হিংসা - ঈর্ষা থেকে মুক্তির পথ
আগের আলোচনাতে আমরা আলোকপাত করেছি যে হিংসা-ঈর্ষার রয়েছে ঈমান বিধ্বংসী অশুভ প্রভাব। এখন আমরা দেখবো ঈমান বিধ্বংসী ঈর্ষা-হিংসা থেকে কীভাবে আমরা পরিত্রাণ পেতে পারি।
ঈর্ষা অন্তরের এমন একটি ব্যাধি যা নিজেকে তিলে তিলে নিঃশ্বেস করে ফেলে। হিংসা একজন ব্যক্তিকে সহজেই পতিত করে। এজন্যই বলে - হিংসা পতনের মূল। যে হিংসা করে তার অন্তর জ্বলতে জ্বলতে কয়লা হয়ে যায়; তার আমলনামা পুড়ে ছাই হয়ে যায়, আর যার প্রতি ঈর্ষা পোষণ করে তার সাথে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। পরিশেষে তার অনুতপ্ত হওয়া ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। তাই আত্মরক্ষা, নিজের প্রশান্তি ও নিজের সাফল্যের স্বার্থেই ঈর্ষা - হিংসা মুক্ত জীবন যাপন করা প্রয়োজন। আর এই জন্য প্রথমেই শোকরগুজার হতে হবে। নিজের যা আছে তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। অন্যের যা কিছু ভাল আছে কিন্তু নিজের নেই তার জন্যও স্রষ্টার শোকরিয়া আদায় করতে হবে। অন্তর থেকে বলতে হবে, হে স্রষ্টা তুমি তাকে কত ভাল রেখেছ, তাকে আরও ভাল রাখ। তুমিতো আমাকেও কত অফুরন্ত অনুগ্রহ ও নেয়ামতে ভাসিয়ে রেখেছ। এজন্য আমার শোকরিয়া গ্রহণ কর।
ঈর্ষা-হিংসা মুক্ত আত্মা পরিশুদ্ধ আত্মা। আর এই পরিশুদ্ধি অর্জন করতে হবে সচেতনভাবে। এ বিষয়ে রাসূল (সঃ) বলেন, তোমরা উপরের দিকে তাকিওনা যারা তোমাদের চেয়ে অধিক সম্পদ ক্ষমতার অধিকারী; নিচের দিকে তাকাও যারা তোমাদের চেয়ে দরিদ্র ও কম অনুগ্রহ প্রাপ্ত, কারন এটা তোমাদের প্রতি স্রষ্টার অনুগ্রহের কথা স্বরণ করিয়ে দিবে। (বুখারী ও মুসলিম)
ঈর্ষা যেহেতু নিজেকে ছোট, বঞ্চিত ভাবারই ফল, কখনো নিজেকে ছোট, বঞ্চিত, অবহেলিত ভাবা যাবে না। সব সময় নিজের সিদ্ধান্তে অটল অবিচল থাকতে হবে। নিজের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস বাড়াতে হবে, নিজের যোগ্যতার প্রমাণ রাখতে হবে দৃঢ়ভাবে, নিজের ও নিজের পেশার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ রাখতে হবে। তবেই অনেকাংশে হিংসামুক্ত থাকা সম্ভব।
কখনো নিজেকে অন্যের সাথে তুলনা করা যাবে না। যে আহা! আমার কত অভাব, আমি কত দুঃখী। আর অন্যরা কত সুখী। কী নেই ওর জীবনে এক জীবনে যা কিছু পাওয়ার সবই ওর আছে। এমনটি কখনো ভাবা যাবে না। বরং আমার যেমন অনেক কিছু নেই আবার অনেক কিছু আছে, ঠিক তেমনি তারও অনেক কিছু আছে আবার অনেক কিছুই নেই। তার অভাব আমার চেয়েও বেশী। কারণ যার যত বেশী আছে; তার অভাব তত বেশী, তার দুঃখ তত বড়।
ঈর্ষা মানুষকে এতটাই অন্ধ করে ফেলে যার ফলে সে বুঝতেই পারে না যে, সে হিংসুটে। হিংসা থেকে মুক্ত থাকতে হলে প্রথমে আমাকে বুঝতে হবে স্বীকার করতে হবে যে আমি ঈর্ষা নামক ব্যাধিতে আক্রান্ত। এই ব্যাধি আমাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। আমার দুনিয়া ও আখেরাত ধ্বংস করে দিচ্ছে। আমাকে সচেতনভাবে এই ব্যাধি থেকে ধীরে ধীরে মুক্ত হতে হবে। আর এই জন্য নিজেকে সৎ সঙ্গ, সৎ কর্ম ও সৎ চিন্তায় ব্যস্ত রাখতে হবে। অন্যের যা ভাল আছে তা নিজের জন্য প্রত্যাশা না করে নিজের যা আছে তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। আর নিজের যা আছে তার জন্য স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকতে হবে ও নিজেকে ধন্যবাদ দিতে হবে এই জন্য যে, আমি এতটুকু অর্জন করতে পেরেছি।
