ফেনীর ‘চিকেন নেক’-এ ভারতের ৯০০ একর: বিনিয়োগ নাকি সার্বভৌমত্বের আত্মসমর্পণ?

বাংলাদেশের ভৌগোলিক গঠন অনেকটাই জটিল এবং সংবেদনশীল। বিশেষ করে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল, যেখানে ফেনী জেলার সোনাগাজী উপজেলা এবং চট্টগ্রামের মীরসরাই উপজেলা মিলিয়ে গড়ে উঠেছে এক সংকীর্ণ ভূখণ্ড, যা দেশের মূল ভূখণ্ডকে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের সঙ্গে যুক্ত রেখেছে। ভূ-রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই অঞ্চলটিই বাংলাদেশের ‘চিকেন নেক’ হিসেবে পরিচিত—a narrow strip of land that connects and holds together vital parts of the nation.
এমন একটি কৌশলগত এলাকায় ভারতের জন্য ৯০০ একর জমি বরাদ্দ দিয়ে একটি বিশাল অর্থনৈতিক অঞ্চল (ইকোনমিক জোন) গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত শুধু বিতর্কিতই নয় বরং অনেক বিশ্লেষকের মতে, এটি সরাসরি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, প্রতিরক্ষা এবং ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের ওপর একটি ভয়াবহ আঘাত। এ জমি বরাদ্দ দেয়া হয়েছিলো ফ্যাসিস্ট হাসিনার শাসনামলে, এবং ভারতীয় রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান Adani Ports & SEZ Ltd-কে সে জমি ব্যবহারের অধিকারও দেয়া হয়। এর বিনিময়ে বাংলাদেশ কী পাচ্ছে? বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান? না কি দীর্ঘমেয়াদে একটি দুর্বল ভূখণ্ডে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ?
চিকেন নেক: একটি ভূরাজনৈতিক স্পর্শকাতর এলাকা
বিশ্ব রাজনীতিতে ‘চিকেন নেক’ শব্দটি অতি পরিচিত। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে মূল ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত করে রেখেছে সিলিগুড়ি করিডোর—যা ভারতের নিজস্ব চিকেন নেক। সেখানে ভারত এমন কোনও বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে তো দূরের কথা, এমনকি আন্তর্জাতিক রাস্তা নির্মাণ বা পাইপলাইন স্থাপনেও চরম সতর্কতা অবলম্বন করে। কারণ তারা জানে, একটি সংকীর্ণ ভূখণ্ড যদি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তবে পুরো অঞ্চল বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে।
তাহলে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এর ব্যতিক্রম হবে কেনো? ফেনীর চিকেন নেক যদি কখনও রাজনৈতিক বা কৌশলগতভাবে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে, তাহলে চট্টগ্রাম, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি—এ পুরো অঞ্চল বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। এমন পরিস্থিতিতে প্রতিরক্ষা বাহিনীর অবাধ চলাচল, যোগাযোগ ও সরবরাহ নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। ফলে, এ অঞ্চল শুধু অর্থনৈতিকভাবে নয়, প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা দিক থেকেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কেনো এ জমি ভারতকে দেয়া হলো? বিনিয়োগ নাকি বন্ধুত্বের নামে চাপ?
বাংলাদেশের জনগণের একাংশ মনে করে, এ জমি বরাদ্দ আদৌ কোনো অর্থনৈতিক চুক্তি নয়, বরং তা ছিলো একটি রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের বিনিময়ে আত্মসমর্পণমূলক সিদ্ধান্ত। কারণ বিনিয়োগের নামে ভারতের যেসব প্রতিশ্রুতি ছিলো, তার অর্ধেকও বাস্তবায়ন হয়নি। কর্মসংস্থান, অবকাঠামো উন্নয়ন, প্রযুক্তি হস্তান্তর- সবই কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ। অথচ তাদের দখলকৃত ৯০০ একর ভূমি আজও বহাল রয়েছে, এবং সেখানে বাংলাদেশের কোনো কর্তৃত্বমূলক কার্যক্রম নেই।
সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার ১০টি প্রস্তাবিত অর্থনৈতিক অঞ্চলের অনুমোদন বাতিল করেছে অর্থনৈতিক বাস্তবতা, পরিবেশগত ঝুঁকি এবং অনুপযোগী বিনিয়োগের অজুহাতে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ভারতের এ ৯০০ একরের প্রকল্প কেনো বাতিল করা হলো না? কেনো তাদের জন্য একক সুবিধা বজায় রাখা হলো, যেখানে জাতীয় স্বার্থের প্রশ্ন জড়িত?
