মালয় থেকে মালয়েশিয়া
মালয় দ্বীপে এক যে বোকা শেয়ালে
লাগলে ক্ষুধা মুরগি এঁকে দেয়ালে
আপন মনে চাটতে থাকে খেয়ালে।
কথিত আছে পশুর জগতে চালাক-চতুর ও বুদ্ধিমান শেয়াল। সুকুমার রায়ের ছড়াটি পড়তাম আর ভাবতাম
যে দেশের শেয়াল এতো বোকা সে দেশের মানুষ কতো বোকা কল্পনাই করা যায় না। বোকা মানুষগুলো যখন বিশ্বের সর্বোচ্চ পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার নির্মান করেছিল তখন গিয়েছিলাম। মালয়েশিয়ার কোনো পুরানো নাম ছিল না। দেশটি ১৯৬৩ সালে মালয় রাজ্য, সিঙ্গাপুর, উত্তর বোর্নিও এবং সারাওয়াকের ব্রিটিশ ক্রাউন উপনিবেশগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে ফেডারেল গঠনের সময় নামকরণ হয় মালয়েশিয়া। এক সময়ের কুসংস্কারের সুতিকাগার দেশটি কোন হ্যামিলনের বাঁশিয়ালার বাঁশির জাদুতে পাগলপারা হয়ে গেল? জানতে কার না ইচ্ছে জাগে?
২০০২ সালে পক্ষকাল অবস্থানের পর যেদিন দেশে ফেরার পালা সেদিনও আমার সঙ্গি-সাথীরা বের হয়েছে শপিং করতে। কেন করবেনা? দুনিয়ার তাবৎ সামগ্রী পাওয়া যায় ওখানে। হোটেলে আমি একা। সন্ধ্যা ৭টায় ফ্লাইট। দুপুর দুটোর আগে কেউ ফিরবে না। বিদেশ পর্যটনে বের হবার প্রাক্কালে গিন্নীসহ দুইমেয়ে তাদের আকাঙ্খার একটা ছোট্ট তালিকা লিখে হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল। ক'বার তালিকার ভাঁজ খুলে পাঠ করে আবার ভাঁজ করে পকেটেই রেখে দিয়েছি। সাধ ও সাধ্যের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান থাকায় শুরু থেকেই কেনাকাটায় আমার আগ্রহ ছিল না। এখানকার আবহাওয়া, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, সবুজ পাহাড়, রোদ-বৃষ্টির কোলাকুলির প্রতি কেমন যেন মমত্ববোধ জাগে।
শেষবারের মত কুয়ালালামপুর শহরটি দেখতে ৪৮তলা হোটেলের ছাদে চলে আসি। হোটেলের ছাদের উপর দাঁড়িয়ে চারপাশে নজর ফেললেই কোয়ালালামপুর শহরের বেশকিছু অংশ দেখা যায়। দেখা যায় নির্মল আকাশ স্বচ্ছল প্রকৃতিও। আমাদের হোটেল ৪৮তলা। এদেশে মাঝারি উচ্চতার হোটেল-মোটেল, এপার্টমেন্ট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানই ৪৮তলা। শপিং করতে প্রচুর পয়সা লাগে। আকাশ ছোঁয়া ইমারতসহ প্রকৃতি দর্শন করতে পয়সা লাগে না।
