Advertisement

আবদুল মাজেদ


প্রকাশিত: ২০:৪৫, ২৪ জানুয়ারি ২০২৫

আপডেট: ২০:৪৬, ২৪ জানুয়ারি ২০২৫

সংবাদ সম্মেলনের নামে মোসাহেব সম্মেলন

সংবাদ সম্মেলনের নামে মোসাহেব সম্মেলন
ছবি: সবার দেশ

পদ্মা, মেঘনা, যমুনায় শুকনো মওসুমে ‘মরা নদীর সোঁতা’র মত কোনো সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম জলধারার  অস্তিত্ব না থাকলেও বিগত সরকারের আমলে এ নদী দিয়ে যেমন অনেক পানি গড়িয়েছে। ভাঙনে নিশ্চিহ্ন হয়েছে নতুন নতুন গ্রাম, জনবসতি; তেমনি এপার ভেঙে ওপার গড়েছে।

বাংলাদেশের এ প্রধান তিনটি নদী চাঁদপুরের নদী-সংগম থেকে মেঘনা নামেই বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। কিন্তু বিগত ১৫ বছরের আওয়ামীলীগের ফ্যাসিস্ট শাসনের কবলে গুম, খুন, অপহরণ, ক্রস-ফায়ার ও বিচার বহির্ভুত হত্যার শিকার যারা হয়েছে তাদের ও তাদের আপনজনের কান্নায় এ তিনটি প্রধান নদী অশ্রূর নদী হয়ে বয়ে গেছে বললেও অত্যুক্তি হয় না। কিংবা বলা যায় বাংলাদেশের নদীগুলো একপ্রকার রক্তগঙ্গায় পরিণত হয়েছে।

পরিবর্তনশীল এ জগতে কোনো কিছুই ধ্রুব নয়। প্রতিনিয়ত সবকিছুই পরিবর্তিত হচ্ছে। কিন্তু এ পনের বছরে যে বিষয়টি অপরিবর্তিত রয়ে গিয়েছিল তা হলো এ শ্রেণির বশংবদ সাংবাদিকের মোসাহিবি স্বভাব। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিদেশ সফর শেষে গণভবনে অনুষ্ঠিত চাটুকার সম্মেলনে এ সাংবাদিক পরিচয়ধারী মোসাহেবদের মোসাহেবির চরম পরাকাষ্ঠার প্রদর্শনী হয়।  

দেশে অনেক কিছুর পরিবর্তন ঘটেছে। নির্বাচনী সংস্কৃতির পরিবর্তন ঘটেছে। বিরোধীদল নির্বাচনের ফলাফল ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে একটু আধটুক গাঁই-গুই করলেও নির্বাচনের মাঠে সরকারী দলের ওয়াক ওভার, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় নির্বাচিত হওয়া, রাতে ব্যালট বাক্স ভরা এমনকি নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক মর্মে দেখানোর জন্য সরকারী দলের লোককেই ডামি প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেয়া-এসব যেন জনগণের এক প্রকার গা সওয়া হয়ে গিয়েছিলো। কারণ, জনগণ জানত যে এসবের প্রতিবাদ করে কোনো লাভ হবে না। প্রতিবাদ করতে গেলে পুলিশি নির্যাতন নেমে আসবে, গুম-খুন, নিখোঁজ হওয়ার মত ঘটনা ঘটতে পারে। এমনকি প্রতিবাদকারীদেরকে চিহ্নিত করে রেখে ভবিষ্যতে প্রতিযোগিতামূলক চাকুরি থেকে পুলিশ ভেরিফিকেশনের মাধ্যমে বাদ দেয়ার মত ঘটনাও ঘটতে পারে। 

জঙ্গী নাটক। নিরপরাধ মানুষকে গুম করে রেখে জঙ্গী নাটক সাজিয়ে তাদেরকে মেরে ফেলার মতো ঘটনা ঘটেছে। আইন-শৃংখলা বাহিনীর সদস্যদের হয়রানি ও অত্যাচারের ভয়ে বাবা-মা তার সন্তানের লাশ নিতে অস্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। বাক-স্বাধীনতা দূরে থাক মানুষ স্বাধীনভাবে চিন্তা করতেও ভুলে গিয়েছিলো। সাধারণ জনগণ তো দূরের কথা দেশের বুদ্ধিজীবীরাও এর প্রতিবাদ করতো না। প্রতিবাদের ভাষা বলে যে একটা কিছু ছিলো সেকথা দেশের আবালবৃদ্ধবণিতা সবাই ভুলে গিয়েছিলো। কেবল চাটুকার সাংবাদিকদের মুখে কথার তুবড়ি ছুটতো। 

