ঈমান ও আমলে সালেহের গুরুত্ব

একজন মুসলিম হিসেবে পরিচয় দেয়ার প্রধান ভিক্তি হলো ঈমান আনা। ঈমান আনা ব্যতীত কেউ নিজকে মুসলিম দাবি করতে পারে না। তাই একজন মুসলমানের জীবনে ঈমান অত্যন্ত মূল্যবান সম্পদ। আর আমল ছাড়া ঈমান মূল্যহীন।
আসুন ঈমান ও আমলে সালেহ এর পরিচয় জেনে নেই।
ঈমান একটি আরবি শব্দ। শব্দটির মূল অর্থ বিশ্বাস করা, স্বীকৃতি দেয়া এবং বিশ্বস্ততা বা হৃদয়ের স্থিতি। এছাড়াও আনুগত্য করা, অবনত হওয়া, নির্ভর করা, স্বীকৃতি দেয়া অর্থেও শব্দটি ব্যবহৃত হয়।
মূলত ঈমান হচ্ছে স্বীকারোক্তি এবং আমলের নাম। অর্থাৎ অন্তর ও জবানের স্বীকারোক্তি এবং অন্তর, জবান ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কর্মকে ঈমান বলা হয়।
ঈমানের মূল পরিচয় একটি হাদিসে সহজভাবে বিবৃত হয়েছে। আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেছেন, একবার হজরত জীবরাঈল (সা.) মানুষের বেশে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সামনে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ঈমান কী? তিনি উত্তরে বলেন, আল্লাহর প্রতি, তাঁর ফেরেশতাগণের প্রতি, তাঁর পুস্তকগুলো (আসমানী কিতাব), তাঁর সাক্ষাতে, তাঁর রাসুলদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা এবং শেষ দিবসে পুনরুত্থান ও তাকদিরের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন। (বুখারি হাদিস)
এ হাদিস থেকে বুঝা যায়,ছয়টি বিশ্বাসের উপর ঈমান প্রতিষ্ঠিত-১. আল্লাহ, ২. ফেরেশতাগণ, ৩. আসমানী কিতাবসমূহ, ৪. রসূলগণ, ৫. শেষ দিবস এবং ৬. ভাগ্যের ভাল-মন্দের প্রতি ঈমান আনা।
ইমাম আবু হানিফা (র.) বলেছেন, ‘ইমান হচ্ছে অন্তরের সত্যায়ন ও মুখের স্বীকৃতি।’
ইমাম শাফেয়ি, মালেক ও আহমদ ইবনে হাম্বল (র.)-র মতে, ‘অন্তরের বিশ্বাস, মৌখিক স্বীকৃতি এবং আমলে বাস্তবায়ন করার নাম ইমান।’
আর ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায়,অন্তরে বিশ্বাস করা, জবান দ্বারা স্বীকৃতি দেয়া এবং সে মোতাবেক কাজে বাস্তবায়ন করার নাম ঈমান।
সুতরাং উপরিউক্ত আলোচনা থেকে একথা বলা যায়, কথা ও কাজের নামই হলো ঈমান।
আমল’ عمل মানে- কর্ম ও আচরণ। صَلَحَ শব্দের অর্থ হলো ভালো, উত্তম, উৎকৃষ্ট, সৎ, সঠিক, যথার্থ, গ্রহণযোগ্য, আল্লাহ নির্দেশিত, সর্বজন স্বীকৃত ন্যায্য ও বাস্তব কর্ম ইত্যাদি।
সাধারণত কুরআনের অনুবাদে আমলে সালেহ অর্থ করা হয়, ‘নেক আমল’ বা ‘ভালো কাজ’ বা ‘সৎকাজ’। সুতরাং ঈমানের মধ্যেই রয়েছে আমলে সালেহ। সহজভাবে বললে,আমলে সালেহ মূলত ঈমানেরই শাখাপ্রশাখা। শাহ অলী উল্লাহ দেহলভী রহ. এর মতে,প্রতিটি ভালো কাজই ঈমানের অঙ্গ।
