সজীবের স্ত্রী ক্রিস্টিনের ব্যাংক লেনদেনের সন্দেহজনক তথ্য মিলেছে
জয়ের বিলাসবহুল ৮ গাড়ি, ৫ প্রতিষ্ঠানের খোঁজ পেয়েছে এফবিআই
ক্ষমতায় থাকাকালীন শেখ হাসিনা ও তার ছেলে জয় যুক্তরাষ্ট্র এবং বৃটেনে ৩০০ মিলিয়ন ডলার (প্রায় ৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা) পাচার করেছেন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়া ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের ৮টি বিলাসবহুল গাড়ি এবং ৫টি কোম্পানির মালিকানা থাকার তথ্য পেয়েছে মার্কিন তদন্ত সংস্থা ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (এফবিআই)। এফবিআই-এর তদন্ত রিপোর্ট বলছে, ক্ষমতায় থাকাকালীন শেখ হাসিনা ও তার ছেলে জয় যুক্তরাষ্ট্র এবং বৃটেনে ৩০০ মিলিয়ন ডলার (প্রায় ৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা) পাচার করেছেন।
এফবিআইয়ের অনুসন্ধানের ভিত্তিতে বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ২০২৪ সালের ২২ শে ডিসেম্বর হাসিনা ও জয়ের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও বৃটেনে ৩০০ মিলিয়ন ডলার পাচারের অভিযোগের তদন্ত শুরু করে। ২০২৩ সালের ২৩ শে এপ্রিল মার্কিন বিচার বিভাগের অপরাধ বিভাগের সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেলের কাছে এফবিআই প্রতিবেদনটি জমা দেয়। এফবিআই’র প্রতিবেদনের একটি অনুলিপি পেয়েছে দুদক। এ নিয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে ইংরেজি দৈনিক নিউ এজ।
রিপোর্টে জয়ের মালিকানাধীন ৮ বিলাসবহুল গাড়ির বিস্তারিত তুলে ধরা হয়। যার মধ্যে রয়েছে ম্যাকলারেন ৭২০এস (মূল্য ২ লাখ ৫০ হাজার ৫৭৮ ডলার), মার্সিডিজ বেঞ্জ এএমজি জিটি (মূল্য ১ লাখ ৯ হাজার ৮০৬ ডলার), মার্সিডিজ বেঞ্জ এস-ক্লাস (মূল্য ৫১ হাজার ৮ ডলার), এসএল শ্রেণির মার্সিডিজ বেঞ্জ (৭৩ হাজার ৫৭০ ডলার), লেক্সাস জিএক্স ৪৬০ (মূল্য ৩০ হাজার ১৮২ ডলার), রেঞ্জ রোভার (৩৭ হাজার ৫৮৬ ডলার), জিপ গ্র্যান্ড চেরোকি (৭ হাজার ৪৯১ ডলার) এবং গ্র্যান্ড চেরোকি (৪ হাজার ৪৭৭ ডলার)।
এফবিআইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা হংকং ও কেম্যান আইল্যান্ডে সজীবের ব্যাংক হিসাব খুঁজে পেয়েছে। স্থানীয় একটি মানি এক্সচেঞ্জ কোম্পানির মাধ্যমে ওয়াশিংটন ডিসি, নিউইয়র্ক ও লন্ডনে সন্দেহজনক অর্থ স্থানান্তরের বিষয়টি জানা যায়। জয়ের সন্দেহজনক কার্যকলাপ খতিয়ে দেখতে এফবিআই বৃটিশ গোয়েন্দাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এ অনুসন্ধানগুলো সম্ভাব্য অবৈধ ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে গুরুতর উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন। এফবিআইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্পেশাল এজেন্ট লা প্রিভোটের সঙ্গে মার্কিন বিচার বিভাগের সিনিয়র ট্রায়াল অ্যাটর্নি লিন্ডা স্যামুয়েলসের যোগাযোগ হয়। তিনি বাংলাদেশ থেকে ৩০০ মিলিয়ন ডলার চুরি এবং যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পাচার সংক্রান্ত একটি মামলায় ওয়াশিংটন ফিল্ডের সহায়তা চেয়েছিলেন।