ছাদে উঠে প্রথমে দৃষ্টি আকর্ষণ করে মেট্রো রেলস্টেশন। মাটির নিচের রেল লাইনকে যদি পাতাল রেল বলা যায় তবে মাটির উপরের রেল লাইনকে আক্শ রেল বলা যাবে। সর্বত্রই তাদের মাঝে ঊর্ধ্বগামী প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। তাই রেল লাইন স্থাপনেও তারা মাটির তলায় না গিয়ে উপরে চলে গেছে। ভূমি থেকে অনুমান বিশ ফুট উপরে স্থাপিত লাইনের ওপর দিয়ে ছবির মতো ছোট ছোট রেলগাড়ি ছুটাছুটি করছে। রঙিন ফুটফুটে চার/পাঁচ বগি বিশিষ্ট এক একটা হাওয়াই রেল সম্পূর্ণ পাশ্চাত্যের আদলে সিস্টেম ট্রানজিট এলিরান রিংগান, এস.ডি. এন.বি.এইচ.ডি নামে প্রাইভেট কোম্পানী ষাট বছরের চুক্তিতে ১৯৯২ সনে এই রেল চালু করে। আকাশ রেল ব্যবস্থার নাম রাখা হয় 'কুয়ালালামপুর লাইট রেল ট্রানজিট' সংক্ষেপে কে.এল.আর.টি.। একটি খুটির লাইনের উপর কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত হাওয়াই রেল দশ/পনের মিনিট পরপর আসা যাওয়া করে। এ ব্যবস্থায় শহরের শোভাবর্ধন, পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণসহ যানজট এড়ানোও সহজ হয়েছে।
রেল স্টেশনের কাছেই একটি কৃত্রিম খাল। খালের দু'পাড় শক্ত করে বাঁধানো। কুয়ালালামপুরে মাঝে মাঝেই এ রকম খাল মরার মতো ঘুমিয়ে থাকে। বৃষ্টি হলেই খালগুলি জীবন পায়। বৃষ্টির পানি হুড়মুড় করে খালে গিয়ে নামতেই ঘুমন্ত খাল জেগে ওঠে। তীব্র স্রোতে বৃষ্টির পানি শহরের বাইরে টেনে নিয়ে যায়। মুষলধারার বৃষ্টি হলে কোথাও কোথাও রাস্তা তলিয়ে যায়। ম্যাজিকের মতো পানি সরে গিয়ে আবার সেই আগের অবস্থায় ফিরে আসে। কুয়ালালামপুর শহরের চারদিকেই পাহাড়। পাহাড়ে পাহাড়ে একটি সুরক্ষিত সবুজ দুর্গের ভিতরে কে.এল.সি.টি.র অবস্থান। পানি নিষ্কাষণ ব্যবস্থা দুর্বল হলে প্রচ- বৃষ্টিতে কুয়ালালামপুর সিটি বৃহত্তর জলাশয়ে রূপান্তরিত হওয়ার কথা। চমৎকার জল নিষ্কাশন ও পরিকল্পিত সুয়ারেজ ব্যবস্থার কারণে জলাশয় হওয়া দূরের কথা পানি দাঁড়াতেই পারে না। শুধু ড্রেনেজ ব্যবস্থায়ই নয়, অতীতের অভিজ্ঞতায় বর্তমানের প্রেক্ষাপটে, সুদূর ভবিষ্যৎ চিন্তা মাথায় নিয়ে বিচক্ষণতার সাথে সুস্থ মস্তিষ্কে আর্কিট্যাক্ট নকশায় নগরটি সজ্জিত করা হয়েছে। যার ফলে পরস্পরের কাজের দ্বারা একে অপরের প্রতিবন্ধক হয় না, সারা বছর অপ্রত্যাশিত ভাঙাগড়ারও প্রয়োজন হয় না।
ঊর্ধ্বে গমনের প্রতিযোগিতায় তারা যেন মরিয়া হয়ে উঠেছে। শুধু টেকনিক প্রযুক্তিতে নয় শিল্প-বাণিজ্য, শিক্ষা সংস্কৃতি, সকল দিক থেকে তারা কারও নিচে থাকতে রাজি নয়। সরকার গৃহীত মাস্টার প্ল্যানের সাথে সাথে সে দেশের যুবক- যুবতী ও শিক্ষার্থীরা উন্নয়ন কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। উন্নয়নের স্রোত এত বেশি তীব্র যে, যার ফলে অগ্রগতির প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী কুসংস্কারের শ্যাওলা-জং, পরগাছা আবর্জনা অগ্রগতির চেতনাকে স্পর্শও করতে পারে না। ধর্ম সংস্কৃতির মোড়লীপনাও উন্নয়নকে রুখতে পারছে না।