মানুষের পরকালীন মুক্তি ও নিষ্কৃতি যে দু’টি জিনিসের ওপর নির্ভরশীল। এর প্রথমটি হচ্ছে ঈমান এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে আমলে সালেহ বা নেক আমল।
এককথায় যদি বলতে হয়, ঈমান হচ্ছে আল্লাহ পাকের দেয়া বুনিয়াদি বিধি-বিধানের ওপর পরিপূর্ণভাবে বিশ্বাস স্থাপন করার নাম। আর আমলে সালেহ হচ্ছে সে বিধানাবলি অনুসারে আমল করা ও এগুলোর বাস্তবায়ন করা। যেভাবে একটি ইমারত ভিত্তি ছাড়া প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না, তেমনি দেয়াল ও স্তম্ভ ছাড়াও সে ইমরাত দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। ঈমান হচ্ছে সে ভিত্তি বা বুনিয়াদ আর আমলে সালেহ বা নেক আমল হচ্ছে-এর ওপর প্রতিষ্ঠিত দেয়াল ও স্তম্ভ।
আল্লাহ তায়ালার বান্দা হিসাবে প্রতিটি মুসলমানের কাংখিত স্বপ্ন থাকে জান্নাতে যাওয়া। কিন্তু একজন মুসলমানের জীবনে ঈমান ও আমলে সালেহ-এ দুই এর পারস্পরিক সেতুবন্ধন যদি মজবুত ও সুদৃঢ় না হয় , তাহলে দুনিয়ায় হয়তো আমরা মুসলিম হিসেবে পরিচয় দিয়ে পার পেয়ে যাবো কিন্তু আল্লাহ তায়ালার সামনে নিজকে মুমিন হিসেবে পরিচয় দেবার হিসাব খুব কঠিন হয়ে যাবে। আর জান্নাতে যাওয়া তো আরও পরের কথা!
একজন মুসলিমের ঈমান কতটুকু মজবুত তা তার আমলে সালেহ এর ধরন দেখেই বুঝা যায়। তাই যার ঈমান যত মজবুত তার আমেল সালেহ এর খুঁটি তত সুদৃঢ়।আর যার আমলে সালেহ এর ব্যপ্তি যত তার ঈমানের খুঁটির জোরও তত মজবুত। একারনেই বলা হয় যে, ঈমান ও আমলে সালেহ পরস্পর পরস্পরের পরিপূরক ও একটি আরেকটির অবিচ্ছেদ্য অংশ।
বীজ ও চারার মধ্যে যে সম্পর্ক,ঈমান ও আমলে সালেহের মধ্যে সে সম্পর্ক বিদ্যমান।বীজ মাটিতে রোপন করার পর যদি তার যত্ন না নেওয়া হয়, তাহলে সে বীজ নষ্ট হয়ে যায়।ফলে বীজ থেকে চারা বের হয় না। ঠিক তেমনি ঈমান আনার পর যদি তা আমলে সালেহ রূপে প্রকাশিত না হয়, তাহলে বুঝতে হবে তার ঈমান যথার্থ অর্থে ঈমান ছিলো না।
মানুষের মুক্তি ও সফলতার জন্য আল কোরআনের সর্বত্রই প্রথম ঈমানকে এবং তারপর নেক আমলকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছে:
‘কালের শপথ! প্রকৃতই মানুষ ক্ষতিগ্রস্ততার মাঝে নিমগ্ন; কিন্তু তাদের ছাড়া, যারা ঈমান এনেছে এবং নেক আমল করেছে।’ (সূরা আসর : ১,২)।
মহান আল্লাহ বলেন,
‘যারা ঈমান এনেছে এবং নেক কাজ করেছে আল্লাহ ওয়াদা দিয়েছেন, তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও মহাপুরস্কার’(সুরা মায়েদা :৯)
মহান আল্লাহ আরও বলেন,
‘নিশ্চয় যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে, তাদের মেহমানদারির জন্য রয়েছে জান্নাতুল ফেরদাউস।’(সুরা কাহাফ:১০৭)
