কীভাবে ঘটেছিলোল জানালেন ইলিয়াসের লাইভে
‘শেখ মুজিব ইজ ডেড’, লাইভে জানালেন রাশেদ চৌধুরী
বজলুল হুদার কথা মতো, শেখ কামাল আর সুলতানা প্রথমে গোলাগুলি শুরু করে। শেখ কামাল নিচে আসছিল সিঁড়ি দিয়ে গুলি করতে করতে চিৎকার করতে করতে। দোতলা থেকে গুলি এসে সিপাহী মারা গেলে একজন নাকি বলে উঠলো শালার গোষ্ঠীসুদ্ধু মেরে দে।
সেদিন সকাল থেকে রেডিওতে ঘোষণা হচ্ছিলো, ‘শেখ মুজিব ইজ ডেড’। কীভাবে ঘটেছিলো- এ ঘটনা বিস্তারিত জানালেন বীর মুক্তিযোদ্ধা লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) এম রাশেদ চৌধুরী (বীর প্রতীক)। শুক্রবার (২৪ জানুয়ারি) রাতে ‘আপনারা দেখছেন বিশেষ আলোচনা অনুষ্ঠান, অতিথি: বীর মুক্তিযোদ্ধা রাশেদ চৌধুরী (বীর প্রতীক)’ শিরোনামের লাইভে যুক্ত হন সাবেক এ সামরিক কর্মকর্তা। সাংবাদিক ইলিয়াস হোসেনের নিজের ইউটিউব চ্যানেলে প্রচারিত আলোচনা অনুষ্ঠানটি মুহূর্তেই ভাইরাল হয়।
এ আলোচনায় রাশেদ চৌধুরী জানান কীভাবে তিনি শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
শুরুতেই পাকিস্তানে চাকরিরত থেকেও রাশেদ চৌধুরী কীভাবে মুক্তিযুদ্ধে এসেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, পাকিস্তান থাকা অবস্থায় দেশে কি হচ্ছে জানতাম না। শুরুতে পাকিস্তানপন্থী থাকলেও মে মাসে বিদেশ থেকে গোপনে পাঠানো কিছু পেপার ক্লিপিং পেলাম। বিখ্যাত ইন্টারন্যাশনালের পেপার ক্লিপিং ছিলো। ওই খবরগুলো দেখে আমার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। আমি কয়েকদিন ঘুমাতে পারিনি। তখন আমার মধ্যে বিরাট পরিবর্তন এলো। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আমি এ দেশে থাকতে পারি না। আমাকে যেতে হবে। তারপর কয়েকটা অ্যাটেম্প নিয়েছি। মনে হচ্ছিলো আমি একটা প্লেন নিয়ে যদি চলে যেতে পারি। শিয়ালকোট দিয়েও যাওয়ার চিন্তা করি। নানাভাবে চেষ্টার পর একদিন জিপ চালিয়ে বর্ডার ক্রস করে ভারতে চলে আসতে সক্ষম হই।
জিয়াউর রহমানকে যুদ্ধের সময় দেখেছেন কিনা…ইলিয়াসের প্রশ্নের উত্তরে রাশেদ চৌধুরী বলেন, জিয়াউর রহমানকে আমি যুদ্ধের সময় দেখেছি। আমি জিয়াউর রহমানের ফোর্সে ছিলাম। কেউ যদি বলে যে উনি যুদ্ধ করেননি, উনি পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন … পাগল ছাড়া এগুলো কেউ বিশ্বাস করবে না।
মতিউর রহমান নিজামীসহ জামায়াতের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন করলে রাশেদ চৌধুরী বলেন, সে সময় পলিটিক্যাল কোনো ইলিমেন্টের সাথে আমার আলাপ হয়নি। যুদ্ধের সময় সময় আমি এদের দেখতে পাইনি। পরবর্তী সময় আমি নানা কাহিনী শুনেছি। আমি ছিলাম সম্মুখ যুদ্ধে, পেছনে কী হয়েছে জানি না। যুদ্ধের শেষ দিকে জয়েন করার জন্য আমি যুদ্ধ নিয়ে খুব ব্যস্ত ছিলাম।