বিমান থেকে বের হওয়ার সময় চোখ যায় 'Salamat Datang' লেখা যুক্ত নামফলকের দিকে। ‘শান্তি বর্ষিত হোক’ লেখাযুক্ত ফলকের তলা দিয়ে বিমানবন্দরে প্রবেশ করি। বাইরে দিনের আলো উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। বাংলাদেশের সময়ের সাথে ঘড়ির ঘণ্টার কাঁটা দু'ঘর যোগ করতে হলো। এখন ডিসেম্বর মাস। তাই আমাদের গায়ে ছিল শীতের কাপড়। কুয়ালালামপুরকে সিটি থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে ‘সেপাং” নামক স্থানে দু'টার্মিনাল বিশিষ্ট বিশাল বিমানবন্দরটি ১৯৯৮ সালে চালু হয়।
বিমানবন্দরের লবিতে প্রবেশ করে চোখে ধাঁ-ধাঁ লেগে যায়। আমাদের জিয়া (বর্তমানে শাহজালাল) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটাকে এর তুলনায় খেলনা বন্দর মনে হয়। লুকিং গ্লাসের সামনে দাঁড়ালে যেমন দেখা যায়, পায়ের নিচেও তেমন দেখা গেল। কিংবা মনে হতে পারে-এই মাত্র বৃষ্টি হয়ে গেছে, স্বচ্ছ ফ্লোরে পানি টলমল করছে; পা ফেললে জুতার তলা ভিজে যাবে-কিংবা অসাবধানে হাঁটতে গেলে পা পিছলে একেবারে ‘আলুর দম’ হয়ে যাব। আসলে এর কিছুই হবে না। লবিতে বিছানো টাইলসগুলো স্ফটিকের মতো এত বেশি উজ্জ্বল ছিল যে, প্রথম দৃষ্টিতে অনেক কিছু মনে হতে পারে।
কামরাঙা আকৃতির আকাশ ছোঁয়া ছাদের স্বচ্ছতা গলিয়ে সূর্যালোক ঠিকরে ভেতরে চলে আসছে। কাচের দেয়াল ঘেরা টার্মিনাল নির্মাণে কৌশলীদের কৌশলের সর্বোত্তম প্রতিভা, নৈপুণ্য ও আধুনিক মননশীলতার বিকাশ ঘটেছে। চলন্ত ফুটপাতে পা ফেলতে না ফেলতেই পৌঁছে দেয় এ্যারোট্রেনের দরজায়। দু’বগি বিশিষ্ট এ্যারোট্রেন নিয়ে যায় একেবারে ইমিগ্রেশন কর্মকর্তার সামনে। ইমিগ্রেশন কর্মকর্তার ইন্টারভিউ শেষ করে বাইরে আসতেই শরীরে মিষ্টি মধুর উষ্ণতা লাগতে শুরু হয়। শরীর থেকে শীতবস্ত্রাদি খুলতে শুরু করি।
দুটি মাইক্রোযোগে আমরা সিটির উদ্দেশে যাত্রা করি। আমাদের জন্য আগেই হোটেল বুক করা আছে। এখন পরিপূর্ণ পর্যটন মৌসুম। আগে ভাগে বুক করা না থাকলে হোটেলে আসন পাওয়া সমস্যা হতে পারে। সিটিতে আছে ডজন ডজন তারকা খচিত হোটেল। অক্টোবর মাস থেকে ফেব্রুয়ারি ট্যুরিস্ট মৌসুম। ডিসেম্বর মাস, এখন পর্যটনের ভরা জোয়ার। টান টান উত্তেজনায় বাণের পানির মতো হু হু করে ঢুকছে পর্যটক। হোটেল লবি, মল মাদুর গিজগিজ করছে পর্যটক আর পর্যটক। গত একদশক থেকে পর্যটকদের নজরে আসে দেশটা। পর্যটকদের নজর পড়ার বহুবিধ কারণের মধ্যে আমার মতে প্রধান চারটি কারণ হলো-
