Header Advertisement

Sobar Desh | সবার দেশ বিশেষ প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ০০:২৪, ২৪ এপ্রিল ২০২৫

আপডেট: ০০:২৯, ২৪ এপ্রিল ২০২৫

আওয়ামীলীগের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জামায়াতি কৌশল

আওয়ামীলীগের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জামায়াতি কৌশল
ছবি: সবার দেশ

বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে খল চরিত্র হলেও আওয়ামী লীগ একটি প্রভাবশালী দল হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় এবং জনগণের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করে আসছে। তবে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর দলটি অভূতপূর্ব সংকটের মুখোমুখি হয়েছে। 

দলের শীর্ষ নেতৃত্বের দেশত্যাগ, কেন্দ্রীয় থেকে তৃণমূল পর্যায়ের কার্যালয় বন্ধ এবং সদস্যদের আত্মগোপনের মধ্যে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ প্রেক্ষাপটে, সম্প্রতি দলটির কিছু কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর (জামায়াত) পূর্ববর্তী কৌশলের সঙ্গে সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিশেষ করে, ঝটিকা মিছিল, গোপন সংগঠন এবং রাজপথে সীমিত উপস্থিতির মাধ্যমে আওয়ামী লীগ তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে বলে মনে করছেন অনেকে। আওয়ামী লীগের বর্তমান কৌশল এবং জামায়াতের পূর্ববর্তী রাজনৈতিক কৌশলের মধ্যে একরকম সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়।

জামায়াতের রাজনৈতিক কৌশল: একটি পটভূমি

বিগত ১৬ বছরে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশে তীব্র দমন-পীড়নের শিকার হয়েছে। দলের শীর্ষ নেতাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর, কেন্দ্রীয় ও শাখা কার্যালয় বন্ধ, মিটিং-মিছিলে অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা এবং গোপন আলোচনাকে ‘ষড়যন্ত্র’ হিসেবে চিহ্নিত করে গ্রেফতারের মতো কঠোর পদক্ষেপ তাদের রাজনৈতিক কার্যক্রমকে সীমিত করে দিয়েছিলো। এ পরিস্থিতিতে জামায়াত তাদের অস্তিত্ব জানান দিতে ঝটিকা মিছিলের কৌশল গ্রহণ করে। এ মিছিলগুলো সাধারণত অলি-গলি থেকে শুরু হয়ে রাজপথে স্বল্প সময়ের জন্য প্রকাশ পেতো, ব্যানার প্রদর্শন করত এবং পুলিশের হাতে ধরা পড়ার আগে দ্রুত ছত্রভঙ্গ হয়ে যেতো। এ কৌশল তাদের সমর্থকদের মধ্যে উৎসাহ ধরে রাখতে এবং সরকারের দমননীতির মধ্যেও দলীয় উপস্থিতি প্রকাশে সহায়তা করেছিলো। 

আরও পড়ুন <<>> আ’লীগের জালিয়াতিতে অতিষ্ঠ কোলকাতার প্রশাসন

জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরও অনুরূপ কৌশল গ্রহণ করেছিলো। তারা প্রকাশ্য কার্যক্রমের পরিবর্তে গোপন সংগঠন এবং অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের আড়ালে কার্যক্রম চালিয়ে যেতো। উদাহরণস্বরূপ, কিছু ক্ষেত্রে শিবিরের সদস্যরা ছাত্রলীগের পতাকাতলে পদ-পদবী গ্রহণ করে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করেছিলো। এ কৌশল তাদের ছাত্রলীগেন ছদ্মাবরণে নিজেদের সাংগঠনিক কাঠামো টিকিয়ে রাখতে সহায়ক হয়েছিলো।

আওয়ামী লীগের বর্তমান পরিস্থিতি

৫ আগস্ট ২০২৪-এ শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক অবস্থান নাটকীয়ভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে। দলের প্রধান নেতৃত্বের একটি বড় অংশ দেশ ত্যাগ করেছে, অনেকে আত্মগোপনে রয়েছে এবং কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে তৃণমূল পর্যায়ের কার্যালয় পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেছে। এ পরিস্থিতিতে দলের সাংগঠনিক কাঠামো প্রায় ভেঙে পড়ার উপক্রম। 