নিজের যা কিছু ভাল আছে, সহায় সম্পদ অর্থ আছে, বাবা-মা, স্ত্রী-পুত্র-কন্যা-পরিজন আছে, শারীরিক সুস্থতা, সুন্দর চেহারা, সুস্থ মস্তিস্ক ইত্যাদি সব কিছু কাগজে লিখে ফেলতে হবে। আমার কী কী যোগ্যতা আছে, যেমন আমি সুন্দর করে কথা বলতে পারি, ভালো রান্না করতে পারি, ভালো বাজার করতে পারি, সুন্দর করে পড়াতে পারি, অন্যকে বুঝতে পারি এরকম বহু যোগ্যতা আমার আছে। সবই কাগজে লিখতে হবে। তারপর এগুলোর জন্য সন্তুষ্টি প্রকাশ করতে হবে এবং সাথে সাথে নিজের অবস্থার আরও ভাল পরিবর্তনের জন্য, মানুষের সাথে সু-সম্পর্ক সৃষ্টির জন্য সক্রিয় চেষ্টা করতে হবে।
আমার চেয়ে নিচে যারা আছে তাদের সাথে আমাকে তুলনা করতে হবে। এখনও পৃথিবীতে এমন অনেক মানুষ যাছে যারা দরিদ্র সীমার নিচে বাস করছে। অন্ন, বস্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার মত মৌলিক চাহিদা থেকে বঞ্চিত, কতজন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছে, অথবা কত ধনীজন আছেন যাদের অর্থ ও খাবারের কোন অভাব নেই অথচ ডায়াবেটিসএ আক্রান্ত হয়ে কোন সুস্বাদু খাবারই খেতে পারছেন না। আমি তাদের চেয়ে কত ভাল আছি। আমি কত ভাগ্যবান।
অন্যের ঈর্ষা না করে আমার নিজের এমন কি আছে যার জন্য অন্যরা আমার প্রতি ঈর্ষা পোষণ করতে পারে তার একটি দীর্ঘ তালিকা তৈরী করি। তাহলে দেখা যাবে শোকরিয়ায় ভরে যাবে অন্তর। নিজের পায়ে জুতো না থাকায় দুঃখ প্রকাশ না করে; অন্যের যে পা-ই নেই সেদিকে খেয়াল করতে হবে। শোকরিয়া করতে হবে যে আমার তো অন্তত পা আছে, আমি তো দাঁড়াতে পারি, হাঁটতে পারি, দৌরাতে পারি, পৃথিবীর সৌন্দর্য ঘুরে ঘুরে উপভোগ করতে পারি।
দানশীল হতে হবে। নিজের যা আছে তা থেকে যাদের নেই তাদেরকে নিঃস্বার্থভাবে দান করতে হবে। তাহলে কিছুটা হলেও অন্যের চেয়ে নিজেকে বেশী অনুগ্রহ প্রাপ্ত মনে হবে। ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী হতে হবে। জীবনকে অনুধাবন করতে হবে বাস্তবতার নিরিখে। হতে পারে অনেকেই আছে যারা দৃশ্যত আমার চেয়ে ভাল; আবার দৃশ্যত আমিও অনেকের চেয়ে ভাল আছি। আবার এভাবেও ভাবতে পারি, যারা মনে করে আমি অনেক ভাল আছি; তারা আমার হৃদয়ের ভেতরে জমে থাকা কষ্টগুলোর কথা জানে না, আমার কত অতৃপ্তি, কত হাহাকার এ খবর তারা রাখে না। একই ভাবে আমি যাদেরকে মনে করি যে তারা আমার চেয়ে অনেক ভাল আছে; তাদের কষ্টগুলোও আমি জানি না।
অতএব ঈর্ষা কার সাথে করব? কি নিয়ে করব? কেন করব? ঈর্ষার তো কোন ভাল দিক নেই। তবে কেন এই হিংসা-ঈর্ষা দ্বারা নিজের ইহকাল ও পরকাল পস্তাব? মহান স্রষ্টা আমাদেরকে ঈর্ষা-হিংসা মুক্ত শুদ্ধ অন্তরের অধিকারী করুন।
লেখক: উপাধ্যক্ষ, কসমো স্কুল অ্যান্ড কলেজ