ছায়ানটী সংস্কৃতির বিকাশ

মেজর নাসিম (অব.)। সেনাবাহিনীর সাবেক এ চৌকস কর্মকর্তা সোশ্যাল মিডিয়া ফেসবুকে সমসাময়িক একটি বিষয় নিয়ে পোস্ট করেছেন। ‘সবার দেশ’ পাঠকদের জন্য ওই পোষ্টটি হুবহু তুলে ধরা হলো, যা পাঠকদের চিন্তার খোরাক কিছুটা হলেও মেটাবে।
সানজিদা খাতুনের (সাখা) মৃতদেহ ঘিরে রবীন্দ্র শিল্পীদের সমাবেশ গীত পরিবেশনের দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গভীর প্রভাব ফেলেছে। নেটীজেনরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিরূপ মন্তব্য করছেন। তবে তার মৃত্যুর জন্য রবীন্দ্র ধারার অনুসারীরা যথেষ্ট বিলাপও করছেন।
সাখাকে দেখা হয় '৬০ দশকে রমনার বটমূলে রবীন্দ্র কনসার্ট চালুর সাংস্কৃতিক বিপ্লবী হিসাবে। তিনি তখন তৎকালীন পাকিস্তান শাসকদের 'রবীন্দ্র বিতৃষ্ণার' বিপরীতে বিদ্রোহ করে রবীন্দ্র সংগীতকে বাঙালীর আত্মপরিচয়ের একটি অন্যতম উপাদান হিসাবে তুলে ধরেন। যার জন্য তিনি দেশে (আওয়ামী এবং বাম ঘরনার কাছে) এবং ভারতে বেশ সমাদৃত ছিলেন। পক্ষান্তরে যারা ইসলামপন্থী রাজনীতি করতেন, নির্দিষ্ট করে বললে বাঙালী মুসলিম মানসকে যারা অগ্রগন্য মনে করতেন তারা ছায়ানটের এ বাড়বাড়ন্ত কে এ দেশের মুসলিম আইডেন্টিটির প্রতিপক্ষ মনে করেন।
ছায়ানটীদের বাহ্যিক বেশভূষা, এ যেমন কপালের আধূলি সাইজের লাল টীপ, হাতাকাটা ব্লাউজ, পুরুষদের খদ্দের পান্জাবী চটের ব্যাগ,,, এসব দেখে ভ্রুকুচকান। তাদের দেখে একধরনের শ্লেষ মিশ্রিত মন্তব্য থাকে।
উল্টো চিএে এ মুসলিম আইডেন্টিটির ধারক বাহকদের দাঁড়ি টুপি, পাগড়ী, টাখনোর উপরে প্যান্ট-পাজামা পড়া, মেয়েদের হিজাব পড়া নিয়ে ছায়ানটী চিন্তা ভাবনার ধারক বাহকদের মধ্যে আতংক মিশানো মন্তব্য থাক।
দেশটা ভারতের করতলে চলে গেলো - এর বিপরীতে দেশটা আফগানিস্তান হয়ে গেছে বা তালেবানে ভরে গেছে এমন সাংস্কৃতিক ভিন্নতা অনেকদিন থেকেই চলছে।
আমাদের দেশের সংস্কৃতির দুটো ধারা: ছায়ানটী বনাম ইসলামি। এ দেশের আওয়ামী সাংস্কৃতিক বোদ্ধারা যাকে তালেবানী সংস্কৃতি বলতে চান।
আওয়ামী লীগের এবং ভারতের স্পষ্ট পক্ষপাতিত্ব ছিলো ছায়ানটী সাংস্কৃতিক লাইনকে জোরালো করার।
আমাদের ইসলামিক আইডেনটিটিকে কটাক্ষ করার একটা রাষ্ট্র প্রযোজিত উদ্যোগকে ভারত খুব প্রমোট করতো। এ দেশের রবীন্দ্র সংগীতকে নিয়ে ভারতের যত্নের ছিটেফোঁটাও নজরুল সংগীতকে নিয়ে হয়নি। ভারতের আধিপত্যের বাহন হিসাবে রবীন্দ্র সংগীতকে মোদী সরকার খুব অগ্রাধিকার দিতো।