প্রথমত, দেশটা ভৌগোলিক দিক থেকে নিরক্ষীয় রেখার (Lititude) ০১- ০৭ ডিগ্রি উত্তর গোলার্ধে এবং দ্রাঘিমা (Lititude) রেখার ১০০-১১৯ ডিগ্রি পূর্ব গোলার্ধে অবস্থান হওয়ায় এখানে বার মাস একই রকম আবহাওয়া বিদ্যমান থাকে। সুপ্-সুপা আবহাওয়ার চিরবসন্তের এ দেশে অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে এবং মে মাস থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত উত্তর-পূর্ব দিক থেকে মৌসুমী বায়ু প্রবাহের ফলে এখানে দুটি মাত্র ঋতু। সারা বছর নাতি-শীতোষ্ণ আবহাওয়া বিরাজমান থাকায় শীতপ্রধান এবং গ্রীষ্মপ্রধান উভয় এলাকা থেকে ভ্রমণ বিলাসীরা এদেশে আসার জন্য ভিড় করছে।
দ্বিতীয়ত, ‘Malaysia Lies in the heart of South east Asia' মোট তিন লক্ষ ত্রিশ হাজার চারশ' চৌত্রিশ বর্গকিলোমিটার পরিমিত সাগর বেষ্টিত দেশটাতে এশিয়া মহাদেশের সব বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান আছে। মালয়েশিয়া পর্যটন করলে সমগ্র এশিয়া পর্যটনের ইচ্ছা পূরণ হয়ে যায়। এখানে একদিকে আছে উগ্র আধুনিকতা অপর দিকে আছে জমাট বাঁধা মান্ধাতা। পরস্পর বিপরীত এ দুই সংস্কৃতির এত কাছাকাছি সহঅবস্থান পৃথিবীর আর কোনো দেশ দাবি করতে পারে না।
তৃতীয়ত, ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরের মিলনস্থলে মালাক্কা প্রণালী। মালাক্কা প্রণালীর দক্ষিণ-পূর্বে এবং চীন সাগরের দক্ষিণ-পশ্চিম পাড়ে বিদ্যমান প্রাচীন ‘মালয় উপদ্বীপ’। মালয় উপদ্বীপের ভূমির সবটাই ছোট-বড় পাহাড়, সবুজ সমতল, প্রাকৃতিক সম্পদ। আকাশে চলে রোদ বৃষ্টির লুকোচুরি আর মেঘ পরীদের মিলনমেলা। এ মিলন মেলা অন্য কোথাও নেই।
চতুর্থত, এখানে আছে বর্তমান পৃথিবীর সর্বোচ্চ ‘পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার' আরও আছে পৃথিবীর তৃতীয় সর্বোচ্চ ‘মিনারা কুয়ালালামপুর'। এসব ছাড়াও প্রযুক্তির ডানায় ভর করে দেশটি কিভাবে উন্নতির শিখরে উড়ে যাচ্ছে সে বিস্ময় স্বচক্ষে দেখার জন্য দফায় দফায় পর্যটক দলে দলে ঢুকছে। এ চারটা কারণ ছাড়াও পর্যটক আকর্ষণের অন্যান্য কারণগুলো পরে বর্ণিত হয়েছে।
প্রথমে এসেই আমরা হোটেল হিলটনে উঠেছিলাম। হিলটন হোটেলের উত্তরের জানালায় দাঁড়িয়ে খুব কাছেই পৃথিবীর সর্বোচ্চ পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার দেখা যায়। দেখে মনে হয়, দু’যমজ বোন হাত ধরাধরি করে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। পেট্রোনাস এবং কে.এল.সি.সি. (হোল্ডিং) এস.ডি.এন.বি.এইচ.