মুসলিমদের ধর্মীয় স্থাপনাগুলো নতুন সংকটে
ভারতে ওয়াকফ বিতর্ক: মসজিদ-মাদ্রাসা কি নিরাপদ?
প্রধান বিচারপতি বলেন, দিল্লি হাইকোর্টও ওয়াকফ জমির ওপর তৈরি। ১৩, ১৪ বা ১৫ শতাব্দীতে তৈরি মসজিদের কাগজপত্র পাওয়া অসম্ভব। তিনি আরও বলেন, ওয়াকফ বাই ইউজার সবসময় ভুল নয়। যেমন, আদালত যে জমি ব্যবহার করছে, তারও কোনো কাগজপত্র নেই, তবু এটি ওয়াকফ সম্পত্তির অংশ।

সাংবিধানিকভাবে ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র, যেখানে নানা ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সহাবস্থান দীর্ঘদিন ধরে বজায় থাকার কথা। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অধিকার ও সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা নিয়ে উদ্বেগ ও বিতর্ক ক্রমবর্ধমান। এ প্রেক্ষাপটে ওয়াকফ আইনের সাম্প্রতিক সংশোধন ও মুসলিম ধর্মীয় স্থাপনাগুলোর উপর হস্তক্ষেপ একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠেছে।
ওয়াকফ আইন ও এর সাম্প্রতিক সংশোধন
ওয়াকফ একটি ইসলামি ধারণা, যেখানে কোনও ব্যক্তি তার সম্পত্তি জনকল্যাণমূলক ও ধর্মীয় উদ্দেশ্যে চিরস্থায়ীভাবে উৎসর্গ করেন। ভারতে ওয়াকফ ব্যবস্থাপনার জন্য ১৯৯৫ সালের Waqf Act অনুসারে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য পর্যায়ে ওয়াকফ বোর্ড গঠিত হয়।
২০২৫ সালে পাস হওয়া Waqf (Amendment) Act, 2025-এ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা হয়েছে, যেমন:
সরকারি নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি: কেন্দ্রীয় সরকার ওয়াকফ সম্পত্তির নিবন্ধন, নিরীক্ষা ও হিসাব সংক্রান্ত নীতি প্রণয়নের ক্ষমতা পেয়েছে।
নারী ও অমুসলিম প্রতিনিধিত্ব: কেন্দ্রীয় ও রাজ্য ওয়াকফ বোর্ডে কমপক্ষে দুজন মুসলিম নারীর অন্তর্ভুক্তি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, পাশাপাশি অমুসলিম প্রতিনিধিত্বের প্রস্তাব রাখা হয়েছে।
সম্পত্তি যাচাই ও বিরোধ নিষ্পত্তি: ওয়াকফ বোর্ডের সম্পত্তি দাবির জন্য বাধ্যতামূলক যাচাই ও বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য উচ্চ আদালতে আপিলের সুযোগ যুক্ত করা হয়েছে।
এ সংশোধনগুলো মুসলিম সমাজে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। অনেকেই মনে করেন, এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে সরকার ওয়াকফ সম্পত্তির উপর নিয়ন্ত্রণ বাড়াতে চাইছে, যা ভবিষ্যতে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহৃত হতে পারে।
মজার ব্যাপার হলো- সম্প্রতি ভারদের প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্না বলেন, দিল্লি হাইকোর্টও ওয়াকফ জমির ওপর তৈরি বলে শুনেছি। ১৩, ১৪ বা ১৫ শতাব্দীতে তৈরি মসজিদের কাগজপত্র পাওয়া অসম্ভব। তিনি আরও বলেন, ওয়াকফ বাই ইউজার সবসময় ভুল নয়। যেমন, আদালত যে জমি ব্যবহার করছে, তারও কোনো কাগজপত্র নেই, তবু এটি ওয়াকফ সম্পত্তির অংশ।
আরও পড়ুন <<>> স্বাধীনতার মুখে মানসিক দাসত্ব: এক আত্মবিশ্লেষণ
আদালত এ আইনের বাস্তবায়নের ওপর স্থগিতাদেশ দিতে অস্বীকার করলেও সরকারের কাছে এর যৌক্তিকতা নিয়ে বিস্তারিত জবাব চেয়েছে।
হিন্দু ট্রাস্ট বনাম মুসলিম ওয়াকফ বোর্ড: কাঠামো ও আইনি অসামঞ্জস্য
১. আইনি কাঠামো
ওয়াকফ বোর্ড
ওয়াকফ বোর্ড কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার দ্বারা পরিচালিত এবং তদারকিকৃত একটি সংস্থা। এটি স্বায়ত্তশাসনের পরিবর্তে প্রশাসনিক হস্তক্ষেপে পরিচালিত হয়। বোর্ডের জমি বিক্রি বা হস্তান্তরের ওপর কঠোর আইনগত বিধিনিষেধ রয়েছে।
হিন্দু ট্রাস্ট ও দেবস্তানম বোর্ড
হিন্দু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় কোনও কেন্দ্রীয় আইন নেই। প্রতিটি রাজ্য নিজস্ব আইন অনুযায়ী দেবস্তানম ট্রাস্ট বা বোর্ড পরিচালনা করে। অনেক হিন্দু মন্দির (যেমন: তিরুপতি) সম্পূর্ণ স্বায়ত্তশাসিত ট্রাস্ট দ্বারা পরিচালিত হয়, যেখানে সরকারি হস্তক্ষেপ নেই বললেই চলে।
২. অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা
