Header Advertisement

Sobar Desh | সবার দেশ সবার দেশ প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১২:৪৯, ১৪ এপ্রিল ২০২৫

আপডেট: ১২:৪৯, ১৪ এপ্রিল ২০২৫

বর্ণিল আয়োজনে মানুষের ঢল

ফ্যাসিবাদমুক্ত দেশে বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রায় বৈচিত্র্যময় উৎসব

ফ্যাসিবাদমুক্ত দেশে বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রায় বৈচিত্র্যময় উৎসব
ছবি: সবার দেশ

বাংলা নববর্ষ ১৪৩২ উদযাপনের অংশ হিসেবে ‘নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান’ প্রতিপাদ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে শুরু হয় বর্ণাঢ্য ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’। সোমবার সকাল ৯টায় চারুকলা অনুষদের সামনে থেকে শুরু হওয়া এ শোভাযাত্রা শাহবাগ মোড়, টিএসসি, শহীদ মিনার, শারীরিক শিক্ষাকেন্দ্র, দোয়েল চত্বর ও বাংলা একাডেমির সামনের রাস্তা ঘুরে পুনরায় চারুকলা চত্বরে এসে শেষ হয়। 

এটি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি উজ্জ্বল প্রকাশ হিসেবে বিবেচিত হয়, যা প্রতিবছরই হাজারো মানুষের অংশগ্রহণে আরও সমৃদ্ধ হয়।

নতুন নাম, নতুন আবহ

এবারের শোভাযাত্রা পূর্ববর্তী ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’র পরিবর্তে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’ নামে আয়োজিত হয়। নামের এ পরিবর্তনের পাশাপাশি শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য ‘নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান’ সমকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক বার্তা বহন করে। এ প্রতিপাদ্যটি বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ঘটনাবলি, বিশেষ করে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিবাদকে প্রতিফলিত করে। শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারীদের মাঝে এ বার্তা গভীর প্রভাব ফেলে এবং আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।

বৈচিত্র্যময় অংশগ্রহণ

শোভাযাত্রায় শিক্ষক, শিক্ষার্থী, শিল্পী, সাধারণ মানুষের পাশাপাশি বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী—চাকমা, মারমা, সাঁওতাল, গারো—এবং বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দল অংশ নেয়। এছাড়া কৃষক দল, রিকশা-শ্রমিক সংহতি, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অশ্বারোহী দলসহ প্রায় ২৮টি সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। শোভাযাত্রার শুরুতে ছিলো আটটি ঘোড়ার বাহিনী, যা আয়োজনের শোভা বাড়ায়। তবে এবার পুলিশের পৃথক কোনো শোভাযাত্রা বাহিনী ছিলো না, যা পূর্ববর্তী বছরগুলোর তুলনায় একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সদস্য, সাংস্কৃতিক উপদেষ্টা, বিশিষ্ট নাগরিক ও শিল্পীরাও শোভাযাত্রায় উপস্থিত ছিলেন। এ বৈচিত্র্যময় অংশগ্রহণ শোভাযাত্রাকে একটি সর্বজনীন উৎসবে পরিণত করে।

প্রতীকী মোটিফ ও বিতর্ক

শোভাযাত্রার অন্যতম আকর্ষণ ছিলো এর মোটিফগুলো। এবার মোট সাতটি প্রধান মোটিফ প্রদর্শিত হয়, যার মধ্যে ‘ফ্যাসিবাদের মুখ’ নামে একটি প্রতীকী মুখাকৃতি সবচেয়ে বেশি আলোচনার জন্ম দেয়। বাঁশ, কাঠ ও বেত দিয়ে তৈরি এ মুখাকৃতিতে খাড়া চারটি শিং, হাঁ করা মুখ, বিশালাকৃতির নাক ও ভয়ার্ত চোখ ছিলো, যা অনেকের মতে পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিকৃতি হিসেবে উপস্থাপিত হয়।

