আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত
হাসিনা-জিয়াউল আহসানের বিরুদ্ধে ২০০ গুমের প্রত্যক্ষ প্রমাণ

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম জানিয়েছেন, প্রায় ২০০টি গুমের ঘটনায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী ফ্যাসিস্ট হাসিনা এবং সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল (বরখাস্ত) জিয়াউল আহসানের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
২০ এপ্রিল ২০২৫, রোববার সকালে ট্রাইব্যুনালে ১৯ জন অভিযুক্তকে হাজির করা হয়, যাদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, বিচারপতি, সচিব এবং পুলিশ-সেনা কর্মকর্তারা। ট্রাইব্যুনাল তদন্তের অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আগামী ২০ জুলাই তারিখ নির্ধারণ করেছে। প্রতিবেদনে এ মামলার তদন্তের অগ্রগতি, প্রমাণ এবং ভবিষ্যৎ পদক্ষেপের বিষয়ে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
তদন্তের অগ্রগতি ও প্রমাণ
চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম জানান, মামলার তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে গণহত্যা, পরিকল্পিত সহিংসতা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে। তিনি বলেন, তদন্তে এমন সব সাক্ষ্যপ্রমাণ উঠে এসেছে, যা থেকে স্পষ্ট যে, অভিযুক্তরা রাষ্ট্রীয় শক্তি ব্যবহার করে নিরীহ জনগণের বিরুদ্ধে সহিংসতা চালিয়েছেন।
তদন্তে সংগৃহীত প্রমাণের মধ্যে রয়েছে:
- ভিকটিমদের সাক্ষ্য: গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবার ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য।
- ভিডিও ও ড্রোন ফুটেজ: ঘটনাস্থলের ভিডিও এবং ড্রোন ফুটেজ, যা অপরাধের পরিকল্পিত প্রকৃতি প্রমাণ করে।
- গোপন আটক কেন্দ্রের প্রমাণ: উত্তরার র্যাব-১ কার্যালয়ে একটি ‘আটক কেন্দ্র’, আগারগাঁওয়ের র্যাব-২ কার্যালয়ে ‘গুম কক্ষ’ এবং কচুক্ষেতের ‘আয়নাঘর’ (জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেল) থেকে নির্যাতনের সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়েছে।
তাজুল ইসলাম আরও জানান, এ স্থানগুলোর কাঠামো পরিবর্তন করে প্রমাণ ধ্বংসের চেষ্টা করা হয়েছে, যা তদন্তে নথিভুক্ত করা হয়েছে। তিনি দাবি করেন, গুমের মোট ঘটনা ৮০০ থেকে ৯০০টি হতে পারে, যার মধ্যে ৩০০ জনের হত্যার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
ট্রাইব্যুনালে হাজিরা ও আইনি প্রক্রিয়া
২০ এপ্রিল ট্রাইব্যুনালে ১৯ জন অভিযুক্তকে হাজির করা হয়। এদের মধ্যে জিয়াউল আহসান অন্যতম, যিনি ইতিমধ্যে অন্য মামলায় কারাগারে রয়েছেন। ট্রাইব্যুনালের তিন সদস্যের বেঞ্চ, বিচারপতি মো. গোলাম মোর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বে, তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ২০ জুলাই নির্ধারণ করেছে।
তাজুল ইসলাম জানান, তদন্ত শেষ হলে প্রতিবেদন পর্যালোচনার ভিত্তিতে মামলাটি প্রসিকিউশনের জন্য প্রস্তুত করা হবে। এরপর অভিযোগ গঠন, শুনানি এবং বিচারিক কার্যক্রম শুরু হবে। তিনি বলেন, আমরা নিশ্চিত করতে চাই যে বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ হয়, তবে আইনের প্রক্রিয়া ভঙ্গ না করে।
শেখ হাসিনা ও জিয়াউল আহসানের ভূমিকা
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি তার ১৫ বছরের শাসনামলে গুম ও বহিঃবিচারিক হত্যাকাণ্ডের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তাজুল ইসলাম দাবি করেন, হাসিনা গোপন আটক কেন্দ্রের একটি জাতীয় নেটওয়ার্কের কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। তদন্তে তার ফোন কল এবং জুলাই-আগস্ট ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের সময় সভার নথি বিশ্লেষণ করা হচ্ছে।