১৫ আগস্ট কেন ঘটালেন? জানতে চাইলে সাবেক এই সামরিক কর্মকর্তা বলেন, যারা যুদ্ধ করেছে তাদের দেশ নিয়ে আশা আকাঙ্ক্ষা অনেক। একজন ইয়াং অফিসার হিসেবে আমার মনের মধ্যেও ও রকম ছিলো। কিন্তু যুদ্ধের পরবর্তী পর্যায়ের অবস্থা পরিস্থিতি দেখে আমরা অনেক হতাশ হয়ে গেছি। পলিটিক্যাল গর্ভমেন্ট যেভাবে চালাচ্ছে মনে হয় দেশের মধ্যে লুটতরাজ…অন্যরকম পরিস্থিতি হয়ে গেছে। ৭২, ৭৩, ৭৪, ৭৫ এ পরিস্থিতি কী হয়েছিল সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। ম্যান মেইড দুর্ভিক্ষ থেকে কী পরিস্থিতি হয়েছিল আমরাও সেটা দেখেছি। এ পরিস্থিতিতে কিছু একটা করা যায় কি না এ নিয়ে আমরা ইয়াং অফিসাররা নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করতাম। হয়তো সিনিয়রদের মধ্যেও আলাপ হতো কিন্তু কেউ এটা শেয়ার করতো না। এগুলো গোপনে আলোচনা করা হতো।
তিনি বলেন, সেভেন্টি ফাইভে যেটা ঘটে, সেটা আগে থেকেই কল্পনা ছিলো, কিন্তু বাকশাল হওয়ার পরে আরও একটু চিন্তাভাবনা শুরু হলো। আমি কিন্তু মূল পরিকল্পনার সঙ্গে খুব একটা জড়িত ছিলাম না। নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করতাম, বাইরে। তখন আমার চাকরিও নাই। আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ ছিলো। ব্যবসা করার জন্য কোনো অর্ডার পেতে আমার আগের ইউনিটিতে ক্যান্টনমেন্টে যেতাম মাঝেমাঝে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা রাশেদ চৌধুরী বলেন, ১৫ আগস্টের পুরো অপারেশনের দায়িত্বে ছিলো ফারুক। আর রশিদের দায়িত্ব ছিলো পলিটক্যাল এলিমেন্টদের সংগত করা, নিয়ে আসা। ফারুক কয়েকটা টার্গেট সিলেক্ট করলো। যেমন শেখ মুজিবের বাসা, সেরনিয়াবাদের বাসা, রেডিও স্টেশন, শেখ মনির বাসা। ফারুক শেখ মুজিবের বাসায় দায়িত্ব দিতে চেয়েছিলো মেজর ডালিমকে। কিন্তু সে অপারগতা প্রকাশ করলো। পরে মেজর বজলুল হুদাকে দায়িত্ব দিলে সে রাজি হলো। হুদার সঙ্গে আরও দুয়েকজন অফিসারকে দেয়া হলো। ডালিমকে সেরনিয়াবাদের বাসার আশেপাশে এবং রেডিও স্টেশনের দায়িত্ব দেয়া হলো। আমার দায়িত্ব ছিলো রেডিও স্টেশনে ডালিমের আন্ডারে। প্রত্যেককে আলাদা টার্গেট বলা আছে।
তিনি বলেন, আমি ভোরের দিকে রেডিও স্টেশন টেকেন ওভার করলাম। আমার দায়িত্ব ছিলো, ওইটা ভাষণ দেয়ার জন্য রেডি করা। সাড়ে ৬টার দিকে ডালিম আসলো। আমাকে খুঁজলো, এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো উই হ্যাভ ডান ইট। সে সময় ডালিমের স্টেটমেন্ট রেকর্ড করে প্রচার করা হয় এবং এটাই বারবার চলতে থাকে।
অপারেশনে যাওয়ার আগে বিস্তারিত ব্রিফ করা হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, মুজিবের ভাগ্য কী হবে আমরা জানি না। রশিদের কথামতে, মুজিবকে তার বাসায় মারার কোনো প্ল্যান ছিলো না। প্ল্যান ছিলো মুজিবকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে এসে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এনে সামারি কোর্ট মার্শাল করা, বাসায় নয়। রশিদ, ফারুক অরিজিনাল প্ল্যানার। এটা সত্য হতে পারে। আমার মনে হয় না মুজিবকে ওখানে মারার কোনো প্ল্যান ছিলো।
রাশেদ চৌধুরী বলেন, সকাল সাড়ে ৮টার দিকে রশিদ খন্দকার মোশতাককে নিয়ে রেডিও স্টেশনে আসলো। আমরা গার্ড অব অনার দিলাম, আফটার অল হি ইজ নিউ প্রেসিডেন্ট। তারপর থেকে রেডিও স্টেশনটাই বাংলাদেশের নতুন সরকারের হেডকোয়ার্টার।
