Header Advertisement

Sobar Desh | সবার দেশ বিশেষ প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ০০:৩২, ২৯ এপ্রিল ২০২৫

আপডেট: ০০:৪০, ২৯ এপ্রিল ২০২৫

জাতীয়তাবাদের মুখোশ খসে পড়ার গল্প

সন্তোষে অসন্তোষ জামায়াত! 

জামায়াত আমিরের আ’লীগকে ‘ক্ষমা করে দেয়ার’ ঘোষণা জনমনে ক্ষত তৈরি করেছিলো। সে ক্ষত না শুকোতেই সন্তোষ শর্মা ইস্যূতে দলের বিশ্বাসযোগ্যতা খাদের কিনারে। জনগণের প্রশ্ন—জামায়াত কি সত্যিই জাতীয়তাবাদের পক্ষে, নাকি ক্ষমতার লোভে ভারতের সঙ্গে গোপন চুক্তির পথে হাঁটছে?

সন্তোষে অসন্তোষ জামায়াত! 
ছবি: সবার দেশ

বাংলাদেশের রাজনৈতিক আঙিনায় জামায়াতে ইসলামী নিজেকে জাতীয়তাবাদের পতাকাবাহী, ভারতবিরোধী অবস্থানের শিরদাঁড়া হিসেবে দাবি করে এসেছে। জনগণের একটি বড় অংশ তাদের এ ‘দেশপ্রেমের’ গল্পে মুগ্ধ হয়ে সমর্থন দিয়ে এসেছে। কিন্তু, সম্প্রতি ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ (RAW)-এর কথিত এজেন্ট সন্তোষ শর্মাকে দলীয় অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়ে জামায়াত যেন নিজের পায়ে কুড়াল মেরেছে। 

এ ঘটনা শুধু জনগণের ক্ষোভের আগুন জ্বালিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, দলের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলাকে টুকরো টুকরো করে ছাত্রশিবির থেকে মূল দলের নেতৃবৃন্দের মধ্যেও অসন্তোষের ঝড় তুলেছে। জামায়াতের জাতীয়তাবাদী মুখোশ খসে পড়ার এ নাটকীয় মুহূর্তে প্রশ্ন উঠেছে—দলটি কি সত্যিই জাতির স্বার্থে, নাকি ক্ষমতার লোভে ভারতের সঙ্গে গোপন হাত মিলিয়েছে?

সন্তোষ শর্মা: বিতর্কের ‘হিরো’ নাকি ‘ভিলেন’?

সন্তোষ শর্মা, দৈনিক কালবেলার সম্পাদক, বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহলে এমন এক নাম, যিনি বিতর্কের সমার্থক। সোশ্যাল মিডিয়ায় তাকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ‘বিশ্বস্ত সঙ্গী’ হিসেবে চিত্রিত করা হয়। আরও গুরুতর অভিযোগ, তিনি ‘র’-এর এজেন্ট, যিনি আওয়ামী লীগের শাসনামলে ‘আয়নাঘর’ নামক গোপন কারাগারে আলেম-ওলামা ও ইসলামী নেতাদের উপর নির্যাতনের মাস্টারমাইন্ড ছিলেন। এমন একজনকে জামায়াতে ইসলামী যখন লাল গালিচা বিছিয়ে স্বাগত জানায়, তখন দলের জাতীয়তাবাদী ভাবমূর্তি যে ধূলিসাৎ হবে, তা কি নেতৃবৃন্দ বুঝতে পারেননি? নাকি এটি কোনো গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ?

সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া একটি পোস্টে বলা হয়, সন্তোষ শর্মা আলেমদের ওপর অত্যাচার করেছেন। জামায়াত কি এখন ভারতের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ক্ষমতার সিঁড়ি বেয়ে উঠতে চায়? মুফতি হারুন ইজহারের মতো আলেম সমাজের প্রতিনিধিরা জামায়াতকে সতর্ক করে বলেছেন, এ পদক্ষেপ ইসলামী আদর্শ ও জাতীয়তাবাদের গলা টিপে মারছে। জনগণের মধ্যে ক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে পড়েছে, আর জামায়াত যেনো নিজের হাতে নিজের কবর খুঁড়ছে।

জামায়াতের জাতীয়তাবাদ: গল্প না গলগ্রহ?

৫ আগস্ট ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পতনের পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলেছে। আওয়ামী লীগকে ভারতের ‘তাঁবেদার’ হিসেবে দেখা হতো, আর জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপি ভারতের হস্তক্ষেপবিরোধী অবস্থানের জন্য জনগণের আস্থা অর্জন করেছিলো। জনগণ প্রত্যাশা করেছিলো, এ দুই দল মিলে একটি স্বাধীন, জাতীয়তাবাদী বাংলাদেশ গড়বে। জামায়াত, যারা নিজেদের বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম জাতীয়তাবাদী দল হিসেবে দাবি করে, তাদের ভারতবিরোধী অবস্থান ছিলো সমর্থকদের মনে গভীর আস্থার মূল। কিন্তু সন্তোষ শর্মার সঙ্গে জড়িয়ে জামায়াত যেন নিজের সে গৌরবময় ইতিহাসে কালির দাগ লাগিয়েছে।

৫ আগষ্টের পর পরই জামায়াত আমিরের আওয়ামী লীগকে ‘ক্ষমা করে দেয়ার’ ঘোষণা ইতিমধ্যে জনমনে ক্ষত তৈরি করেছিলো। সে ক্ষত না শুকোতেই সন্তোষ শর্মার এ প্রহসন দলের বিশ্বাসযোগ্যতাকে আরও খাদের কিনারে ঠেলে দিয়েছে। জনগণ প্রশ্ন তুলছে—জামায়াত কি সত্যিই জাতীয়তাবাদের পক্ষে, নাকি ক্ষমতার লোভে ভারতের সঙ্গে গোপন চুক্তির পথে হাঁটছে?

অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা: শিবির থেকে নেতৃত্ব পর্যন্ত

সন্তোষ শর্মাকে আমন্ত্রণের ঘটনা জামায়াতের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলাকে তছনছ করে দিয়েছে। ইসলামী ছাত্রশিবিরের সভাপতি জাহিদুল ইসলাম এ ঘটনা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় বক্তব্য দিয়েছেন, কিন্তু তার ব্যাখ্যা সমালোচনার ঝড় থামাতে পারেনি। শিবিরের সদস্যরা প্রকাশ্যে নেতৃত্বের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করছে। একজন শিবির সদস্য সোশ্যাল মিডিয়া লিখেছেন, এ ইস্যুতে গত পনেরো বছরে জামায়াত ও শিবিরের ইন্টেলেকচুয়াল গ্রাউন্ড হারিয়েছে। সন্তোষ শর্মার ইস্যুতে মুফতি হারুন ইজহারের প্রতি তাদের আচরণ আমাদের দুর্বলতা উন্মোচন করেছে।

জামায়াতের মূল সংগঠনের মধ্যেও ফাটল ধরেছে। নেতৃবৃন্দের মধ্যে এ সিদ্ধান্ত নিয়ে তীব্র মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এ সিদ্ধান্ত আমাদের জাতীয়তাবাদী অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আমরা জনগণের আস্থা হারাচ্ছি। এ অসন্তোষ দলের ঐক্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

জনগণ ও আলেম সমাজের তোপের মুখে

আলেম সমাজ এ ঘটনাকে ‘ইসলামী আদর্শের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। মুফতি হারুন ইজহার সোশ্যাল মিডিয়ায় বলেছেন, সন্তোষ শর্মা ইসলাম বিদ্বেষী। জামায়াতের এ পদক্ষেপ আমাদের মূল্যবোধের উপর আঘাত। আলেম সমাজ জামায়াতকে সতর্ক করে বলেছে, এ ধরনের কাজ তাদের সমর্থকদের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়াবে।

জনগণের ক্ষোভও কম নয়। সোশ্যাল মিডিয়ার একজন ব্যবহারকারী লিখেছেন, জামায়াত পাকিস্তানি চর, আওয়ামী লীগ ভারতীয় চর, আর সন্তোষ শর্মা ‘র’-এর এজেন্ট। জামায়াত কীভাবে তাকে কোল দিয়ে বসালো? এ ধরনের তীব্র মন্তব্য জামায়াতের জনপ্রিয়তাকে মাটিতে মিশিয়ে দিচ্ছে।

রাজনৈতিক কৌশলের হাস্যকর ভুল

জামায়াতের এ সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক কৌশলের একটি হাস্যকর ভুল বলা যায়। দলটি কি ভেবেছিলো, সন্তোষ শর্মার মতো বিতর্কিত ব্যক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়ে তারা জনগণের আস্থা ধরে রাখতে পারবে? নাকি এটি ভারতের সঙ্গে গোপন সমঝোতার অংশ? যে দলটি বছরের পর বছর ভারতবিরোধী স্লোগানে জনগণের মন জয় করেছে, তারা এমন আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত কীভাবে নিলো, তা রীতিমতো রহস্য।

জামায়াতের ইতিহাসে ভারতবিরোধী অবস্থান তাদের পরিচয়ের মূল স্তম্ভ। সন্তোষ শর্মার সঙ্গে জড়িয়ে তারা এ স্তম্ভ ভেঙে ফেলেছে। এটি শুধু দলের অভ্যন্তরীণ ঐক্য নয়, বিএনপির সঙ্গে সম্ভাব্য জোটের সম্ভাবনাকেও প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে।

জামায়াতের সামনে কঠিন পরীক্ষা

সন্তোষ শর্মা ইস্যু জামায়াতে ইসলামীর জন্য একটি সংকটের মুহূর্ত। দলটি যদি জনগণ ও আলেম সমাজের আস্থা ফিরিয়ে আনতে চায়, তবে তাদের স্বচ্ছতার সঙ্গে এ ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে হবে। জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী আদর্শের প্রতি প্রতিশ্রুতি পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য দায়িত্বশীল পদক্ষেপ জরুরি। অন্যথায়, এ ঘটনা জামায়াতের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎকে অন্ধকারে ঠেলে দেবে, আর বিএনপির সঙ্গে সহযোগিতার স্বপ্ন হয়ে উঠবে একটি দুঃস্বপ্ন। জামায়াতের নেতৃত্বকে এখন প্রমাণ করতে হবে, তারা জাতির পাশে, নাকি ক্ষমতার লোভে নিজেদের বিকিয়ে দিয়েছে।

সবার দেশ/কেএম