জিয়াউল আহসান, সাবেক র্যাব মহাপরিচালক এবং ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) প্রধান হিসেবে, গুম ও নির্যাতনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। তিনি বর্তমানে কারাগারে থাকলেও এ মামলায় তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে হাজির করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত গুম বিষয়ক কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হাসিনা ১৫ বছর ধরে গুমের নির্দেশ দিয়েছিলেন। কমিশন ১,৬৭৬টি অভিযোগ রেকর্ড করেছে, যার মধ্যে ৭৫৮টি পরীক্ষা করা হয়েছে। এর ২৭% শিকার কখনো ফিরে আসেনি।
র্যাব ও গোপন আটক কেন্দ্র
তদন্তে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) ভূমিকা উঠে এসেছে। তাজুল ইসলাম জানান, র্যাব হাসিনার নির্দেশে গুম ও নির্যাতনের কাজে সরাসরি জড়িত ছিলো। ঢাকার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছে র্যাবের একটি গোপন কারাগার আবিষ্কৃত হয়েছে, যেখানে বিরোধী নেতাকর্মীদের আটক ও নির্যাতন করা হতো।
‘আয়নাঘর’ নামে কুখ্যাত একটি জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলে বন্দিদের নির্যাতনের জন্য বিশেষ সরঞ্জাম ব্যবহার করা হতো। তদন্তকারীরা জানান, দেশব্যাপী ৫০০-৭০০টি অনুরূপ কক্ষ ছিলো, যা গুমের ঘটনাকে ‘ব্যাপক ও পরিকল্পিত’ করে তুলেছিলোল।
আইনি ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এটি দ্বিতীয় গ্রেফতারি পরোয়ানা। প্রথম পরোয়ানা জারি হয়েছিলো ১৭ অক্টোবর ২০২৪, জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে। তিনি বর্তমানে ভারতে পালিয়ে আছেন, এবং বাংলাদেশ সরকার তার প্রত্যর্পণের জন্য ভারতের কাছে আনুষ্ঠানিক অনুরোধ জানিয়েছে।
আওয়ামী লীগ দাবি করছে, এ গুম ও নির্যাতনের ঘটনাগুলো দলের জ্ঞানের বাইরে এবং সামরিক প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ গতিশীলতার ফল। তবে সেনাবাহিনী এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে।
সম্ভাব্য ফলাফল ও চ্যালেঞ্জ
এ মামলা বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিচারিক প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তবে, বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে:
- শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ: হাসিনা ভারতে থাকায় তার প্রত্যর্পণ প্রক্রিয়া জটিল। ভারত এখনও এ বিষয়ে স্পষ্ট সাড়া দেয়নি।
- প্রমাণ ধ্বংসের চেষ্টা: গোপন কেন্দ্রগুলোর কাঠামো পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রমাণ ধ্বংসের অভিযোগ তদন্তকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
- বিচারের নিরপেক্ষতা: আইসিটির বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে পূর্বে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ উঠেছে, যা এ মামলার বিশ্বাসযোগ্যতার উপর প্রভাব ফেলতে পারে।
তদন্তের অগ্রগতি এবং প্রমাণের শক্তি বিবেচনায়, এ মামলা শেখ হাসিনা ও তার প্রশাসনের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ প্রমাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে, আইনি প্রক্রিয়ার দীর্ঘমেয়াদী ফলাফল এবং রাজনৈতিক প্রভাব নির্ভর করবে বিচারের স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার উপর।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্তে মাফিয়া হাসিনা ও জিয়াউল আহসানের বিরুদ্ধে ২০০টি গুমের প্রমাণ একটি গুরুতর অভিযোগ। ভিকটিমদের সাক্ষ্য, ভিডিও ফুটেজ এবং গোপন আটক কেন্দ্রের প্রমাণ এ মামলাকে শক্তিশালী করেছে। ট্রাইব্যুনালের পরবর্তী পদক্ষেপ এবং তদন্ত প্রতিবেদনের ফলাফল বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হবে।
সবার দেশ/কেএম