ওএমএস’র ট্রাক সেল, সামাজিক মর্যাদা
একই দেশে একই কাজের বিষয়ে মানুষের চিন্তার ফারাক বিস্তর, যেটা নৈতিকতার মানদন্ডে উত্তীর্ণ নয়। আমাদের দেশে অনেকেই রেশন পান, যেমন ধরুন বাংলাদেশের বিভিন্ন বাহিনীগুলো সেখানে কর্মকর্তা-কর্মচারী সবাইকে রেশন দেয়া হয়। সংশ্লিষ্ট বাহিনীর সদস্যরা রেশন গ্রহণে মর্যাদা হানিকর কোন কিছু মনে করেন না। বরং রেশন নিয়ে তারা মানসিক ও আর্থিক দুইদিকেই সমানভাবে স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন।
বর্তমান বাজারে দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধিতে কম আয়ের লোকদের জন্য বাংলাদেশ সরকার ওএমএস নামে ট্রাক সেলের মাধ্যমে রেশনের ব্যবস্থা করেছে। সদ্য পতিত সরকারও চালু রেখেছিলেন এটি। টিসিবি বা ওএমএস ট্রাক সেল থেকে সাধারণত নিম্ন আয়ের লোকজনই পণ্য ক্রয় করে থাকেন।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং রাজনৈতিক অস্থিরতায় শুধু অপেক্ষাকৃত কম আয়ের লোকজনই না, যারা আগে বেশ ভালো অবস্থায় ছিলেন, তাদের মধ্যেও অনেকেই লোক লজ্জার ভয়ে মাঝে মাঝে মুখ ঢেকে বা পরিচয় লুকিয়ে এসব পণ্য ক্রয় করে থাকেন।
পরিচয় লুকানো বা লজ্জা পাওয়া! কেন লজ্জা পাবেন তারা? তারা তো কোনও অপরাধের কাজ করতে যাননি। বরং রাষ্ট্র বা সমাজ তাদের যথাযথ দায়িত্ব নিতে না পারার কারণে লজ্জা তো তাদেরই পাওয়ার কথা। উন্নত বিশ্বে তা-ই হয়।
আমাদের সামরিক বাহিনী এবং পুলিশ বাহিনীতেও রেশন দেয়া হয়। সেখানে কিন্তু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা রেশন গ্রহণে লজ্জা পাওয়া বা অসম্মানিত বোধ করেন না। সেটা তাদের অধিকার ভেবে নিজেরা সব সময় করে থাকেন। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় যখন সাধারণ জনতার মধ্যে কেউ কেউ এ ধরনের রেশন গ্রহণ করতে চান। এখানে রেশন গ্রহীতা এবং তথাকথিত দেখনেওয়ালা উভয়েই বিষয়টিকে অমর্যাদাকর হিসেবে ভাবেন। আমাদের সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামো আসলে সেভাবেই গড়ে উঠেছে।
কিন্তু সরকার যদি বিতরণ ব্যবস্থাপনায় পদ্ধতিগত পরিবর্তন আনেন, তাহলে এমনটি আর হয়তো হবে না। আগে যেমন বিভিন্ন এলাকায় নির্দিষ্ট জায়গায় রেশন ঘর থেকে দ্রব্যাদি বিক্রি হতো, ঠিক তেমনি বর্তমান রাস্তায় ট্রাক সেল এর পরিবর্তে যদি সেটার প্রচলন করা হয়, তাহলে কিন্তু অনেকটাই সম্মানজনক হয়। স্বস্তিতে রেশন ক্রয় করতে পারবেন কর্মহীন মধ্যবিত্তরাও। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে বিষয়টি বিবেচনার জন্য আবেদন করছি। এমনটি করা যায় কিনা ভেবে কার্যকরী ব্যবস্থা নিবেন।
একই কাজ করতে গিয়ে কেউ লজ্জা পায় আর কেউ সম্মান বোধ করে। মানসিক অবস্থার এরূপ দ্বৈততা ও দৈন্যতা কিন্তু দীর্ঘদিন ধরেই আমাদের সমাজে চলমান আছে। ধরুন ঘুষখোর একজন সরকারি কর্মকর্তা অথবা অসৎ উপায়ে অর্জিত বেসরকারি কর্মকর্তা, তাকে সবাই সমাজে তার অর্থনৈতিক অবস্থার বিবেচনায় সমীহ করে। বিপরীত দিক থেকে একজন সৎ ন্যায়-নীতি সম্পন্ন ব্যক্তি যাদের অর্থনৈতিক যোগ্যতা কম, তাদেরকে কিন্তু মানুষ অন্য চোখে দেখে।