ওয়াকফ সম্পত্তির আয় মূলত মসজিদ, মাদ্রাসা ও দুঃস্থ মুসলিমদের কল্যাণে ব্যবহৃত হওয়ার কথা থাকলেও অনেক সময় দুর্নীতি ও প্রশাসনিক জটিলতার কারণে তা বাস্তবায়ন হয় না। অন্যদিকে, বহু হিন্দু মন্দির যেমন তিরুপতি প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি রুপি আয় করে, যার একটি অংশ সামাজিক খাতে ব্যবহৃত হলেও সরকারের নিয়ন্ত্রণে যাওয়ার ঘটনা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে।
৩. সমালোচনার দৃষ্টিভঙ্গি
- মুসলিম সম্প্রদায়ের অভিযোগ: ওয়াকফ বোর্ডে অতিরিক্ত সরকারি নিয়ন্ত্রণ ধর্মীয় স্বাধীনতার পরিপন্থী। হিন্দু ট্রাস্টগুলোর মত স্বাধীনতা ওয়াকফ বোর্ডে নেই।
- হিন্দু সম্প্রদায়ের উদ্বেগ: কিছু হিন্দু সংগঠন মন্দির আয়ের উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণকে অযৌক্তিক মনে করে। তারা দাবি করে, মন্দিরগুলোও ওয়াকফ বোর্ডের মতো স্বতন্ত্র ও স্বাধীন সংস্থা হিসেবে পরিচালিত হোক।
৪. সংবিধানিক দৃষ্টিকোণ
ভারতের সংবিধানের ২৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, প্রতিটি ধর্মীয় সম্প্রদায় তাদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান পরিচালনার অধিকার রাখে। বাস্তবে, ওয়াকফ বোর্ডের ওপর সরকারের অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ এবং হিন্দু ট্রাস্টগুলোর তুলনামূলক স্বাধীনতা সংবিধানিক ভারসাম্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। এটি ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা ও সামাজিক ন্যায়বিচারকে দুর্বল করে।
ধর্মীয় স্থাপনায় হস্তক্ষেপ ও ধ্বংস
১৯৯২ সালের বাবরি মসজিদের ধ্বংস একটি ঐতিহাসিক ঘটনা, যার পর ভারতজুড়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে আদালতের রায়ে অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণ অনুমোদিত হলেও মুসলিম সমাজের বড় একটি অংশ এ রায়কে পক্ষপাতদুষ্ট বলে মনে করে।
বর্তমানে বারাণসীর জ্ঞানবাপী মসজিদ এবং মথুরার ঈদগাহ মসজিদ নিয়েও বিরোধ চলছে। এসব ইস্যু মুসলিম ধর্মীয় স্থাপনাগুলো নিয়ে অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতা বৃদ্ধি করছে।
২০২৩ সালে হরিয়ানার নুহ ও গুরগাঁওয়ে সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় বহু মুসলিম ক্ষতিগ্রস্ত হন এবং সংঘর্ষ-পরবর্তী সময়ে শতাধিক মুসলিম ঘরবাড়ি ও দোকান বুলডোজার দিয়ে ধ্বংস করা হয়, যাকে অনেকেই ‘এথনিক ক্লিনজিং’ বলে অভিহিত করেছেন।
মুসলিম নির্যাতনের পরিসংখ্যান ও বিদ্বেষ
- ঘৃণাত্মক বক্তব্য বৃদ্ধি: ২০২৩ সালের দ্বিতীয়ার্ধে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণাত্মক বক্তব্যের ঘটনা ৬২% বেড়ে ৬৬৮টি পৌঁছায়, যার ৭৫% বিজেপি শাসিত রাজ্যে ঘটে।
- রোহিঙ্গা মুসলিমদের অবস্থা: পুলিশের নির্যাতন, আটক ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ আছে। কাশ্মীরে একটি রোহিঙ্গা শিশুর মৃত্যুর ঘটনা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিন্দিত হয়।
- ইসলামোফোবিয়া ও রাজনৈতিক বিদ্বেষ: মুসলিম নারীদের অনলাইনে নিলামে তোলা, ‘লাভ জিহাদ’ ষড়যন্ত্র, ও মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির আতঙ্ক ছড়ানো, এসব ঘটনা বিদ্বেষমূলক পরিবেশ সৃষ্টি করছে।
ভারতের সংশোধিত ওয়াকফ আইন ও মুসলিম ধর্মীয় স্থাপনাগুলোর উপর আক্রমণ মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে গভীর উদ্বেগ ও নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করেছে। এ পরিস্থিতি কেবল ধর্মীয় স্বাধীনতার পরিপন্থী নয়, বরং ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা ও সংবিধানিক মূল্যবোধকে চ্যালেঞ্জ করে।
ভারত যদি সত্যিকারের ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকতে চায়, তবে সব ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সম্পত্তি ও প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় সমান নীতি ও ন্যায়সঙ্গত আইনি কাঠামো নিশ্চিত করতে হবে। কোনো নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করা হলে তা রাষ্ট্রের বহুত্ববাদী চরিত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভারতের গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
লেখক:
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও
রাজনৈতিক বিশ্লেষক।