Header Advertisement

Sobar Desh | সবার দেশ সবার দেশ প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ০০:৫৯, ২০ এপ্রিল ২০২৫

দেশের পরমাণু নীতিও ভারতের হাতে, প্রতিবাদকারীদের বেতন বন্ধ

ভারত নিয়ন্ত্রিত সফটওয়্যারে কমিশনের কর্মীদের নাম, পারিবারিক তথ্য, আমদানি-রফতানির বিবরণ, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে চুক্তি এবং গবেষণার তথ্য ইনপুট করতে হবে। তাতে চেন্নাই থেকে নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় পরমাণু প্রযুক্তি সংক্রান্ত সংবেদনশীল তথ্যের গোপনীয়তা ঝুঁকির মুখে পড়বে।

দেশের পরমাণু নীতিও ভারতের হাতে, প্রতিবাদকারীদের বেতন বন্ধ
ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের (বাপশক) প্রায় ৬০০ বিজ্ঞানীসহ ২৫০০ কর্মকর্তা ও কর্মচারী গত দুই মাস ধরে বেতন-ভাতা থেকে বঞ্চিত রয়েছেন। এমনকি গত ঈদুল ফিতরেও তারা বেতন বা উৎসব ভাতা পাননি, যার ফলে তাদের পরিবারগুলো চর প্রকট আর্থিক ও মানবিক সংকটে পড়েছে। 

এ সংকটের মূল কারণ হিসেবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের একটি সিদ্ধান্তকে দায়ী করা হচ্ছে, যেখানে ভারতীয় একটি প্রতিষ্ঠানের তৈরি সফটওয়্যারের মাধ্যমে বেতন-ভাতা প্রদানের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ সফটওয়্যারটি ভারতের চেন্নাই থেকে নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় কমিশনের বিজ্ঞানী ও কর্মকর্তারা গোপনীয়তা লঙ্ঘনের আশঙ্কা প্রকাশ করে এর বিরুদ্ধে দ্বিমত পোষণ করেছেন। প্রতিবাদের জেরে তাদের বেতন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

সফটওয়্যার বিতর্ক ও গোপনীয়তার প্রশ্ন

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বেতন-ভাতা প্রদানের জন্য ভারতীয় একটি প্রতিষ্ঠানের তৈরি সফটওয়্যার ব্যবহার করা হচ্ছে। এ সফটওয়্যারে কমিশনের কর্মীদের নাম, পারিবারিক তথ্য, আয়-ব্যয়, আমদানি-রফতানির বিবরণ, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে চুক্তি এবং পরমাণু প্রযুক্তি সংক্রান্ত গবেষণার তথ্য ইনপুট করতে হবে। বিজ্ঞানীদের অভিযোগ, এ সফটওয়্যারটি ভারতের চেন্নাই থেকে নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় পরমাণু প্রযুক্তি সংক্রান্ত সংবেদনশীল তথ্যের গোপনীয়তা ঝুঁকির মুখে পড়বে। আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) নীতিমালা অনুযায়ী পরমাণু গবেষণা ও সেবা কার্যক্রমে গোপনীয়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ সফটওয়্যার ব্যবহার করলে কমিশনের গবেষণা ও কার্যক্রমের তথ্য বাইরের দেশের হাতে চলে যেতে পারে বলে তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কমিশনের কর্মকর্তা ও বিজ্ঞানীরা দ্বিমত পোষণ করায় গত দুই মাস ধরে তাদের বেতন-ভাতা বন্ধ রাখা হয়েছে। এ পদক্ষেপকে অনেকে প্রতিবাদ দমনের কৌশল হিসেবে দেখছেন।

কর্মীদের প্রতিবাদ ও কর্মসূচি

বেতন সংকট ও সফটওয়্যার বিতর্ক নিয়ে গত মঙ্গলবার (১৫ এপ্রিল ২০২৫) কমিশনের কার্যালয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় বিজ্ঞানী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত নেন। তারা ইতোমধ্যে এ বিষয়ে উপদেষ্টার সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছেন। উপদেষ্টা ইতিবাচক নির্দেশনা দিলেও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় থেকে সমাধানে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

কর্মীরা জানিয়েছেন, তারা এ সংকট সমাধানে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। তারা দাবি করেছেন, সফটওয়্যারের মাধ্যমে তথ্য নিয়ন্ত্রণের সিদ্ধান্ত বাতিল করা হোক এবং অবিলম্বে বেতন-ভাতা ও পেনশন প্রদান নিশ্চিত করা হোক।

বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের প্রেক্ষাপট

বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন ১৯৭৩ সালের প্রেসিডেন্সিয়াল অর্ডার নং ১৫ এবং ২০১৭ সালের ২৩ নং আইনের অধীনে প্রতিষ্ঠিত একটি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান। এটি পরমাণু শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার, গবেষণা, শিক্ষা এবং সেবামূলক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য গঠিত। কমিশনের আওতায় ৪০টি ইনস্টিটিউট রয়েছে, যেগুলো আন্তর্জাতিক রীতিনীতি মেনে পরমাণু বিজ্ঞান সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম পরিচালনা করে। কমিশনের প্রধান লক্ষ্য হলো দেশের বিদ্যুৎ চাহিদা মেটানোর জন্য রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো প্রকল্প বাস্তবায়ন, সে সঙ্গে গবেষণা ও উন্নয়ন কার্যক্রম চালানো।

কমিশনকে প্রশাসনিক, আর্থিক ও বিচারিক ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে যাতে এটি প্রচলিত আমলাতান্ত্রিক কাঠামোর বাইরে থেকে বিশেষায়িত কাজ পরিচালনা করতে পারে। তবে বর্তমানে অর্থ ছাড় না হওয়ায় কমিশনের গবেষণা, সেবা এবং কর্মীদের বেতন-ভাতা ও পেনশন প্রদানে গুরুতর অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।

কর্মীদের দুর্ভোগ

বেতন-ভাতা বন্ধ থাকায় কমিশনের ৬০০ বিজ্ঞানী এবং ২৫০০ কর্মকর্তা-কর্মচারী চরম আর্থিক সংকটে পড়েছেন। অনেকে জানিয়েছেন, তারা মৌলিক চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন। গত ঈদুল ফিতরে বেতন ও ভাতা না পাওয়ায় তাদের পরিবারগুলো উৎসবের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। একজন বিজ্ঞানী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমরা দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করছি, কিন্তু বেতন না পাওয়ায় আমাদের পরিবার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। এ সফটওয়্যারের মাধ্যমে আমাদের তথ্য বিদেশে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, যা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি।

জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন

বিজ্ঞানীদের মতে, পরমাণু শক্তি সংক্রান্ত তথ্য অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং এটি যদি বিদেশি সফটওয়্যারের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়, তবে তথ্য ফাঁসের ঝুঁকি তৈরি হবে। বাংলাদেশের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র রাশিয়ার রোসাটমের সহায়তায় নির্মিত হচ্ছে, এবং এ প্রকল্পে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও নিরাপত্তা নীতি গুরুত্বপূর্ণ। ভারতীয় সফটওয়্যারের মাধ্যমে তথ্য নিয়ন্ত্রণের সিদ্ধান্ত এ প্রকল্পের স্বচ্ছতা ও নিরাপত্তার প্রতি প্রশ্ন তুলেছে।

এছাড়া, কমিশনের বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এ সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের পরমাণু নীতির স্বাধীনতাকে খর্ব করতে পারে। তারা দাবি করেছেন, দেশীয় প্রযুক্তি বা স্বাধীন সফটওয়্যার ব্যবহার করে বেতন-ভাতা ও তথ্য নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা উচিত।

সরকারি পদক্ষেপের অভাব

কমিশনের কর্মীরা জানিয়েছেন, তারা এ বিষয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করেছেন, কিন্তু কোনো সুরাহা হয়নি। উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে ইতিবাচক আশ্বাস পাওয়া গেলেও মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের কারণে অর্থ ছাড়ে বিলম্ব হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে কর্মীরা সরকারের কাছে অবিলম্বে হস্তক্ষেপের দাবি জানিয়েছেন।

সম্ভাব্য প্রভাব

বেতন সংকট ও সফটওয়্যার বিতর্কের কারণে কমিশনের গবেষণা ও সেবা কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের কার্যক্রমও এর প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এছাড়া, কর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষ বাড়ছে, যা দীর্ঘমেয়াদে কমিশনের কার্যকারিতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

দাবি ও সমাধানের পথ

কমিশনের কর্মীরা দাবি করেছেন:

  • ভারতীয় সফটওয়্যার ব্যবহারের সিদ্ধান্ত বাতিল করে দেশীয় বা নিরাপদ সফটওয়্যার প্রবর্তন করা হোক।
  • অবিলম্বে বেতন-ভাতা, পেনশন এবং গবেষণার জন্য অর্থ ছাড় করা হোক।
  • পরমাণু শক্তি সংক্রান্ত তথ্যের গোপনীয়তা নিশ্চিত করতে স্বাধীন নীতি প্রণয়ন করা হোক।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এ সংকট সমাধানে সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। জাতীয় নিরাপত্তা ও পরমাণু গবেষণার স্বার্থে স্বচ্ছ ও স্বাধীন ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন। সরকার যদি কর্মীদের দাবি মেনে নেয়, তবে এ সংকট কাটিয়ে কমিশন তার কার্যক্রমে পুনরায় গতি ফিরে পেতে পারে। অন্যথায়, এটি দেশের পরমাণু শক্তি খাতের জন্য একটি বড় ধাক্কা হতে পারে।

সবার দেশ/কেএম

সম্পর্কিত বিষয়: