Advertisement

মো. আফজাল ওয়ার্সী

প্রকাশিত: ২৩:০০, ১০ জানুয়ারি ২০২৫

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় ভারতের উর্দুভাষী মুসলমানদের অবদান এবং উপকারের প্রতিদান

(প্রবন্ধটি অন্তর্বর্তী সরকারের মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে দেয়া হয়েছে তার সদয় অবগতি এবং অতিসত্বর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য)

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় ভারতের উর্দুভাষী মুসলমানদের অবদান এবং উপকারের প্রতিদান
সবার দেশ

ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহর অর্থে ও উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় অল ইন্ডিয়ান মুসলিমলীগ। এরই পতাকাতলে সমগ্র ভারতের সকল ভাষার মুসলমানগণ ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রাম ও কুরবানীর ফলশ্রুতিতে প্রতিষ্ঠা পায় পাকিস্তান। প্রতিপক্ষ বৃটিশ শাসকগোষ্ঠী ও তাদের হিন্দু সহযোগীরা মুসলমানদের জন্য আলাদা দেশ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় বাধ্য হয় মুসলিমদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের কারণে।

ভারতের যেসব এলাকার মুসলমানরা জানত যে, তারা কখনও পাকিস্তানের অংশ হবে না তারাও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় নিজেদের শ্রম, ঘাম, রক্ত বিলিয়ে দেয়। তাদের আশা ছিল একটি শক্তিশালী মুসলিম দেশ গঠিত হলে ভারতের হিন্দুরা মুসলমানদের উপর নির্যাতন করতে ভয় পাবে।

১৯৭১ সাল পর্যন্ত তাদের এ বিশ্বাস তাদেরকে নিরাপত্তা নিয়েছে। কিন্তু বাঙালী মুসলমানরা ভারতের চক্রান্তে সমগ্র ভারতীয় মুসলমানদের রক্তমূল্যে অর্জিত পাকিস্তানকে ভেঙ্গে এক অংশ ভারতের হাতে তুলে দিলে তাদের স্বপ্ন ভংগ হয়। এরপর থেকে ভারতে অবস্থান করা মুসলমানগন এবং হিজরত করে বাংলায় বসতি স্থাপন করা মুসলমানরা চরম অত্যাচার নির্যাতনের শিকার হয়ে বর্তমানে অস্তিত্বহীনতার সংকটে নিমজ্জিত। 

বাংলাভাষী মুসলমাননের আমরা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান অর্জিত হওয়ার পর দেশ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত থাকার মত কোন স্থাপনা, সড়ক বা বিমান চলাচল ব্যবস্থা এদেশে ছিল কি? দেশভাগের চুক্তি অনুযায়ী হিন্দু ভারত কেন্দ্রীয় ভারতীয় ফান্ড থেকে পাকিস্তানের পাওনা ১ লক্ষ অন্ত এবং ১ কোটি টাকা দিয়েছিল কি? পূর্ব বাংলার মুসলমানদের হাতে কোন মিল-কারখানা, নৌবন্দর, সমুদ্রবন্দর ছিল কি? সচিবালয়, হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠা করার কোন দক্ষ জনবল বা ভবন ছিল কি? উত্তর হবে না। 

এমন কঠিন পরিদ্বিতিতে পরবর্তী ২ বছর পর্যন্ত পাকিস্তান পরিচালনার অর্থ যোগান দিয়েছিলেন শিল্পপতি এস.এম ইস্পাহানি ও হায়দরাবাদের নিজাম। তারা কি কেউ বাঙালী ছিলেন? ছিলেন না, তবে তারা মুসলমান ছিলেন তাই মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে তারা পাকিস্তান যাতে টিকে থাকে তার জন্য অর্থ প্রদান করেছেন।

১৯৫১ সালে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ সরকার জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ করায় এদেশের ৪.৫০ কোটি হিন্দু-মুসলিম রায়ত জমির মালিক হয়ে ১৯৫২ সাল থেকে পাকিস্তানীদেও, উর্দুভাষীদের শোষক বলা শুরু করল এবং একশত নব্বই বছরের শোষক বৃটিশ ও হিন্দু অত্যাচারীদের অত্যাচার ও শোষণকে চাপা দিয়ে দেয়া হল।

১৯৪৭ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের ৮০% মুসলমানের ছিল এদেশের ২০% ভূমি। ২০% হিন্দু জমিদারদের নিকট ছিল এদেশের ৮০ শতাংশ ভূমি। ১৯৪৭ এর দেশভাগের সময় এসব জমিদাররা তাদের সমুদয় অর্থ এবং অস্থাবর সম্পত্তি ভারতে নিয়ে গিয়ে এদেশকে সম্পূর্ণ পঙ্গু অবস্থায় রেখে গিয়েছিল। 

যেসব ভারতীয় মুসলমান নিজেদের পুজি এনে এদেশকে সমৃদ্ধির পানে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল তারাই ১৯৫২ সাল থেকে শোষক উপাধি পেল এবং যারা এদেশ গড়তে নিজেদের কারিগরি দক্ষতা দিয়ে সহায়তা করেছিল তারা ১৯৭১ সাল থেকে অদ্যাবধি এদেশে তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিকের ন্যায় জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। জেনে বুঝে যদি এ অবিচার অব্যাহত রাখা হয়, তবে আমরা আল্লাহর নিকট এর প্রতিকার চাইব। যারা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় জীবনবাজি রেখে কাজ করেছে এবং বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছে তারা কি প্রতিকার চাইবে না। আমাদের উপরোক্ত বক্তব্যের পক্ষে নিম্নে কিছু প্রমান্য তথ্য প্রদান করা হলঃ

০১। ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস মুসলমানদের আলাদা দল মুসলিমলীগকে স্বীকৃতি দেয়নি। মুসলমানদের আন্দোলনে বাধ্য হয়ে বৃটিশ সরকার ১৯৪৫ সালে মুসলমানদের জন্য কেন্দ্রে ৩০ আসন এবং সকল প্রাদেশিক পরিষদ সমূহে সর্বমোট ৪৯৫টি আসন নির্দিষ্ট করে দেয় এবং সমগ্র ভারতে গনভোটের আয়োজন করে। বৃটিশ সরকার ও তাদের সহযোগী হিন্দুদের আশা ছিল- যেসব প্রদেশ প্রস্তাবিত পাকিস্তানের অংশ হবে না, তারা পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিপক্ষে ভোট দিবে। কিন্তু কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বে মুসলিম ভ্রাতৃত্ব বিজয়ী হয়। 

(ক) ১৯৪৫ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় পরিষদের জন্য নির্ধারিত ৩০ আসনে মুসলিমলীগের প্রার্থীরা বিজয়ী হয়। কংগ্রেস সব আসনে কংগ্রেসী মুসলিম প্রার্থীদের নমিনেশন দিয়েছিল, কিন্তু তারা সবাই পরাজিত হয়।

কেন্দ্রীয় পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৪৫ সালের ডিসেম্বর মাসে, প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৪৬ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে। হিন্দুদের জন্য বরাদ্দকৃত সব আসন পায় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস। ভোটের ফলাফলে দৃশ্যত ভারত দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যায়।

এমতাবস্থায় বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী ভারতের রাজনৈতিক ক্ষমতা ভারতীয়দের হাতে তুলে দেয়ার জন্য হিন্দুদের দাবী মোতাবেক পন্ডিত জওহর লাল নেহেরুর বন্ধু লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনকে ভাইসরয় নিয়োগ দিয়ে ভারতে পাঠান। ভারতে আসার পর লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনের সাথে ২৯ বছর বয়সী নেহেরু কন্যা ইন্দিরা গান্ধীর এবং লেডি মাউন্ট ব্যাটেনের সাথে নেহেরুর ঘনিষ্ট ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে উঠে। এ দুই অবৈধ সম্পর্কের ফলশ্রুতিতে মাউন্ট ব্যাটেন গণভোটের ফলাফলকে পাশ কাটিয়ে কেন্দ্রে নেহেরুকে সরকার গঠনের আমন্ত্রণ জানান। এমতাবস্থায়, আত্মপ্রত্যয়ী মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ দিবস হিসাবে ডাইরেক্ট এ্যাকশন ডে পালনের আহ্বান জানান

