দলের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার চমৎকার উদাহরণ
এনসিপির সভায় সারজিস-হাসনাতের জবাবদিহিতা
এনসিপির সুস্পষ্ট বার্তা, দলের কোনও নেতা প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নন। সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা তাদের মূল লক্ষ্য। তদন্ত কমিটির কার্যক্রম এবং এর ফলাফল এখন দলের অভ্যন্তরীণ ঐক্য ও জনগণের আস্থা অর্জনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা হিসেবে বিবেচিত হবে।

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) তৃতীয় সাধারণ সভায় দলের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত নানা অভিযোগ নিয়ে তীব্র আলোচনা ও জবাবদিহিতার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। সভায় সাংগঠনিক শৃঙ্খলা রক্ষা এবং অভিযোগ তদন্তের জন্য একটি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, যার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আজ রোবার (২০ এপ্রিল) দেয়া হবে।
শুক্রবার (১৮ এপ্রিল) বাংলামোটরে দলের অস্থায়ী কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিকেল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত প্রায় ৯ ঘণ্টা ধরে চলা এ সভায় উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম, দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ এবং যুগ্ম সদস্যসচিব গাজী সালাহউদ্দিন তানভীরের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলো প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিলো।
সভার পটভূমি ও প্রেক্ষাপট
সাম্প্রতিক সময়ে সোশ্যাল মিডিয়ায়, বিশেষ করে ফেসবুকে, এনসিপির কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে বিলাসী জীবনযাপন, আর্থিক অনিয়ম এবং সাংগঠনিক শৃঙ্খলা লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। এসব অভিযোগের কেন্দ্রে ছিলেন সারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহ এবং গাজী সালাহউদ্দিন তানভীর। এ অভিযোগগুলো দলের অভ্যন্তরে উত্তেজনা সৃষ্টি করায় কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে ব্যাপক প্রশ্ন ও ক্ষোভ দেখা দেয়। এ প্রেক্ষাপটে শুক্রবারের সাধারণ সভা দলের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম হয়ে ওঠে, যেখানে নেতারা খোলামেলা আলোচনার মাধ্যমে অভিযোগগুলোর সত্যতা যাচাই ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার চেষ্টা করেন।
সভার সভাপতিত্ব করেন দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, এবং সঞ্চালনার দায়িত্ব পালন করেন সদস্যসচিব আখতার হোসেন। সভায় কেন্দ্রীয় নেতারা ছাড়াও বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।
সারজিস ও হাসনাতের বিরুদ্ধে অভিযোগ ও তাদের জবাব
সভায় সারজিস আলমের বিরুদ্ধে প্রধানত ‘বিলাসী জীবনযাপন’ এবং দামি গাড়ি ব্যবহারের অভিযোগ উঠে। বিশেষ করে, গত ৫ আগস্টের পর তাদের জীবনযাত্রা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। নেতাকর্মীরা জানতে চান, তারা কীভাবে ব্যয়বহুল গাড়িতে চলাফেরা করেন এবং এর অর্থের উৎস কী। এ ছাড়া, গত মাসে পঞ্চগড়ে সারজিসের গাড়িবহর নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক সমালোচনা হয়, যা সভায় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।
মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম, যুগ্ম সদস্য সচিব গাজী সালাহউদ্দিন তানভীর তাদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে বেশ সমালোচনার মুখে পড়েন। দলীয় কার্যক্রমের চেয়ে নিজের নির্বাচনী তৎপরতায় জড়িয়ে পড়ায় আরেক মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহকেও জবাবদিহির কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়।
এনসিপির কিছু নেতা আরও অভিযোগ করেন যে, সারজিস ও হাসনাত দলের সঙ্গে সমন্বয় না করে এককভাবে বিভিন্ন বিষয়ে অবস্থান নিচ্ছেন এবং ব্যক্তিগতভাবে ‘ডিল’ করার চেষ্টা করছেন। গত ৯ এপ্রিল দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান আবদুল মোমেনের সঙ্গে তাদের সাক্ষাতের বিষয়টিও সভায় উঠে আসে। এ সাক্ষাতে তারা লিখিতভাবে কিছু অভিযোগ জমা দিয়েছিলেন, যা এনসিপির সঙ্গে সম্পর্কিত নয় বলে হাসনাত দাবি করেন। তবে তিনি কার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন, তা সভায় প্রকাশ করেননি।
জবাবে সারজিস ও হাসনাত বলেন, তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক অপপ্রচার চালানো হচ্ছে, যার উদ্দেশ্য এনসিপিকে প্রশ্নবিদ্ধ করা। তারা দাবি করেন, নিরাপত্তার কারণে এবং জরুরি প্রয়োজনে তারা ভাড়া গাড়ি ব্যবহার করেন। পঞ্চগড়ের গাড়িবহর প্রসঙ্গে সারজিস বলেন, তার জীবনযাত্রা পূর্ব থেকেই সচ্ছল, এবং ফেসবুকে ছড়ানো অভিযোগগুলো অতিরঞ্জিত। তারা আরও জানান, জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পর অনেকে তাদের কাছে সহযোগিতা চেয়েছিলেন, এবং তারা কাউকে সহযোগিতা করলেও কোনো আর্থিক সুবিধা নেননি। তারা বলেন, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অনেকে তাদের সঙ্গে ছবি তুললেও, পরে সে ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে তাদেরকেও ভুলভাবে জড়ানো হচ্ছে।
তানভীরের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ
গাজী সালাহউদ্দিন তানভীরের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগও সভায় আলোচনায় আসে। ফেসবুকে তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত এ অভিযোগগুলো নিয়ে কেন্দ্রীয় নেতারা প্রশ্ন তুললে তানভীর সেগুলো অস্বীকার করেন। তিনি যেকোনও তদন্তে পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দেন এবং অভিযোগগুলোর সত্যতা যাচাইয়ে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার পক্ষে অবস্থান নেন।
শনিবার (১৯ এপ্রিল) গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো. রাশেদ খান ফেসবুকে একটি পোস্টে তানভীরের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসক নিয়োগ, এনসিটিবির বাণিজ্য এবং তদবিরের মাধ্যমে অবৈধ অর্থ উপার্জনের অভিযোগ তুলেন। তিনি সারজিস আলমকে তানভীরের সহযোগী হিসেবেও উল্লেখ করেন। রাশেদ খান দাবি করেন, এ অভিযোগগুলো নিয়ে সারজিস ও তানভীর তাদের দলের সদস্যদের কাছে জেরার মুখে পড়ছেন এবং শিগগিরই তাদের দুদকের মুখোমুখি হতে হতে পারে।
তদন্ত কমিটি গঠন ও সাংগঠনিক শৃঙ্খলা
সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, উত্থাপিত অভিযোগগুলো তদন্তের জন্য একটি ‘শৃঙ্খলা ও তদন্ত কমিটি’ গঠন করা হবে। এ কমিটি অভিযোগগুলোর সত্যতা যাচাই করবে এবং প্রয়োজনীয় সুপারিশ প্রদান করবে। সভায় উপস্থিত একজন নেতা জানান, তদন্তে কোনো অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হলে দল ব্যবস্থা নেবে। তবে তদন্ত সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট নেতাদের পাশে থাকবে দল।
এনসিপির একজন দায়িত্বশীল নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ফেসবুকে খেয়ালখুশি মতো পোস্ট করে অবস্থান নেয়ার প্রবণতা নিয়ে সভায় তীব্র আপত্তি উঠেছে। তিনি জানান, সভায় সবাই একমত হয়েছেন যে দলের চেয়ে কোনো ব্যক্তি বড় নয়। এ ঐকমত্য দলের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ও ঐক্য জোরদার করবে বলে তিনি আশাবাদী।
সভার তাৎপর্য ও প্রতিক্রিয়া
এনসিপির একজন কেন্দ্রীয় নেতা সভাকে ‘আশাব্যঞ্জক’ আখ্যা দিয়ে বলেন, এ সভা দলের মধ্যে জবাবদিহিতার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক। তিনি জানান, নেতাকর্মীরা খোলামেলা আলোচনার মাধ্যমে তাদের ক্ষোভ ও প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন, এবং অভিযুক্ত নেতারা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে জবাব দিয়েছেন। এ প্রক্রিয়া দলের স্বচ্ছতা ও গুণগত মান বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। তিনি আরও বলেন, নিয়মিত এ ধরনের চর্চা দলের অন্য নেতাকর্মীদেরও সতর্ক করবে এবং দলকে আরও শক্তিশালী করবে।
সারজিস আলম সভার আলোচনা ও অভিযোগ প্রসঙ্গে বলেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদের বিরুদ্ধে ছড়ানো অপপ্রচার অসত্য এবং এতে তারা বিব্রত। তিনি এ চর্চাকে দলের আন্তঃসম্পর্ক ও সাংগঠনিক সম্পর্ক শক্তিশালী করার উপায় হিসেবে দেখছেন। তিনি বলেন, জবাবদিহির সুযোগ থাকলে কেউ ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠতে পারবে না। পাশাপাশি অপপ্রচারকারীদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে।
হাসনাত আবদুল্লাহর বক্তব্য জানতে চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন বা হোয়াটসঅ্যাপে পাওয়া যায়নি।
বৃহত্তর প্রেক্ষাপট
এনসিপির এ সাধারণ সভা বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে নতুন রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের আস্থা অর্জনের জন্য স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ওপর জোর দিচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে এনসিপির এ সভা দলের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার একটি উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তবে অভিযোগগুলোর তদন্ত এবং তদন্ত কমিটির ফলাফল দলের ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
সভার মাধ্যমে এনসিপি এ বার্তা দিতে চেয়েছে যে, দলের কোনও নেতা প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নন, এবং সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা তাদের মূল লক্ষ্য। তদন্ত কমিটির কার্যক্রম এবং এর ফলাফল এখন দলের অভ্যন্তরীণ ঐক্য ও জনগণের আস্থা অর্জনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা হিসেবে বিবেচিত হবে।
সবার দেশ/কেএম