আরও পড়ুন>> আইএমএফ’র চাপে আরোপিত কর, সাধারণ জনতার প্রত্যাশা
এ যে মানসিক অবস্থার দৈন্যতার কারণে দিনের পর দিন মিথ তৈরি হয়েছে আমাদের সমাজে, আমরা সেটা যত্নের সঙ্গে আবার লালনও করে যাচ্ছি দিনের পর দিন। এভাবেই সামাজিক মূল্যবোধ তৈরি হয়েছে। আমাদের প্রত্যেককেই নিজেকে প্রশ্ন করা উচিত, সমাজের এসব দৈন্যতা আর কতদিন বহন করে বেড়াবো।
সময় এসেছে দিন বদলের। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রী নিয়েও কেউ স্বেচ্ছায় কৃষি কাজ করছেন, কেউবা ফুটপাতে টংয়ের দোকান সাজিয়ে পিঠা বিক্রয় করছেন। পরিশ্রমের মাধ্যমে সৎ উপায়ে স্বাবলম্বী হচ্ছেন।
প্রিয় পাঠক, আমি জানিনা আপনার অর্থনৈতিক অবস্থা কেমন। আপনি নিজেই যদি কখনো এমন অবস্থার পাত্র হয়ে যান, তাহলে আপনারও কিন্তু এরকম টিসিবির বা ওএমএস ট্রাকসেল থেকে নিত্যপণ্য প্রকাশ্যে নিতে মন সায় দেবে না। কারণ, আপনি ভাবছেন আপনার পাশের পরিচিত কেউ আপনাকে দেখে ফেললে আপনার ইজ্জত চলে যাবে।
কেন এমনটি হচ্ছে বলুন তো, এ কাজ করা কি কোন অপরাধ, ‘না' এক বাক্যে সকলে উত্তর দিবে অপরাধ নয়, তবে কেন? আসলে সামাজিক মূল্যবোধের মধ্যেই বৈষম্য লুকিয়ে আছে। একই কাজ কোন এক শ্রেণীর মানুষের কর্তৃক হলে তার মর্যাদার কোন হানি হয় না, অথচ সে কাজ অন্য আরেক শ্রেণীর কেউ করলে তার মর্যাদার হানি ঘটে। এটি স্পষ্টত সামাজিক অনাচার। এ অনাচার রাতারাতি সমাধান করা যাবে না, তার জন্য দরকার অব্যাহতভাবে আমাদের মানসিকতা পরিবর্তনের প্রচেষ্টা ।
পরিবর্তিত মানসিকতার মাধ্যমে এ বৈষম্য দূর করে সমাজে সাম্য তৈরি করা যেতে পারে। যে সমাজে থাকবে না কোন অনাচার এবং কোন শ্রেণী-বৈষম্য, মানুষ মানুষকে যথোপযুক্ত সম্মান, মূল্য দিবে একে অপরকে ভালোবাসবে, ভালো চোখে দেখবে।
আমাদের সকলেরই এভাবে ভেবে দেখা দরকার, একজন বড় সরকারী কর্মকর্তার রেশন থেকে পন্য ক্রয় করলে যদি তার মর্যাদাহানি না ঘটে, তাহলে মধ্যবিত্ত বা যে কোন শ্রেণীর লোক রেশনের কম মূল্য পণ্য ক্রয় করলে তারও ইজ্জত যাবার কোনো কারণ নেই। আসলে প্রয়োজন আমাদের মানসিকতা পরিবর্তনের। অপরকে মর্যাদা দিলে নিজেও মর্যাদাবান হবো।
আসুন সবাই আমরা নিজেদের মূল্যবোধ পরিবর্তন করে সমাজ উন্নয়ন অংশগ্রহণ করি। বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা গঠনের মাধ্যমে সত্যিকারের মর্যাদাশীল জাতি হিসাবে নিজেদের অবস্থান পোক্ত করি। ২৪ এর ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা তৈরি করার অত্যন্ত উর্বর সময় এখনই। তাই বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা গঠিত হোক, যেখানে থাকবে না কোন শ্রেণী-বৈষম্য, সর্বস্তরে থাকবে সাম্যতা এবং সকল নাগরিক নিজের মর্যাদা নিয়ে বুক চিতিয়ে বাস করবে নিজের মাতৃভূমিতে।
লেখক:
প্রকৌশলী এম এম এ শাহজাহান
মার্কেটিং অ্যাডভাইজার, ফাইন গ্রুপ।