Header Advertisement

Sobar Desh | সবার দেশ ঢাবি প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ১৬:৩৮, ১২ এপ্রিল ২০২৫

চারুকলায় নাশকতার ছায়া, ধরা পড়লো সিসিটিভিতে 

বৈশাখী মোটিফে আগুন দেয় কালো মাস্কধারী

বৈশাখী মোটিফে আগুন দেয় কালো মাস্কধারী
ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) চারুকলা অনুষদে পয়লা বৈশাখের আনন্দ শোভাযাত্রার জন্য তৈরি মূল মোটিফ ‘ফ্যাসিস্টের প্রতিকৃতি’ ও ‘শান্তির পায়রা’ আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। 

শনিবার (১২ এপ্রিল) ভোর ৪টা থেকে সাড়ে ৪টার মধ্যে ঘটে যাওয়া এ ঘটনা সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়েছে। ফুটেজে দেখা গেছে, কালো মাস্ক পরা এক ব্যক্তি ঠান্ডা মাথায় মোটিফে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছেন। এ ঘটনায় চারুকলা অনুষদে শোক ও ক্ষোভের ছায়া নেমে এসেছে।

সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো নাশকতা

চারুকলা অনুষদের সহযোগী অধ্যাপক মো. ইসরাফিল রতন জানিয়েছেন, সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মুখে কালো মাস্ক ও জিন্স পরা এক ব্যক্তি মোটিফে আগুন দিয়েছেন। তিনি বলেন, ওই ব্যক্তি ঠান্ডা মাথায় এ কাজটি করেছেন। তবে তার পরিচয় এখনও শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। কর্তৃপক্ষ ফুটেজের ভিত্তিতে তদন্ত শুরু করেছে এবং দোষীকে চিহ্নিত করতে পুলিশের সহায়তা নেয়া হচ্ছে।

মোটিফের ধ্বংস: উৎসবের আগে ধাক্কা

এ বছরের বাংলা নববর্ষের শোভাযাত্রার জন্য চারুকলা অনুষদ বাঁশ-বেতের কারুকাজে প্রায় ২০ ফুট উচ্চতার একটি ‘ফ্যাসিস্টের প্রতিকৃতি’ তৈরি করেছিলো। এ মোটিফে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী ভারতে পলাতক মাফিয়া হাসিনার মুখাবয়বের প্রতীকী উপস্থাপনা ছিলো, যার দুপাশে শিংয়ের মতো অবয়ব যুক্ত করা হয়েছিলো। এটি ছিলো শোভাযাত্রার প্রধান মোটিফ। পাশাপাশি ‘শান্তির পায়রা’ নামে আরেকটি মোটিফও তৈরি করা হয়েছিলো। আগুনে উভয় মোটিফই সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে পুড়ে গেছে।

চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক আজহারুল ইসলাম চঞ্চল বলেন, ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতিকে টার্গেট করে এ আগুন লাগানো হয়েছে। মোটিফটি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে, এবং শান্তির পায়রার অবয়বটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এটি একটি পরিকল্পিত নাশকতা।

তদন্ত ও জবাবদিহিতার দাবি

ঘটনার পরপরই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, প্রক্টর, এবং পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। সহকারী প্রক্টর জানিয়েছেন, নিরাপত্তা ক্যামেরার ফুটেজ পর্যালোচনা করে ঘটনার কারণ ও দায়ী ব্যক্তির সন্ধান চলছে।

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিশেষ সহকারী ফায়েজ তাইয়েব আহমেদ ফেসবুকে এক পোস্টে বলেন, এটি একটি পরিকল্পিত নাশকতা বলে আমার সন্দেহ। এ ঘটনা প্রমাণ করে যে চারুকলা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফ্যাসিবাদের গভীর প্রভাব এখনও রয়ে গেছে। চারুকলার শিক্ষকদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা প্রয়োজন। তবে তার এ বক্তব্যে শিক্ষক সম্প্রদায়ের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।

শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের ক্ষোভ

চারুকলার শিক্ষার্থী আবির বলেন, আমরা উৎসবমুখর পরিবেশে কাজ করছিলাম। এমন ঘটনা ঘটবে, তা আমরা কল্পনাও করিনি। ফ্যাসিস্টের প্রতিকৃতিকে টার্গেট করে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ফ্যাসিবাদ চলে গেলেও তার সমর্থকরা এখনও সক্রিয়। এটা তাদেরই কাজ।

সাবেক শিক্ষার্থী মিজানুর রহমান বলেন, গত এক মাস ধরে আমরা এ মোটিফ তৈরির কাজ করছিলাম। ৯০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছিলো। এমন একটি প্রতিকৃতি দুই-এক দিনে তৈরি করা সম্ভব নয়। আমরা এখন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি। তবে আমাদের ধারণা, পতিত সরকারের সমর্থকরা এ কাজ করেছে।

অন্য এক শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করে বলেন, মোটিফের নির্মাণকাজ প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিলো। আজকের মধ্যে সব কাজ শেষ হতো। এটি স্পষ্ট ষড়যন্ত্র। রাতে এখানে পুলিশের উপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও এমন ঘটনা ঘটেছে। প্রশাসনের ভূমিকাও খতিয়ে দেখা উচিত।

শোভাযাত্রার ভবিষ্যৎ

পয়লা বৈশাখের শোভাযাত্রা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের একটি ঐতিহ্যবাহী আয়োজন, যা ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ। এ ঘটনার পর শোভাযাত্রা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, শিগগির এ নিয়ে সিদ্ধান্ত জানানো হবে। তবে শিক্ষার্থীদের একাংশ বলছেন, এ নাশকতা তাদের উৎসবের উদ্দীপনা ভাঙতে পারবে না।

সমাজে মিশ্র প্রতিক্রিয়া

এ ঘটনা সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। অনেকে এটিকে ফ্যাসিবাদের প্রতি প্রতীকী প্রতিবাদের ধ্বংস হিসেবে দেখছেন, আবার কেউ কেউ এটিকে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ওপর আঘাত বলে মনে করছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, এ ঘটনা দেশে আওয়ামী প্রেতাত্মাদের পুনর্বাসনের সম্ভাব্য পরিণতি হিসেবে দেখছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. রেহানা আক্তার বলেন, এ ঘটনা শুধু একটি মোটিফ পোড়ানোর বিষয় নয়। এটি আমাদের সমাজে বিদ্যমান বিভেদ এবং প্রতিহিংসার মানসিকতার প্রকাশ। এ ধরনের নাশকতা সাংস্কৃতিক ঐক্যের জন্য হুমকি। তবে তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি।

কর্তৃপক্ষের প্রতিক্রিয়া

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ঘটনাটি তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে আইনের আওতায় আনা হবে। পাশাপাশি, শোভাযাত্রার জন্য নতুন মোটিফ তৈরির বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তবে সময়ের স্বল্পতার কারণে নতুন মোটিফ তৈরি করা চ্যালেঞ্জিং হবে বলে শিক্ষার্থীরা মনে করছেন।

চারুকলার এ ঘটনা পয়লা বৈশাখের উৎসবের আগে একটি অশনি সংকেত হিসেবে দেখা হচ্ছে। শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মাসব্যাপী শ্রম ধ্বংসের এ ঘটনা কেবল চারুকলা নয়, সারা দেশের সাংস্কৃতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে শোক ও ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। তবে অনেকে আশা প্রকাশ করেছেন, এ নাশকতা বাঙালির ঐতিহ্যবাহী আনন্দ শোভাযাত্রাকে দমিয়ে রাখতে পারবে না। 

সবার দেশ/এমকেজে