ঈর্ষা-হিংসার রয়েছে ঈমান বিধ্বংসী অশুভ প্রভাব
হিংসা, ঈর্ষা, ঘৃণা এগুলো হলো নেতিবাচক আবেগ। অন্যের ভালো দেখলে যদি নিজের ভেতরে কোন কষ্ট, হাহাকার সৃষ্টি হয় সেটাই হিংসা বা ঈর্ষা। হতে পারে এমন যে আমি দারিদ্রতায় জীবন যাপন করছি, অথচ আমার শৈশবের সহপাঠি অনেক টাকা কড়ির মালিক হয়ে গিয়েছে। আমি কিছু্ই করতে পারলাম না, অপরদিকে আমার ভাই বাড়ি, গাড়ী, ফ্ল্যাট সবই করেছে। আমার টিনশেড বাড়ীর উল্টোপাশে আমার ভাইয়ের ৬ তলা বিল্ডিং।
আমার সন্তান জিপিএ-৫ পায়নি, অথচ আমার প্রতিবেশীর সন্তান জিপিএ-৫ পেয়েছে। এমন প্রতিটি ক্ষেত্রে আমার না থাকা, না পাওয়া, না হওয়ার যে কষ্ট তার চেয়ে বেশী কষ্ট কী এ জন্যে যে অন্যের আছে, অন্যরা পেয়েছে, অন্যের হয়েছে? নিজের না থাকাটা যতো না কষ্টের, তারচেয়ে বেশি কষ্ট এ জন্যে যে আমার যা নেই, অন্যের তা আছে? যদি এমন অনুভূতি হয় বুঝতে হবে যে আমি ঈর্ষাকাতর।
স্রষ্টা কাউকে কিছু দিয়ে পরীক্ষা করেন আবার কাউকে না দিয়ে পরীক্ষা করেন। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের সূরা আন-নিসা এর ৩২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে বিশ্বাসীগণ! যে-সব বিষয়ে আল্লাহ তোমাদের একে অপরের তুলনায় অতিরিক্ত অনুগ্রহ ও সুযোগ-সুবিধা দান করেছেন, তোমরা সে ব্যাপারে লোভাতুর হয়ো না।---’
একসাথে বেড়ে ওঠা দুই বোন। এক প্লেটে ভাগাভাগি করে খেয়ে, একের পোষাক অন্যে পড়ে, একই খাটে ঘুমিয়ে, একই সাথে খেলাধূলা-লেখাপড়া করে একই পরিবারে বড় হয়েছে। কিন্তু যখন দেখা যায় যে ছোট বোনের স্বামী বড় বোনের স্বামীর চেয়ে বেশি বেতন পায়, উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা, সফল ব্যবসায়ী তখন ভেতরে ভেতরে কেমন একটা কষ্ট বোধ হয়। এটাই হিংসা বা ঈর্ষা। আবার স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই কর্মজীবি। যদি এমন হয় যে স্বামীর চেয়ে স্ত্রী বেশি বেতন পাচ্ছেন বা পদ-পদবীতে স্বামীর চেয়ে স্ত্রী বেশি ওপরে; এরূপ ক্ষেত্রেও অনেক সময় স্ত্রীর প্রতি স্বামী ঈর্ষাকাতর হন।
যদি এমন হয় যে, আমার সামনে আমার কোন এক ভাই বা বোন সম্পর্কে খুব ভালো ভালো কথা বলা হচ্ছে। তখন ইচ্ছে করে সে কথায় অমনোযোগী থাকা বা এমন ভাব করা যে তার সম্পর্কে যে ভালো ভালো বলছ তা আমার জানা নেই বা এ প্রথম শোনলাম। অথবা এমন মন্তব্য করা, ‘ও আচ্ছা এতটুকু ভালো? অমুকে এর চেয়েও ভালো।’ যদি এমন হয় তাহলে বুঝতে হবে যে তার প্রতি আমি ঈর্ষান্বিত।