হাসিনা ও সজীব সজীব যুক্তরাষ্ট্র ও কেম্যান আইল্যান্ডে অর্থ পাচার করেছেন উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, বিচার বিভাগের সম্পদ বাজেয়াপ্তকরণ বা মানি লন্ডারিং বিভাগ এসব তহবিল খুঁজে বের করতে, সংযত করতে, জব্দ করতে ওয়াশিংটন ফিল্ডের সহায়তা চেয়েছিলো। আমাদের তদন্তে ওয়াজেদ কনসাল্টিং ইনকর্পোরেটেড নামে সন্দেহজনক কার্যকলাপও পাওয়া গেছে। ওয়াজেদ কনসালট্যান্ট বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে অসংখ্য ব্যবসায় নিয়োজিত ছিল এবং বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট প্রকল্পের যুক্ত ছিল।
প্রতিবেদনে বলা হয়, এসব আর্থিক লেনদেনের বৈধতা নির্ধারণ ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে সতর্কতার সঙ্গে যাচাই-বাছাই ও তদন্তের দাবি রাখে। এফবিআই আরও বলেছে, তারা ব্যাংক অ্যাকাউন্টের তথ্য যাচাই এবং যে কোনো সম্ভাব্য অবৈধ কার্যক্রম মোকাবেলায় সহযোগিতা করার জন্য দুদকের সাথে যোগাযোগ করেছে।
তদন্তে ম্যাসাচুসেটস ও ভার্জিনিয়ায় সজীব, সজীবের স্ত্রী ক্রিস্টিন ও. ওয়াজেদের সঙ্গে সন্দেহজনক ব্যাংক কার্যক্রমের তথ্যও পাওয়া গেছে বলেও উল্লেখ করা হয়। এফবিআই আরও জানিয়েছে, তাদের গোপন তথ্যদাতা জয়ের দুই সহযোগীর নামও জানিয়েছেন- যুক্তরাষ্ট্র মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান ও জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সম্পাদক নিজাম চৌধুরী।
গোয়েন্দা সংস্থাটি ওয়াজেদ কনসাল্টিং, ইকম সিস্টেমস, এমভিয়ন ও ইন্টেলিজেন্ট ট্রেড সিস্টেমস লিমিটেডসহ পাঁচটি প্রতিষ্ঠানে সজীবের সম্পৃক্ততা খুঁজে পেয়েছে। ৩৬ জুলাই খ্যাত ৫ই আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর শেখ হাসিনা, তার ছেলে সজীব ও পরিবারের অন্য সদস্যদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। কমিশনের উপ-পরিচালক মো. সালাউদ্দিনের নেতৃত্বে একটি তদন্ত দল অনুসন্ধান শুরু করে এবং ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় তথ্য চেয়ে সরকারের বিভিন্ন সংস্থাকে চিঠি দিয়েছে।
অনুসন্ধান দলের এক সদস্য নিউ এজকে সোমবার (১৩ জানুয়ারি) বলেন, তারা প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সচিব, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট, পাসপোর্ট অফিস, নির্বাচন কমিশনসহ বিভিন্ন দপ্তরে তথ্য চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন। অর্থ পাচারের বিষয়ে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সূত্র থেকে ইতোমধ্যে তথ্য পাওয়া গেছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, পাসপোর্ট অফিস ও নির্বাচন কমিশন তাদের কিছু তথ্য দিলেও বাকি অফিসগুলো এখনো চিঠির জবাব দেয়নি।
তবে সজীব তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দাবি করেছেন, তার ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তা সম্পূর্ণ বানোয়াট। তিনি বলেন, আমরা কখনো কোনো সরকারি প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত ছিলাম না বা থেকে অর্থ উপার্জন করিনি।
তিনি বলেন, অবশ্যই এই দুই দেশে আমাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট রয়েছে। আমাদের কোনো অফশোর অ্যাকাউন্ট নেই। যে পরিমাণ অর্থ দাবি করা হচ্ছে, তা আমরা কেউ কখনও দেখিনি। এর আগে গত ১৭ ডিসেম্বর শেখ হাসিনা, সজীব সজীব, শেখ রেহানা এবং শেখ রেহানার মেয়ে ও ব্রিটিশ মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে ৮০ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত শুরু করে কমিশন।
২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্পসহ ৯টি প্রকল্পে ৮০ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে।
সবার দেশ/কেএম