Header Advertisement

Sobar Desh | সবার দেশ সামিউর সাগর


প্রকাশিত: ১৯:৪৬, ২৬ জানুয়ারি ২০২৫

আপডেট: ১৯:৫৮, ২৬ জানুয়ারি ২০২৫

সাবেক এসবি’র মনিরুল ইসলামের ক্যাশিয়ারের সম্পদের পাহাড়

কুমিল্লার পিটিসি ছাত্রলীগ নেতা এসপি ফারুক

ডিএমপি’র মুখপাত্র হলেও তিনি ছিলেন হাসিনার মাফিয়াচক্রের বরকন্দাজ (ভারতে পলাতক) আসাদুজ্জামান কামাল, গণহত্যার দায়ে কারাগারে থাকা পুলিশের সাবেক আইজি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন এবং স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি)র শীর্ষ কর্মকর্তা মনিরুল ইসলামের ক্যাশিয়ার-ক্যারিয়ার।

কুমিল্লার পিটিসি ছাত্রলীগ নেতা এসপি ফারুক
ছবি: সংগৃহীত

ছাত্র-জনতার হত্যার দায়ে কথা ছিলো কারাগারে থাকার। কথা ছিলো ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ ও বিপুল অবৈধ সম্পদ অর্জনকারী এ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক)র একাধিক মামলা হওয়ার। কিন্তু হাসিনা উৎখাত হওয়ার পাঁচ মাস পেরিয়ে গেলেও কিছুই হয়নি তার। তার কেশাগ্রও স্পর্শ করেনি কেউ। বরং গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় (পুলিশ সুপার, কুমিল্লার পুলিশ ট্রেনিং সেন্টার-পিটিসি) পোস্টিং নিয়ে দিব্যি চাকরি করছেন পুলিশের প্রভাবশালী এ কর্মকর্তা।

নাম তার মো: ফারুক হোসেন। ২৭ তম বিসিএস (পুলিশ) এ যোগদান। জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতা হত্যার সময় দায়িত্বে ছিলেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ডেপুটি পুলিশ কমিশনার (মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিকেশন্স’র। গায়ে পুলিশের পোশাক জড়ালেও জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে সাবেক এ ছাত্রলীগ নেতার হাতে লেগেছে রক্তের দাগ। ছাত্র-জনতা হত্যায়  মো: ফারুক হোসেনের (বিপি: ৭৮০৮১২১৫৬৯) ছিলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

পদবীতে ডিএমপি’র মুখপাত্র হলেও গোপনে তিনি ছিলেন হাসিনার মাফিয়াচক্রের বরকন্দাজ (ভারতে পলাতক) আসাদুজ্জামান কামাল, গণহত্যার দায়ে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে থাকা পুলিশের সাবেক আইজি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন এবং স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি)র শীর্ষ কর্মকর্তা মনিরুল ইসলামের ক্যাশিয়ার-ক্যারিয়ার।

মুখপাত্রের দায়িত্বে থাকাকালে ফারুক হোসেনই ২০২৩ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর সাফাই গেয়েছিলেন মার্কিন নিষেধাজ্ঞা পাওয়া  বেনজীর আহমেদ এবং চৌধুরী মামুন আব্দুল্লাহর পক্ষে। সাংবাদিকদের প্রশ্ন খন্ডন করে তৎকালিন ডেপুটি কমিশনার (ডিসি) ফারুক বলেছিলেন, যাদের ওপরে ভিসা নীতি আসবে তারাই শুধু আমেরিকায় যেতে পারবেন না। কিন্তু দুই লক্ষাধিক সদস্যের পুলিশ বাহিনীর কয়জনই বা আমেরিকায় যান। খুবই নগণ্য সংখ্যক যান।  সে দৃষ্টিকোণ  থেকে আমরা মনে করি, এ ভিসা নীতির কারণে পুলিশ বাহিনীর কাজে  কোনো প্রভাব পড়বে না।

জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানকালেও তিনি মখুপাত্র হিসেবে ছিলেন স্বোচ্ছার। এ সময় বিভিন্ন ব্রিফিংয়ে দেয়া বক্তব্যে ফারুক শেখ হাসিনার মতোই আন্দোলনকারীদের ‘সন্ত্রাসী’ আখ্যা দেন। কিন্তু ৫ আগস্ট হাসিনা উৎখাতের পর গা ঢাকা দেন এ কর্মকর্তা। তাকে গ্রেফতারেরও চেষ্টা লক্ষ্য করা যায় না।