তবে শোভাযাত্রার আগের দিন শনিবার ভোরে এ মোটিফটি পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনা ঘটে। একই সঙ্গে ‘শান্তির পায়রা’ মোটিফেও আগুন দেয়া হয়। এ ঘটনা ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয় এবং শোভাযাত্রার আয়োজকদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি করে। তবে চারুকলার শিক্ষার্থী ও শিল্পীরা দ্রুত পদক্ষেপ নেন এবং শনিবার রাতের মধ্যে থার্মোকল ও ককশিট ব্যবহার করে ‘ফ্যাসিবাদের মুখ’ মোটিফটি পুনরায় তৈরি করেন। এ ঘটনা শোভাযাত্রার প্রস্তুতিতে একটি নাটকীয় মোড় নিয়ে আসে এবং আয়োজনের প্রতি মানুষের আগ্রহকে আরও বাড়িয়ে দেয়।

অন্য একটি উল্লেখযোগ্য মোটিফ ছিলো ‘পানি লাগবে পানি’ লেখা পানির বোতল, যা জুলাই আন্দোলনে গুলিতে নিহত মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধর স্মরণে প্রদর্শিত হয়। এ মোটিফটি দর্শকদের মাঝে গভীর আবেগ জাগায় এবং সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলনের স্মৃতিকে তুলে ধরে। এছাড়া বাঘ, ইলিশ মাছ, পালকি ও শান্তির পায়রার মোটিফ শোভাযাত্রায় ঐতিহ্যবাহী বাঙালি সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করে।

রাজনৈতিক বার্তা ও প্রতিবাদের ভাষা

এবারের শোভাযাত্রা শুধু সাংস্কৃতিক উৎসবই ছিলো না, এটি একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক ও সামাজিক বার্তার বাহকও ছিলো। ‘ফ্যাসিবাদের অবসান’র প্রতিপাদ্য এবং প্রতীকী মোটিফগুলো স্বৈরাচার ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিবাদের প্রতিফলন ঘটায়। শোভাযাত্রার বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড, ব্যানার ও শিল্পকর্মে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ঘটনাবলির প্রভাব স্পষ্ট ছিল। দর্শনার্থীদের মধ্যে এ প্রতিবাদী ভাষা ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয় এবং শোভাযাত্রাকে একটি গণজাগরণের প্ল্যাটফর্মে পরিণত করে।

সাংস্কৃতিক ও সামাজিক তাৎপর্য

বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি কেবল নববর্ষ উদযাপনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং বাংলাদেশের বৈচিত্র্যময় সমাজের ঐক্য ও সংহতির প্রতীক। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী, পেশাজীবী ও সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ এ শোভাযাত্রাকে একটি সর্বজনীন মিলনমেলায় রূপ দেয়। এবারের আয়োজনে নারী ফুটবল দল, আদিবাসী সম্প্রদায় ও শ্রমিক সংগঠনের উপস্থিতি বাংলাদেশের সামাজিক বৈচিত্র্যকে আরও উজ্জ্বলভাবে তুলে ধরে।

চ্যালেঞ্জ ও সাফল্য

শনিবার ভোরে মোটিফে আগুন দেয়ার ঘটনা শোভাযাত্রার আয়োজকদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিলো। তবে চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থী ও শিল্পীদের তৎপরতায় দ্রুত নতুন মোটিফ তৈরি করা সম্ভব হয়। এ ঘটনা শোভাযাত্রার প্রতি তাদের নিষ্ঠা ও অঙ্গীকারের প্রমাণ বহন করে। আগুনের ঘটনা সত্ত্বেও শোভাযাত্রা নির্ধারিত সময়ে শুরু হয় এবং হাজারো মানুষের উপস্থিতিতে সফলভাবে সম্পন্ন হয়।

‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা ১৪৩২’ বাঙালির সংস্কৃতি, ঐক্য ও প্রতিবাদের একটি অসাধারণ মিলনমেলা ছিলো। এটি একদিকে যেমন নববর্ষের আনন্দ ছড়িয়েছে, অন্যদিকে ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিবাদকে শিল্পের মাধ্যমে প্রকাশ করেছে। বৈচিত্র্যময় অংশগ্রহণ, প্রতীকী মোটিফ ও রাজনৈতিক বার্তার মাধ্যমে এ শোভাযাত্রা বাংলাদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায় রচনা করেছে।

সবার দেশ/এমকেজে