সম্প্রতি, আওয়ামী লীগের কিছু সদস্য রাতের অন্ধকারে বা ভোরের আলো ফোটার আগে ঝটিকা মিছিলের মাধ্যমে রাজপথে উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। এ মিছিলগুলো স্বল্প সময়ের জন্য সংগঠিত হয়, ভিডিও ধারণ করা হয় এবং পুলিশের হাতে ধরা পড়ার আগে অংশগ্রহণকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। কিছু ক্ষেত্রে গ্রেফতারও হচ্ছে, যেমনটি সম্প্রতি ঢাকায় ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনের ১০ সদস্যের গ্রেফতারের ঘটনায় দেখা গেছে। 

আরও পড়্রুন <<>> ‘র’-আওয়ামী পলাতক নেতাদের ভয়ঙ্কর বাণিজ্য

এ কার্যক্রম জামায়াতের ঝটিকা মিছিলের কৌশলের সঙ্গে আকর্ষণীয় সাদৃশ্য বহন করে। জামায়াত যেমন দমননীতির মধ্যে সীমিত উপস্থিতির মাধ্যমে দলীয় সমর্থকদের মধ্যে আশা জাগিয়ে রাখতো, তেমনি আওয়ামী লীগও এ কৌশলের মাধ্যমে তাদের কর্মীদের মধ্যে মনোবল ধরে রাখার চেষ্টা করছে বলে মনে হয়।
 
তুলনামূলক বিশ্লেষণ

  • ঝটিকা মিছিলের কৌশল: জামায়াত এবং আওয়ামী লীগ উভয়ই তাদের রাজনৈতিক সংকটের সময় ঝটিকা মিছিলকে একটি কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। জামায়াতের ক্ষেত্রে এটি ছিল সরকারের কঠোর দমননীতির মধ্যে দলীয় উপস্থিতি প্রকাশের একমাত্র উপায়। আওয়ামী লীগের বর্তমান কার্যক্রমেও একই ধরনের পরিস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। রাতের অন্ধকারে বা ভোরে সংগঠিত এ মিছিলগুলো দ্রুত শেষ হয় এবং ভিডিওর মাধ্যমে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। এটি দলের সমর্থকদের মধ্যে এ বার্তা দেয় যে দলটি এখনো সক্রিয় রয়েছে।
  • গোপন সংগঠন এবং আত্মগোপন: জামায়াতের নেতা-কর্মীরা দীর্ঘদিন ধরে গোপন সংগঠনের মাধ্যমে কার্যক্রম চালিয়ে এসেছে। আওয়ামী লীগের বর্তমান পরিস্থিতিও অনুরূপ। দলের অনেক নেতা আত্মগোপনে থাকলেও তারা গোপনে সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছে এবং ঝটিকা মিছিলের মতো কার্যক্রমের পরিকল্পনা করছে। এটি জামায়াতের কৌশলের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ, যেখানে দলটি প্রকাশ্য কার্যক্রমের পরিবর্তে গোপন নেটওয়ার্কের উপর নির্ভর করতো। 
  • ছাত্র সংগঠনের ভূমিকা: জামায়াতের ছাত্রশিবির যেমন ছাত্রলীগের আড়ালে কার্যক্রম চালিয়ে তাদের অবস্থান শক্তিশালী করেছিলো, তেমনি আওয়ামী লীগের ছাত্রলীগও বর্তমানে ঝটিকা মিছিলের মতো কার্যক্রমে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। তবে, পার্থক্য হলো, ছাত্রশিবির তাদের কার্যক্রম গোপন রাখতে সফল হলেও ছাত্রলীগের সদস্যরা প্রায়ই গ্রেফতার হচ্ছে। এটি ছাত্রলীগের কৌশলের দুর্বলতা বা সমন্বয়ের অভাব নির্দেশ করে। 
  • জনমনে প্রভাব: জামায়াতের ঝটিকা মিছিলগুলো জনমনে ভয়ের পরিবর্তে তাদের সমর্থকদের মধ্যে এবং জনমনে উৎসাহ সৃষ্টি করতো।  তবে, বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে জনগণের মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রতি বিরূপ মনোভাব থাকায় এ কৌশল কতটা কার্যকর হবে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কেনোনা, আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে ঠিক তার উল্টোওটাই হয়। তাদের মিছিল দেখলে জনমনে ত্রাস সৃষ্টি হয়। এমন মিছিলে জনমত গঠন তো হয়ই না, বরং তাদের বিরুদ্ধে জনগণ নতুন করে সংঘবদ্ধ হয়।

