সহযোগীদের খবর
মেঘনা আলমের হানিট্র্যাপ আন্তঃরাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে কারা?

‘মেঘনা আলমের হানিট্র্যাপ আন্তঃরাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে কারা?’-এটি দৈনিক ইনকিলাবের প্রধান শিরোনাম। খবরে বলা হয়, সুন্দরী মেয়েদের দিয়ে বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের প্রেমের ফাঁদে ফেলার ঘটনায় প্রতারণার মামলায় মেঘনা আলমের সহযোগী কাওয়াই প্রতিষ্ঠানের সিইও ও সানজানা ম্যান পাওয়ার প্রতিষ্ঠানের মালিক মো. দেওয়ান সমিরের (৫৮) পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।
গতকাল শনিবার তাকে আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ভাটারা থানার উপ-পরিদর্শক মো. আরিফুল ইসলাম। শুনানি শেষে আদালত ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুৃর করেন। এদিকে, মেঘনা আলমের হানি ট্র্যাপ আন্তঃরাষ্ট্রীয় বিপর্যয়ের কৌশলের নেপথ্যে বড় ধরণের যড়যন্ত্র আছে বলে তথ্য পেয়েছে পুলিশ। শুনানিতে সে বিষয়টিও তুলে ধরেছেন মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর ওমর ফারুক ফারুকী।
মামলার অভিযোগ থেকে জানা গেছে, ১০ এপ্রিল বসুন্ধরা এলাকায় একটি সংঘবদ্ধ প্রতারকচক্র সুন্দরী মেয়েদের মাধ্যমে বিভিন্ন বিদেশি রাষ্ট্রদূত এবং ধনাঢ্য ব্যক্তিদের প্রেমের ফাঁদে ফেলে ব্ল্যাকমেইল করে অর্থ আদায়ের চেষ্টা করার তথ্য পায় পুলিশ। ওই দিন রাত ১০টা ৩৫ মিনিটে আসামি দেওয়ান সমিরকে সেখানে পাওয়া যায়। জিজ্ঞাসাবাদে ও প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা যায়, দেওয়ান সমির প্রতারক দলের সদস্য তথা বিভিন্ন সুন্দরী মেয়েদের দিয়ে প্রেমের ফাঁদে ফেলে ও অবৈধ সম্পর্ক তৈরি করে। পরবর্তীতে সুকৌশলে বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে অর্থ আদায়ের চেষ্টা করে।
পুলিশ জানায়, আসামিরা বাংলাদেশে সউদী আরবের রাষ্ট্রদূত ইসা বিন ইউসেফ আলদুহাইনকে টার্গেট করে গত বছরের জানুয়ারি মাস হতে এখন পর্যন্ত তার সঙ্গে প্রতারক দলের সদস্যরা সখ্যতা তৈরি করে। এক পর্যায়ে ব্যক্তিগত যোগাযোগ স্থাপন করে ফাঁদে ফেলে পাঁচ মিলিয়ন ডলার দাবি করে। দেওয়ান সমির এ টাকা দেয়ার জন্য বিভিন্ন মাধ্যমে চাপ সৃষ্টি করে। এ ঘটনার বিষয়টি বিভিন্ন মাধ্যমে জানাজানি হওয়ায় বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি হুমকির সম্মুখীন হয়। এদিকে এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে তৃতীয় শ্রেণির মডেল মেঘনা আলমকে বিশেষ ক্ষমতা আইনে গ্রেফতার দেখিয়ে গত ১০ এপ্রিল ৩০ দিনের জন্য কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
নেপথ্যে কারা?