জুলাই-আগস্ট গণহত্যায়  যেসব পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গ্রেফতারি পরোয়ানা রয়েছে তাতে নাম নেই ফারুকের। এমনকি দুদক পুলিশের যেসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং অর্থ পাচারের অনুসন্ধান করছে, মামলা রুজু করছে সে তালিকায়ও নেই ফারুক। সাবেক এ ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষও করছে রহস্যময় নমনীয় আচরণ।  

মো: ফারুকের ‘ওস্তাদ’ এসবি’র সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তা মনিরুল ৫ আগস্টের পালিয়ে গেলেও তার বিরুদ্ধে দায়ে করা হয়েছে ৩টি হত্যাসহ বেশ কিছু মামলা। তাকে চাকুরিচ্যুত করা হয়।  মনিরুলের বিরুদ্ধে দুদুকের একটি টিম অনুসন্ধান চালাচ্ছে। মনিরুল ইসলাম সিঙ্গাপুর হয়ে বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে।

মনিরুলের অনুসন্ধানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অভ্যুত্থানকালে ছাত্র-জনতা হত্যায় ব্যয় করার জন্য মনিরুলকে ২৫ কোটি টাকা দেয়া হয়। এ অর্থ নূরুজ্জামান খানের কাছ থেকে বহন করে আনেন মো: ফারুক হোসেন। কিন্তু ৫ আগস্ট হাসিনা উৎখাত হলে মনিরুলও পালিযে যান। ওই টাকা পুলিশ এবং ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতাদের মাঝে বিলি-বন্টনের সুযোগ তিনি পাননি। টাকাটা রয়ে যান মনিরুলের অফিসেই।

গত ১২ সেপ্টেম্বর উদ্ধার হওয়া ওই টাকা পরবর্তীতে গায়েব হয়ে যায়। কোথা থেকে, কিভাবে এ অর্থ এলো, কিভাবেই বা গায়েব হলো- সে উত্তর মিলতে পারে কুমিল্লার পিটিসি (এসপি) মো: ফারুক হোসেনকে গ্রেফতার এবং রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে। কারণ, মনিরুলের বিশ্বস্ত ক্যাশিয়ার হলেন ফারুক।

ছাত্রলীগের ‘ত্যাগী’ নেতা হিসেবে ফারুক চাকরি পান পুলিশে। এ কারণে হাসিনার দীর্ঘ মাফিয়াতদন্ত্রের যেসব পুলিশ কর্মকর্তা দুর্নীতিতে আকন্ঠ নিমজ্জিত ছিলেন তাদের অনেকের ‘আস্থাভাজন’ ফারুক হোসেন। মনিরুলের ‘ক্যাশিয়ার’ হওয়ার পাশাপাশি অনেক পুলিশ কর্মকর্তার ছিলেন অর্থের ‘ক্যারিয়ার’ বা বহনকারী। হাসিনা উৎখাতের পর  গেরিলা কায়দায় লুকিয়ে ফেলেন নিজেকে। দৃষ্টির অন্তরালে চলে যাওয়ার জন্য ৪ কোটি টাকা দিয়ে পোস্টিং নেন কুমিল্লায়। চলে যান দৃশ্যপটের আড়ালে।

অত্যন্ত ধূর্ত ও চতুর কর্মকর্তা দেখতে এখন ‘গোবেচারা’। প্রকাশ্যে হাসিনাকে গালাগাল দিলেও বিভিন্নভাবে দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া আ’লীগ,ছাত্রলীগ নেতা এবং আওয়ামী পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে রাখছেন গোপন যোগাযোগ। সরবরাহ করছেন গোপন তথ্য।

গায়ে পুলিশের পোশাক জড়ালেও তার অন্তর-আত্মা কতটা আওয়ামীলীগার সে প্রমাণ মেলে  গত ১ জুলাই নিজের স্বাক্ষরিত একটি সংক্ষিপ্ত জীবন-বৃত্তান্তে। তাতে উল্লেখিত তথ্য মতে, মো: ফারুক হোসেনের বাড়ি কুষ্টিয়ার কুমারখালি উপজেরার কুলশীবাসা গ্রামে। দরিদ্র, নিম্নবিত্তের পরিবারে জন্ম নেয়া ফারুকের পিতার (মুক্তিযোদ্ধা দাবিদার) নাম আব্দুস সামাদ। তিনি স্থানীয় আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। মায়ের নাম মোছা: আছিয়া খাতুন। পড়াশুনা করেছেন কুলশীবাসা হাইস্কুল এবং কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে পড়াশুনা করেন। থাকতেন সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে।