যে সাংবাদিকরা জাতির বিবেক, তারাও প্রতিবাদ করতো না। প্রতিবাদ না করার কারণ ছিলো। তারাও মানুষ। তাদের সংসার আছে, আত্মীয় পরিজন আছে, অত্যাচার তাদের উপরেও নেমে আসে। তাই বলে সরকারের গৃহীত যে কোনো নির্যাতনমূলক কার্যকলাপকে মুক্তকণ্ঠে সমর্থন জানাবে এবং সরকারে বিপক্ষে অবস্থানকারীদেরকে সুসংগঠিতভাবে সমালোচনা করে জীবন অতীষ্ঠ করে তুলবে, এটা মেনে নেয়া কষ্টকর। সরকারের দীর্ঘস্থায়ী অগণতান্ত্রিক ও ফ্যাসিবাদী আচরণের কারণে দেশের অনেক প্রতিষ্ঠিত সংস্কৃতিই পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিলো। তবে সব থেকে বেশি পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিরো প্রধানমন্ত্রীর তথাকথিত সংবাদ সম্মেলনের ধরণ। সংবাদ সম্মেলনে সাধারণত সরকারের দুর্বলতা নিয়ে প্রশ্ন করা হয়, দেশের বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ নিয়ে প্রশ্ন করা হয়। এতে সরকার কোনো কোনও প্রশ্নে বিব্রত হলেও সরকারের অবস্থা ও অবস্থান সম্পর্কে জনগণ জানতে পারে। কিন্তু বিগত পনের বছরে এটা মূলত: একটা মোসাহেব সম্মেলনে পরিণত হয়েছিলো। 

বলা যায় প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন একটি সম্মিলিত প্রশস্তির অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছিলো। কেউ কোনও প্রশ্ন করতো না। সবাই প্রশংসার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়তো। উপস্থিত সব সাংবাদিক সরকারের নিকট থেকে অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা নিয়ে সরকারের কাছে একরকম জিম্মি হয়ে পড়েছিলো। তাই বাধ্য হয়েই তারা কেবল সরকারের গৃহীত ব্যবস্থাগুলোকে প্রশংসা করতো। সরকারী দলের কর্মী এবং আইনশৃংখলা বাহিনী কর্তৃক গুম, খুন, অপহরণ, ক্রসফায়ার, জঙ্গীনাটক ইত্যাদি সব ঘটনাকে সমর্থন করে বক্তব্য দিতো। এতে প্রধানমন্ত্রীর আত্মবিশ্বাস বেড়ে যেতো। সাংবাদিক নামধারী চাটুকারদের বাড়াবাড়ি রকমের আস্কারা পেয়ে তিনি তার আচার-আচরণে আরো বেপরোয়া হয়ে উঠতেন। কথায় বলে একে তো নাচুনী ছুঁড়ি, তার উপরে ঢোলের বাড়ি। একে তো মা মনসা, তায় ধূনোর গন্ধ।  

আমরা হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর তৈল প্রবন্ধ পড়েছি, নজরুল ইসলামের মোসাহেব কবিতা, আবু সাইয়ীদ আইয়ুবের তোষামোদ ও রাজনীতির ভাষা পড়েছি। এ সব লেখায় আমরা তোষামোদের যে ধারণা পেয়েছি তার সব কিছুকে ছাপিয়ে গেছে প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের চাটুকারিতা ও মোসাহিবী।  
আমরা শিশু শ্রেণিতে বেণি ও তার মাসির গল্প পড়েছি। বেণির চুরি করার স্বভাব ছিলো। সে কিছু চুরি করে বাড়িতে নিয়ে এলে তার মাসি তাকে শাসন না করে বরং খুশি হতো। এতে বেণির চুরির উৎসাহ আরো বেড়ে যায়। একবার বেণি চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে এবং বিচারে সে দোষী সাব্যস্ত হয় এবং তার সাজা হয়। তখন বেণি তার মাসিকে কাছে ডেকে কানে কানে কিছু বলতে চায়। মাসি বেণির মুখের কাছে কান নিয়ে যেতেই বেণি তার মাসির কান কামড়ে ছিঁড়ে নেয়। 

বেণির মাসি এ ঘটনায় সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত হয়ে যায়। তখন বেণি তার মাসিকে বলে যে, সে যখন চুরিকরা জিনিসপত্র বাড়িতে আনতো তখন তার মাসি তাকে শাসন করলে বেণি চৌর্যবৃত্তি থেকে নিবৃত হতো এবং আজ তার সাজা হতো না। মাসি তা না করে বরং তাকে উৎসাহিত করেছে। তাই বেণির আজকের পরিণতির জন্য তার মাসিই দায়ী। এ জন্য সে তার মাসির কান ছিঁড়ে নিয়ে তাকে তার প্রাপ্য শাস্তি দিয়েছে। 

সাংবাদিকরা যদি কেবল প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা না করে প্রয়োজনে বিরূপ সমালোচনাও করতো তাহলে প্রধানমন্ত্রী তার আচার আরচণে, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বেপরোয়া হতে পারতেন না। পক্ষান্তরে প্রধানমন্ত্রীও যদি সাংবাদিকদের স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতেন তাহলে সাংবাদিকরাও অন্ধ স্তাবক হতেন না। এ ক্ষেত্রে ডিম আগে না মুরগি আগে সে প্রশ্ন আসতে পারে। তবে পরিণতি যে কারোরই ভালো হয়নি, সেটা তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি। আশাকরি, আমরা অতীত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিতে পারবো। কিন্তু পরিতাপের কথা হলো আমরা কেউ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিই না। কাজে কাজেই ইতিহাসের পুণরাবৃত্তি আমাদেরকে দেখতেই হবে। 

২৩/০১/২০২৫
লেখক: সরকারী কর্মকর্তা ও কথাসাহিত্যক

সম্পর্কিত বিষয়: