আত্মশুদ্ধি কী ও কেন?
মানব জাতীর শিক্ষা ও কল্যাণের জন্য মহান স্রষ্টা যুগে যুগে কালে কালে নবী রাসুলদের প্রেরণ করেছেন। সকল নবী রাসূলদেরই প্রথম কাজ ছিল তাওহিদের বাণী প্রচার করা। অর্থ্যাৎ আল্লাহ এক ও অদ্ভিতীয় এই বিশ্বাস মানুষের মনে স্থাপন করা। একইভাবে প্রত্যেকেরই অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল মানুষের আত্মশুদ্ধি অর্জনের পথ দেখানো। অর্থাৎ কী কাজ, কী চিন্তা মানুষের আত্মাকে বিশুদ্ধ করে আর কী কাজ, কী চিন্তা মানুষের আত্মাকে কলুষিত করে এ শিক্ষা দেয়া।
এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘এজন্যেই আমি তোমাদের মধ্য থেকে একজনকে রসূল মনোনীত করে তোমাদের কাছে পাঠিয়েছি, যে আমার সত্যবাণী তোমাদেরকে শোনায়, তোমাদের জীবনকে পরিশুদ্ধ করে, কিতাব ও হিকমা শিক্ষা দেয়। আর তোমাদের সেই সত্যসমূহ জানায়, যা তোমরা জানতে না।’ – সূরা আল বাকারা, আয়াত : ১৫১।
আবার পবিত্র কোরআনে সূরা আলে-ইমরান এর ১৬৪ নং আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন, ‘বিশ্বাসীদের প্রতি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ এই যে, তিনি তাদের মধ্য থেকে একজনকে রসূল হিসেবে পাঠিয়েছেন। সে আল্লাহর আয়াত (বিধিবিধান) তাদের পাঠ করে শোনায়, তাদের অন্তরকে পরিশুদ্ধ (মনকে দূষণমুক্ত) করে আর তাদের কিতাব ও হিকমা শিক্ষা দেয়। যদিও তারা ইতঃপূর্বে স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে নিমজ্জিত ছিল।’
উপরোক্ত আয়াত দু’টি থেকে এটা সুস্পষ্ট যে, মহান আল্লাহ তায়ালা নবী – রসুল পাঠানোর পেছনে যে সকল কারণ রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম একটি উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের আত্মার পরিশুদ্ধি করা। আয়াত দুটোতে আরও যে বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বলা হয়েছে তা হলো দুনিয়া ও আখেরাতের সাফল্যের জন্য জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি আত্মার পরিশুদ্ধি অর্জন করা আবশ্যক। আত্মার পরিশুদ্ধিই হচ্ছে আত্মাকে ঢেলে সাজানো। আর যার মধ্যে সঠিক জ্ঞান নেই ও যে আত্মা পরিশুদ্ধ নয় সে সুস্পষ্ট গোমরাহীতে, অবিদ্যায়, ভ্রান্তিতে নিমজ্জিত।
আত্মশুদ্ধি লাভের বিপরীত হচ্ছে কলূষতা। কলুষিত আত্মা স্রষ্টার অবাধ্যতা ও পাপে জর্জরিত। এরূপ আত্মা দুনিয়াতে অশ্রদ্ধার পাত্র আখেরাতেও শান্তির পরিবর্তে শাস্তি অবধারিত।
আত্মশুদ্ধি ইসলাম ধর্মের একটি অন্যতম মৌলিক শিক্ষা। দুনিয়া ও আখেরাতের চুড়ান্ত কল্যান লাভের জন্যই আত্মার পরিশুদ্ধি প্রয়োজন। মানুষের আত্মার পরিশুদ্ধিই ছিল নবী – রাসূল, ওলী বুযর্গ, মুনী, ঋষিদের অন্যতম মিশন। পবিত্র কোরআন ও হাদীসে প্রদর্শিত পথই হচ্ছে আত্মার প্রকৃত পরিশুদ্ধি অর্জনের পথ। তাই আত্মার পরিশুদ্ধি নিয়ে আলোচনা মানেই হচ্ছে পবিত্র কোরআন ও হাদীসের মূল শিক্ষা ও প্রদর্শিত সহজ সরল পথ নিয়ে আলোচনা।
