আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করাটাই হবে বড় সংস্কার
আওয়ামী লীগকে মাঠে নামানোর নেপথ্যের উসকানি

গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে প্রাণভয়ে দেশ ছেড়ে পালান আওয়ামী লীগ সভাপতি ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ফ্যাসিস্ট হাসিনা। এর মাধ্যমে দেশে সাড়ে ১৫ বছরের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটে। তবে মাত্র আট মাসের মাথায় আওয়ামী লীগ আবারও রাজনৈতিক মাঠে সক্রিয় হচ্ছে, যা নানা প্রশ্ন ও সন্দেহের জন্ম দিয়েছে।
রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে তাদের ঝটিকা মিছিল, গোপন সমাবেশের প্রস্তুতি এবং অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে নিয়মিত বিবৃতি জনমনে উদ্বেগ তৈরি করছে। কারা এ ফ্যাসিস্ট দলটির পুনরুত্থানের পেছনে মদদ দিচ্ছে এবং কীভাবে তারা এত দ্রুত সংগঠিত হচ্ছে—এ প্রশ্নগুলো এখন আলোচনার কেন্দ্রে।
নেপথ্যে কারা: প্রশাসন ও রাজনৈতিক শক্তির ভূমিকা
বিশ্লেষকদের মতে, আওয়ামী লীগের এ সক্রিয়তার পেছনে প্রশাসনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা তাদের সমর্থক এবং কিছু রাজনৈতিক দলের কৌশলগত সমর্থন রয়েছে। গণহত্যার মতো অপরাধের পরও দলটির নেতাকর্মীরা যেভাবে প্রকাশ্যে মিছিল করছে, তা প্রশাসনের ‘সবুজ সংকেত’ ছাড়া সম্ভব নয় বলে মনে করছেন অনেকে। পুলিশ ও সিভিল প্রশাসনের মধ্যে আওয়ামী লীগের ‘দোসররা’ কৌশলে উৎসাহ ও সমর্থন দিচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, গত শুক্রবার উত্তরায় ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আতিকুর রহমান মিলনের নেতৃত্বে ঝটিকা মিছিল অনুষ্ঠিত হয়, যা পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার কারণে সম্ভব হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
এছাড়া, কিছু রাজনৈতিক দলের নেপথ্য সমর্থনের কথাও উঠেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, তৃতীয় শক্তি বা ‘কিংস পার্টি’ প্রতিরোধে কিছু দল আওয়ামী লীগকে বিরোধী দল হিসেবে পুনর্বাসনের চক্রান্তে লিপ্ত। এমনকি আওয়ামী লীগকে সংসদে বিরোধী দল হিসেবে প্রতিষ্ঠার গভীর ষড়যন্ত্র চলছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এর ফলে জুলাই গণহত্যার বিচার ‘রাজনৈতিক মামলা’ হিসেবে আটকে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
দেশি-বিদেশি শক্তির ভূমিকা
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশের মতে, ভারত আওয়ামী লীগের পুনরুত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। মাফিয়া হাসিনার ভারতে আশ্রয় নেয়ার পর থেকে দেশটি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নানাভাবে উৎসাহ ও সমর্থন দিচ্ছে। এছাড়া, দেশি-বিদেশি কিছু শক্তি গোপনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলেছে। বিদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ কালোটাকা এবং আর্থিক বিনিয়োগের মাধ্যমে তারা আওয়ামী লীগকে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। এ শক্তিগুলো আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনের জন্য একাধিক ‘বিকল্প প্ল্যান’ নিয়ে কাজ করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
জাতীয় নাগরিক পার্টির মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ তার ফেসবুক পোস্টে বলেন, যেদিন থেকে আমাদের আওয়ামীবিরোধী অবস্থান এবং কম্প্রোমাইজের রাজনীতির বিরোধিতাকে ‘শিষ্টাচারবহির্ভূত’ বলা শুরু হয়েছে, সেদিন থেকেই আওয়ামী লীগের মিছিল বড় হতে শুরু করেছে। তিনি কম্প্রোমাইজের রাজনীতির বিরুদ্ধে সতর্ক করে বলেন, আওয়ামী লীগ নিয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত না নিলে পরিস্থিতি জটিল হবে।
