Header Advertisement

Sobar Desh | সবার দেশ মোঃ হাবিবুর রহমান


প্রকাশিত: ০০:২১, ২৫ এপ্রিল ২০২৫

ওয়াকফ আইন-পেহেলগাম হামলা কী পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত?

ওয়াকফ আইন-পেহেলগাম হামলা কী পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত?
ছবি: সবার দেশ

ভারতের ওয়াকফ (সংশোধনী) আইন, ২০২৫ এবং জম্মু ও কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং ধর্মীয় গতিশীলতার দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে সামনে এনেছে। এ দুটি ঘটনা সময়ের দিক থেকে কাছাকাছি হওয়ায় এবং এর ফলে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে উদ্ভূত প্রতিক্রিয়ার কারণে একটি প্রশ্ন বারবার উঠে আসছে: এ ঘটনাগুলো কি নিছক কাকতালীয়, নাকি এর পেছনে রাজনৈতিক কৌশল কাজ করছে? 

ওয়াকফ আইন সংশোধন: উদ্দেশ্য ও বিতর্ক

ওয়াকফ (সংশোধনী) আইন, ২০২৫ ভারতের লোকসভায় ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট পেশ করা হয় এবং ২০২৫ সালের এপ্রিলে পাস হয়। এ আইন ১৯২৩ সালের মুসলমান ওয়াকফ আইন বাতিল এবং ১৯৯৫ সালের ওয়াকফ আইন সংশোধনের লক্ষ্যে প্রণীত। এর মূল উদ্দেশ্য হিসেবে সরকার দাবি করেছে, ওয়াকফ সম্পত্তির ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং দক্ষতা বৃদ্ধি। আইনটি ১৯৯৫ সালের আইনের নাম পরিবর্তন করে ‘একীভূত ওয়াকফ ব্যবস্থাপনা, ক্ষমতায়ন, দক্ষতা এবং উন্নয়ন আইন’ (UWMEED Act, 1995) করেছে। এছাড়া, এটি ওয়াকফ বোর্ডে নারী ও বিভিন্ন মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব বাধ্যতামূলক করেছে এবং কেন্দ্রীয় সরকারকে ওয়াকফ নিবন্ধন, অডিট এবং হিসাব ব্যবস্থাপনার নিয়ম তৈরির ক্ষমতা দিয়েছে।)

তবে, এ সংশোধনী ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। মুসলিম সম্প্রদায়ের একাংশ এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো এটিকে ধর্মীয় স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের সম্পত্তির উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ বাড়ানোর প্রচেষ্টা হিসেবে দেখছে। ওয়াকফ বোর্ডে অমুসলিম প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি বিশেষভাবে সমালোচিত হয়েছে। সমালোচকদের যুক্তি, হিন্দু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান যেমন তিরুপতি তিরুমালা দেবস্থানম বোর্ডে মুসলিম প্রতিনিধি না থাকলে, ওয়াকফ বোর্ডে অমুসলিম প্রতিনিধি কেন? এটি ধর্মনিরপেক্ষতা ও সাংবিধানিক সাম্যের সাথে সাংঘর্ষিক বলে মনে করা হচ্ছে।

অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন (AIMIM) নেতা আসাদউদ্দিন ওয়াইসি এ আইনকে ‘গণতান্ত্রিকভাবে চাপিয়ে দেয়া’ এবং মুসলিম অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ বলে অভিহিত করেছেন। কংগ্রেস নেতা মল্লিকার্জুন খাড়্গে জানিয়েছেন, লোকসভায় বিলটির বিরুদ্ধে ২৩২টি ভোট পড়েছে, যা বিরোধিতার তীব্রতা প্রকাশ করে। এছাড়া, পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে সংশোধিত আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ সহিংসতায় রূপ নিয়েছে, যাতে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। ভারতের প্রতিবেশী বাংলাদেশেও বিএনপি, জামায়াত-ই-ইসলামী এবং হেফাজতে ইসলামী এই আইনের সমালোচনা করেছে।

অন্যদিকে, সরকার এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দাবি করেছেন, ওয়াকফ ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘদিনের দুর্নীতি, অস্বচ্ছতা এবং অদক্ষতার কারণে এ সংশোধনী প্রয়োজন ছিল। মোদী এটিকে ‘ওয়াটারশেড মোমেন্ট’ হিসেবে অভিহিত করে বলেছেন, এটি নাগরিক অধিকার সুরক্ষিত করবে এবং স্বচ্ছতা বাড়াবে। তবে, সমালোচকরা মনে করেন, এ আইনের মাধ্যমে ওয়াকফ সম্পত্তি (৮৭০,০০০টি সম্পত্তি, মূল্য ₹১,০০,০০০ কোটি) রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে আনার পথ সুগম হচ্ছে, যা মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বায়ত্তশাসনকে হুমকির মুখে ফেলছে।

