর সরকারের ৫০৯ জন কর্মচারীর তালিকায় তার নাম অনুপস্থিত। এসব তথ্য তার মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দাবির বৈধতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে।
প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদফতর, এনবিআরের সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল এবং অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের তদন্তে এ ভুয়া সনদ ব্যবহারের অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। এছাড়া, তিনি এ সনদের সুবাদে বিভিন্ন সরকারি সুবিধা গ্রহণ করেছেন এবং দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
তদবির বাণিজ্য ও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ
ড. জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ রয়েছে যে, তিনি চাকরি দেয়ার নামে প্রতারণা, তদবির বাণিজ্য এবং জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করেছেন। এনবিআরে কর কমিশনার থাকাকালীন তিনি বিভিন্ন ব্যক্তিকে কর ফাঁকির সুযোগ করে দিয়ে আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন বলে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সাবেক সচিব খায়রুজ্জামান চৌধুরী ২৭টি অভিযোগে উল্লেখ করেছেন। এতে সরকারের বিপুল রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করা হয়। বর্তমান সরকারের আমলে তিনি নিজেকে ‘কর গবেষক’ হিসেবে পরিচয় দিয়ে তদবির বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
বিএনপি আমলে পুরস্কার ও সম্মাননা
তৎকালীন বিএনপি সরকারের সময় ড. জাহাঙ্গীর আলম ২০০৩ সালে জিয়া সাংস্কৃতিক সংগঠন (জিসাস) এবং ২০০৪ সালে জাতীয় যুব সাংস্কৃতিক সংস্থা (যুসাস) থেকে স্বর্ণপদকে ভূষিত হন। এসব সম্মাননা তার রাজনৈতিক যোগসাজশের প্রমাণ হিসেবে দেখা হয়। উল্লেখ্য তিনি ‘বঙ্গবন্ধুর মর্মকথা’ বই লিখেও তরতর করে ওপরে উঠে গেছেন পতিত হাসিনার আমলে। তিনি ছিলেন সকল তদবির বাণিজ্যের হোতা, অথচ আইনের ধরাছোঁয়ার বাইরে।
ভুয়া চিঠি কাণ্ডে সাঁটলিপিকার বরখাস্ত
সম্প্রতি, জাহাঙ্গীর আলমের নির্দেশে এনবিআর কর অঞ্চল-৮- এর সাঁটলিপিকার বাবর আলী বিভিন্ন কর্মকর্তার নামে-বেনামে ভুয়া ও মিথ্যা চিঠি প্রদান করেন। এ ঘটনায় বাবর আলী বরখাস্ত হয়েছেন এবং তার ব্যবহৃত কম্পিউটার জব্দ করা হয়েছে। কর অঞ্চল-৮-এর কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, এ ঘটনার পেছনে জাহাঙ্গীর আলমের দায়িত্ব রয়েছে এবং তারও শাস্তি হওয়া উচিত।
তদন্ত ও মামলা
২০০২ সালে দুর্নীতি দমন ব্যুরো (বর্তমান দুদক) তার বির Beast মামলা দায়ের করে, যা ২০০৩ সালে হাইকোর্ট স্থগিত করে। এছাড়া, মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় ২০০২ সালে তার ভুয়া সনদ নিয়ে তদন্তের নির্দেশ দিলেও তা অগ্রগতি পায়নি। বর্তমানে তার বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ তদন্তাধীন বা স্থগিত রয়েছে।
এনবিআরের প্রতিক্রিয়া
এ বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান বলেন, দুর্নীতি, হয়রানি ও স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে এনবিআর ‘জিরো টলারেন্স নীতি’ গ্রহণ করেছে। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে কঠোর শাস্তি নেওয়া হবে। তবে, জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে এখনও কোনো কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।
জনমত ও প্রতিক্রিয়া
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনবিআরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ভুয়া সনদে চাকরি, তদবিরে পদোন্নতি, এবং দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদ অর্জন—এসবের পরও শাস্তি না হলে অন্য কর্মকর্তারা অনিয়মে উৎসাহিত হবেন। জাহাঙ্গীর আলমের দুদকের মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগে সাধারণ মানুষের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।
ড. এস. এম. জাহাঙ্গীর আলমের অতীতের দুর্নীতি ও জালিয়াতির অভিযোগ সত্ত্বেও দুদকের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে তার নিয়োগ অনেকের কাছে বিস্ময়কর। তার এ পদে কীভাবে দায়িত্ব পালন করবেন, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন অনেকে। এ নিয়োগের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের দুর্নীতি দমন নীতির প্রতি জনগণের ভরসা কতটা অটুট থাকবে, তা সময়ই বলে দেবে।
সবার দেশ/কেএম