Header Advertisement

Sobar Desh | সবার দেশ মোঃ হাবিবুর রহমান


প্রকাশিত: ০১:০৪, ১৮ এপ্রিল ২০২৫

স্বাধীনতার মুখে মানসিক দাসত্ব: এক আত্মবিশ্লেষণ

স্বাধীনতার মুখে মানসিক দাসত্ব: এক আত্মবিশ্লেষণ
ছবি: সবার দেশ

স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের কাছে যতটা আবেগের, বাস্তবে তা ততটাই জটিল ও বহুস্তরবিশিষ্ট। একটি জাতি কিংবা ব্যক্তি শারীরিকভাবে স্বাধীন হতে পারে, কিন্তু প্রকৃত স্বাধীনতা তখনই আসে, যখন সে মানসিক দাসত্ব থেকে মুক্তি পায়। দুঃখজনক হলেও সত্য, অনেক সময় দেখা যায় দাসত্বের শৃঙ্খল কেটে যাওয়ার পরও মানুষ স্বাধীনভাবে বাঁচার, ভাবার এবং উচ্চারণ করার সাহস হারিয়ে ফেলে। এ অবস্থাকে বলা যায় ‘স্বাধীনতার মুখে মানসিক দাসত্ব’।

১. দাসত্বের প্রভাব: শুধু বাহ্যিক নয়, গভীরভাবে মানসিক

দীর্ঘদিনের শাসন, নির্যাতন কিংবা আধিপত্য শুধু রাজনৈতিক কাঠামোকে নয়, ব্যক্তির মনন ও মানসিক কাঠামোকেও প্রভাবিত করে। ফ্রানৎস ফ্যানন তার The Wretched of the Earth গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ঔপনিবেশিক শাসন এক ধরণের মানসিক কলোনাইজেশন ঘটায়, যেখানে শাসিত মানুষ নিজেকে অধম ভাবতে শুরু করে এবং শাসকের ভাষা, সংস্কৃতি ও মানসিক কাঠামো নিজের করে নেয়। ফলে খাঁচা খুলে দিলেও সে পাখি উড়তে জানে না।

২. স্বাধীনতার বিকৃতি: মুক্তি মানেই কি স্বাধীনতা?

‘৩৬শে জুলাই’ এখানে একটি প্রতীকি দিন। এমন এক তারিখ, যা বাস্তবে নেই। এটি এমন এক মুক্তির প্রতিচ্ছবি যা বাস্তব নয়, কেবল কাগজে-কলমে বিদ্যমান। জঁ-জাক রুশো বলেছিলেন, ‘Man is born free, but everywhere he is in chains.’ মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীন, কিন্তু সামাজিক কাঠামো ও শক্তির দাস হয়ে পড়ে। অনেক সমাজে স্বাধীনতার পরও পূর্বের ক্ষমতা কাঠামো ফিরে আসে নতুন রূপে। ফলে মানুষের আত্মা রয়ে যায় পুরোনো শৃঙ্খলে বাঁধা।

৩. উপনিবেশবাদ থেকে উত্তরাধুনিক আগ্রাসন

আগে দাসত্ব ছিলো বাহ্যিক ও বিদেশি শক্তির নিয়ন্ত্রণে থাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু আধুনিক যুগে আগ্রাসন আরও সূক্ষ্ম। মিশেল ফুকো মতপ্রকাশ, জ্ঞান এবং ক্ষমতার সম্পর্ক বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে, আধুনিক সমাজে ক্ষমতা কেবল জোর করে নয়, জ্ঞান ও ভাষার মাধ্যমে মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে। আমরা যা ‘স্বাভাবিক’ বা ‘যুক্তিসঙ্গত’ বলে মনে করি, তার পেছনেও লুকিয়ে থাকে ক্ষমতার প্রভাব। এইভাবে মানুষ নিজের অজান্তেই এক ধরণের মানসিক অনুগত্যে জড়িয়ে পড়ে।

আরও পড়ুন <<>> রাষ্ট্র ও জনগণ: ক্ষমতার বিভ্রমে পতনের রাজনীতি

৪. মুক্তির অর্থ: শুধু বাহ্যিক নয়, আত্মিক ও মনস্তাত্ত্বিক

স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ শুধুমাত্র শাসকের পরিবর্তন নয়, বরং চিন্তা, ভাষা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতায় মুক্তি অর্জন। ইমানুয়েল কান্ট বলেন, ‘Sapere aude’ সাহস করো জ্ঞানী হতে। তিনি ব্যক্তির আত্মনির্ভরতার ওপর গুরুত্ব দেন এবং বলেন, প্রকৃত প্রজ্ঞা তখনই আসে, যখন মানুষ নিজে চিন্তা করতে শেখে। সুতরাং, প্রকৃত মুক্তি মানে এমন একটি মানসিক অবস্থা, যেখানে ব্যক্তি নিজস্ব চিন্তা ও মূল্যবোধ নিয়ে দাঁড়াতে পারে।

আমাদের সময় এসেছে আত্মবিশ্লেষণের। কেবল ইতিহাসে স্বাধীনতা অর্জনের কথা লিখে বা উদযাপন করে আমাদের চলবে না। আমাদের দেখতে হবে আমরা সত্যিই কতটা স্বাধীন? আমরা কি নিজের মতামত প্রকাশ করতে পারি? নিজের ভবিষ্যৎ নিজের মতো করে গড়তে পারি? নাকি এখনও আমরা অন্যের চিন্তা, অনুমোদন বা স্বার্থের দাস হয়ে বেঁচে আছি?

স্বাধীনতার পূর্ণতা আসে তখনই, যখন আমরা মানসিক দাসত্বকে চিহ্নিত করতে পারি এবং তা থেকে মুক্তি পেতে সচেষ্ট হই। সে মুক্তিই আমাদের প্রকৃত উড়ান। যেখানে পাখি শুধু খাঁচা থেকে বের হয় না, আকাশও ছুঁয়ে ফেলে। প্রকৃত স্বাধীনতা কেবল বাহ্যিক বা রাজনৈতিক নয় বরং মানসিক মুক্তির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। ঔপনিবেশিক শাসন কিংবা আধুনিক ক্ষমতার কাঠামো মানুষের চিন্তা ও আত্মপরিচয়কে প্রভাবিত করে, ফলে শৃঙ্খল ভাঙলেও মানসিক দাসত্ব থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন হয়। স্বাধীনতার পূর্ণতা আসে মানসিক মুক্তির মাধ্যমে, যখন ব্যক্তি নিজস্ব চিন্তা ও মূল্যবোধ নিয়ে দাঁড়াতে শেখে।

লেখক: 
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও
রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

সম্পর্কিত বিষয়: