মুর্শিদাবাদে সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় বাংলাদেশের তীব্র প্রতিবাদ
ভারতের মুসলিমদের নিরাপত্তার আহ্বান

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনায় বাংলাদেশকে জড়ানোর অভিযোগের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার। একই সঙ্গে ভারত সরকার ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রতি সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠীর ‘পূর্ণ নিরাপত্তা’ নিশ্চিত করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (১৭ এপ্রিল) প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস)-এর কাছে সরকারের এ অবস্থান তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, মুর্শিদাবাদের সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় বাংলাদেশকে জড়ানোর যেকোনো চেষ্টাকে আমরা দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করি। তিনি আরও জানান, বাংলাদেশ সরকার ভারতে মুসলিমদের ওপর হামলা এবং তাদের জানমালের নিরাপত্তাহানির ঘটনার তীব্র নিন্দা জানায়।
সহিংসতার পটভূমি
ভারতের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত সপ্তাহে পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম-অধ্যুষিত মুর্শিদাবাদ জেলায় নতুন ওয়াকফ আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বিক্ষোভের সময় সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। এ বিক্ষোভ মালদহ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, হুগলি এবং মুর্শিদাবাদের জেলা সদর বহরমপুর শহরে সংগঠিত হয়। এ সহিংসতার সময় আগুন লাগানো, ইটপাটকেল নিক্ষেপ এবং রাস্তা অবরোধের মতো ঘটনা ঘটে। স্থানীয় প্রশাসন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করে।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী এ সহিংসতার জন্য ‘বাংলাদেশি দুষ্কৃতকারী’, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) এবং ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)-কে দায়ী করেছেন। তিনি দাবি করেন, এ ঘটনা বিজেপির ‘পরিকল্পিত’ ষড়যন্ত্রের অংশ। তবে বাংলাদেশ এ অভিযোগকে ভিত্তিহীন আখ্যা দিয়ে তা প্রত্যাখ্যান করেছে।
বাংলাদেশের অবস্থান
শফিকুল আলম বলেন, আমরা ভারত সরকার এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠীর পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সব ধরনের পদক সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানাই। তিনি মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনাকে ‘দুঃখজনক’ এবং ‘অগ্রহণযোগ্য’ বলে উল্লেখ করেন। বাংলাদেশ সরকার এ ঘটনার তদন্ত এবং দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছে।
মুর্শিদাবাদের প্রেক্ষাপট
মুর্শিদাবাদ পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি জেলা। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, এ জেলার জনসংখ্যা প্রায় ৭১ লাখ, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ মুসলিম। ঐতিহাসিকভাবে এ অঞ্চল বাংলার নবাবদের রাজধানী ছিলো এবং এটি সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তবে, সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা এ অঞ্চলে অতীতেও দেখা গেছে, যা প্রায়ই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
ভারতের প্রতিক্রিয়া
মমতা ব্যানার্জী একটি সভায় বলেন, বিজেপির লোক বাইরে থেকে এসে গন্ডগোল পাকিয়ে পালিয়ে গেছে। বিএসএফ কেন এদের প্রবেশ করতে দিয়েছে? তিনি এ ঘটনাকে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র হিসেবে আখ্যা দিয়ে বলেন, এটি মুর্শিদাবাদের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নষ্ট করার চেষ্টা। তবে, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বা বিএসএফ এখনও এ অভিযোগের জবাব দেয়নি।
আন্তর্জাতিক প্রভাব
এ ঘটনা ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ওপর নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের এ বিবৃতি দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। বিশেষ করে, সীমান্ত নিরাপত্তা এবং সংখ্যালঘু অধিকার নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে পূর্বেও বিতর্ক হয়েছে। বাংলাদেশের এ আহ্বান ভারতের অভ্যন্তরীণ নীতি এবং সংখ্যালঘু নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে।
সমাজে প্রভাব
মুর্শিদাবাদের এ সহিংসতা স্থানীয় জনগণের মধ্যে আতঙ্ক ও অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনাগুলো প্রায়ই সামাজিক মেরুকরণকে আরও তীব্র করে। অনেকে মনে করেন, এ ঘটনার পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকতে পারে, যা স্থানীয় শান্তি ও সম্প্রীতির জন্য হুমকি। স্থানীয় নাগরিক সমাজ এবং ধর্মীয় নেতারা শান্তি বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছেন।
পরবর্তী পদক্ষেপ
বাংলাদেশ সরকার এ ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত এবং দোষীদের শাস্তির দাবি জানিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ প্রশাসন ইতোমধ্যে সহিংসতার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেফতার শুরু করেছে বলে জানা গেছে। তবে, এ ঘটনা দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক আলোচনার বিষয় হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সংখ্যালঘু নিরাপত্তা এবং সীমান্ত ব্যবস্থাপনা নিয়ে উভয় পক্ষকে আরও স্বচ্ছ ও সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে।
মুর্শিদাবাদের এ ঘটনা কেবল স্থানীয় সমস্যা নয়, বরং এটি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক, সংখ্যালঘু অধিকার এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিষয়ে গভীর প্রশ্ন তুলেছে। সবার দৃষ্টি এখন ভারত সরকারের প্রতিক্রিয়া এবং ঘটনার তদন্তের দিকে।
সবার দেশ/কেএম