ডি-এর যৌথ মালিকানায় কুয়ালালামপুর সিটির উত্তর-পশ্চিম কোনে একশ' একর ভূমির ওপর ১৯৯২ সালে পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার নামে যমজ বুরুজটি নির্মাণ করা হয়। ৪৫২ মিটার উচ্চতাসম্পন্ন ৮৮ তলবিশিষ্ট পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার-এর ডিজাইন করেছেন বিখ্যাত আর্কিটেক্ট সিজার পেলি (Cesar Pelli). ৪৪ তলার উপরে মূল দুটি টাওয়ারের সাথে একটা সংযোগ ব্রিজ আছে। সংযোগ ব্রিজের ফলে দু'টাওয়ারের ভারসাম্য রক্ষা সৌন্দর্য বৃদ্ধিসহ যোগাযোগ সহজ হয়েছে।
টাওয়ার দুটোর আছে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন দু'ডেক বিশিষ্ট দুটো লিফট। প্রতিটি লিফট একই সময়ে ২৯ জন আরোহীসহ প্রতি সেকেন্ডে একটা করে ফ্লোর অতিক্রম করতে পারে। আনুভূমিক (Horizontal) ভাবে পাতলা রেশমী ফিতা (Ribbons), রিফ্লেক্টিং ভিশন গ্লাস এবং স্টেইনলেস স্টিলের সাহায্যে বিশেষভাবে নির্মিত টাওয়ার দুটোর ওপর দিনে সূর্যালোক প্রতিফলিত হয়ে চিকচিক করতে থাকে, রাতে চন্দ্রালোকে অপরূপ আলোচ্ছটা বিচ্ছুরিত হয়, সকাল-সন্ধ্যায় রুপালি আভা উদ্ভাসিত হয় ও অন্ধকারে হয়ে ওঠে রহস্যময়ী। কুয়ালালামপুরের যে কোনো দিকের ২০ কিলো- মিটার দূর থেকে এ বহুমাত্রিক অপূর্ব দৃশ্য পর্যটকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মালয়েশিয়ার অহংকার এ টাওয়ারের সংযোগ ব্রিজ পর্যন্ত পর্যটকের জন্য উন্মুক্ত থাকে। বিশেষ অনুমতি সাপেক্ষে পর্যটকগণ সংযোগ ব্রিজ পর্যন্ত ওঠার সুযোগ পায়। এই টাওয়ারের কিছু অংশ পেট্রোলিয়াম ডিসকভারি সেন্টার, এনার্জি লাইব্রেরি, পেট্রো রসায়নাগার এবং পেট্রোনাস আর্ট গ্যালারি।
আধুনিক স্থাপত্য শিল্পের সর্বোৎকৃষ্ট নিদর্শন টাওয়ার দুটোর মোট নির্মিত ইমারত এলাকার পরিমাণ তিন লক্ষ একচল্লিশ হাজার সাতশ' ষাট বর্গমিটার। সর্বাধিক ব্যবহার উপযোগী আরামদায়ক, কার্যকর নিরাপদ, প্রতিকূল আবহাওয়া প্রতিরোধক উপাদানে নির্মিত পেট্রোনাস টুইন টাওয়ারের নিচের কয়েকটি তলা জুড়ে রয়েছে শপিংমল। শপিংমল এলাকার অপর নাম সুরিয়া কে. এল. সি. সি.। সুরিয়া কে. এল.সি.সি.তে শপিংমল ছাড়াও আছে অত্র এলাকার সর্ববৃহৎ খাবারের দোকান।
টুইন টাওয়ার দর্শন করে বিস্ময়ের ঘোর কাটতে না কাটতে ঠিক দক্ষিণ- পশ্চিম দিকে একবার তাকিয়ে দেখুন। দেখবেন, নিকটেই দাঁড়িয়ে আছে পৃথিবীর তৃতীয় সর্বোচ্চ ‘মিনারা কুয়ালালামপুর’ বা ‘কুয়ালালামপুর টাওয়ার’। একটা মাত্র স্তম্ভের ওপর মুক্ত আকাশে স্বাধীনভাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে চারশ' একুশ মিটার উচ্চতাসম্পন্ন মিনারা। টোরেন্টোর সি.এন. টাওয়ার এবং মস্কোর ওসটেংকিউ (Ostankio) টাওয়ার ছাড়া পৃথিবীর আর কোনো টাওয়ার মিনারা কুয়ালালামপুরকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি(২০০২ সাল পর্যন্ত)। মালয়েশিয়া টেলিকম এবং জার্মান স্থপতি ওয়েজ এন্ড ফ্রেটেজ (Ways and Freytag)-এর যৌথ উদ্যোগে দু'শ সত্তর মিলিয়ন রিংগিট ব্যয়ে ১৯৯২ সালে কুয়ালালামপুর টাওয়ার নির্মাণ করা হয়।
