সোনার পাথর-বাটি: নির্জলা গুজব, এর সত্যতা
ঢাকাই বাংলা সিনেমায় শাবানার সেলাই মেশিন আর জসিমের ঠেলাগাড়ির মত পরিচিত আরেকটি দৃশ্য প্রায়ই দেখা যায়। তা হলো, ভিলেন কোনো একজনকে ছুরিকাঘাত করে চম্পট দিলো, নায়ক এসে নায়কোচিত উদারতার কারণে দয়াপরবশ হয়ে তাকে বাঁচাতে গিয়ে ছুরিটা খতস্থান থেকে যেই না বের করলো, অমনি বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত পুলিশ এসে নায়ককে হাতকড়া পরালো। ভিলেনের কৃতকর্মের দোষ গিয়ে পড়লো নায়কের ঘাড়ে।
এভাবে একজনের দোষে আরেক জনকে শাস্তি ভোগ করতে হলে যে বিনাদোষে শাস্তি ভোগ করে ইংরেজিতে তাকে বলে Scape goat বা বলির পাঁঠা। বাংলায় এ ফ্রেজকে কয়েকভাবেই বর্ণনা করা হয়: ‘উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে’, গরু মারল আদেল, গো-ডাক ডাকল বাদেল’, ‘গাঁজা খেলো কেদারে, ঘুরে মরল মাদারে’, ‘খেলেন দই রমাকান্ত, বিকারের বেলায় গোবর্ধন’। আরো একটি ইংরেজি ইডিয়ম দিয়ে এটা প্রকাশ করা যায়: One doth the scathe, another hath the scorn.
৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে ছাত্রজনতার গণ-অভ্যূত্থান ও বিপ্লবের ফলে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার ক্ষমতার গণেশ উল্টে গেলে তিনি তার দলীয় নেতা-কর্মীদেরকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়ে তার মেন্টরের ডেরাতে পালিয়ে যান। কিন্তু শেখ হাসিনার এ পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি ভারতীয় বেশ কিছু মিডিয়া হজম করতে পারছে না। তারা তাদের এ পালানোর দায়টা বারবার বিপ্লবোত্তর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. ইউনুসের উপর চাপিয়ে নিজেদের অপমানিত হওয়ার বিষয়টি প্রশমিত করতে চায়।
নির্বাচনে কারচুপি, ভোটারবিহীন নির্বাচন, গুম, খুন, ক্রসফায়ার যা কিছুই শেখ হাসিনা করুক না কেনো, ভারতীয় মিডিয়া শেখ হাসিনার বিকল্প ভাবতে পারে না। শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যূতি ও পলায়ন যেন এ সকল ভূঁইফোড় হলুদ মিডিয়ার পরাজয়। তারা কোনো রকমেই এ পরাজয়কে মানতে পারছে না।
ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রফেসর ড. ইউনুস যতবার রাষ্ট্রীয় সফরে বিদেশ গিয়েছেন ততবারই এই মিডিয়াগুলো জোরেসোরে প্রচারণা শুরু করে দিয়েছে, ড. ইউনুস পালিয়ে গেছেন, আর ফিরবেন না। এ লেখা যখন লিখছি, তখনও মাননীয় প্রধান উদেষ্টা রাষ্ট্রীয় সফরে সুইজারল্যান্ডে অবস্থান করছেন। এ অবস্থায়ও হলুদ মিডিয়াগুলো সেনসেশনাল নিউজ স্টোরি প্রচার করে যাচ্ছে যে, তিনি পালিয়ে গেছেন।
শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার কারণে তাদের হৃদয়ে যে রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে, সে রক্তক্ষরণ তারা বন্ধ করতে চায় ড. ইউনুস-এর পলায়নের মিথ্যা খবর প্রচারের মাধ্যমে। ড. ইউনুস-এর পলায়নের খবরটি তারা তাদের রক্তক্ষরণ বন্ধ করার ব্যান্ডেজ হিসেবে ব্যবহার করতে চায়। কিন্তু প্রত্যেক ক্ষেত্রেই তাদের জন্য এটা কাটা-ঘায়ে নুনের ছিটায় পরিণত হচ্ছে।