সর্বভারতীয় মুসলমানরা একযোগে পাকিস্তান সৃষ্টির পক্ষে ভোট দেয়ার পরদিন থেকে কংগ্রেস লালিত বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী সংগঠন, আর.এস.এস এবং বজরং দল সারা ভারতের মুসলিম সংখ্যালঘু প্রদেশ সমূহে মুসলিম নিধন শুরু করে। প্রকৃত পরিসংখ্যান মোতাবেক ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত উগ্র সশস্ত্র হিন্দুরা ২০ লাখ মুসলিমকে হত্যা করে। অগনিত মুসলমান আহত ও পঙ্গু হয়, মুসলমানদের ঘরবাড়ী, সহায়-সম্পদ জ্বালিয়ে দেয়া হয়। অসংখ্য মুসলিম নারী ধর্ষিতা হয়। ১৯৪৬ সালের ১৬ই আগস্টের ডাইরেক্ট এ্যাকশন ডে'র দিন থেকে কলকাতায় ও বিহারে যে ভয়াবহ গনহত্যা শুরু হয় তার জেরে বিহার মুসলিম শূন্য হয়ে পড়ে। তখন থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত ভারতের মুসলমানরা যেসব এলাকা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হবে সেসব এলাকায় আশ্রয় নিতে থাকে।

২। ১৯৪৭ এর ১৪ আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর দেশ পরিচালনার জন্য পূর্ব পাকিস্তানী কোন আই.সি.এস অফিসার ছিলো না। দেশ গঠনের প্রয়োজনেই উর্দুভাষীরা এদেশে এসেছিল। এ সংক্রান্ত তথ্য।

(ক) ১৯৪৭ সালে নবপ্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান প্রশাসন পায় ১০০ জন আই, সি.এস অফিসার, ভারত পায় ৫০০ জন। তন্মধ্যে ১ জনও বাঙালী ছিলোনা। তারা ছিলো পাকিস্তান বা উত্তর প্রদেশ এর মুসলমান। (সূত্র: আলী আহমেদ রোল অফ হায়ার সার্ভিস ইন পাকিস্তান, লাহোর, পৃ-৩৫)

(খ) চরম ব্রিটিশ বিরোধী মানসিকতার কারণে বৃটিশ আমলে বাঙ্গালীদের সেনাবাহিনীতে নেয়া হতো না। ১৯৪৭ সালে ফেডারেল সেনাবাহিনীকে এদেশে দায়িত্ব প্রদান করা হয়। (সূত্র: বাংলাদেশ মারাত্মক অপপ্রচারনা ও ভারতীয় আধিপত্যবাদের শিকার, এম.টি. হোসেন পৃ-৫)

(গ) ১৯৪৭ সালে পূর্ব বাংলায় কোন পাটকল ছিলো না। আদমজী, ইস্পাহানী ও বাওয়ানী তাদের ভারতে অবস্থিত পাটকল বিক্রি করে বাংলাদেশে পাটকল স্থাপন করে। এদেশে যেহেতু কোন দক্ষ শ্রমিক ছিল না তাই তারা তাদের পাটকল শ্রমিকদেরও সাথে করে নিয়ে আসে। এসব মিলের দক্ষ শ্রমিকরাই এদেশবাসীকে কারখানা পরিচালনা শিখিয়েছেন।

(ঘ) রেলওয়ে, টেলিফোন, বিদ্যুৎ বিভাগ পরিচালনায় ১৯৪৭ এর পূর্বে হিন্দুরা নিয়োজিত ছিলো। ১৯৪৭ সালে তারা ভারতে চলে যাওয়ায় অবাঙালী মুসলমানরাই এসব বিভাগের দায়িত্ব গ্রহণ করে।