টুইন টাওয়ারটা কুয়ালালামপুর টাওয়ার থেকে একত্রিশ মিটার বেশি উঁচু হলেও কোনো কোনো দিক থেকে পর্যটকদের নিকট টুইন টাওয়ারের চেয়ে কুয়ালালামপুর টাওয়ার বেশি আকর্ষণীয়। কারণ, পূর্বানুমতি ছাড়াই টিকেট কেটে দর্শনার্থীরা কুয়ালালামপুর টাওয়ারে ওঠানামা করতে পারে। মাত্র সাত রিংগিত দিয়ে টিকেট কেটে যে কোনো পর্যটক এই টাওয়ারের চূড়ায় অবজারভেশন ডেকে আরোহণ করে চারদিক ঘুরে ঘুরে শহরের আকাশ ছোঁয়া সুরম্য ইমারত, দূরের পাহাড়, সবুজ বনভূমিসহ মেঘপরীদের ছুটাছুটি দর্শন করতে পারে। অবজারভেশন ডেকের ওপরও নিচের দিকে কয়েকতলা ফ্লাট টেলিকম বিভাগের কাজের জন্য সংরক্ষিত আছে। সাপুড়ের নাগিনবাঁশির মোটা অংশ উপরের দিকে রেখে খাড়া করে দাঁড় করালে দেখতে যেরকম হবে, মিনারা কুয়ালালামপুরটি দেখতে যেন অনেকটা সে রকম। দূর থেকে দেখলে সহসা মনে হবে, উল্টা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা প্রকা- এক নাগিনবাঁশি।
কুয়ালালামপুর টাওয়ারের অবজারভেশন ডেকে আরোহণ করে টেলিস্কোপে চোখ রেখে মেঘরাজ্যের ফাঁকে ফাঁকে দৃশ্যমান স্থাপনা ও প্রকৃতি কাছে এনে দেখলে পর্যটকের পর্যটন ব্যয় কিছুটা উসুল হয়ে যাবে। অবশিষ্ট পর্যটন ব্যয় উসুল হওয়ার মতো স্থান হাতে রাখা হলো। সময়মতো অবশ্যই উসুল করা হবে।
টুইন টাওয়ারের কাছাকাছি এ্যামপাং টাওয়ার নামে আরও একটি সুরম্য আকাশ ছোঁয়া ইমারত দেখা হবে। আশপাশে আরও হাইরাইজ ইমারত নির্মিত হচ্ছে। পাশাপাশি তিন তিনটি টাওয়ার যেন ঊর্ধ্বে গমনের জন্য সমসাময়িককালে প্রতিযোগিতা শুরু করেছে, যার মধ্যে এ্যামপাং টাওয়ার তৃতীয়, কুয়ালালামপুর টাওয়ার দ্বিতীয় ও পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার প্রথম স্থান লাভ করেছে। প্রতিযোগিতা শেষ হয়নি, আরও হাইরাইজ ইমারত নির্মিত হচ্ছে। সবকিছু দেখে শুনে মনে হয় বেঁটেখাটো মানুষগুলো আর নিচে থাকতে রাজি নয় প্রযুক্তি, স্থাপনা, শিল্প-বাণিজ্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি সব বিষয়ে যেন ঊর্ধ্বগমনের প্রতিযোগিতায় নেমেছে তারা।