আওয়ামী লীগের কৌশল: বিভেদ ও আপসরফা
আওয়ামী লীগ কৌশলগতভাবে জুলাই আন্দোলনের শক্তিগুলোর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টিতে সফল হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। স্থানীয় পর্যায়ে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ বড় দলগুলোর সঙ্গে আপসরফার মাধ্যমে তারা ধীরে ধীরে শক্তি সঞ্চয় করছে। এছাড়া, বিভিন্ন স্থানে বিএনপি, জামায়াত এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীদের ওপর আওয়ামী লীগ ও নিষিদ্ধ জঙ্গি ছাত্রলীগের হামলার ঘটনা ঘটছে। উদাহরণস্বরূপ, গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং চট্টগ্রামের ওয়াসা মোড়ে ছাত্রলীগের হামলার অভিযোগ উঠেছে। এসব ঘটনা আওয়ামী লীগের আগ্রাসী মনোভাব এবং রাজনৈতিক মাঠ দখলের প্রচেষ্টার ইঙ্গিত দেয়।
সরকার ও পুলিশের ভূমিকা
আওয়ামী লীগের ঝটিকা মিছিলের প্রেক্ষিতে সরকার নড়েচড়ে বসেছে। গত শনিবার ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ ছয়জন আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী পুলিশকে আওয়ামী লীগের মিছিল ঠেকানোর নির্দেশ দিয়েছেন। তবে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, যা আওয়ামী লীগের সক্রিয়তাকে উৎসাহিত করছে বলে মনে করা হচ্ছে।
নিষিদ্ধকরণের দাবি ও ভবিষ্যৎ ঝুঁকি
আওয়ামী লীগের পুনরুত্থান নিয়ে জনমনে ক্ষোভ বাড়ছে। জনগণ এবং রাজনৈতিক নেতারা দলটিকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানাচ্ছেন। ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক মুভমেন্টের চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ বলেন, ফ্যাসিজম যেন বাংলাদেশে আর দাঁড়াতে না পারে, সেজন্য আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতেই হবে। এটাই হবে বড় সংস্কার। তিনি সতর্ক করে বলেন, এটি না হলে দেশের মানুষকে ভবিষ্যতে খেসারত দিতে হবে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ না করলে নির্বাচনি তফশিল ঘোষণার পর তারা পুরোনো আগ্রাসী রূপে ফিরে আসবে। এটি দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে অশান্ত করবে এবং বিএনপি বা ভবিষ্যৎ জাতীয় সরকারকে ব্যর্থ করতে তারা একের পর এক ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করবে। জুলাই গণহত্যার বিচার বাধাগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি দেশ অস্থিতিশীলতার দিকে ধাবিত হতে পারে।
বিশ্লেষকদের মতামত
কোনও কোনও রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে না থাকলেও তাদের অপকর্মের মূলহোতাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। বিচার নিশ্চিত না হলে এ ধরনের অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটবে। তারা সরকারকে সতর্ক করে বলেন, আওয়ামী লীগের অপরাধীদের দায়মুক্তি দেয়া হলে দেশে ফ্যাসিজমের পুনরুত্থান ঘটতে পারে।
আওয়ামী লীগের পুনরুত্থানের পেছনে প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা, কিছু রাজনৈতিক দলের কৌশলগত সমর্থন এবং দেশি-বিদেশি শক্তির আর্থিক ও রাজনৈতিক মদদ স্পষ্ট। ভারতের ভূমিকা, কালোটাকার প্রবাহ এবং আপসরফার রাজনীতি দলটিকে নতুন করে শক্তি জোগাচ্ছে। জঙ্গি ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হলেও আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার বিষয়টি ঝুলে থাকায় তাদের সক্রিয়তা বাড়ছে। সময় থাকতে দলটিকে নিষিদ্ধ করা এবং অপকর্মের মূলহোতাদের বিচার নিশ্চিত না করলে জুলাই আন্দোলনের অর্জন বিপন্ন হবে। দেশ আবারও অশান্তি ও ফ্যাসিজমের কবলে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
সবার দেশ/কেএম