তিস্তা নিয়ে ভারতীয় অবস্থান এবং বৈষম্যমূলক কূটনীতি
ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অনেক জটিল। সীমান্ত হত্যা, পানিবণ্টন, বাজারে একতরফা প্রবেশাধিকার, রেল ও নৌপথ ব্যবহার ইত্যাদি বিষয়ে বারবার বাংলাদেশকে একতরফা ছাড় দিতে দেখা গেছে। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো তিস্তা চুক্তি—যা আজ এক যুগ পার হলেও ভারতের সংসদে অনুমোদন পায়নি। বরং উল্টোভাবে ভারত তিস্তার উজানে নিজেদের বৃহৎ জলাধার নির্মাণে ব্যস্ত, যাতে বাংলাদেশের কৃষি, জলজ সম্পদ এবং পরিবেশ হুমকির মুখে পড়ে।
যেখানে ভারত আমাদের তিস্তা নদীর স্বাভাবিক প্রবাহেও বাধা দিচ্ছে, সেখানে আমরা কেন তাদের দেশের ভেতরে ঢুকে পড়ার মতো সুযোগ করে দেবো? তাও আবার দেশের সবচাইতে সংবেদনশীল জায়গায়?
সমাধান: অর্থনৈতিক অঞ্চল নয়, সেখানে চাই ক্যান্টনমেন্ট বা প্রতিরক্ষা স্থাপনা
বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব দেশকে রক্ষা করা। বিনিয়োগ, উন্নয়ন এসব গুরুত্বপূর্ণ—কিন্তু তা যেনো কখনও সার্বভৌমত্ব বা নিরাপত্তার বিনিময়ে না হয়। এ অবস্থায় আমাদের জোর দাবি, ফেনীর চিকেন নেক এলাকায় ভারতের জন্য বরাদ্দকৃত ৯০০ একর জমি অবিলম্বে বাতিল করতে হবে। সেখানে প্রয়োজন একটি স্থায়ী সেনানিবাস, আধুনিক ক্যান্টনমেন্ট বা বিশেষ প্রতিরক্ষা এলাকা স্থাপন করা। এতে দেশের ভূখণ্ডের একীভবন যেমন নিশ্চিত হবে, তেমনি ভবিষ্যতের যেকোনো অভ্যন্তরীণ বা বহিরাগত হুমকি মোকাবেলাও সহজ হবে।
উন্নয়নের নামে আত্মবিক্রয় নয়
ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় সার্বভৌমত্ব রক্ষা করাই একটি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ দায়িত্ব। উন্নয়নের নামে, বন্ধুত্বের নামে, কিংবা ভূরাজনৈতিক সুবিধার নামে যদি কোনো রাষ্ট্র তার কৌশলগত অঞ্চল অন্য দেশের নিয়ন্ত্রণে ছেড়ে দেয়—তা হলে সেই রাষ্ট্রের অস্তিত্বই হুমকির মুখে পড়ে।
বাংলাদেশের জনগণ আর নীরব থাকবে না। তারা জানে—দেশপ্রেম কেবল আবেগ নয়, এটি দায়িত্ব। আজ সময় এসেছে, সে দায়িত্ব পালনের। আওয়াজ তুলুন, প্রতিবাদ জানান, এবং দাবি করুন-
- ফেনীর চিকেন নেক বাঁচাও
- ভারতকে দেয়া জমি ফিরিয়ে নাও
- সেখানে ক্যান্টনমেন্ট গড়ো
- সার্বভৌমত্ব রক্ষা করো
লেখক:
আইনজীবী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।