বাংলাদেশ এবং সউদী আরবের সম্পর্ক সুদৃঢ় বহু বছর ধরেই। বাংলাদেশের রেমিটেন্সের বিশাল একটি অংশ জুড়েই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে সউদী প্রবাসীরা। বাংলাদেশের যেকোন প্রয়োজনে যে কয়েকটি দেশ সবার প্রথমে এগিয়ে আসে সে তালিকার শুরুর দিকে রয়েছে সউদী সরকার। সাম্প্রতিক সময়ে সোশ্যাল মিডিয়াসহ বিভিন্ন মাধ্যমে আলোচনার শীর্ষে রয়েছে সউদীর সদ্য বিদায়ী রাষ্ট্রদূত এবং মেঘনা আলমের ঘটনা। দেশ থেকে প্রস্থানের আগে নানা সময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা এ রাষ্ট্রদূত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনানুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ করেন মেঘনা আলম এবং তার গ্যাং সম্পর্কে। সেখান থেকেই বেরিয়ে আসে থলের বেড়াল।
অখ্যাত এ মডেলের কাজই ছিলো বিভিন্ন কূটনীতিকদের সাথে বিভিন্ন প্রোগ্রামে যোগদান করা এবং তাদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করে তাকে নিয়োগকারী প্রভুদের কাছে সে বার্তা পৌছে দেয়া। মূলত দেশি-বিদেশি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের হানি ট্রাপে ফেলে নানা রকম তথ্য হাতিয়ে নিতেই এ মেঘনা আলম চক্র। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, তাকে ভারতের মদদপুষ্ট একাধিক স্থানীয় মিডিয়া এ সমস্ত ন্যাক্কারজনক কাজ করতে রীতিমতো ট্রেনই-আপ করতো এবং এভাবেই জিম্মি করে গুরুত্বপূর্ণ কাজ বাগিয়ে নিতো এ সকল মিডিয়া। বিনিময়ে তিনি পেতেন মোটা অঙ্কের টাকা এবং দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ।
এমনকি মেঘনা আলম আটক কান্ডে ভারত এবং হাসিনার এজেন্ডা বাস্তবায়নকারী সংবাদমাধ্যমগুলোর ভীত নড়বড়ে হওয়ার আশঙ্কায় তার গ্রেফতারের বিষয়টিকে এ সমস্ত হলুদ সাংবাদিক এবং ফ্যাসিস্ট হাসিনার মদদপুষ্ঠ মিডিয়া গুজব ছড়িয়েছে যে তাকে গুম করা হয়েছে বা অপহরণ করা হয়েছে। যদিও ইতোমধ্যে বিষয়টি খোলাসা হয়ে গেছে যে এটি নিছকই প্রোপাগান্ডার একটি অংশ এবং ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ ও ভারতের মদদ পুষ্ট মিডিয়ার কালেক্টিভ কোলাবোরেটেড প্রোপাগান্ডা।
শুধু তাই নয়, দেশের নাজেহাল অবস্থায় যে সমস্ত মানবাধিকার বুলি আওরানো সংস্থাগুলো নিশ্চুপ ছিলো তারাও সামিল হয়েছে মেঘনার ডুবন্ত নায়ে। দেশের হাজারও ছাত্র-জনতা যখন বুলেটবিদ্ধ অবস্থায় মৃত্যুর ক্ষণ গুনছিলো অথচ একটি বিবৃতি আসেনি এসকল সংস্থা থেকে। এখন তারা নানাভাবে ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে মেঘনা আলমকে বাঁচাতে। বিবৃতি দিয়ে মেঘনার মুক্তি দাবি করছে। বলছে, বিশেষ ক্ষমতা আইনে মেঘনাকে গ্রেফতার মানবাধিকার লঙ্ঘন! গতকাল এরকম বেশ কয়েকটি তথাকথিত মানবাধিকার সংস্থা মেঘনার পক্ষে বিবুতি দিয়েছে। তাই স্বভাবতই জনমনে প্রশ্ন জাগছে তারা কি কেবলই মেঘনাকে বাঁচাতে চাইছে নাকি নিজেদের অন্ধকার জগৎ প্রকাশ পাওয়ার ভয়ে মরণ কামড় দিতে চাইছে?
মেঘনার উদ্দেশ্য কী ছিলো? শুধুই টাকা কামানো?
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, নিশ্চয় তা নয়। বর্তমান সরকার যেভাবে সারাবিশ্বে বাংলাদেশের ইমেজ উদ্ধারে সাফল্য দেখাচ্ছে-সেটা হয়তো ভারত তথা ফ্যাসিস্ট হাসিনার সহযোগিদের সহ্য হচ্ছে না। এজন্যই তারা সউদী আরবের মতো মুসলিম দেশকে টার্গেট করে ছক এঁকেছে। যাতে সউদী আরবের সাথে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতি ঘটে। সউদীর ভিসা বন্ধ করে দেয়াসহ প্রবাসীদের দেশ, থেকে বিতারিত করা হয়। ওই কর্মকর্তা বলেন, খুব শিগগিরি সউদীর বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের মালিকসহ সউদী যুবরাজের বাংলাদেশে আসার কথা। সেটা যাতে না হয় সে জন্যই এ যড়যন্ত্রের ফাঁত পাতা হয়েছিলো।