পেহেলগাম হামলা: রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব

২২ এপ্রিল, ২০২৫-এ জম্মু ও কাশ্মীরের পেহেলগামে সংঘটিত সন্ত্রাসী হামলায় ২৫ জন ভারতীয় পর্যটক এবং একজন নেপালি নাগরিক নিহত হন। এ হামলার দায় স্বীকার করেছে ‘দ্য রেসিস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ (টিআরএফ), যারা পাকিস্তানভিত্তিক লস্কর-ই-তৈয়বার সহযোগী বলে পরিচিত। ভারত অভিযোগ করেছে, পাকিস্তান কাশ্মীরে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন দিচ্ছে, যা পাকিস্তান অস্বীকার করেছে। হামলার পর ভারত সিন্ধু নদী পানি চুক্তি স্থগ alveolar, সীমান্ত বন্ধ, এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক হ্রাসের মতো কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে, যখন পাকিস্তান পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে সিমলা চুক্তি স্থগিত এবং ভারতীয় বিমানের জন্য আকাশসীমা বন্ধ করেছে।

এ হামলা ওয়াকফ আইন সংশোধনী পাসের মাত্র দুই সপ্তাহ পর ঘটেছে, যা অনেকের মনে ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব জাগিয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, এ হামলা ওয়াকফ আইন নিয়ে মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতিবাদকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে ঘটানো হতে পারে। এ তত্ত্বের সমর্থকরা যুক্তি দেন যে, হামলাটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মনোযোগকে কাশ্মীর এবং পাকিস্তান-বিরোধী আখ্যানের দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছে, যা ওয়াকফ আইন নিয়ে সৃষ্ট বিতর্ক ও সহিংসতাকে (যেমন মুর্শিদাবাদে) পটভূমিতে ঠেলে দিয়েছে।

ওয়াকফ সংশোধন নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে থাকাকালীন সময়ে কাশ্মীরের পেহেলগাম সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে। এতে একাধিক সেনা নিহত হন এবং জাতীয় গণমাধ্যমের ফোকাস দ্রুত সরে যায় নিরাপত্তা ও সন্ত্রাসবাদের দিকে। ঘটনাপ্রবাহের এ নাটকীয় মোড় অনেককে ভাবিয়ে তোলে। এ হামলা কি কেবল নিরাপত্তাজনিত সংকট, নাকি রাষ্ট্রীয় কৌশলের অংশ? ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, রাজনীতি প্রায়শই নিরাপত্তাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে অভ্যন্তরীণ সমস্যা আড়াল করতে।

এছাড়া, এ হামলা ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডাকে শক্তিশালী করতে পারে। বিজেপি সরকার প্রায়ই পাকিস্তান-বিরোধী জাতীয়তাবাদী বক্তৃতার মাধ্যমে নির্বাচনে সুবিধা পেয়েছে। পেহেলগাম হামলা এবং এর ফলে ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা বিজেপিকে আগামী নির্বাচনে জাতীয় নিরাপত্তার ইস্যুতে জনমত গঠনের সুযোগ দিতে পারে। ইসরায়েলের ভারত সমর্থন এ আখ্যানকে আরও জোরদার করেছে, কারণ এটি ভারতকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে সন্ত্রাসবাদের শিকার হিসেবে উপস্থাপন করতে সাহায্য করছে।

ধর্মনিরপেক্ষতা ও সাম্যের প্রশ্ন

ওয়াকফ আইন সংশোধনী নিয়ে উঠে আসা একটি মূল প্রশ্ন হলো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব। বিরোধীরা যুক্তি দিয়েছেন, যদি হিন্দু ধর্মীয় বোর্ডে অন্য ধর্মের প্রতিনিধি না থাকে, তবে ওয়াকফ বোর্ডে অমুসলিম প্রতিনিধি থাকা ধর্মনিরপেক্ষতার সাথে সাংঘর্ষিক। ভারতের সংবিধানের ২৫ ও ২৬ নম্বর অনুচ্ছেদ ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান পরিচালনার অধিকার নিশ্চিত করে। ওয়াকফ বোর্ডে অমুসলিম প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্তি এ অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

ধর্মনিরপেক্ষতার প্রকৃত অর্থ হলো রাষ্ট্রের নিরপেক্ষ ভূমিকা এবং সকল ধর্মের প্রতি সমান আচরণ। তবে, সমালোচকরা মনে করেন, ওয়াকফ আইন সংশোধনী মুসলিম সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে তৈরি করা হয়েছে, যা সংবিধানের ১৪ নম্বর অনুচ্ছেদে উল্লিখিত আইনের সামনে সাম্যের নীতি লঙ্ঘন করে। এ প্রেক্ষিতে, পেহেলগাম হামলা এবং এর পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ মুসলিম সম্প্রদায়কে জঙ্গি হিসেবে চিত্রিত করার একটি প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা যেতে পারে, যা ওয়াকফ আইন নিয়ে তাদের প্রতিবাদকে দুর্বল করতে পারে।

আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ প্রভাব

পেহেলগাম হামলা এবং ওয়াকফ আইন সংশোধনী নিয়ে ভারতের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়েছে। ইসরায়েলের ভারত সমর্থন এবং ইরানের পাকিস্তানের সঙ্গে সীমান্তে সেনা মোতায়েনের পরিকল্পনা এ উত্তেজনাকে আঞ্চলিক মাত্রা দিয়েছে। ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পেহেলগাম হামলার নিন্দা করলেও ভারতের অভ্যন্তরীণ নীতি, বিশেষ করে ওয়াকফ আইন সংশোধনী নিয়ে মুসলিম বিশ্বে উদ্বেগ বাড়ছে।

অভ্যন্তরীণভাবে, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি স্পষ্টভাবে বলেছেন, তার রাজ্যে এ আইন কার্যকর হবে না, এবং তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে এ আইনের সমালোচনা করেছেন। তবে, বিজেপি এবং অন্যান্য দল তৃণমূল কংগ্রেসকে এ ইস্যুতে রাজনৈতিক সুবিধা নেয়ার অভিযোগ করেছে। জম্মু ও কাশ্মীরের বিধানসভা সদস্য ইরফান হাফিজ লোন ওয়াকফ আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন, এবং জাতীয় সম্মেলন (JKNC) নেতা তানভীর সাদিক সতর্ক করেছেন যে, এ আইন ধর্মীয় সংঘাতের কারণ হতে পারে।

ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব: বাস্তবতা নাকি অতি-কল্পনা?

পেহেলগাম হামলা এবং ওয়াকফ আইন সংশোধনীর সময়িক সান্নিধ্য অনেককে ষড়যন্ত্রের তত্ত্বের দিকে ঠেলে দিলেও, এটি প্রমাণ করা কঠিন। কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলা দীর্ঘদিনের একটি সমস্যা, এবং পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের উত্তেজনা নতুন নয়। তবে, এ হামলার সময় এবং এর ফলে জাতীয় মনোযোগের সরে যাওয়া সন্দেহের জন্ম দিয়েছে। সমালোচকরা মনে করেন, বিজেপি সরকার এ ধরনের ঘটনাকে ব্যবহার করে হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা এগিয়ে নিতে পারে, যেমনটি ২০১৯ সালে পুলওয়ামা হামলার পর দেখা গিয়েছিলো।

অন্যদিকে, সরকারের সমর্থকরা এ তত্ত্বকে অতি-কল্পনা হিসেবে উড়িয়ে দিয়ে বলছেন, ওয়াকফ আইন সংশোধনী দীর্ঘদিনের দুর্নীতি মোকাবিলার জন্য প্রয়োজনীয় ছিলো, এবং পেহেলগাম হামলা কাশ্মীরে চলমান নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের একটি অংশ। কর্ণাটক ওয়াকফ বোর্ডের জমি কেলেঙ্কারি এবং তামিলনাড়ুর তিরুচির মতো ঘটনা সরকারের যুক্তিকে সমর্থন করে।

আরও পড়্রন <<>> অন্তর্বর্তী সরকারেই মুক্তি দেখছে বাংলাদেশ

ওয়াকফ আইন সংশোধন এবং পেহেলগাম হামলা ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র এবং সামাজিক সংহতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো জনগণের প্রশ্নের জবাব দেয়া এবং স্বচ্ছতার সাথে নীতি বাস্তবায়ন করা। ওয়াকফ আইনের ক্ষেত্রে, সরকারের উচিত মুসলিম সম্প্রদায়ের সঙ্গে সংলাপের মাধ্যমে তাদের উদ্বেগ দূর করা এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে সম্প্রদায়ের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করা। একইভাবে, কাশ্মীরের নিরাপত্তা ইস্যুতে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপের পাশাপাশি স্থানীয় জনগণের আস্থা অর্জনের জন্য কূটনৈতিক ও উন্নয়নমূলক প্রচেষ্টা জোরদার করা প্রয়োজন।

যদি এই দুটি ঘটনা রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হয়, তবে তা ভারতের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের জন্য হুমকি। তবে, এটি কাকতালীয় হলেও, সরকারের ওপর দায়িত্ব রয়েছে এ সংকটগুলো স্বচ্ছ ও ন্যায়সঙ্গতভাবে মোকাবিলা করার। সুপ্রিম কোর্টে ওয়াকফ আইনের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিতে পারে। এ মুহূর্তে, সংযম, সংলাপ এবং সাংবিধানিক মূল্যবোধের প্রতি প্রতিশ্রুতিই ভারতকে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এগিয়ে নিতে পারে।

লেখক: 
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও
রাজনৈতিক বিশ্লেষক।