টুইন টাওয়ারের দক্ষিণ দিকে সর্পিল আকারের একটি লেক। লেকের ওপর সারি সারি সজ্জিত পানির ফোয়ারা। তিন পাড়ে দুর্লভ বাহারী পাতার গাছ, ঘনকচি ঘাস, নানা বর্ণের ফুল। পড়ন্ত বেলায় একেক ফোয়ারা দিয়ে একেক গতিতে তীব্র বেগে পানি বের হওয়ায় সৃষ্ট ধূম্রকু-লীতে সূর্যালোক পতিত হয়ে রংধনুর সৃষ্টি হয়। অভূতপূর্ব এ স্বপ্নিল দৃশ্য রক্ত-মাংসে গড়া দু'চোখ দিয়ে দেখাদেখি না হলে জড়বস্তুর গড়া কলম দিয়ে লেখালেখি করে বিশ্বাস করানো যাবে না। লেকের পাড়ে সবুজ ঘাসের ওপর শরীর এলিয়ে দিয়ে ফোয়ারার পানির ভঙ্গিমাময় নাচানাচি দেখতে দেখতে সেকেন্ড মিনিট ও ঘণ্টা পেরিয়ে কখন সন্ধ্যা নামবে আপনি টেরই পাবেন না।
আমাদের মতো ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল মালয়েশিয়াও। এটি ৩১ আগস্ট ১৯৫৭ মুক্ত হয়। তাদের সংবিধানে ওই দিনটি তাদের স্বাধীনতা দিবস। সুকুমা রায় তার ছড়ায় মিল খুঁজতে গিয়ে কিংবা মালয়দ্বীপের অভাব ও বোকামির প্রতীক হিসাবে ছড়াটি লিখেছেন তা একমাত্র ছড়াকারই বলতে পারেন। তবে আমরা যতদূর জেনেছি, মালয় দ্বীপের শেয়ালের মাঝে না হলেও মানুষের মাঝে এক সময় জ্ঞানবিজ্ঞান ও খাদ্য দুটোর-ই অভাব ছিল। শত শত বছর পরাধীন থেকে তাদের মেরুদ- ভেঙ্গে গিয়েছিল। নাগরিকদের অধিকাংশই ছিল জেলে ও জোলা। আধুনিকতার ছোঁয়া থেকে তারা ছিল বঞ্চিত। অভাব ছিল নিত্য সহচর। গ্রাম এলাকার মালাইরা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া রাজ্যের প্যারাডাইজ এলাকার 'আমিস' সম্প্রদায়ের লোকজনের মতো, যাদের জীবন প্রণালী একেবারে সাদামাটা অনাড়ম্বর। আধুনিকতা বর্জিত পুরানো আমলের রীতি রেওয়াজ জীবন প্রণালী ধরে রাখতে এরাও পছন্দ করে।
এককালের জেলে জোলাদের মালয়দ্বীপটিই আজকের মালয়েশিয়া। এশিয়ার দেশ ছাড়িয়ে বিশ্বকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। বিশ্ব উন্নয়ন সূচিপত্রে তাদের সাফল্যের তালিকা হুহু করে বাড়ছে। উন্নয়নের জোয়ার বললে কম বলা হবে, মহাপ্লাবন বললেই মনে হয় ঠিক হবে। একদিন লম্-লমা সাগরের যেসব দ্বীপকে কালাপানির নির্বাসন দ্বীপ হিসাবে মনে করা হতো, যে-সব দ্বীপের নাম শুনলে ভয়ে গা ছমছম করত, ঘুম হতো না, আজ সেসব দ্বীপই পর্যটকদের তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে। পর্যটকরা এক সময়ের ভয়ঙ্কর দ্বীপ দর্শনে বর্তমানে ভয়ঙ্কর ক্রেজী হয়ে উঠেছে। তা লক্ষ্য করে সরকার হাত-পা গুটিয়ে বসে নেই। পর্যটনকে শিল্পের মর্যাদা দিতে ÔMalaysia Tourism Promotion Board (MTPB) গঠন করে অতিথি সেবার যাবতীয় আয়োজনসহ ‘সালামত ডেটাং' নাম ফলকযুক্ত তোড়ন উন্মুক্ত করে রেখেছে। লসএঞ্জেলস, নিউইয়র্ক, লন্ডন, স্টকহোম, প্যারিস, মিলান, জোহানেসবার্গ, ওসাকা, টোকিও, সিউল, হংকং, ব্যাংকক, সিঙ্গাপুরসহ ১৮টি দেশে মালয়েশিয়া