প্রতিটি মানুষ পরিশুদ্ধ আত্মা নিয়েই পৃথিবীতে আসে। কিন্তু এ সংসার জগতের বিভিন্ন চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে অবিদ্যার অভিশাপ ও ভুল দৃষ্টিভঙ্গির কারণে সে আত্মাকে কলুষিত করে ফেলে। কারণ সাধারণের ধারণা দুনিয়ার শান-শওকতই সাফল্যের মানদন্ড। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে সূরা আশ শামস এর ৯ – ১০ আয়াতে অল্লাাহ সোবহানাহু তায়ালা বলেন, ‘অতএব যে নিজেকে পরিশুদ্ধ করেছে সে-ই সফল, আর যে নিজেকে কলুষিত করেছে সে-ই ব্যর্থ।’ অর্থাৎ, মানুষের প্রকৃত সাফল্য নির্ভর করে আত্মার পরিশুদ্ধতার উপর। এর ব্যাতিক্রম হলেই সে ব্যর্থ।
নবী (সঃ) তার প্রার্থনায় বলতেন, ‘হে আল্লাহ তুমি আমাকে পবিত্রতা ও আত্মশুদ্ধি দান কর। একমাত্র তুমিই তা সর্বোত্তম করতে পার কারণ তুমি এর প্রভু।’
সূরা আল আ’লা এর ১৪ নম্বর আয়াতে মহান রাব্বুল আল আমীন বলেন, ‘নিশ্চয়ই যে নিজেকে পরিশুদ্ধ করে, সবসময় প্রতিপালকের স্মরণ করে এবং নামাজ কায়েম করে, সে ব্যক্তিই সুখী ও সফল।’ দুনিয়া ও আখেরাতে সুখী হওয়ার জন্যে, সফল হওয়ার জন্যে সদা সর্বদা স্রষ্টার স্বরণ যেমন আবশ্যক, নামাজ কায়েম যেমন আবশ্যক, আত্মশুদ্ধি অর্জনও তেমনই আবশ্যক।
মহানবী (সঃ) বলেন, ‘মানুষের নৈতিকতা বা অনৈতিকতা শুরু হয় অন্তর থেকে। যদি অন্তর পরিশুদ্ধ হয় তো সে পরিশুদ্ধ; আর যদি অন্তর কলুষিত হয় তো সে কলুষিত’। একইভাবে রাসূল (সঃ) অন্যত্র বলেন, ‘মানুষের শরীরে এক টুকরো মাংস রয়েছে। এটা যদি পরিশুদ্ধ হয় তো সমস্ত শরীর পরিশুদ্ধ; আর এটা যদি কলুষিত হয় তো সমস্ত শরীর কলুষিত। আর এটা হচ্ছে আত্মা।’ (বুখারী শরিফ)।
মুসলিম শরীফ ও তিরমীজি শরিফের এক হাদীস অনুযায়ী , একজন মানুষ যখন পাপকর্ম করে তার অন্তরে কালো দাগ পড়ে। অর্থাৎ আত্মা কলুষিত হয়। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে সূরা আল – মুতাফ্ফিফীন এর ১৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন, ‘কক্ষনোই নয়, বরং এ লোকদের অন্তরে এদেরই পাপ কাজের মরিচা জমে গেছে।’ অর্থাৎ মানুষের প্রতিটি কাজ সরাসরি আত্মাকে প্রভাবিত করছে। হয়তো বিশুদ্ধ করছে; নয়তো আত্মাকে কলুষিত, অসুস্থ করছে।
সূরা আশ্ শু’আরা এর ৮৮ থেকে ৮৯ আয়াতে মহান আল্লাহ বিশুদ্ধ আত্মার বিষয়ে চুড়ান্ত ভাবে বলে দেন যে, ‘সেদিন অর্থ বিত্ত, সন্তান সন্ততি কোন কাজে আসবে না। সেদিন বিশুদ্ধ অন্তর নিয়ে যে আল্লাহর কাছে হাজির হবে, সে-ই সার্থক হবে।’
পরম করুনাময় আল্লাহ তায়ালা মানুষকে তার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি ও প্রতিনিধি করে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। কিন্তু অবিদ্যা ও ভুল দৃষ্টিভঙ্গির জন্য মানুষ এমন আচরণ করে যার ফলে সে পশুতুল্য এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট জীবে পরিণত হয়।