পুলিশেরভাষ্যে, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিঘিœত করা, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি সম্পর্কে মিথ্যাচার ছড়ানোর মাধ্যমে আন্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের অবনতির অপচেষ্টা এবং দেশকে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অভিযোগে মেঘনাকে নিরাপত্তা হেফাজতে নেয়া হয়েছে। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে মেঘনার সহযোগী দেওয়ান সামির বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে। এ ঘটনার নেপথ্যে বড় কোনো চক্র জড়িত। সে কারণেই ওই পুলিশ কর্মকর্তা কারো নাম উল্লেখ করতে চান নি। বলেছেন, জিজ্ঞাসাবাদে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বেরিয়ে আসবে এবং আমরা পুরো চক্রকে চিহ্নিত করতে পারবো।
সউদী ও বাংলাদেশ সরকারের কয়েকটি বিশ্বস্ত সূত্র বলা হয়েছে, রাষ্ট্রদূত ঈসা বাংলাদেশে তার দায়িত্বের মেয়াদ প্রায় শেষ করে চলতি এপ্রিলে ঢাকা ত্যাগের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এরই একপর্যায়ে সম্প্রতি তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনানুষ্ঠানিকভাবে জানান, একজন নারী ‘আর্থিক সুবিধা নেয়ার জন্য’ তার সঙ্গে প্রতারণার চেষ্টা করছেন। তাকে বিভিন্ন হুমকি দিচ্ছেন। এরপরই নড়েচড়ে বসে পুলিশ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে পুলিশ বিষয়টি খতিয়ে দেখতে গিয়ে রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে মেঘনা আলমের যোগাযোগ থাকার বিষয়টি জানতে পারে। পুলিশ মেঘনা আলমের পরিবারের মাধ্যমে বিষয়টি সুরাহার চেষ্টা করে। তবে এ উদ্যোগ ব্যর্থ হয়।
এক পর্যায়ে মেঘনা এক ফেসবুক পোস্টে দাবি করেন, কয়েকজন লোককে রাষ্ট্রদূত ঈসা পুলিশ দিয়ে তুলে নিয়েছেন। তাকে হুমকি দেয়া হয়, সরকার রাষ্ট্রদূতের পক্ষে থাকবে। তিনি যেন রাষ্ট্রদূতকে জড়িয়ে ফেসবুকে কিছু পোস্ট না করেন।
এমন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে, বুধবার রাতেই রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার একটি বাসা থেকে মেঘনা আলমকে আটক করা হয়। আটক হওয়ার আগে মেঘনা ফেসবুক লাইভে এসে অভিযোগ করেন, ‘পুলিশ পরিচয়ধারীরা’ তার বাসার দরজা ভেঙে প্রবেশের চেষ্টা করছেন। প্রায় ১২ মিনিট ধরে চলা সে লাইভে তিনি নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন এবং একাধিকবার সউদী রাষ্ট্রদূতের কথা উল্লেখ করেন। তবে তাকে আটকের পরপরই ফেসবুক লাইভ বন্ধ হয়ে যায়। ভিডিওটি পরে তার আইডিতে পাওয়া যায়নি। তবে কয়েকজন ভিডিওটি ফেসবুকে শেয়ার করেন।
ওই অভিযানে অংশ নেয়া ভাটারা থানার এক কর্মকর্তা বলেন, আমরা মেঘনা আলমকে আটকের জন্য বসুন্ধরা এলাকায় যাই। দরজা খুলতে তিনি অনীহা দেখান। পরে তাকে আটক করে মিন্টো রোডে গোয়েন্দা পুলিশের অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়।
এদিকে সরকারি কয়েকটি সূত্রের দাবি, পুলিশ ও সরকারের একাধিক সংস্থার কর্মকর্তারা দফায় দফায় মেঘনা আলমের সঙ্গে কথা বলেন। তারা বোঝার চেষ্টা করেন ঢাকায় বিদেশি কূটনৈতিক মহলে কার কার সঙ্গে তার (মেঘনা) যোগাযোগ রয়েছে। সউদী রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে তার কোনো ভিডিও রয়েছে কি না। এর বাইরে সউদী আরবে বাংলাদেশের প্রায় ২৫ লাখ শ্রমিকের উপস্থিতি, বড় শ্রমবাজারসহ বিভিন্ন কারণে দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের গুরুত্বের দিকগুলো বিবেচনায় নিয়ে রাষ্ট্রদূত ঈসার বিষয়টি থেকে তাকে (মেঘনা) সরে আসতে অনুরোধ করা হয়। তবে মেঘনা কোনো প্রকার সহযোগিতা করতে রাজি না হওয়ায় পুলিশ তাকে আদালতে সোপর্দ করার সিদ্ধান্ত নেয়।
পুলিশ গত বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে মেঘনা আলমকে সোপর্দ করে। পুলিশের আবেদনের ভিত্তিতে আদালত বিশেষ ক্ষমতা আইনে মেঘনাকে ৩০ দিনের আটকাদেশ কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
সবার দেশ/এমকেজে