পেহেলগাম হামলার প্রভাব ও আঞ্চলিক উত্তেজনা
পাকিস্তান সীমান্তে সেনা মোতায়েন পরিকল্পনা ইরানের

জম্মু ও কাশ্মীরের পেহেলগামে ২২ এপ্রিল, ২০২৫-এ সংঘটিত ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা, যাতে ২৫ জন ভারতীয় পর্যটক এবং একজন নেপালি নাগরিক নিহত হয়েছেন, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ককে চরম উত্তেজনার দিকে ঠেলে দিয়েছে। এ হামলার জেরে দুই দেশ পাল্টাপাল্টি কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে, যা একটি সম্ভাব্য সামরিক সংঘাতের আশঙ্কাকে বাড়িয়ে তুলেছে। এ প্রেক্ষাপটে, ইরান পাকিস্তানের সঙ্গে তার সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদার করতে কয়েক ব্রিগেড সৈন্য মোতায়েনের পরিকল্পনা করছে বলে দ্য ইরান অবজারভার জানিয়েছে।
এর আগে, সীমান্ত নিরাপত্তা জোরদার ও আন্তঃসীমান্তের সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় সহযোগিতা বৃদ্ধির বিষয়ে ইরান ও পাকিস্তান একমত হয়েছে। এ পদক্ষেপ ইরান-পাকিস্তান সম্পর্ক এবং আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক গতিশীলতার ওপর নতুন প্রভাব ফেলতে পারে।
ইরানের সেনা মোতায়েন: উদ্দেশ্য ও প্রেক্ষাপট
ইরানের এ পরিকল্পনা ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার প্রেক্ষিতে তার নিজস্ব জাতীয় নিরাপত্তা স্বার্থ রক্ষার একটি কৌশলগত পদক্ষেপ। ইরান ও পাকিস্তানের মধ্যে ৯০৯ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত, যা ইরানের সিস্তান-বালুচেস্তান এবং পাকিস্তানের বালুচিস্তান প্রদেশের মধ্য দিয়ে বিস্তৃত, দীর্ঘদিন ধরে অস্থিতিশীল। এ অঞ্চল বালুচ বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী যেমন জয়েশ আল-আদল এবং বালুচিস্তান লিবারেশন আর্মি (বিএলএ)-এর তৎপরতার কারণে চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। এ গোষ্ঠীগুলো প্রায়ই সীমান্তের দুই পাশে সন্ত্রাসী হামলা চালায়, যা দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক অভিযোগ ও উত্তেজনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইরানের সেনা মোতায়েনের পরিকল্পনা সম্ভবত এ সীমান্ত অঞ্চলে সম্ভাব্য অস্থিতিশীলতা রোধ এবং ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের কোনো সম্ভাব্য ছড়িয়ে পড়া (spillover) প্রতিরোধের লক্ষ্যে গৃহীত। পেহেলগাম হামলার পর ভারতের পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপের আশঙ্কা এবং ইসরায়েলের ভারতের পক্ষে স্পষ্ট সমর্থন ইরানের জন্য উদ্বেগের কারণ হতে পারে। ইরান, যিনি ইসরায়েলের সঙ্গে দীর্ঘদিনের শত্রুতার সম্পর্ক রাখে, সম্ভবত এ পরিস্থিতিতে তার সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদার করে নিজেকে রক্ষা করতে চাইছে।
ইরান-পাকিস্তান সহযোগিতা: সাম্প্রতিক উন্নয়ন
ইরান ও পাকিস্তান সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সীমান্ত নিরাপত্তা এবং সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় সহযোগিতা বাড়ানোর চেষ্টা করেছে। ২০২৪ সালের নভেম্বরে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাইয়্যেদ আব্বাস আরাঘচি ইসলামাবাদ সফর করেন এবং সীমান্ত ব্যবস্থাপনা জোরদার ও সন্ত্রাসী হামলা প্রতিরোধে উন্নত সমন্বয়ের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন। এছাড়া, ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল মোহাম্মদ বাগেরি পাকিস্তান সফরে গিয়ে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আসিফ মুনিরের সঙ্গে সীমান্ত নিরাপত্তা এবং সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে সমন্বয় নিয়ে আলোচনা করেন।