এভাবে আমাদের পূর্বপুরুষরা তাদের রক্তে ঘামে অর্জিত পূর্ব পাকিস্তানে এসে এখানে নিজেদের আবাসভূমি গড়ে তোলে। কিন্তু ভার্গের নির্মম পরিহাস: ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পর আমরা এদেশবাসীর শত্রু আখ্যায়িত হলাম। আমাদেরকে ১৯৭১ সালের ১লা মার্চ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত হত্যা, নির্যাতন, পঙ্গু ও ধর্ষণ করা হলো। এ সময়ের মধ্যে আমাদের কয়েক লক্ষ লোককে হত্যা করা হলো। আমাদের সম্পত্তি শত্রুসম্পত্তি হিসাবে কেড়ে নেয়া হলো। অথচ যুদ্ধকালীন মালেক মন্ত্রীসভায় আওয়ামীলীগ, মুসলিম লীগ, কৃষক শ্রমিক পাটি ও পি. ডিবির লোকেরাই মন্ত্রী ছিলো। তাদের সম্পত্তি শত্রু সম্পত্তি হলো না। 

বিগত আওয়ামীলীগ সরকার ১৯৭১ সালের রাজাকারদের নামের তালিকা প্রকাশ করেছিলো। সে তালিকায় দেখা গেছে ১৯৭১ সালে সারা দেশে মোট ১০৭৮৯ জন রাজাকার ছিলো। তন্মধ্যে ৮০৬৩ জন ছিলো আওয়ামী লীগের, ৩৭ জন ছিলো জামায়াতে ইসলামীর সদস্য। বাকীরা ছিল নির্দলীয় সাধারণ মানুষ। উক্ত তালিকায় কিছু হিন্দু ছিলো। আমাদের উর্দুভাষী ২০ জনও ছিলো ওই তালিকায়। এতদসত্বেও শুধু আমরাই বাংলাদেশের শত্রু হয়ে গেলাম? আমাদের সহায় সম্পত্তি ও নাগরিক অধিকার কেড়ে নেয়া হলো।

১৯৭২ সালের সিমলা চুক্তিতে আমাদেরকে আটকে পড়া পাকিস্তানী বানিয়ে দেয়া হলো। অথচ আমরা কখনও পাকিস্তানে যাইনি কিংবা কোন আমাদের কেউ পাকিস্তান থেকে এখানে আসেনি।

১৯৪৭ থেকে ২০২৪ সময়কালে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ মাত্র ৪ জন মহান নেতা পেয়েছে। তন্মধ্যে প্রথমজন কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, দ্বিতীয় জন লিয়াকত আলী খান, তৃতীয় জন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান এবং চতুর্থ জন ড. মুহাম্মদ ইউনুস। উপরোক্ত ঐতিহাসিক বাস্তবতার আলোকে বাংলাদেশী ভাইদের নিকট আমাদের আকুল আবেদন, ১৯৭২ সালে আমাদের থেকে কেড়ে নেয়া সম্পত্তি আমাদের ফিরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করুন অথবা ক্ষতিপুরণসহ আমাদেরকে পূনর্বাসন করার ব্যবস্থা করুন। বিগত ৭৬ বছর আমরা নিজদেশে পরবাসীর ন্যায় জীবন-যাপন করছি। আমাদের আশাহত যুবশ্রেণী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আমাদের ভবিষ্যত ক্রমাগত গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত হচ্ছে। মানবিক কারণে আমরা সহায়তা প্রত্যাশা করছি।

তথ্যসূত্রঃ
১। বইঃ সাম্রাজ্যবাদী রাজনীতির সদরে-অন্দরে, এস এম নজরুল ইসলাম।
২। বই: কলকাতা হত্যাকান্ড ও উর্দুভাষী সমস্যা, এস এম নজরুল ইসলাম।

লেখক: 
সেক্রেটারী জেনারেল
ইন্ডিয়ান বংশোদ্ভুত উর্দুভাষী সংখ্যালঘু কাউন্সিল, বাংলাদেশ