ট্যুরিজম প্রমোশন বোর্ড এর ওভারসিজ প্রমোশন অফিস খুলে রেখেছে। ট্যুরিজম সেক্টরে উন্নয়নে সরকারি উদ্যোগ ছাড়াও বেসরকারি উদ্যোগে দেশে বিদেশে অনেক পর্যটন সংস্থা সফলতার সাথে কাজ করে যাচ্ছে। তাদের মাস্টার প্ল্যানের মাঝেও পর্যটন সংস্থাকে বিশেষ অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। আমাদের দশ বছর পর স্বাধীন হয়ে আজ তারা কোথায় আর আমরা কোথায়? এর পেছনে অবদান কার? ১৯৮১ সাল থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত ২৩ বছর মায়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মহাথির মোহাম্মদ। তার পন তিনি স্বেচ্ছোয় ক্ষমতা থেকে অবসরে যান। অবসর থেকে ফিরে এসে দলের বিরুদ্ধে গিয়ে বিরোধী দলের হয়ে ২০১৮ সালে তিনি আবার নির্বাচন করে প্রধানমন্ত্রী হন এবং ২০২০ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।২৫ বছর মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।
একবার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম তার বিরুদ্ধে দুর্ণীতির অভিযোগ তোলায় মহাথির মোহাম্মদ বলেছিলেন, ‘তিনি মহাথির মোহাম্মদ বর্তমাণ প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের সাথে সুইজারল্যান্ড যেতে চান। ওই দেশের কোন ব্যাংকে টাকা গচ্ছিত রেখেছেন দেখতে চায়।’ প্রমাণ পেলে এই অর্থ তুলে দেশবাসীকে দিয়ে দিবেন। মহাথির মোহাম্মদ ২৫ বছর মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে যে বেতন পেয়েছেন শুধু সেই অর্থই তার কাছে ছিল। পওে নির্বাচন করতে গিয়ে সেই অর্থও খরচ হয়ে যায়। ১৯৮১ সালে মহাথির মোহাম্মদ যখন প্রধানমন্ত্রী হন তখন তাঁর বেতন ছিল ৮ হাজার রিঙ্গিত(১ হাজার ৭০০ মার্কিন ডলার)। তাঁর ভাষায়, ‘ঐ বেতনই অনেক বেশি ছিল। আমাকে গাড়ি চালকসহ গাড়ি দেওয়া হয়েছিল। সরকার থেকে আমার বিড়–্যৎ পানির বিল দেওয়া হতো। অধমার কোনো কিছুর জন্যই অর্থ খরচ করতে হতো না। এমনকি উড়োজাহাজ ভাড়াও দিতে হতো না। প্রধানমন্ত্রী গিসেবে সরকার থেকে সব সুবিধা পেতাম। ২৯ বছরের বেশি সময় ধরে তাই আমি বেতনের অর্থ সঞ্চয় করতে পেরেছি।’(১২জুন ২০২৪ আল জাজিরা, প্রকাশ প্রধম আলো) মালয়েশিয়া ২০২০ সালে পৃথিবীর শীর্ষ তালিকাভুক্ত দেশের শ্রেণীভুক্ত হওয়ার লক্ষ্যে ১৯৯০ সালে কয়েকটি মাস্টার প্ল্যান হাতে নিয়ে পোস্ট-ডেট এর অনেক আগেই জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা (NDP) দেশটিকে লক্ষ্যস্থলে পৌঁছে দিয়েছে।
লেখক: আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক
২১ ডিসেম্বর ২০২৪
[email protected]