তিনি বলেন, এখন মুজিবের বাসভবনে কী হলো? আমি সেখানে ছিলাম না। পরবর্তীতে জেনেছি। আমার বইয়ে মেজর বজলুল হুদার স্টেটমেন্ট আছে। সে বলেছে, সে সৈন্য সামন্ত নিয়ে তখনও ভোর হবে হবে মুজিবের বাসভনে পৌঁছায়। হুদা সুবেদারকে গিয়ে বললো, আর্মি হ্যাজ টেকেন ওভার। মুজিব ইজ নো মোর ইন পাওয়ার। মুজিবকে অ্যারেস্ট করতে আসছি। আপনারা আমাদের সাথে আছেন কি না। এক বাক্যে সবাই বললো, স্যার আমরা আপনাদের সাথে আছি।
নিচে শব্দ শুনে দোতলা থেকে শেখ কামাল স্টেনগান দিয়ে গোলা ছুঁড়তে ছুঁড়তে উপর থেকে নিচে আসছে। শেখ কামালের ওয়াইফ সুলতানা একটা অটোমেটিক রাইফেল দিয়ে নিচে গুলি করতে লাগলো। তারা বুঝতে পেরেছিল তাদের কেউ অ্যাটাক করতে আসছে। এ গোলাগুলিতে একজন সিপাহী মারা গেছে, কয়েকজন আহত হয়। এটা দেখে অন্যান্য সিপাহীরা ক্ষেপে গেছে।
বজলুল হুদার কথা মতো, শেখ কামাল আর সুলতানা প্রথমে গোলাগুলি শুরু করে। শেখ কামাল নিচে আসছিল সিঁড়ি দিয়ে গুলি করতে করতে চিৎকার করতে করতে। দোতলা থেকে গুলি এসে সিপাহী মারা গেলে একজন নাকি বলে উঠলো শালার গোষ্ঠীসুদ্ধু মেরে দে। শেখ মুজিবের বাসার এক চাকর যে পালিয়ে গিয়েছিলো, সেও স্বীকার করেছে গোলাগুলি শেখ কামাল আর সুলতানা শুরু করেছে প্রথমে। এরপর সিপাহীরা গেট ভেঙে ভেতরে ঢুকে যায়। এরমধ্যে হুদাও আসছে। পরে হুদা লোকজন নিয়ে ভেতরে ঢুকলো। বাই দ্যাট টাইম শেখ কামাল ওয়াজ ডেড, শেখ নাসেরও ছিলো।
হুদার বক্তব্যের বরাত দিয়ে রাশেদ চৌধুরী বলেন, সে কয়েকজনকে নিয়ে উপরে গেছে শেখ মুজিবকে নামানোর জন্য। মেজর মহিউদ্দীনও ছিলো। এরমধ্যে শেখ মুজিবও ঘর থেকে বের হয়ে আসলো। তারা শেখ মুজিবকে নিয়ে নিচে আসার সময়, উপর থেকে আবার গুলি ছোড়া শুরু করে সুলতানা ও শেখ জামাল। এলোপাথাড়ি গুলি ছোড়ে তারা। এক গুলিতে মুজিবের পেছনে ছিল এক সিপাহী, সে পড়ে গেছে। মুজিব দাঁড়িয়ে ছিলো, হুদা আর মহিউদ্দীন তখন ডাক করে বেঁচে যায়।
এদিকে, গুলাগুলির শব্দ শুনে অন্যান্য লাঞ্চারের লোকজনও চলে আসে। তারাও পাল্টা গুলি ছোড়ে। তখন নিচে থেকে গুলি মুজিবের গায়ে লাগলে তিনি পড়ে যান, রক্ত গড়িয়ে পড়ে, জানান রাশেদ চৌধুরী।
শেখ রাসেলকে কেন হত্যা করা হলো জানতে চাইলে তিনি বলেন, সবাই দোতলার একটা রুমে বন্ধ ছিলো। শেখ মুজিব যখন পড়ে গেলো তখনই আরেক রাউন্ড গোলাগুলি শুরু হলো উপর থেকে নিচের দিকে জানালা দিয়ে। বজলুল হুদার বক্তব্য অনুযায়ী, এই পর্যায়ে কয়েকজন সিপাহী ক্রল ওই রুমের জানালা দিয়ে ভেতরে গ্রেনেড ড্রপ করে সরে পড়ে। ওই গ্রেনেড বাস্ট করে বাকি সবাই একসঙ্গে মারা যায়। রাসেল নিচে আসেনি। শুধু শেখ কামাল নিচে মারা যায়। মুজিবের মৃত্যুর পর ফরেনসিক করলে হয়তো দেখা যেতো তারা কীভাবে মারা গেছে, গুলিতে না গ্রেনেড বিস্ফোরণে।
ততক্ষণে রেডিওতে ঘোষণা হচ্ছে, শেখ মুজিব ইজ ডেড, লাইভে বলছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা রাশেদ চৌধুরী (বীর প্রতীক)।
উল্লেখ্য, সেনাবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা রাশেদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। বর্তমানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসে অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে।
সবার দেশ/এমকেজে