অপরের বিষয়-আশয়, প্রভাব-প্রতিপত্তি, সম্মান-সাফল্যের প্রতি আমাদের অদম্য উৎসাহ কাজ করে। যেমন অমুক এত টাকার মালিক কীভাবে হলো? অমুকের বাড়িটি দেখতে খুবই মনোরম - এটা কীভাবে বানালো? অমুকের এত সুন্দর গাড়ী কোত্থেকে এলো? কীভাবে অমুক এত আয়েশী জীবন কাটাচ্ছে? অমুকের সন্তান এত ভালো রেজাল্ট - ভালো চাকরি কীভাবে পেলো? এভাবেই অন্যকে নিয়ে আমাদের যত চিন্তা ও কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অন্যের জিনিস যখন নিজের জিনিসের চেয়ে বেশী মনোরম মনে হবে এবং এ জন্য ভেতরে চাপা একটা কষ্ট বোধ হবে তখন বুঝতে হবে আমি ঈর্ষাকাতর হয়ে পড়েছি।
হয়তো দুই বন্ধু একসাথে কোথাও গেলাম। দেখা গেলো যে সেখানে আমার চেয়ে আমার বন্ধুকে বেশী গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে, তাকে বড় চেয়ারে বসতে দেয়া হচ্ছে, ভাল খাবার দেয়া হচ্ছে, বাতাস করা হচ্ছে কিন্তু আমাকে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে, এরুপ ক্ষেত্রে আমার মনের প্রতিক্রিয়া কী হয়? আমি কী অন্তর থেকে তার এ গুরুত্বের স্বীকৃতি দিতে পারছি? না পারলে বুঝতে হবে তার প্রতি আমি ঈর্ষা কাতর। কখনও কখনও এমনও হয় যে, আমার সন্তান যখন বলে যে, অমুকের বাবা তাকে কত দামী দামী খেলনা কিনে দেয়, প্রতি সপ্তাহে রেষ্টেুরেন্টে খেতে নিয়ে যায়, প্রতি বছর বিদেশে বেড়াতে নিয়ে যায় তুমি কেন আমাকে এসব দাওনা? তখন অমুকের বাবা ঘুষ খায়, সুদ খায়, অসদুপায় অবলম্বন করে টাকা কামায় এসব বলি কী? বললে বুঝতে হবে অমুকের বাবার প্রতি আমি হিংসা পোষণ করছি।
হিংসা করা মূলত হিংসুকের জন্যই ক্ষতিকর। দুনিয়া ও আখেরাত উভয় কালের জন্যই হিংসার রয়েছে অশুভ প্রভাব। এটি একটি আত্মঘাতী নেতিবাচক আবেগ। হিংসা মানেই হচ্ছে একটি অশুভ প্রতিক্রিয়া। হিংসার অর্ন্তজ্বালার প্রভাবে সে শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর তার সকল সৎকর্মকে হিংসার আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ভস্মবানিয়ে দেয়। অথচ যার প্রতি হিংসা বা ঈর্ষা পোষণ করা হয় তার কোন ক্ষতিই হয়না।
আরও পড়ুন>> টেনশন: সুখী জীবনের অন্তরায়
হিংসার একটি প্রকাশ হচ্ছে এমন যে, যার প্রতি হিংসা পোষণ করা হয়, সে যখন কোন দুঃখ কষ্ট বা দুদর্শায় পতিত হয় তখন হিংসুক খুব খুশি হয়। আর সে কোন উন্নতি বা কল্যাণ লাভ করলে অর্থাৎ কোন নেয়ামতের প্রাচুর্য তাকে স্পর্শ করলে হিংসুক তখন দুঃখে ভারাক্রান্ত হয়। তারা এমনকি নিজের এমন সাফল্যও চায় না, নিজের যে সাফল্যের জন্য অন্যের সাফল্যের সুযোগ থাকে।
কাউকে যদি এমন একটি ব্যবসার প্রস্তাব দেয়া হয় যে, তোমার যদি ১ টাকা লাভ হয় তো তোমার ভাই লাভ করতে ২ টাকা। এভাবে তুমি যত ইচ্ছা লাভ করতে পারো। আর তোমার লাভের দ্বিগুণ লাভ করবে তোমার ভাই। আবার এমন একটি ব্যবসা করতে পারো যে তোমার যত ক্ষতি হবে তার দ্বিগুণ ক্ষতি হবে তোমার ভাইয়ের। এরূপ ক্ষেত্রে হিংসুটে লোক নিজের লাভের চেয়ে ভাইয়ের দ্বিগুণ লাভ সহ্য করতে পারে না বলে , নিজে লাভ করার পরিবর্তে নিজের ক্ষতি হয় এমন ব্যবসায় জড়িত হয় কারণ তার ক্ষতির দ্বিগুণ ক্ষতি হবে তার ভাইয়ের। আর সেটাই তাকে তুষ্ট করে।