মুসলিম উম্মাহর জন্য রাসূল সা. হলেন আমেল সালেহ এর উজ্জ্বল আদর্শ। আবু জার (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমার হাস্যোজ্জ্বল মুখ নিয়ে তোমার ভাইয়ের সামনে উপস্থিত হওয়া তোমার জন্য সদকাস্বরূপ। তোমার সৎকাজের আদেশ এবং তোমার অসৎকাজ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ তোমার জন্য সদকাস্বরূপ। পথহারা লোককে পথের সন্ধান দেওয়া তোমার জন্য সদকাস্বরূপ, স্বল্পদৃষ্টিসম্পন্ন লোককে সঠিক দৃষ্টি দেওয়া তোমার জন্য সদকাস্বরূপ। পথ থেকে পাথর, কাঁটা ও হাড় সরানো তোমার জন্য সদকাস্বরূপ। তোমার বালতি দিয়ে পানি তুলে তোমার ভাইয়ের বালতিতে ঢেলে দেয়া তোমার জন্য সদকাস্বরূপ।’ (তিরমিজি, হাদিস)
কাজেই আমরা যদি শুধু মুখে ও অন্তরে ঈমান আনি অথচ কর্মে তা বাস্তবায়ন না করি তাহলে আমাদের ঈমান প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যাবে। আমরা দুনিয়া ও আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাবো। যেমন,পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় সালাত মুমিনদের উপর নির্দিষ্ট সময়ে ফরয।’(সুরা নিসা:১০৩)
রাসূল সা. বলেছেন, ‘সে ব্যক্তিই হচ্ছে প্রকৃত মুসলমান যার হাত ও মুখ থেকে ওপর মুসলমান নিরাপদ থাকে।’(বুখারী হাদিস)
আমরা জানি কিন্তু কুরআন ও হাদিস অনুযায়ী কি তা আমল করি? অথচ আমরা দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে আল্লাহ তায়ালার কাছে সুরা ফাতিহা তেলাওয়াত করে সাক্ষ্য দেই- ‘আমরা তোমারই ইবাদত করি ও তোমারই কাছে সাহায্য প্রার্থনা করি’!
মনে রাখতে হবে, ঈমানের ৬ টি পিলারকে যে ব্যক্তি মুখে ও অন্তরে বিশ্বাস করে এবং কাজেও তা বাস্তবায়ন করে সে হচ্ছে মুমিন। আর যে ব্যক্তি মনে বিশ্বাস করে কিন্তু আমলে তা বাস্তবায়ন করে না, সে ব্যক্তি জালেম। আর যে ব্যক্তি মনে বিশ্বাস করে না কিন্তু বাহ্যিকভাবে প্রকাশ করে যে বিশ্বাসী সে মুনাফিক। আর যার কথা, কাজে ও অন্তরে কিছুই কাজ করে না সে কাফের।
কাজেই আমরা আল্লাহর উপর ঈমান এনেছি বললেই হবে না, আমলে সালেহের মাধ্যমে তা যদি বাস্তবায়ন না করা যায়, তাহলে বিচারের দিন আল্লাহ তায়ালার সামনে আমরা কি অবস্হায় দাঁড়াবো মুমিন, জালেম,- মুনাফেক নাকি কাফের?
আর ঈমান আনার পর আমরা মুসলিম, এ পরিচয় তখনই আল্লাহর কাছে গ্রহনযোগ্যতা পাবে যখন আমরা মুমিনের পরিচয় দিতে পারবো। আর মুমিন তো তারাই যারা আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করে।
মহান আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ মুমিনদের অভিভাবক’(সুরা আলে ইমরান:৬৮)
মহান আল্লাহ আমাদের ঈমান ও আমলে সালেহ সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যমে প্রকৃত মুমিন হবার তৌফিক দিন।
গ্রীনরোড,ঢাকা