আরও পড়ুন <<>> ‘রিফাইন্ড আওয়ামীলীগ’র গোপন অফিস মতলুবের ভবন!

এটি কি সচেতন অনুকরণ?

আওয়ামী লীগের বর্তমান কৌশল কি জামায়াতের কৌশলের সচেতন অনুকরণ, নাকি পরিস্থিতির চাপে স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া? এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। আওয়ামী লীগের দীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাস এবং সাংগঠনিক ক্ষমতা বিবেচনায়, এটি সম্ভব যে তারা জামায়াতের কৌশল থেকে শিক্ষা নিয়েছে। জামায়াত যেমন দমননীতির মধ্যেও তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছিলো, তেমনি আওয়ামী লীগও এ কৌশলের মাধ্যমে তাদের সমর্থকদের মধ্যে আশা জাগিয়ে রাখতে চাইছে। তবে, জামায়াতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের মতাদর্শগত এবং সাংগঠনিক পার্থক্য বিবেচনায়, এ অনুকরণ সম্পূর্ণ সচেতন নাও হতে পারে। বরং, এটি রাজনৈতিক সংকটে সীমিত সম্পদ ও সুযোগের মধ্যে বেঁচে থাকার স্বাভাবিক কৌশল হতে পারে। 

সম্ভাব্য ফলাফল

আওয়ামী লীগের বর্তমান কৌশলের ফলাফল নির্ভর করবে কয়েকটি বিষয়ের উপর:  

  • জনসমর্থন: জামায়াতের কৌশল তাদের নির্দিষ্ট সমর্থক গোষ্ঠীর মধ্যে কার্যকর ছিলো। কিন্তু আওয়ামী লীগের প্রতি জনগণের বিরূপ মনোভাব এ কৌশলের কার্যকারিতা কমিয়ে দিতে পারে।  
  • আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিক্রিয়া: জামায়াতের সময় পুলিশের দমননীতি তাদের কার্যক্রমকে সীমিত করেছিলো। আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রেও ইতিমধ্যে গ্রেফতারের ঘটনা দেখা যাচ্ছে, যা তাদের কৌশলের ধারাবাহিকতা বাধাগ্রস্ত করতে পারে।  
  • দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা: জামায়াতের কৌশল ছিলো দীর্ঘমেয়াদী অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য। আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে এ কৌশল যদি শুধু স্বল্পমেয়াদী উপস্থিতি প্রকাশের জন্য হয়, তবে এটি দলের পুনরুজ্জীবনে সহায়ক নাও হতে পারে।

আওয়ামী লীগের বর্তমান কৌশল, বিশেষ করে ঝটিকা মিছিল এবং গোপন সংগঠনের মাধ্যমে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার চেষ্টা, জামায়াতে ইসলামীর পূর্ববর্তী কৌশলের সঙ্গে উল্লেখযোগ্য সাদৃশ্য বহন করে। এটি সচেতন অনুকরণ হোক বা পরিস্থিতির চাপে স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া, এই কৌশল দলটির সমর্থকদের মধ্যে মনোবল ধরে রাখতে সাময়িকভাবে সহায়ক হতে পারে। তবে, জনসমর্থনের অভাব, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারি এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অনুপস্থিতি এ কৌশলের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে তারা কীভাবে এ সংকট মোকাবিলা করে এবং জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার করতে পারে তার ওপর।

সবার দেশ/কেএম