একটি গল্প আছে যে, দুই ভাই মরুভূমিতে প্রচন্ড রোদের তাপে তৃষ্ণার্ত । তাদের কাছে আছে অল্প একটু পানি। এতোই অল্প যে এক জনের হলে অন্যজনের হবে না। তাই কার আগে কে পান করবে এটা নিয়ে ঝগড়া, তারপর মারামারি। এভাবে এক পর্যায়ে পানি মরুভূমির তপ্ত বালিতে পড়ে গেলে সেখান থেকে বিরাট এত দৈত্য বের হয়ে বলে ‘আমি এ মরুভূমির দৈত্য। আমি পানির তৃষ্ণায় এখানে বহু বছর ধরে মরে পড়ে আছি। তোমাদের পানি পেয়ে আমি পূর্নজীবিত হলাম। আমি তোমাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। তোমরা ইচ্ছেমতো তিনটি জিনিস আমার কাছে চাইতে পারো। তবে শর্ত হলো যে, এক ভাই যা পাবে অন্যভাই তার দ্বিগুন পাবে।
এ কথা শুনে এক ভাই বলল, ‘আমার এক চোখ অন্ধ, এক পা খোড়া আর এক কান বধির করে দাও।’ যথারীতি তার এক চোখ অন্ধ, এক পা খোড়া ও এক কান বধির হওয়ার সাথে সাথে অপর ভাই এর দুই চোখ অন্ধ, দুই পা খোড়া ও দুই কান বধির হয়ে গেল। এক ভাই নিজের ভালোর দ্বিগুণ অন্য ভাইয়ের জন্য সহ্য করতে না পেরে অন্য ভাই এর বেশী ক্ষতির জন্য নিজের ক্ষতি আনন্দ চিত্তে গ্রহণ করতে কোন দ্বিধা নেই। এটাই হিংসা।
হিংসার নিগূঢ় বার্তা হলো অন্যের ভালোগুলো বিলুপ্ত হয়ে যাক মনে মনে এ প্রত্যাশা করা বা সক্রিয়ভাবে তার ক্ষতির জন্য চেষ্টা করা। হিংসা বা ঈর্ষা পোষণ করা মানে হচ্ছে আল্লাহর সিদ্ধান্তের উপর প্রশ্ন তোলা। যে, স্রষ্টা কেন এ ভালোটা তাকে দিলেন? একই সাথে হিংসা - ঈর্ষা হচ্ছে না শোকরিয়ার প্রকাশ। নিজের যা আছে তাতে সন্তুষ্ট না থেকে, তার শোকরিয়া আদায় না করে অন্যের যা আছে তার জন্য একটা পেরেশানি, কষ্ট অনুভব করা। হিংসা-ঈর্ষা মূলত অন্তরের একটি ব্যাধি। হিংসার আগুন নিভু নিভু করে অন্তরে জ্বলতে থাকে। এ আগুন ধীরে ধীরে অন্তর জ্বালানোর পাশাপাশি সকল সৎ কর্মকে ভস্মীভুত করে আমলের খাতাকে শূণ্য করে দেয়।
হিংসুকের ক্ষতিকর দৃষ্টি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে হবে। আর এ প্রার্থনা মহান স্রষ্টা নিজে শিখিয়ে দিয়েছেন। সূরা ফালাক এর ৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন, ‘ও হিংসুকের অনিষ্ট হতেও, যখন সে হিংসা করে।’ - আমি মহান স্রষ্টার আশ্রয় প্রার্থনা করি।
রাসূলে পাক (স) বলেন, ‘হিংষা বিদ্বেষ নেকী সমূহকে এমনভাবে ধ্বংস করে দেয়, যেমনি আগুন শুকনো কাঠকে জ্বালিয়ে দেয়।’
ঈর্ষা - হিংসা অন্তরের একটি মারাত্বক ব্যাধী। একজন হিংসুটে লোক চাইলে তার শত্রুর মৃত্যুতেও অন্তর থেকে কান্না করতে পারে কিন্তু বন্ধুর সাফল্যে আন্তরিকভাবে হাসতে পারে না।
রাসূল (স) বলেন, ‘তোমাদের জাতীগুলোর সামনে একটি ব্যাধী এসেছে-সেটা হচ্ছে - ঈর্ষা ও ঘৃণা। এটা ধ্বংসকারী। এটা ঈমান ধ্বংস করে।’ (তিরমিজী শরীফ)
