হাইকোর্টের রায়ও মানছেন না মাওলানা আনিসুর!

নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাৎ ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগে ২০১৭ সালে চাকরিচ্যুত হয়েছিলেন ঢাকা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর ওয়াকফ এস্টেট পরিচালিত বাবুস সালাম মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মাও: আনিসুর রহমান। তার চাকরিচ্যুতির বিষয়ে হাইকোর্টের রায়ও আছে। হাইকোর্টের সে রায় অমান্য করে এখনও মাদ্রাসার প্রিন্সিপালের পদ ধরে রেখেছেন মাওলানা আনিসুর রহমান। এছাড়া বৈষ্যম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে ছাত্র হত্যার দায়ে তার বিরুদ্ধে ২টি মামলা হলেও গ্রেফতার হননি তিনি।
জানা গেছে, ঢাকা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর ওয়াকফ এস্টেটের (ইসি নং-১৮৮৭১) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও মোতাওয়াল্লী ছিলেন সৈয়দ মুশতাক হোসেন। ২০০২ সালে ওয়াকফ প্রশাসনে আবেদনের মাধ্যমে তালিকাভুক্ত হয়। ওয়াকফ এস্টেটের মাদরাসার প্রধান শিক্ষক আনিসুর রহমানের নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাৎ ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগে ২০১৭ সালে কর্তৃপক্ষ তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়। পরবর্তীতে নোটিশের কোনো জবাব না পাওয়ায় ওই বছরই তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়।
ওয়াকফ এস্টেট সূত্রে জানা গেছে, কারণ দর্শানোর ও বরখাস্তের বিষয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে তৎকালীন মন্ত্রী ও ঢাকা- ১৮ আসনের এমপি অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনের প্রভাব খাটিয়ে ওয়াকফ এস্টেটের মোতাওয়াল্লী ও সভাপতি সৈয়দ মুশতাক হোসেনের ওপর হামলা চালিয়ে গুরুতর আহত করেন। একইসঙ্গে তিনি বাবুস সালাম ওয়াকফ্ এস্টেট মসজিদ, মাদরাসা ও মার্কেট দখল করেন। এছাড়াও মোতাওয়াল্লী ও সভাপতির পরিচালনার কাজে বাধা দিয়ে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে প্রতিষ্ঠানের ২০ বছরের মূল্যবান ফাইলপত্র চুরি করে নিয়ে যান।
এরপর এস্টেটের অধীনস্থ বরাদ্দকৃত বৈধ মালিকদের ৯টি দোকান দখল করেন মাওলানা আনিসুর রহমান, মফিজ উদ্দিন বেপারী, ৪৯ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর নাঈম, বিমান বন্দর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি শাজাহান আলী মন্ডল ও হাবীব হাছানসহ কয়েকজন। এ ঘটনায় ওয়াকফের প্রতিষ্ঠাতা মোতাওয়াল্লী ঢাকার সিএমএম আদালতে মফিজউদ্দিন বেপারী, কাউন্সিলর নাঈম ও মাওলানা আনিসুর রহমান গংদের বিরুদ্ধে সিআর মামলার দায়ের করেন। পরে আদালত সিআইডিকে মামলাটিকে তদন্তের জন্য নির্দেশ দেন।
সিআইডি কর্তৃপক্ষ ওয়াকফ্ প্রশাসন বরাবর উক্ত আসামিদের দোকান ভাড়া আদায়, চুক্তিপত্র বরাদ্দ অনুমতি ছিলো কিনা তা যাচাইয়ের জন্য চাহিদাপত্র প্রতিবেদন দেয়ার জন্য ওয়াকফ্ প্রশাসনকে অনুরোধ করেন। পরে ওয়াকফ্ প্রশাসন সিআইডিকে জানায় মামলার আসামিদের বাবুস সালাম ওয়াকফ্ এস্টেট পরিচালনা, দোকান ভাড়া উত্তোলন ও চুক্তিপত্র বরাদ্দ বিষয় সংক্রান্ত কোনো অনুমতি দেয়নি তারা।