এর সাথে যুক্ত হয়েছে স্থানীয় কিছু এলিমেন্টের অপপ্রচার ও গুজব। তারা ড. ইউনুসের ফেইক পদত্যাগপত্র ফেসবুকে প্রকাশ করছে। আজই ফেসবুকে দেখলাম একজন এ রকম একটি পদত্যাগপত্র শেয়ার করে আশাব্যঞ্জক পোস্ট দিয়ে উল্লাস প্রকাশ করেছে। আমি তার নিচে মন্তব্য করলাম, ‘ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্নে আকাশ ফুটো করতে থাকো, ঘুম ভাঙলেই টের পাবা আসল ঘটনা কী।’ আমি এ কথা দিয়ে কী বুঝাতে চেয়েছি তা আশা করি সবাই বুঝতে পেরেছেন।
পতিত স্বৈরাচার ও তাদের সহযোগীরা বৈশাখের খরতাপে মেঘশূন্য আকাশের দিক চেয়ে চাতক পাখির মত বৃষ্টি চাচ্ছে। কিন্তু তাদের আকাশে মেঘ জমতে সময় লাগবে। তার জন্য অনেক দুর্যোগের ঘনঘটা অতিক্রম করে যেতে হবে। শেষ পর্যন্ত তার ধকল সহ্য হলেই হয়। শকুন সর্বদা চায়, গরুটা যেন মরে। কিন্তু শকুনের অভিশাপে মরে কয়টা গরু?
আরও পড়ুন<<>> সংবাদ সম্মেলনের নামে মোসাহেব সম্মেলন
শেখ হাসিনার পলায়ণের ঘটনা যতদিন তার দেশী-বিদেশী সমর্থকদের হৃদয়ের রক্তক্ষরণের কারণ হবে, ততদিন তারা তাদের অপমানের ঘটনা ড. ইউনুসের পলায়ণের কিংবা পদত্যাগের ফ্যাব্রিকেটেড কাহিনী তৈরী করে তা প্রচারের মাধ্য আত্মতুষ্টি লাভ করে নিজেদের অপমানের ঘায়ে কিছুটা হলেও মলম দেয়ার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে। কিন্তু কাটা-ঘায়ে মলম দেয়ার চেষ্টায় যে গুজবগুলো ছড়ানো হচ্ছে, সে সকল গুজব তৈরিতে মুন্সিয়ানা আছে বলতে হবে।
গুজবগুলোকে আপাতঃদৃষ্টিতে বেশ অথেনটিক বলে মনে হচ্ছে। ধৈর্য ধরে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর অবশ্য এসব গুজবের অন্তঃসারশূন্যতা আপনাআপনিই বেরিয়ে আসছে। যে গুজবকে আপাত-সত্য মনে হচ্ছে সে গুজব যদি একটু পরেই নির্জলা গুজব হিসেবে প্রমাণিত হয় তবে কাটাঘায়ে মলমের পরিবর্তে নূনের ছিটাই পড়ে। আর এ নির্জলা গুজব সৃষ্টিতে একাট্টা হয়ে আদাজল খেয়ে নেমে পড়েছে দেশি ও বিদেশি হলুদ-সংবাদ মাধ্যম। ময়ূখ রঞ্জন হলো এদের পালের গোদা বা কেবলা।
নিকট অতীতে একটি ফ্যাসিবাদী সরকার এক সময় তার ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী ও নিষ্কণ্টক করার জন্য গুজবের পর গুজব সৃষ্টি করেছে, ইস্যু চাপা দিয়ে নতুন ইস্যু তৈরি করেছে, একের পর এক জঙ্গী নাটক তৈরি করে নিরপরাধ তাজা প্রাণগুলোকে অকালে ঝরে যেতে বাধ্য করেছে। এত কিছু করেও শেষ রক্ষা হয়নি। তাসের ঘরের মত হুড়মুড় করে ভেঙে পড়েছে ফ্যাসিবাদের মসনদ। হারানো ক্ষমতা ফিরে পেতে তারাই আবার মনোযোগ দিয়েছে গুজব তৈরিতে। কিন্তু জনগণ এতদিনে বুঝে ফেলেছে নির্জলা-গুজব ও গুজবের সত্যতার ভিতরকার পার্থক্য কোথায়।
২৫/০১/২০২৫
লেখক: সরকারী কর্মকর্তা ও কথাসাহিত্যক