Header Advertisement

Sobar Desh | সবার দেশ মোঃ হাবিবুর রহমান


প্রকাশিত: ০০:০৬, ১৭ এপ্রিল ২০২৫

আপডেট: ০৮:১৭, ১৭ এপ্রিল ২০২৫

রাষ্ট্র ও জনগণ: ক্ষমতার বিভ্রমে পতনের রাজনীতি

রাষ্ট্র ও জনগণ: ক্ষমতার বিভ্রমে পতনের রাজনীতি
ছবি: সবার দেশ

রাষ্ট্র ও ক্ষমতা পরস্পর সম্পর্কযুক্ত হলেও সমার্থক নয়। রাষ্ট্রের মৌল কাঠামো দাঁড়িয়ে থাকে জনগণের সম্মতি, অংশগ্রহণ ও প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা যখন ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে এবং জনসম্মতির বিকল্প হিসেবে ভয়, নিপীড়ন ও আমলাতন্ত্র ব্যবহার করা হয়, তখনই গণতন্ত্র সংকটে পড়ে। বাংলাদেশে ফ্যাসিস্ট হাসিনার শাসনামলের সাম্প্রতিক চিত্র বিশ্লেষণ করলে এমন এক পরিণতিরই সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় যেখানে রাষ্ট্রের উপরতলায় গণতন্ত্রের ভাষ্য থাকলেও বাস্তবিক পরিসরে তার প্রতিচ্ছবি অনুপস্থিত।

রাষ্ট্রীয় সহিংসতা: ব্যতিক্রম নাকি নিয়মতান্ত্রিকতা?

২০২৪ সালের জুলাই-অগাস্টে বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক সহিংসতা সংঘটিত হয়েছে—বিশেষত রাজপথে শিশু-কিশোর, ছাত্রদের গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর ঘটনা তা কেবল একটি ‘law and order failure’ নয়, বরং এটি একটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত রাষ্ট্রীয় দমননীতির চিত্র। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো একাধিকবার উল্লেখ করেছে যে, বাংলাদেশ সরকার বিরোধী মতকে নির্মূল করতে নিরাপত্তা বাহিনীকে ‘instrument of fear’ হিসেবে ব্যবহার করছে।

এ বাস্তবতায় প্রশ্ন উঠে এটি কি বিচ্ছিন্ন ঘটনা, নাকি একটি কাঠামোবদ্ধ, অনুমোদিত রাজনীতি? বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, মামলা-হয়রানি এবং ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’-এর মতো আইনি অস্ত্র ব্যবহারে সরকার নিজেকে একটি নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্যে নিয়ে এসেছে, যেখানে জনগণের অধিকার রাষ্ট্রের জন্য ঝুঁকি হিসেবে বিবেচিত হয়।

গণতন্ত্রের বাহ্যিকতা বনাম অন্তর্নিহিত শূন্যতা:

বাংলাদেশের সংবিধান স্পষ্টভাবে বলে, ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ।’ কিন্তু কার্যত এখানে নির্বাচনপ্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রিত, রাজনৈতিক বিরোধী শক্তি দমনকৃত, এবং মিডিয়ার স্বাধীনতা কাগুজে পরিহাস। ফলে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক কাঠামো বাহ্যিকভাবে সক্রিয় থাকলেও তার অন্তর্নিহিত প্রাণশক্তি ক্ষয়ে গেছে।

আরও পড়ুন <<>> ফেনীর ‘চিকেন নেক’-এ ভারতের ৯০০ একর: বিনিয়োগ নাকি সার্বভৌমত্বের আত্মসমর্পণ?

Freedom House-এর ২০২৪ সালের প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে ‘partly free’ বলা হয়েছে, যেখানে রাজনৈতিক অধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতার সূচক নিম্নমুখী। কিন্তু বাস্তবতা ছিলো আরও ভয়াবহ। আবার ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের ডেমোক্রেসি ইনডেক্সে বাংলাদেশ ২০১৮ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে ‘hybrid regime’ হিসেবে চিহ্নিত। অর্থাৎ নির্বাচন থাকলেও তা আস্থার উৎস নয়।

ব্যুরোক্র্যাটিক শাসন ও দলীয়ীকৃত রাষ্ট্র:

বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় দেখা যায়, রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের কেন্দ্রে আমলাতন্ত্র এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী রয়েছে। দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে নিয়োগ ও পদোন্নতি, প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে রাজনৈতিক প্রভাব, এবং আদালতের ওপর নির্বাহী হস্তক্ষেপ একটি ব্যুরোক্র্যাটিক অথচ দলীয়ীকৃত রাষ্ট্র কাঠামো গড়ে তুলেছে। এ কাঠামোতে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা নয়, বরং রাষ্ট্রযন্ত্রের দখলই ক্ষমতায় থাকার মূল উপায় হয়ে উঠেছে।

ক্ষমতার চরিত্র ও রাজনৈতিক অধঃপতন:

খ্যাতনামা দার্শনিক লর্ড অ্যাকটন বলেছিলেন, ‘Power tends to corrupt, and absolute power corrupts absolutely.’ দীর্ঘমেয়াদি একক শাসন ও কার্যত প্রতিদ্বন্দ্বিহীন রাজনৈতিক পরিবেশে ক্ষমতা এখন আত্ম-নির্ভর নয়, বরং আত্ম-মগ্ন। শাসকের ভেতরে জন্ম নিচ্ছে এক ‘অখণ্ড দেশ’ হওয়ার বিভ্রম যেখানে সরকারই দেশ, দলই রাষ্ট্র।

এ রাজনীতির চরিত্র প্রজন্মকে রাজনীতি থেকে বিমুখ করছে, প্রতিপক্ষকে বৈধতা না দিয়ে সম্পূর্ণরূপে নির্মূলের কৌশল গ্রহণ করছে এবং রাজনীতিকে একপ্রকার প্রশাসনিক প্রকল্পে পরিণত করছে। ফলে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির ক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে পড়ছে, যা ভবিষ্যতে আরও বড় অস্থিরতার জন্ম দিতে পারে।

বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হলো রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যকার আস্থা পুনরুদ্ধার। এর জন্য প্রয়োজন অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও জবাবদিহিতা, মতপ্রকাশ ও মিডিয়ার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা এবং আমলাতন্ত্র ও নিরাপত্তা বাহিনীকে রাজনৈতিক নিরপেক্ষতায় ফেরত আনা।

রাষ্ট্র কোনো শাসকের সম্পত্তি নয়; এটি জনগণের সম্মিলিত কাঠামো। যতক্ষণ না এ মৌল সত্য প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত গণতন্ত্রের নামে অগণতান্ত্রিকতার চর্চা চলতেই থাকবে।

একটি রাষ্ট্র তখনই টিকে থাকে, যখন তার জনগণ তাকে নিজের বলে বিশ্বাস করে। সে বিশ্বাস পুনর্গঠনের সময় এসেছে, যার নেতৃত্ব নিতে হবে রাজনীতি ও রাষ্ট্রচিন্তার নতুন ধারাকে।

লেখক: 
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও
রাজনৈতিক বিশ্লেষক।