একজন মানুষের আচরণ হচ্ছে তার বিশ্বাস বা দৃষ্টিভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ। কোন একজনের নেতিবাচক আচরণই প্রমান করে যে সে জীবন ও জীবনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে ভুল ধারনা পোষণ করে। ব্যাক্তিগত জীবনে সে চরম ভাবে ব্যর্থ ও হতাশ। পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে সে অনাকাঙ্খিত ও অশ্রদ্ধার পাত্র। এমনিক স্রী-সন্তানরাও তাকে অশ্রদ্ধা করে, ভয় পায় ও তার কাছ থেকে যতদূর সম্ভব দূরে থাকে।
নেতিবাচকতা কখনো কোন কল্যান বয়ে আনতে পারে না। কর্মক্ষেত্রেও রয়েছে এর সূদুর প্রসারী কুফল। একজন ব্যাক্তি যখন নিজেকে অপেক্ষাকৃত দূর্বল, অযোগ্য ও কম গ্রহনযোগ্য মনে করে তখনই মূলত তার নেতিবাচক আচরণের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ব্যাক্তিগত ও পারিবারিক জীবনের কোন সমস্যা যেমন কর্মক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে; কর্মক্ষেত্রের ও সামাজিক সমস্যাও পরিবার ও ব্যাক্তি জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
নেতিবাচক আচরণগুলো হচ্ছে জীবন ঘণিষ্ঠ শত্রু। এগুলো হলো হৃদয় বা আত্মার রোগ। আর হৃদয় বা আত্মাকে রোগমুক্ত করাই হলো স্রষ্টার প্রতি মানুষের কর্তব্য। এই শত্রু আমাদের নিজেদের মধ্যেই অবস্থান করে আমাদের জীবনকে হতাশ, ব্যর্থ, অর্থহীন ও নিরানন্দময় করে তোলে ও আত্মাকে কলুষিত করে।
নবী – রসূলদের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল অদৃশ্য এই শত্রু থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা তথা আত্মাকে বিশুদ্ধ রাখা। আমরা প্রথমে এই জীবন ঘণিষ্ঠ শত্রুগুলোর সাথে একে একে পরিচিত হব ও দেখার চেষ্টা করব কীভাবে এগুলো আমাদের জীবনকে প্রভাবিত করছে, আত্মাকে কলুষিত করছে। তারপর দেখব কীভাবে আমরা এই সর্বনাশী শত্রুর কাছ থেকে মুক্ত হয়ে সুন্দর, সফল, প্রশান্তি ও অর্থপূর্ণ জীবন যাপন করতে পারি তথা বিশুদ্ধ চিত্ত বা আত্মার অধিকারী হতে পারি।
আসলে আমাদের নিজেদের স্বার্থে, নিজেদের অনন্ত কল্যাণ নিশ্চিত করণের জন্যেই আত্মশুদ্ধি লাভ করার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চালাতে হবে। আর এ বিষয়টিই মহান স্রষ্টা সূরা আনকাবুত এর ৬ নম্বর আয়াতে এভাবে বলেন, ‘যে ব্যক্তি (আত্মশুদ্ধির জন্যে) প্রাণান্ত প্রয়াস চালায়, সে তা নিজের কল্যাণের জন্যেই করে – কর্মের সুফল সে-ই ভোগ করবে। আল্লাহ কারো মুখাপেক্ষী নন।’
মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে পরিশুদ্ধ আত্মার অধিকারী হওয়ার তৌফিক দান করুন। আমীন।
লেখক: উপাধ্যক্ষ, কসমো স্কুল অ্যান্ড কলেজ