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি ধ্যানমগ্ন হয়ে রেজোয়ানা বন্যা’জীর গান শুনছেন তা দেখে আমাদের ছায়ানটী সংস্কৃতির জগতে বিশাল ঢেউ খেলে গেছে। পদ্মশ্রী খেতাব পেয়ে আমরা যারপরনাই খুশী। এ দেশের মুসলিম আইডেন্টিটিকে কটাক্ষ করা যায় এমন সবকিছুই ছিলো ছায়ানটী সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের লক্ষ্য- অনাবশ্যক ভাবে একটি নাটকের একটি খারাপ চরিত্রের মাথায় একটি টুপি পরিয়ে দেয়া হবে। তাই তো আমরা দেখি পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রাকে ঘিরে রাষ্ট্রের হুড়োহুড়ি, দাড়ি টুপিওয়ালা চাঁদ তারকার দানবটিকে মুসলিম আইডেন্টিটি হিসাবে প্রতিবার দেখানো হয়।
মৃত্যুর পর দাফন কাফন কবরস্থ করা, মৃতকে ঘিরে কোরআন শরীফ তেলোয়াত ইসলামিক রীতি। এটার কোন দরকার নেই, তাই চলো শহীদ মিনারে - জানাজার দরকার কি কবর দেয়ার দরকার কি, লাশকে মানবতার সেবার জন্য মেডিক্যাল কলেজে দান করে দাও। লেটা চুকে যাবে, মৌলভী ডেকে জানাজা পড়ার কোথায় কবর হবে তার ঝক্কি সামলানো।
যারা নাস্তিক তারা যে মৃত্যুর পরও নির্ভিক এবং শ্রষ্ঠার কাছে গেলাম না, বা তাকে মানি না এরকম একটা দূর্বিনীত মনোভাব কে তুলে আনা। এসবই আমাদের সমাজের সব সময়ের দেখা অভ্যস্হ চোখকে ভিন্ন এক জগতে ঠেলে দেয়া যেন দেখতে দেখতে সব গা সওয়া হয়ে যায়। ইসলামিক সেনসিটিভিটি বিলীন হয়ে যায়। এসবই করা হয় মুক্ত চিন্তা- প্রগতিশীল চিন্তার -ব্যক্তিস্বাধীনতার কথা বলে। তাই উন্মুক্ত আকাশের নীচে রাস্তার মোড়ে সিগারেট হাতে তরুণীদের শক্তির যোগান দিতে তৎপর কিছু মহল। কারন সে একই, এটা আমাদের মুসলিম আইডেন্টিটিকে চ্যালেন্জ করে।
আমাদের মিডিয়া জগতের দারুণ পক্ষপাতীত্ব থাকে এ ছায়ানটী সাংস্কৃতিক ধারার প্রতি:
‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে বহে কিবা মৃদু পায়’- অচিরেই আমরা দেখবো চ্যানেল আইতে এ ছায়ানটীর প্রতি শ্রদ্ধার মন্জুরী।
অধিকাংশ বাম শাহবাগী এবং ছায়ানটীরা আমাদের ইসলামিক আইডেনটিটির বিরুদ্ধে একটা কালচারাল ক্যূ ঘটিয়ে ফেলেছে। যা কিছুতেই মুসলিম আইডেন্টিটি আছে, সেটাতেই তালিবানী গন্ধ পায়। এ ছায়ানটী সংস্কৃতির বিপরীতে বা তাকে টেক্কা দিতে নামতে দেখি ঈদ-ই- মিলাদুন নবী বা ঈদ মিছিলের আয়োজন। এবার শুনতে পাচ্ছি বটমূলে নাকি গরু কোরবানি হবে!
রবীন্দ্র সংগীত চর্চা বা তার সাহিত্যের চর্চা ছিলো শুধুই একটা মামুলি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড এখন এটা হয়ে গেছে ফেনী নদীর উপর ভারতের আগ্রহে সেতু নির্মাণের নামে আগ্রাসনের একটা সেতুবন্ধন! রবীন্দ্র সঙ্গীতকে একটা ধর্মীয় আচার-আচরণে পরিনত করার মধ্য দিয়ে এ দেশে আওয়ামী লীগ কর্তৃক নব প্রচলিত ধর্ম ‘দীন-ই- আওয়ামী লীগ’র সমার্থক করা হচ্ছে।
এতোদিন যা একটু রবীন্দ্রসংগীত শুনতাম তাও বুঝি বন্ধ হবে। অনুমান করি ঈদের পরে ইসলামিক জলসা বা ওয়াজ মাহফিলের প্যান্ডেলে মৌলানা সাহেবদের জন্য নতুন কন্টেন্ট হিসাবে এ রবীন্দ্রপ্রীতি ঝড় তুলবে।
মেজর নাসিম (অব.)
২৭-০৩-২০২৫
সবার দেশ/কেএম