পরে মাওলানা আনিসুর রহমান হাইকোর্টে দু’টি রিট পিটিশন দায়ের করেন। পরবর্তীতে রিট পিটিশন দু’টি হাইকোর্ট খারিজ করে দেন। এ তথ্য গোপন করে পূনরায় ওয়াকফ্ প্রশাসনের করা ২০২৩ সালের ভাড়ার নোটিশের বিরুদ্ধে রিট পিটিশন দায়ের করেন মাওলানা আনিসুর। উক্ত রিট পিটিশন মামলায় ওয়াকফ্ ও অন্যান্য পক্ষসহ সকল বিবাদীপক্ষ মামলাটি খারিজের আবেদন করেন। কিন্তু আদালত ২০২৩ সালে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি নুরুজ্জামান ননীকে ১ লাখ ১০ হাজার টাকা বেতন-ভাতায় স্টেট পরিচালনার জন্য প্রশাসক হিসেবে নিয়োগের আদেশ দেন। কিন্তু অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি নুরুজ্জামান ননী দায়িত্ব নিয়ে রিটকারী মাওলানা আনিসুরের পক্ষ নেন।
এমতাবস্থায় বিবাদীপক্ষ রেসপন্ডেন্ট ওয়াকফ্ প্রশাসন ও অন্যান্য পক্ষগণের ন্যায্য দাবিসমূহ অগ্রাহ্য করে তাদের কোনও মতামত না নিয়ে নিয়মবহির্ভূতভাবে এস্টেটের যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছিলেন। এরপর অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি নুরুজ্জামানকে প্রশাসকের পদ থেকে অপসারণের জন্য রেসপন্ডেন্ট সকল পক্ষ উল্লেখিত রিট খারিজের জন্য হাইকোর্টে আবেদন করে। এরই প্রেক্ষিতে চলতি বছরের ৫ মার্চ চূড়ান্ত শুনানি শেষে রিট মামলাটি খারিজ করে রেসপন্ডেন্ট নং-১ হতে ১৩ এর অনুকূলে রায় প্রদান করেন। পরে মাওলানা আনিছুর রহমান হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে সুপ্রীম কোর্টের চেম্বার জজ আদালতে আপিল দায়ের করেন। আপিল বিভাগ প্রিন্সিপাল মাওলানা আনিসুর রহমানের আবেনের বিরোধিতা করে সকল পক্ষগণ শুনানি করেন। ফলে চেম্বার জজ আদালত নো অর্ডার প্রদান করেন অর্থাৎ হাইকোর্টের আদেশ বহাল থাকে।
মাওলানা আনিসুর রহমান হাইকোর্টের দেয়া ২০১৭ সালের আদেশ ও ওয়াকফ্ প্রশাসনের সকল আদেশ লঙ্ঘন করে ২০১৭ হতে ২০২৪ সাল পর্যন্ত এস্টেটের সকল খাতের আয়ের ১০ কোটি টাকা ওয়াকফ্ নির্ধারিত ব্যাংক হিসাবে জমা না করে আত্মসাৎ করেন। পরে মাওলানা আনিসুর রহমানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দোকান মালিক বিভিন্ন সময়ে থানা ও কোর্টে জাল- জালিয়াতি, অর্থ আত্মসাৎ, প্রতারণার অভিযোগে মোট ১০টি মামলা দায়ের করেন। মামলাগুলো বিভিন্ন তদন্তকারী সংস্থা সরেজমিনে তদন্ত করে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় সংশ্লিষ্ট আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। এরপরও মাওলানা আনিছুর রহমান স্থানীয় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাদের ও উশৃঙ্খল ছাত্রদের ব্যবহার করে অবৈধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন ।
এ ব্যাপারে মাদরাসার বর্তমান মোতাওয়াল্লী সৈয়দ মুশতাক হোসেনের আইনগত প্রতিনিধি ইঞ্জিনিয়ার নাজমুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, দেশের সর্বোচ্চ কোর্টের রায় পাওয়ার পরও আমরা মাদরাসায় গেলে গত ১ এপ্রিল কিছু উশৃঙ্খল ছাত্রদের এবং আওয়ামী পন্থী লোকজন দিয়ে হামলা চালিয়ে আমাদের হত্যার চেষ্টা চালায়। হামলায় ওয়াকফের প্রতিষ্ঠাতা, সাবেক মোতায়াল্লী ও সভাপতি সৈয়দ মোশতাক হোসেন রতন এবং আমিসহ অনেকেই মারাত্মকভাবে আহত হয়েছি।
পরে পুলিশ এবং সেনাবাহিনী মাদ্রাসায় এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।ইঞ্জিয়ার নাজমুল ইসলাম ভূঁইয়া জানান, অবৈধ প্রিন্সিপাল মাওলানা আনিসুর রহমান ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পক্ষ নিয়ে আন্দোলনরত ছাত্র আব্দুল্লাহ বিন যাহি হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে মাওলানা আনিসুর রহমানের বিরুদ্ধে যাত্রাবাড়ী থানায় ১টি এবং এয়ারপোর্ট থাকায় ১টি হত্যা মামলা হয়েছে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে মাওলানা আনিসুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। তার ব্যবহৃত মুঠোফোন নাম্বারে একাধিকবার ফোন দিলেও ধরেননি তিনি।
সবার দেশ/কেএম