আরও পড়ুন <<>> যুদ্ধে ভারতকে সমর্থনের ঘোষণা ইসরায়েলের
দুই দেশ ২০২৩ সালে যৌথ সীমান্ত নিরাপত্তা মহড়া এবং ২০২৪ সালের এপ্রিলে একটি নিরাপত্তা সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, যার মাধ্যমে সীমান্ত অঞ্চলে উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের মোতায়েন এবং সন্ত্রাসবিরোধী প্রচেষ্টা জোরদার করা হয়েছে। এছাড়া, ইরান আগামী ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তান নৌবাহিনীর আয়োজিত আমান-২৫ নৌ-মহড়ায় অংশ নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যা দুই দেশের সামরিক সহযোগিতার গভীরতা নির্দেশ করে।
ইরানের সম্ভাব্য ভূমিকা ও আঞ্চলিক প্রভাব
ইরানের সেনা মোতায়েনের পরিকল্পনা শুধুমাত্র সীমান্ত নিরাপত্তার জন্য নয়, বরং ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের প্রেক্ষিতে আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্য বজায় রাখার একটি প্রচেষ্টাও হতে পারে। ইরান ইতিমধ্যে পাকিস্তানের সঙ্গে সামরিক সহযোগিতা বাড়িয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে যৌথ সামরিক উৎপাদন এবং নৌ-মহড়া। এছাড়া, ইরান তার পূর্ব সীমান্তে ড্রোন বেস নির্মাণ এবং স্মার্ট নজরদারি ব্যবস্থা স্থাপনের মাধ্যমে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করছে।
ইরানের এ পদক্ষেপ পাকিস্তানের জন্য সমর্থন হিসেবে দেখা গেলেও, এটি সরাসরি ভারতের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার ইঙ্গিত নাও হতে পারে। ইরান সম্ভবত নিজের সীমান্তে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে এবং সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর তৎপরতা নিয়ন্ত্রণে এ ব্যবস্থা নিচ্ছে। তবে, ইসরায়েলের ভারত সমর্থন এবং ইরানের পাকিস্তানের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান সহযোগিতা এ অঞ্চলকে একটি বৃহত্তর সংঘাতের দিকে ঠেলে দিতে পারে।
আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিও এ উত্তেজনাকে প্রভাবিত করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো ভারত ও ইসরায়েলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখে, যখন পাকিস্তান চীন ও ইরানের সঙ্গে কৌশলগত মৈত্রী গড়ে তুলেছে। ভারত ও পাকিস্তান উভয়ই পারমাণবিক শক্তিধর দেশ, এবং যুদ্ধ শুরু হলে তা আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক স্থিতিশীলতার জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করতে পারে।
ইরানের পাকিস্তান সীমান্তে সেনা মোতায়েনের পরিকল্পনা পেহেলগাম হামলা ও ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার প্রেক্ষিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন। এটি ইরানের নিজস্ব নিরাপত্তা স্বার্থ রক্ষার পাশাপাশি আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্য বজায় রাখার প্রচেষ্টাকে নির্দেশ করে। তবে, এ পদক্ষেপ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলতে পারে, বিশেষ করে ইসরায়েলের ভারত সমর্থন এবং পাকিস্তানের পাল্টা অবস্থানের প্রেক্ষিতে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এখন দায়িত্ব হলো কূটনৈতিক উদ্যোগের মাধ্যমে এ উত্তেজনা কমানো এবং একটি সম্ভাব্য সংঘাত এড়ানো। ভারত, পাকিস্তান, ইরান এবং তাদের মিত্রদের সংযত আচরণই এখন একমাত্র পথ হতে পারে এ অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার।
সবার দেশ/কেএম