ঈর্ষা মানুষের ঈমান ধ্বংস করে। কারণ, সে আল্লাহর সিদ্ধান্তের উপর প্রশ্নতোলে। সে মনে করে আল্লাহ অন্য কাউকে এ ভালোটা দিয়ে, এ কল্যাণটা করে আমার সাথে ন্যায়বিচার করেননি। এ ভালোটা, এ কল্যাণটা স্রষ্টা তাকে না দিয়ে আমাকে দিতে পারতেন। একই সাথে তার উপর বর্ষিত সকল নেয়ামতের না শোকর হয়ে যায় সে।
এ সম্পর্কে সূরা আন-নহল এর ৭১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ তোমাদের কাউকে কাউকে অন্যদের চেয়ে বেশি জীবনোপকরণ দিয়েছেন। যাদের অতিরিক্ত জীবনোপকরণ দেয়া হয়েছে, তারাও (সাধারণত) নিজেদের জীবনোপকরণ থেকে তাদের অধীনদের এমন কিছু দেয় না, যাতে ওরা তাদের সমকক্ষ হতে পারে। এর মাধ্যমে তারা আল্লাহর নেয়ামতকে অস্বীকার করছে না?’ অর্থাৎ তারা কী এর মাধ্যমে স্রষ্টার প্রদত্ত অনুগ্রহের না শোকর হচ্ছে না?
এ সম্পর্কে রাসূল (সঃ) বলেন, ‘তারা হলো স্রষ্টার দয়ার বিরুদ্ধে শত্রু।’ সাহাবীরা জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ, তারা কারা? উত্তরে রাসূল (স) বলেন, তারা হলো ঐ সমস্ত লোক যারা অন্যের হিংসা করে এ জন্য যে অন্যকে স্রষ্টা দয়া করেছেন।’ (আত -তাবরানী)
হিংসা সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের সূরা আন-নিসা’র ৫৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন, ‘তবে কি আল্লাহ মানুষকে নিজ অনুগ্রহে যা যা দিয়েছেন তা নিয়ে ওরা ঈর্ষা করে?---’ কেননা আল্লাহ সোবহানাহু তায়ালা একেক জনকে একেকভাবে অনুগ্রহ করে থাকেন। একজনের প্রাপ্ত অনুগ্রহ দেখে অন্যজনের দহন যন্ত্রণাই হচ্ছে ঈর্ষা বা হিংসা।
স্রষ্টা নিঃসন্দেহে সর্বশ্রেষ্ঠ ন্যায়বিচারক ও মহাজ্ঞানী। কাকে বেশী দিতে হবে, কাকে কম দিতে হবে, কেন এ কম-বেশী দিতে হবে তা স্রষ্টার চেয়ে ভালো আর কেউ জানেন না। এ সম্পর্কে আল কোরআনে সূরা জুখরুফ এর ৩২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন, ‘(হে নবী! ওদের জিজ্ঞেস করো) তোমার প্রতিপালকের অনুগ্রহ কী ওরা বন্টন করে? বরং আমিই ওদের মধ্যে জীবিকা বন্টন করি এবং পার্থিব জীবনে একজনকে অন্যজনের ওপর মর্যাদায় উন্নীত করি, যাতে একে অপরের সহযোগিতা নিতে পারে। কিন্তু ওদের প্রভাবশালীরা যা সঞ্চয় করে, তার চেয়ে তোমার প্রতিপালকের রহমত অনেক উত্তম।’
আত্মার পরিশুদ্ধি অর্জন ছাড়া আত্মিক মুক্তি সম্ভব নয়। আর ঈর্ষা-হিংসা, গীবত, রাগ-ক্ষোভের মতো নেতিবাচক আবেগ বর্জন ছাড়া আত্মিক পরিশুদ্ধি অর্জন সম্ভব নয়। পরম করূণাময় আমাদের সবা্কে নেতিবাচক এ আবেগগুলো বর্জন করার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধির পথে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ দান করুন। আমীন।
লেখক: উপাধ্যক্ষ, কসমো স্কুল অ্যান্ড কলেজ