জীবনবৃত্তান্তে তিনি আরো উল্লেখ করেন, কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে পড়ার সময় মো: ফারুক ছিলেন কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ ছাত্রলীগের (১৯৯৫-১৯৯৬) যুগ্ম-সম্পাদক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় এসএম হলের ছাত্রলীগের (১৯৯৮-১৯৯৯) তথ্য সম্পাদক। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের (১৯৯৯-২০০০) ছিলেন সহ-সভাপতি।

ডাকসাইটে এ ছাত্রলীগ নেতা পুলিশে যোগদান করেন শুধু ইউনিফর্ম ধারণের জন্য। কার্যক্রম পরিচালনা করেন ছাত্রলীগ ক্যাডার হিসেবেই। হাসিনাকে যেকোনও মূল্যে ক্ষমতায় রাখতে ফারুক ছিলেন জানবাজ। বিপরীতে হাসিনাও তাকে দিয়ে রাখেন দু’হাতে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার ব্ল্যাংঙ্ক চেক। যেখানে পোস্টিং নিয়েছেন সেখানেই হাতিয়েছেন বস্তা বস্তা টাকা। দেশে-বিদেশে, নামে- বেনামে গড়ে তুলেছেন সম্পদের পর্বত।  

ফারুক ছিলেন পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি)র তৎকালিন প্রধান মনিরুল ইসলামের ক্যাশিয়ার। এ সুবাদে নিজে ইচ্ছে মতো বিস্তৃত করেছেন সম্পদ-সাম্রাজ্য। নিজ জেলা কুষ্টিয়ার কুমারখালি এবং কুলশিবাসায় এক সঙ্গেই কিনেছেন ৬০ বিঘা জমি। পৈত্রিকভিটায় করেছেন আলীশানা বাড়ি। রাজধানমন্ডির ১১/এ, রোডের ৭৪ নম্বর বাড়িতে  রয়েছে ২ হাজার স্কয়ার ফিটের বিশাল ফ্ল্যাট। সপরিবারে তিনি এ ফ্ল্যাটেই বসবাস করছেন।
দুবাইয়ে রয়েছে শপিং মল। ব্যবসায়িক অংশীদারিত্ব রয়েছে রূপগঞ্জ কায়েতপাড়ার সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান, আ’লীগ নেতা ও শিল্পপতি (খান গ্রুপের চেয়ারম্যান) নূরুজ্জামান খানের সঙ্গে।

অবৈধ অর্থ ‘ বৈধ’ করতেই তিনি বেনামে অংশীদারিত্ব নেন  খান গ্রুপের মতো অন্তত: ৮টি প্রতিষ্ঠানে। নারায়ণগঞ্জ এবং গাজীপুর এলাকায় তার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো অবস্থিত। রাজধানীতে তার রয়েছে অন্তত: ১২টি বাড়ি। আনন্দ পুলিশ হাউজিংয়ে প্লট ছাড়াও পূর্বাচলে রয়েছে নিজের পৃথক প্লট।  সিঙ্গাপুর, দুবাই এবং ইতালিতে পাচার করেন শত শত কোটি টাকা। মালয়েশিয়ায়ও রয়েছে ব্যবসা।

ডিএমপিতে পোস্টিং নেযার আগে মো: ফারুক হোসেন ৮টি গুরুত্বপূর্ণ স্টেশনে পোস্টিং নিয়েছিলেন। এগুলো হচ্ছে, ঢাকা জেলাধীন কেরাণীগঞ্জ মডেল থানা, গাজীপুর সদর সার্কেল,টঙ্গি মডেল থানা, মানিকগঞ্জ জেলার সিনিয়র এএসপি, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (মিরপুর বিভাগ) সিনিয়র সহকারি পুলিশ কমিশনার, নারায়ণগঞ্জ জেলা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)’র অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার, নারায়ণগঞ্জ শিল্পপুলিশ-৪ এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এবং ডিএমপি’র উপ-পুলিশ কমিশনার (অপারেশন ও মিডিয়া অ্যান্ড পি.আর.)।

প্রাপ্ত তথ্য মতে, ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ সময় কেটেছে গাজীপুর এবং নারায়ণগঞ্জে। এ সময় তার সঙ্গে সখ্যতা হয় দুই এলাকার ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের। এর মধ্যে নূরুজ্জামান খান হচ্ছেন তার সবচেয়ে বড় ব্যবসায়িক পার্টনার। রূপগঞ্জের এ আ’লীগ নেতার রয়েছে রিয়েল এস্টেট, ডকইয়ার্ড, ড্রেজিং ও গার্মেন্টস ব্যবসা।